পৌষের কোন এক বিকেলে পর্ব-০২

0
243

#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ২
অপরাজিতা অপু

” আসছে বছরের প্রথম শৈত্য প্রবাহ। ঠাণ্ডা নামবে ভয়াবহ রকমের। সবাইকে কয়েকদিন সাবধানে থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো। বিশেষ করে বৃদ্ধ এবং শিশুদের ভালোভাবে যত্ন নেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।”

টিভির পর্দায় চলছে সময় টিভির সংবাদ। ভীষণ শব্দে পুরো বাড়িতে এই খবর শোনা যাচ্ছে। বাবা এতটাই মনোযোগ দিয়ে শুনছেন যে তার আশে পাশের কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কে কি করছে কোনদিকেই তিনি তাকাচ্ছেন না। তিনি ভ্রু কুচকে টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন। রিমোট টা এমন ভাবে ধরে আছে যেনো সেটা হাত ফস্কে গেলেই টিভিও বন্ধ হয়ে যাবে। মা কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বাবাকে এমন উচ্চ শব্দে টিভি দেখতে দেখে ভীষণ বিরক্তিকর মুখভঙ্গি করে পুনরায় ঘরে চলে গেলেন। এরকম ঘটনা বাসায় প্রায়ই ঘটে। বাবা একবার টিভির ভেতরে ঢুকে গেলে আর কারো খেয়াল করেন না। টিভির শব্দটা আমার বেশ বিরক্ত লাগছে। আমি ঘরে বসে থাকতে পারছি না। এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে মাথা ব্যাথা শুরু হতে পারে। এই মুহূর্তে সেই যন্ত্রণা সহ্য করার মতো ইচ্ছা আমার নেই। তাই উপায় না দেখে বের হয়ে এলাম ছাদে। এসেই বুঝতে পারলাম শৈত্য প্রবাহের দাপট দেখাতে শুরু করেছে প্রকৃতি। কয়েকদিনের চেয়ে ঠাণ্ডা বেশি পড়েছে। শুধু শাল দিয়ে ঠাণ্ডা আটকানো সম্ভব হচ্ছে না। কুয়াশা শিরশির করে এসে নাকে ঢুকে যাচ্ছে। আমি শালটা নাক পর্যন্ত টেনে দিলাম। হাত দুটো গুটিয়ে নিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাড়ালাম। আজ সূর্য উঠেনি। কুয়াশায় লেপ্টে আছে পুরো শহর। ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ছে।

” এই ঠান্ডায় এখানে কি করছো?”

বাবার গলা শুনে চমকে উঠলাম। পেছন ঘুরে তাকালাম সত্যি কিনা বুঝতে। কিন্তু ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হতেই অবাক হয়ে গেলাম। এতো শান্ত, নরম কণ্ঠে বাবা কখনো বাসায় কথা বলে না। কোন কাজ ছাড়া তো কখনো ছাদেও ওঠে না। বাবা আমার দিকে তাকিয়েই ঠোঁট প্রশস্ত করলেন। হয়তো আমার অবাক হওয়ার কারণটা আন্দাজ করতে পেরেছেন। আমার পাশে এসে দাড়িয়ে রেলিঙে হাত রেখে একদম নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
” বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। শীতের তেমন কাপড় পরনি তো। ঠাণ্ডা লাগছে না?”

“মাত্রই তো আসলাম। এখনো তেমন বুঝতে পারছি না।”

কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। ঠাণ্ডা ঠিকই লাগছে। আসলে এই মুহূর্তে নিচে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তাই মিথ্যেটা বললাম। বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল
” অনেকদিন ছাদে আসা হয়না। তাই ভাবলাম আজ ছাদে বসে বিকেলের চা টা খাবো। রেশমা কে চা আনতে বললাম।”

আমার কি বলা উচিত বুঝতে পারলাম না। বাবার এই পরিবর্তনের কারণ বুঝতেই ব্যস্ত আমার মস্তিষ্ক। বাসার কাজের ছেলেটা তিনটা টুল দিয়ে গেলো বসার জন্য। তার ঠিক পেছনেই ভাবী চায়ের ট্রে নিয়ে আসলো। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। আমিও সৌজন্য হাসলাম। তিনজন টুলে বসে চায়ের কাপ হাতে নিলাম। গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ে প্রথম চুমুক টা দিতেই বাবা বলল
” আজরা! তুমি তো কিছুই বললে না।”

আমি নির্বোধের মতো চায়ের কাপ থেকে মুখ সরিয়ে ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকালাম। বাবা ভাবী দুজনেই আমার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। আমি কোন কিছুই আন্দাজ করতে না পেরে বললাম
” কি ব্যাপারে বাবা?”

বাবা আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
” ছেলেটাকে কেমন লাগলো?”

আমি ঝটকা খেলাম। সেই ঘটনার কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে। ঠিক কয়দিন আগে দেখা করেছি ছেলেটার সাথে সেটাও ভুলে গিয়েছি। এতদিন বাড়িতে এই নিয়ে কোন আলোচনা চলেনি। আজ হঠাৎ করে এমন একটা অপ্রস্তুত পরিবেশে পড়ে যাবো ভাবতে পারিনি। বাবা এভাবে আয়োজন করে জিজ্ঞেস করবে সেটাও ভাবিনি। ভাবলে হয়তো কিছু একটা ভেবে রাখতাম। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। কি বলবো বাবাকে? এই মুহূর্তে কোন সিদ্ধান্তে না পৌঁছাতে পেরে একটা বড় শ্বাস ছেড়ে সবটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে বাবাকে বললাম
” তোমার কেমন লেগেছে বাবা?”

