প্রণয়প্রেমিকের নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব-০৯

0
318

#প্রণয়প্রেমিকের নেশাক্ত প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৯

রেস্টুরেন্টে আহিফাকে অন্য এক ছেলের সঙ্গে গল্পগুজব করতে দেখে চমকে গেল আশফি। সে রেস্টুরেন্ট এসে ছিল রোদ্দুরের সঙ্গে এক নতুন জমি কেনার তাগিদে। জমির মালিক জমি বিক্রি করতে চাইছে। পাওনাও বেশি নয় ফলে সে কেনার আগ্রহ পোষণ করে। ঐ জমির মধ্যে সে তার বাবার স্বপ্নের বাগান বানাতে ইচ্ছুক। বিধেয় জমির মালিকের সঙ্গে খুটিনাটি দলিলাদির মধ্যে স্বাক্ষর নিতে এসে ছিল। এসেই যে এলাহি দৃশ্য চোখে পড়বে কে জানতো!
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
আহিফা সামনে মুখ করে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলার কারণে জানতেই পারল না। তার পেছনে যমরাজ রাগী ভাব নিয়ে ফোঁসছে।
রোদ্দুর আহিফাকে দেখে চোখ বড় করে তার বন্ধুর দিকে তাকায়। বন্ধুর মতিগতি বেশ গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়ে গিয়েছে তন্মধ্যে। অথচ গাড়ির মধ্যে তারা দুজনে কতই হেসে মেতে কথা বলেছে। রোদ্দুর গলা ঝেড়ে আশফির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। বৃথা গেল গলা ঝাড়ার পদ্ধতি। কেননা বন্ধুর তিক্ষ্ণ দৃষ্টি তখনো আহিফার উপর নিবদ্ধ। রোদ্দুর গর্দভের মত চেয়ে ভাবলেশনহীন সরে যায় আশফির নিকটস্থ হতে। একটা টেবিল বুক করে আয়েশে বসে পড়ে সে। আশফি আড়চোখে আহিফাকে খেয়ালে রেখে টেবিলে গিয়ে বসল। রোদ্দুর দেখে বলে,

‘আসলি কেন দাঁড়িয়ে তোর লায়লাকে দেখতি!’
‘চুপ দেখিস না কেমনে হেসে মাতামাতি করছে। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় মুখের মধ্যে তিতা করলার রস খেয়ে দাঁড়ায়। মিষ্টি কথা যেন আমার সামনে মুখ থেকে ভুলেও বের করে না।’
‘দুনিয়ায় আর মেয়ে পাইলি না। এমন মেয়েকে বউ হিসেবে বেছে রাখলি যে কিনা তোর জানেপরাণের শত্রু।’
‘আরে ডুড শত্রুর সঙ্গে প্রেম করার মজাই আলাদা।’
‘হে আর সংসারটা তেজপাতায় ত্যানা ত্যানা হয়।’
‘ধুর এমনটা হতে দিলে তো হবে।’

রোদ্দুর চোখ ঘুরিয়ে টেবিলে তবলা বাজানোর ন্যায় হাতের মৃদু বারি দিতে লাগে। চোখজোড়া চর্তুপাশ্বে ঘুরানোর ন্যায় তার দৃষ্টিকোণে সন্দেহের দৃশ্য ভেসে উঠে। রোদ্দুর সেদিক নজর রেখে আশফিকে ডাক দেয়। তার বন্ধু সাড়া হিসেবে মুখ থেকে শুধু ‘হুম’ বের করল। রোদ্দুর শুনে বিরক্তির ভাব নিয়ে বলে,

‘আব্বে শা’লা তোর বউরে পরে দেখিস আগে বউকে বাঁচানোর প্ল্যানিং কর।’

আশফি চট করে রোদ্দুরের দিকে তাকায়। আশ্চর্যের দৃষ্টিকোণে জিজ্ঞেস করে।

‘মানে বউকে কার থেকে বাঁচাবো!’
‘দশ না হয় বিশ মিনিট পরই তোর হবু বউ কিডনাপ হবে দেখিস।’

