পৌষের কোন এক বিকেলে পর্ব-০৩

0
216

#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ৩
অপরাজিতা অপু

সারারাত গাঢ় কুয়াশার চাদরে মুড়ে থাকা শহরে ভোর নামছে। রাতের সেই গাঢ় কুয়াশা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আলো ফুটছে ওই আকাশে। সূর্যের প্রথম আলোটা জানালা গলিয়ে মুখে পড়তেই ঘুম ভেংগে গেলো। চোখটা মেলে তাকালাম জানালার বাইরে। কাল রাতে দরজা জানালা খুলে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে বসে বিছানা থেকে পা নামাতেই দরজার বাইরে চোখ পড়লো মা হন্তদন্ত করে রান্না ঘরে যাচ্ছে। নাস্তা বানাবার প্রস্তুতি শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। বাবা আবার সকালে তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে ফেলেন। আমি ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। এই আমি কাল রাতে এক বড়ো বোকামী করতে যাচ্ছিলাম। ছাদ অব্দি গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু সময় মতো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি। আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু এটা বুঝতে দেরি হয়নি যে ক্ষতিটা আমারই হতো। এমন একটা কাজ করে ওই বিশ্বাস ঘাতক টাকে জিতিয়ে দেয়া হতো। অপমান করা হতো আমার ভালোবাসাকে। সম্পর্কটা যেহেতু দুজনের মাঝেই ছিলো তাহলে আমি একাই কেনো তার মাশুল গুনবো। কেনো আমি একাই কষ্ট বয়ে বেড়াবো সারাজীবন। আমি তো নিজের কোন অপরাধ খুজে পাইনি। তাহলে আমি কেনো নিজেকে শাস্তি দেবো। কেনো মুক্তি হিসেবে মৃ ত্যুকে বেছে নেবো। আমার উচিত নিজেকে জীবনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এতটা ভালো থাকা যে সেই মানুষটা যেনো আফসোস করে। আমি তার জীবনের এক মাত্র আফসোস হতে চাই যাকে না পেয়ে সে সারাজীবন পস্তাবে। নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নিচে এসে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমি আর ভাবতে চাই না তার কথা। শুধু যে তাকে ভুলে যেতে চাই তা নয়। আরো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। বাবার পছন্দের ছেলেকে একটা সুযোগ দিতে চাই। জড়াতে চাই একটা বেনামী সম্পর্কে। আবেগ দিয়ে আর জীবন বিচার করবো না। এবার বাস্তবতায় বাঁচবো। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসলাম। ততক্ষণে বাবাও চলে এসেছে টেবিলে। আমাকে এতো সকালে দেখে কিছুটা অবাক হল বোধহয়। আমি সাধারণত এতো সকালে উঠিনা। সবার নাস্তা খাওয়া শেষ হলেই তবে আমার নাস্তার সময় শুরু হয়। এভাবে কখনো বাবার সাথে একসাথে বসে নাস্তা খাওয়ার সুযোগ হয়নি। হয়নি বললে ভুল হবে আমিই চাইনি। আমার মাঝেই জড়তা ছিল। বাবা নিজের কৌতূহল চেপে রাখতে পারলো না। কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল
” তুমি এতো সকালে উঠেছো যে? রাতে ঘুম হয়েছে? শরীর খারাপ নাকি তোমার?”