বাবা চমৎকার হাসলেন। তার হাসির অর্থ উপস্থিত যে কেউ বুঝতে পারবে। বাবা হাস্যজ্বল চেহারায় বলল
” আমি কথা বলেছি ছেলেটার সাথে। ভালই লেগেছে। তুমি যদি আমার কাছে শুনতে চাও তাহলে বলবো এমন ছেলেকেই আমি জামাই হিসেবে খুঁজছিলাম। শুধু আমি কেনো আমার তো মনে হয় রেশমারও পছন্দ হয়েছে। কি রেশমা কেমন লেগেছে?”

ভাবী অকপটে স্বীকার করে নিলো তার ভালো লেগেছে। আমি অথৈ সাগরে ভাসছি। যার কোন কুল কিনারা নেই। বাবাকে আর না বলার সাহস আমার নেই। কারণ শাতিলের এমন কাণ্ডের পর থেকেই বাবাও হতাশ ছিলেন। এতদিন বাদে মনটা ভালই দেখলাম। নিরুপায় আমি কোন কথা খুঁজে পেলাম না। বাবা ঠোঁটে সেই চমৎকার হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেই বলল
” ওনারা ফোন করেছিলেন। আমাদের মতামত যদি হ্যা হয় তাহলে একদিন এসে আংটি পরিয়ে যাবে। আমি একটু সময় নিয়েছি। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে। যাক আর কয়টা দিন।”

বাবার কথায় কিছুটা স্বস্তি পেলাম। কয়টা দিন অন্তত সময় পাচ্ছি একটু ভাবার।


নিস্তব্ধ রজনীর ক্লান্ত প্রহর। বৃষ্টির মতো ঝরঝরে শিশির বিন্দু নামছে ধরণীর বুকে। হাড় কাঁপানো শীতে কাবু হয়ে সবাই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। আমি স্থির হয়ে শিশির পড়া দেখছি। দুচোখে ঘুমের বালাই নেই। বাবার কথাটাই মাথায় ঘুরছে। শাতিলের কথা যে আমি ভুলে গিয়েছি তা কিন্তু নয়। তিনটা বছরের স্মৃতি এতো সহজে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রতিটা রাত আমাকে মনে করিয়ে দেয় জীবনের সেই ব্যর্থতার কথা। কি এমন ভুল ছিল আমার? ভালই তো বেসেছিলাম মানুষটাকে। তাহলে কেনো এমন করলো? এই প্রশ্নের জবাব এক মাত্র দিতে পারে শাতিল নিজেই। একটাবার জানা তো দরকার আমার ভুলটা। শাতিলের সাথে কথা বলা প্রয়োজন।আবেগের বশবর্তী হয়ে কোন কিছু না ভেবেই ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করলাম আরো একবার সেই পরিচিত নাম্বারে। প্রথমবারের কলটা কেটে গেল। পুনরায় ডায়াল বাটনে চাপ দিলাম। দুইবার রিং হতেই ধরে ফেললো। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল
” হ্যালো?”

আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না। শুধু বুক জুড়ে হাহাকার। কান্না গলায় দলা পাকিয়ে আছে। হয়তো ঘুমের মাঝে সে নাম্বারটা খেয়াল করেনি। তাই আমাকে চিনতেও পারেনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
” আজরা তুমি এতো রাতে কেনো ফোন করেছো?”

ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এতক্ষণের কান্না আটকে রাখা সম্ভব হলো না। কান্নাজড়িত গলায় বললাম
” বাবা আমার বিয়ে ঠিক করছে শাতিল।”

কোন সময় না নিয়েই ওপাশ থেকে বিরক্তিকর উত্তর এলো
” সেটাই কি সাভাবিক নয়? তোমাকে তো আর সারাজীবন বাসায় রেখে পুষবে না। বিয়ে তো দিবেই। এখানে আমার কি করার আছে? আমি আমার বাসায় কনভেনস্ করার চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। তুমি খুব আবেগী আজরা। আবেগ দিয়ে না ভেবে বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করো। পরিবারের অমতে বিয়ে করে আমরা কি আদৌ সুখী হতে পারবো? এক দুইদিনের ব্যাপার না। সারাজীবনের ব্যাপার। গভীর ভাবে ভাবতে হবে। আবেগে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি বাকি জীবনটা পস্তাতে চাই না। আমাকে কাল সকালে অফিসে যেতে হবে। রাখলাম।”

সে ফোনটা কেটে দিলো। আমি না ঘুমালে যে কোনদিন রাতে ঘুমায় না সেই মানুষটা আমাকে একটাবার ঘুমানোর কথাটাও বলল না। এতটা পরিবর্তন কি হতে পারে? পারে তো বটেই। নাহলে আজ তিন বছরের পরিচিত মানুষটা সমস্ত অভ্যাস বদলে ফেললো নিমেষেই। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। কান্নায় ভেংগে পড়লাম। নিমেষেই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। সাজানো জীবনটা অগোছালো হয়ে গেলো। আমি যে মানতে পারছি না। কিভাবে পারলো শাতিল সব ভুলে যেতে? এতটাই কি সহজ? তাহলে আমি কেনো পারছি না? কেনো আমার এতো কষ্ট হচ্ছে? আমি বাঁচতে চাই না। এভাবে বাঁচা সম্ভব না। চোখের পানি মুছে বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে। সবাই এখন ঘুমাচ্ছে। বাইরের দরজা খুলে উত্তেজনার বসে দৌড়ে ছাদে উঠছি। ছাদে গিয়ে রেলিং ধরে অনেক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এখান থেকে লাফিয়ে পড়লে কি মরে যাবো? রেলিঙে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে ভাবছি। এদিকে হিম শীতল হাওয়ার তোড়ে আমার পুরো শরীর কাপছে থরথর করে। যা সিদ্ধান্ত নেয়ার তা আমাকে দ্রুতই নিতে হবে।

চলবে