তার চোখজোড়া তখনো সেদিক রয়ে আছে। আশফি রোদ্দুরকে তার দিক না তাকিয়ে থাকতে দেখে সেও বন্ধুর চোখের চাহনী অনুসরণ করে তাকাল। পরক্ষণে হতভম্ব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। মোকলেস সাহেব বসে আছে একই রেস্টুরেন্টে। তার সঙ্গে বসা ব্যক্তিকে কি যেনো ফসুর ফসুর করে বলছে! আশফি দেখে তৎক্ষণাৎ নিজেকে আড়াল করে নেয়। পিঠটা সটান করে চেয়ার ঠেলে রোদ্দুর বিপরীত দিকে হেলে বসে। এতে তাকে দেখে বোঝা মুশকিল যে বসা লোকটি কি আশফি ফাওয়াজ নাকি অন্য কেউ! সে রোদ্দুরকে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘মাইক্রোপ্যান আছে!’
‘হে এটা অলওয়েজ পকেটে নিয়ে ঘুরি।’
‘চার্জ আছে!’
‘ইয়াহ্।’
‘ওকে সেটা নিয়ে চুপচাপ অর্ডার করতে যাওয়ার ভান ধরে কলমটা মোকলেসের চেয়ারের নিচে ছুঁড়ে দেয়। মনে রাখিস বেশি দূরে ফেললে শুনতে পারব না।’

রোদ্দুর মাথা নেড়ে মুখে মাস্ক লাগিয়ে হাঁটা ধরে। মোকলেস সাহেবের পেছনে এসে নিচে কিছু পড়েছে এমন ভান ধরল। নিচু ঝুঁকে মাইক্রোপ্যান মোকলেস সাহেবের চেয়ারের নিচে রেখে দাঁড়ায়। আশফি এতক্ষণ গার্ন আকঁড়ে রেখেছিল। যদি মোকলেস পাল্টা আক্রমণ করে তবে সেও একবার ট্রিগার চাপ দেবে। ব্যস ফিল্মের ক্লাইমেক্স ফিনিশ হয়ে যাবে। তবুও বেক্কলমার্কা মোকলেস এসবের ধারে কাছেও নেই। বিধেয় সে বুঝতে পারেনি। রোদ্দুর খাওয়ার জন্য অর্ডার করে নিজ স্থানে এসে বসে পড়ে। মাইক্রোপ্যানের কানেকশন লগইন করে ফোনের মধ্যে। ফোন টেবিলে রেখে দুজন গভীর ভাবে শুনতে লাগল অপরপাশ্বে হওয়া কথন!

‘শোন মিয়া তোকে এত লাখ টাকা হুদাই দিচ্ছি না। মাল যেটা এখানে বসে আছে ঐ আশফি ফাওয়াজের হবু বউ। তারে কিছুক্ষণ পর গিয়ে অপহরণ করে আমার পাঠানো ঠিকানায় নিয়ে আসবি। ঐ আশফিকে বুঝিয়ে দেবো আমার সঙ্গে লড়াই করার ফল! বউটারে প্রথমে রে’প করব, তারপর পিচ করে কেটে নদীতে ফেলে দেব। আর জীবনেও খোঁজে পাবে না।’

বিশ্রী কণ্ঠের সমাপ্তিতে কুৎসিত হাসি দেয় মোকলেস সাহেব। তার সামনে বসা ব্যক্তিকে সুটকেস ধরিয়ে দেয়। আশফি ও রোদ্দুর দেখে বুঝে ফেলল সুটকেসভর্তি টাকা রয়েছে। তারা বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে রেকর্ডিং তাদের ফাহাদ আঙ্কেলকে পাঠিয়ে দেয়। যেহেতু তিনি একজন সরকারী কমিশনার সেহেতু কাজ চটজলদি হয়ে যাবে। আশফি আড়চোখে আহিফাদের টেবিলে তাকায়। সে ও তার সঙ্গে থাকা ছেলেটি তখনো হেহে করে হাসছে। যেন কত যুগের হাসি আটকে রেখে ছিল। আজ সব উগলে দেবে নিজেদের মাঝে। তবে বিরক্তকর লাগছে আশফির এক দৃশ্যের মাঝে। ছেলেটি বিনা কারণে আহিফার হাত স্পর্শ করার প্রয়াস করছে। যা আহিফার কাছে অস্বস্তিদায়ক মনে হচ্ছে। আশফি সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আহিফার অস্বস্তি মুখশ্রী! তবুও সে নিশ্চুপ সাইকোনেসের বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। তার স্থানে অন্য কেউ হলে তৎক্ষণাৎ ঠাসঠুস মেরে,গা’লিগালা’জের সঙ্গে ফ্রি’মেন্ট পতিতাবৃত্তির উপাধি দিয়ে দিতো। অর্থাৎ বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি যাকে বলে!
কুল্ড মিল্কসেইক,স্যান্ডউইচ ও কাস্টাড অর্ডার করেছে রোদ্দুর। যা সবে মাত্র ওয়েটার এসে দিয়ে গেল। আশফি স্যান্ডউইচ কামড়ে সূক্ষ্ম পলক ফেলে ঘাড় বাঁকিয়ে। দেখতে পেল আহিফাদেরও অর্ডারকৃত খাবার দেওয়া হয়েছে। আহিফা ক্রিম জাতীয় কিছু খাওয়ায় তার ঠোঁটের ফাঁকে ক্রিম লেগেছে বোধ হয়। ফলস্বরুপ ছেলেটা তার সীমানা লঙ্ঘন করে ফেলে। সে তার হাতের মধ্যে টিস্যু নিয়ে ঠোঁট মুছে দেওয়ার স্পর্ধা দেখায়। মেজাজ বিগড়ে গেল আশফির। শান্ত,নিবিড়ভাবে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে ওয়েটারকে ইশারায় ডাক দেয়। তার হাতে বকশিশ দিয়ে বলে,