আমি সরাসরি বাবার চোখে চোখ রাখলাম। দুটো চোখে কি স্নিগ্ধতা! অস্থিরতা! সবটাই আমার জন্য। ভাবতেই ভেতরটা কেমন শীতল হয়ে গেলো। আর সহজ হয়ে গেলো সিদ্ধান্ত নেয়াটা। কাল রাতে যদি আমি বোকামী করে বসতাম তাহলে শুধু শুধু এই মানুষ গুলোকে কষ্ট পেতে হতো। আমার প্রতি তাদের এই অগাধ ভালোবাসা আর কোনদিন অনুভব করা হতো না। এই আফসোস টা থেকেই যেতো। মৃদু হেসে বললাম
” কিছুই হয়নি। আমি একদম ঠিক আছি। ঘুম ভেংগে গেলো তাই উঠে গেছি। তোমার সাথে কথা ছিলো কিছু।”

বাবা চিন্তিত চেহারায় বলল
“বলো।”

মা খাবার দিয়ে গেলো। আমার সামনে খাবারের প্লেট রেখে রান্না ঘরে চলে গেল না। দরজার এক পাশে দাড়িয়ে আছে অধীর আগ্রহে আমার কথা শোনার জন্য। তার মাঝের দুশ্চিন্তা আমার চোখে ধরা পড়লো। বুঝলাম তাদের মানসিক অবস্থা ভালো না। আমাকে নিয়ে বেশ ভয়েই আছে। আমি খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললাম
” বাবা তোমার যদি ছেলেকে ভালো লাগে তাহলে হ্যা বলে দাও। আমার আপত্তি নেই।”

আমার কথা শেষ হলেও তার রেশ রয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ড। সবকিছু নিস্তব্ধ। আমি বাবার দিকে তাকালাম। তার চেহারায় অবাধ আনন্দ। খুশির আমেজ ঝলকে উঠছে। বাবা হেসে উঠে বলল
” আমি জানতাম। ছেলেটা অপছন্দ করার মতো নয়। আমি আজই তাদেরকে জানিয়ে দিবো।”

আমি নিশব্দে নাস্তা শেষ করে টেবিল ছাড়লাম। ঘরে যাবার আগে বাবাকে বললাম
” তোমার কাছে কিছু টাকা হবে?”

বাবা অবাক চোখে চাইলো। আমি এর আগে মুখ ফুটে বাবার কাছে কখনো টাকা চাইনি। আমার জতটুকু প্রয়োজন বাবা নিজেই দিয়ে দিতো। সেখান থেকেই টাকা বাঁচিয়ে হাত খরচ করতাম। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো
” কত টাকা লাগবে?”

“খুব বেশি না হাজার দুয়েক হলেই হবে। ভাবছি শপিং এ যাবো। আমার কাছে তো টাকা নেই।”

বাবা নাস্তা ছেড়ে ঘরে চলে গেল। অল্প কিছু সময় পরেই আবার বাইরে এসে মুড়ে রাখা হাজার টাকার কয়েকটা নোট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
” এটা রাখো। তোমার যা লাগবে খরচ করো। আর বাকিটা রেখে দিও।”

আমি বাবার চোখের কোনে লুকানো পানিটা খেয়াল করলাম। মুচকি হেসে টাকা নিয়ে ঘরে চলে এলাম। বিছানায় বসে আরো প্রশস্ত হাসলাম। আমার কাছে টাকা আছে। তারপরেও বাবার কাছে চাইলাম। বাবার সাথে বরাবর আমার প্রয়োজনের সম্পর্ক। প্রয়োজন ছাড়া কখনো কথা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। কিন্তু কয়েকদিন থেকে খেয়াল করছি বাবা নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে সহজ হওয়ার চেষ্টা করছে। তাই আমিও একটু সহজ হয়ে গেলাম। সম্পর্কটা সহজ করে নিলাম। বাবা মায়ের সাথে শুধু প্রয়োজনের সম্পর্ক হয়না। সম্পর্কের গভীরতা থাকতে হয়। আজ প্রথমবার টাকা চাইলাম বলে বাবা যে কি খুশি হয়েছে সেটা চোখে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। ভাবীর সাথে সম্পর্কটাও খুব ভালো ছিলো না। কিন্তু এই কয়দিনে ভাবী একজন বন্ধুর চেয়েও বেশি হয়ে উঠেছে। যতটা সাপোর্ট পেয়েছি কখনো ভাবিনি এমন হতে পারে। এবার আমার পালা। ভাবীর সাথে কখনো বাইরে যাওয়া হয়নি। ভাইয়ার এখন অফিস টাইম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়বে। তাই আমিও এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলাম। দরজায় নক করতেই ভাইয়া বলল
” কে?”