‘কফিটা নিয়ে ঐ টেবিলের ছেলের টিশার্টে ফেলে আয়।’

ওয়েটার বকশিশ পেয়ে কাজ করতে রাজি হয়ে যায়। অসাবধানবশত মগে থাকা কফি আহিফার সঙ্গে থাকা ছেলের গায়ে ফেলল। আড়ালে ‘ইয়েস’ বলে দাঁত কেলায় রোদ্দুর কে দেখিয়ে। রোদ্দুর ভ্রু কুঁচকে বন্ধুর হাবভাব বুঝার চেষ্টা করছে। ছেলেটার গায়ে কফি পড়ায় সে বেশ ক্ষেপে উঠে। ওয়েটারকে ধরে চড় লাগায়। যা দেখে আশফির হাত মুঠো হয়ে গেল। আহিফা নিজেও হতবাক ছেলের আচরণে। সে ভাবেনি সামান্য এক বিষয়ে মিসকিন ওয়েটারের গায়ে হাত উঠাবে ছেলেটা। আহিফা চরম ক্ষাপান্বিত গলায় বলে,

‘খায়ের সামান্য কফি ফেলায় ওমন অমানসিক বিহেভ করছিস কেন! পেছনেই টয়লেট আছে গিয়ে পরিষ্কার করে এলে তোর ঠেং ভেঙ্গে যাবে না। রাদার এগেইন ডু দ্যাট আই উইল কমপ্লেইন ইউর ড্যাড রা’স’কেল।’

আহিফার থেকে অপমানিত হয়ে নিশ্চুপে টয়লেটের দিকে এগোয় খায়ের। তার কাছে কফি ফেলা সামান্য নয় বিরাট বড় কিছু। কারণ তার পরণের টিশার্ট জাপান থেকে লাখ টাকা খরচ করে আনিয়েছে। সেখানে আহিফার বলা কথার দ্বারা টিশার্টের মূল্য তার কাছে ক্ষুদ্র লাগছে বটে! আহিফা গ্লানিকর দৃষ্টিতে চেয়ে ওয়েটারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ওয়েটার ‘ইটস ওকে ম্যাম’ বলে চলে যায়। আশফি সেই ওয়েটারের কাছে গিয়ে এক্সট্রা বকশিশ ধরিয়ে তার গালে আদুরীয় স্পর্শ দিয়ে বলে,

‘তোর গালে পড়া চড়ের শোধ আমি নিয়ে নেবো এবার কাজে যাহ্।’

কৃতজ্ঞার দৃষ্টিকোণে চেয়ে ওয়েটার তার কাজে মনোনিবেশ করে। আশফি তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রোদ্দুরের সঙ্গে গিয়ে বসল। সে তাকে চড়াও করে বলে,

‘কি রে যা আহিফা এখন একলা বসে আছে।’
‘উহুম কিডনাপ হোক তারপর কমেডি স্টার্ট করব।’
‘এ্যা কি বললি বুঝলাম না!’
‘আগে আগে দেখ ফিকচার আভি বাকি হেয়ে মেরে দোস্ত!’

আশফি হামি দিয়ে মোকলেস যে স্থানে বসে ছিল সে স্থানে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। বাঁকা হাসি ফুটে উঠে তার ঠোঁটের কোণায়। রোদ্দুরকে শিষ বাজিয়ে ইশারায় সে স্থানে তাকাতে বলে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মোকলেসের বসারত স্থান খালি। সে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আশফির দিকে তাকায়। অথচ আশফি মিল্কসেইকের পাইপে চুমুক দিয়ে চুষে নিচ্ছে ভাবলেশনহীন। ভাব যেন আকাশচুম্বী তার। রোদ্দুর তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে আহিফার বসারত স্থানে তাকায়। সেখানে আহিফার চেয়ার শূন্য দেখে আশফিকে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে,

‘ডুড আহিফা ভাবী নেই! চল এখনি খোঁজ লাগাতে হবে।’

রোদ্দুর কথা শুনে আশফি মিল্কসেইক স্বল্পখানিক রেখে কাস্টার্ডের প্যাকেট খুলে স্পন দিয়ে খাওয়া শুরু করে। রোদ্দুর তীব্র ক্রোধের দৃষ্টিতে চেয়ে কিছু বলবে তার পূর্বেই আশফি হাতের ইশারায় বন্ধুর খাওয়া শেষ করতে বলে। রোদ্দুর চাপা ক্রোধ নিয়ে খেতে লাগল। কুড়ি মিনিট পার হলে আশফি ঢোকর তুলে চর্তুপাশ্বে নজর বুলিয়ে নেয়। হামি দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। বেসিনের সামনে গিয়ে মুখে বারদুয়েক পানি ছিটকিয়ে নিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে নেয়। রোদ্দুর শুরু হা-কর দৃষ্টিকোণে তার বন্ধুর চলন দেখছে। তন্মধ্যে রোদ্দুর খাওয়া শেষ সে বসে থেকে হাত-মুখ মুছে নেয়। বিল পে করে আশফিকে বলতে নিলে খেয়াল করে দেখে আশফিই উধাও! রোদ্দুর হতবাক দৃষ্টিকোণে প্রতিপাশে নজর বুলায়। হ্যা নেই বলদ বন্ধুটা! একদম ফাজিল তাকে রেখে বিপদের সঙ্গে টক্কর করতে গেল। রোদ্দুর না পেরে হতাশ হয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে দেখল। পুলিশ ফোর্স দাঁড়িয়ে আছে। ফাহাদ ভিআইপি গাড়িতে বসারত অবস্থায় জানালা খুলে রোদ্দুরকে ইশারা করে আসতে! সেও সময় বিলম্ব না করে গাড়ির কাছে চলে আসল। ফাহাদ সাহেব রোদ্দুরকে দেখে বলে,

‘বাবা শুন আশফি আমাকে লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছে। সে তোর বাইক করে চলে গেছে। তুই আয় আমরা একসঙ্গে যাবো।’

রোদ্দুর মাথা নেড়ে বসে পড়ে তার ফাহাদ আঙ্কেলের সঙ্গে। আশফির পরিচিত হওয়ায় তারাও বেশ ভাব জমানো পরিচিত আঙ্কেল-ভাতিজার ন্যায় আচরণ সুলভ অভ্যাস গড়েছে।

____

নাঈম ঝালমুড়ি দিয়ে ফারিনকে প্রপোজ করছে দেখে কফির লাভা বেরিয়ে পড়ল আজীবের মুখ থেকে। করুণ নেত্রপল্লবে দাঁত কিড়মিড় করে সে নাঈমের গোষ্ঠি উদার করছে মনপ্রান্তে। নাঈম বেচারা ক্লান্ত প্রায় নাটক করে করে! তার মনে আলগা কহন জাগ্রত হয়েছে যে,
আজীব ভাই জলদি প্রপোজ করে ফেলুন, একবার আপনি প্রপোজ করলেই আমি একবছরের আউট অফ কান্ট্রি হয়ে যাবো।
ফারিন লাজুক নয়নে চেয়ে ঝালমুড়ি নিয়ে একচামচ খাই তো আরেক চামচ নাঈমের মুখে পুরে দেয়। কফি যেন হজমহীন হয়ে উঠল আজীবের কাছে। বেশিক্ষণ স্থায়ীভাবে শায়িত হয়ে বসে থাকতে পারল না ড্রয়িংরুমে। ঠং করে কফির মগ কাঁচের টেবিলে রেখে বইটই গুছিয়ে হনহন করে রুমে ঢুকে পড়ে। দরজা ধড়াস করে বন্ধ করতে গিয়ে সে নিজেই ব্যথা পেয়ে গেল। আঙুলে চাপ পড়ায় ‘আহ্ আহ্ ব্যথা পেলাম’। দরজাকে লা’থি দিয়ে কাঠিন্য কণ্ঠে বলে,