“ভাইয়া আমি।”

ভাইয়া গলা তুলে বলল
” ভেতরে আয়।”

আমি ভেতরে ঢুকেই ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললাম
” তোমার আজ কি বিশেষ কোন কাজ আছে? একটু সময় দিতে পারলে ভালো হতো।”

ভাবী অবাক হয়ে বলল
” কেনো বল তো?”

আমি মুচকি হেসে বললাম
” তেমন কিছু না। তোমাকে নিয়ে একটু বাইরে যেতাম।”

ভাইয়া ভাবী দুজনেই অবাক হলো। ভাবী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
” কখন যাবে আমাকে বলিও।”

আমি মৃদু হেসে বেরিয়ে এলাম। নিজের ঘরে এসে জানালার পাশে দাড়ালাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি। কিছুক্ষণ পরেই ভাবী দুই কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। আমাকে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
” মন খারাপ?”

আমি বেশ সাভাবিক ভাবেই বললাম
” না তো। মন খারাপ হওয়ার কোন কারণ আছে কি?”

ভাবী হেসে ফেললো। চায়ের কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি সেটা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে ভাবীর দিকে তাকালাম। বেশ খুশি লাগছে তাকে। বুঝতে পারলাম আমার চেষ্টা সফল হয়েছে। সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টায় আমি সফল। আর নিজের মাঝেও এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আশে পাশের সবাই ভালো থাকলে সত্যিই অনেক আনন্দ পাওয়া যায়। হুট করেই কেমন সব পরিবর্তন হয়ে গেলো। কথাটা মাথায় ঢুকতেই মস্তিষ্ক খুলে গেলো। মনে পড়ে গেলো সেদিন সেই মানুষটার বলা কথাটা
‘ নিজে ভালো থাকলেই অন্যকে ভালো রাখা যায়।’
এতদিন বাদে কথাটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। নিজে ভালো থাকলেই বাকি সবাই ভালো থাকতে পারে। মানুষটা আসলেই অদ্ভুত। তার কথার গভীরতা অনেক বেশী। আমার মতো অলস মস্তিষ্ক সেই সূক্ষ্ম কথার ধার ধরতে পারবে না সেটাই স্বাভাবিক। ভাবীর সাথে আরো কিছুক্ষণ চলল কথোপকথন। চা শেষ করে ভাবী কাপ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আমিও ভাবছি আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। ঘুমের ঔষধ খাওয়ার পরেও ঘুমটা ঠিক মতো হয়নি তাই মাথাটা ব্যথা করছে। আর ঘণ্টা খানেক ঘুমালে হয়তো ভালো লাগবে। শুয়ে পড়লাম। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ঘুম চলে এলো। বেশ গাঢ় ঘুম। কত সময় ঘুমালাম জানিনা। ফোনের শব্দে ঘুমটা ভেংগে গেলো। ঘুমু ঘূমু চোখে তাকিয়ে দেখি অপরিচিত একটা নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করলাম।
” হ্যালো।”

“কেমন আছেন?”

শীতল কণ্ঠ শুনেই মস্তিষ্ক স্থির হলো। আমি কিছুটা গা ছাড়া ভাবেই বললাম
” কে বলছেন?”

” আমি রুপম। মনে আছে আমাকে?”

ঘুম ছুটে গেলো আমার। মুহূর্তেই কয়েকবার চোখের পলক ফেলে গলার স্বর নামিয়ে বললাম
” জী।”

বলার মতো আর কোন কথা খুজে পেলাম না। আমি চুপ করেই থাকলাম। উনি বললেন
” আপনার সাথে কথা ছিলো। একটু সময় দিতে পারবেন আজরা?”

চলবে