‘শা’লার কাঠমিস্ত্রিগুলোকে গণধোলাই দেওয়া উচিৎ! দরজা শক্ত করে লাগাতে কে বলছিল! আজ বুঝি আঙুলগুলো হাত থেকে আলাদা হয়ে পড়তো। যতসব!’

বাহিরে ফারিন ও নাঈম মিটমিটিয়ে হাসি দেয়। আজীব দীর্ঘক্ষণে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ইংরেজি একটা অক্ষরও যেন তার ঠোঁটে নড়ছে না বরং তার ঠোঁটে বিরক্তির ভাবে গালি আসছে!
যে পড়ুয়া ছেলে সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুজে রাখত সে কিনা এখন এক মেয়ের উপেক্ষায় দিনরাত ব্যথিত হচ্ছে। মন কে বোঝালে ইগো সামনে চলে আসে, ইগোকে বোঝলে মন মাঝে হাতড়ে আসে। সে দোটানার মাঝে নেতিয়ে পড়ছে। ফারিন আস্তেধীরে দরজা খোলে ইদুঁরের মত মুখখানি ভেতরে ঢুকিয়ে শরীর বাঁকায়। আজীব তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে গম্ভীর দৃষ্টিকোণ বইয়ের মাঝে আবদ্ধ রাখে। ফারিন কাচ্চি বিরিয়ানী বানিয়েছে। যা সর্বদা পছন্দের ক্যাটাগরিতে থাকে আজীবের। কাচ্চি বিরিয়ানীর সুঘ্রাণ পেতেই তার জিভে লাভা চলে আসে। ফারিন কোমর দুলিয়ে আবেদনময়ী কণ্ঠে বলে,

‘কেউ যদি আমার হাত থেকে খেতে চাই, তাহলে খেতে পারে।’

শুনে আজীব প্রত্যত্তুর করতে গিয়েও থেমে যায়। মনে পড়ে দুপুরে ঘটা দৃশ্যের কথা। সে তীক্ষ্ণ মেজাজে চড়াও গলায় ‘বের হও’ বলে দেয় ফারিনকে। সে ঠোঁট কামড়ে রাগের গলায় বলে,

‘হে হচ্ছিল বের। ভুল করছিলাম আপনাকে বন্ধুভেবে খাওয়াতে এসে! আমার হাতের রাঁধা খাবার আপনার রিযিকে নেই। তাই আপনি তিরস্কার, অস্বীকার করলেন। এ রিযিক খালি আমার নাঈমের আছে হাহ্।’

মুখ ভেটকিয়ে আজীবের রুম থেকে প্রস্থান করে। সে যেন থতমত খেল। ইগো দেখিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারল সে। টেবিলে ঠাস করে বা’রি দিয়ে ‘শিট’ বলে উঠে। তড়িঘড়ি ফারিনকে নিজের রুমে আনতে বেরিয়ে পড়ে। সিড়ির কাছে গিয়ে দেখে ফারিন সত্যি নাঈমের রুমের নিকটস্থ হচ্ছে। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আজীবের মনমেজাজে। ইগো যেন একদমে উবে গেছে তার হৃদয় থেকে। ফারিন কেন নাঈমকে খাওয়াবে! তার চেয়ে বড় কথা ফারিনের রাঁধা কাচ্চি বিরিয়ানী শুধু তার রিযিকে থাকবে! অন্য পুরুষের গালে-পেটে সেই রিযিক হজম করতে দেবে না সে। দৃঢ় মনবলে দৌড়ে ফারিনের কাছে গেল। তন্মধ্যে ফারিন নাঈমের দরজার হ্যান্ডেলে হাত রাখতে নিলে সেই হাত আকঁড়ে ধরে আজীব। নিঃশব্দে তাকে হেঁচকা টেনে নিজের রুমে এনে দরজা আঁটকিয়ে দেয়। আকস্মিক কাজে ফারিন ভীতিগ্রস্থ হলো। ভাবল কোনো চড়-টর দিয়ে বসবে না তো খচ্চরটা! কিন্তু তার কল্পনায় একমগ জল ঢেলে আজীব করুণ কণ্ঠে বলে,

‘এতটা খারাপ ভাবছিস কেন! তখন মেজাজ গরম ছিল বলে বকে দিছি। এই কাচ্চি বিরিয়ানী কত ফেভারিট আমার তুই জানিস না! তাও কোন অধিকারে বললি এই রিযিক নাঈমের।’

ফারিন অবুঝ গলায় বলে,

‘নাঈম আমার হবু বর! তার প্রতি অধিকার বিবাহ হবে বলে অধিকারবোধ জাগ্রত হচ্ছে। আপনাকে কোন অধিকারে খাওয়াব!’

ফারিনের প্রশ্নাত্মকে আজীব নিজেকে শূন্যতার ভোগান্তিতে ফেলছে। একসময় সে যার কলিজার টুকরো ছিল, সেই তাকে জিজ্ঞেস করছে কোন অধিকারে সে খাওয়াবে! এতটা নিষ্ঠুরতা কেনো চলে এসেছে ভালোবাসার মাঝে। আজীব ভাবে সে তো কখনো বলেনি ভালোবাসার কথা। অথচ ‘ভালোবাসি’ বলে বলে পাগলপ্রায় হয়ে ছিল ফারিন! সে শুধু অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ভেবেই আজীব মনে মনে নিজেকে ধীক্কা জানায়।
ফারিন আজীবের মৌনতা দেখে হতাশার শ্বাস ফেলে বলে,

‘আসেন খেয়ে নেন।’
‘তুই না খাওয়াবি!’
‘চেয়ে ছিলাম এখন আর চাওয়াটা নেই।’
‘প্লিজ!’

আজীবের করুণ গলা শুনে পুনরায় অগ্রাহ্য করার সাধ্য পেল না ফারিন। নিশ্চুপে ওয়াশরুমে যায় হাত ধুতে। আজীব খুশি হলো ফারিনের কর্ম দেখে। তার চোখজোড়ায় আমেজ ফুটে উঠেছে।
নাঈম ছবি তুলে সেগুলো তার বড় আব্বু অর্থাৎ আরভীক কে দেখায়। তিনি দেখে তার পরম স্ত্রীর দিকে সন্দেহের বশবর্তী নজরে চাই। পুনরায় ছবির দিকে আড়চোখে চাই। এমনী পুনরাবৃত্তি চাওয়াচাওয়ির ফলে আনজুমা বিরক্তির গলায় জিজ্ঞেস করে।

‘কিচ্চে ওমন পাগলের মত চাওয়াচাওয়ি করছেন কেন!’
‘দেখতেছি আজীব আমার ছেলে নাকি হসপিটালে তুমি তাকে পরিবর্তন করে দিয়েছো!’

শুনে যেন হতভম্বতার ন্যায় তাকায় আনজুমা। স্বামী তার মেজাজ তিক্ত করার পণ করেছে বোধ হয়। কোমরে আচঁল গুজে বিছানার নিচ থেকে ফ্রাইপেনটা হাতে নেই। আরভীক দেখে ভড়কে গেল। হেহে করে হেসে বলে,

‘আমি মজা করছিলাম ডোন্ট বি সিরিয়াস বউ!’
‘রিয়ালি তো নিজের সন্তানকে চিনতে পারস না বুড়া কোনখান!’
‘ওগো প্রণয়োণী এভাবে বলো না জাওয়ানী বুড়ার মধ্যে ফিলিং নষ্ট করো কেনো!’
‘চুপ বে’য়া’দব একদমে জাওয়ানী পিছ থেকে ছুটিয়ে দেব।’
‘বউ এটা কিন্তু হত্যাচারমূলক বাক্য।’

ব্যস ঠাসস করে আরভীক এর মাথায় বা’রি বসিয়ে দেয় আনজুমা। আরভীক ‘আহ্ বারি দিল রে’ বলে মৃদু আর্তনাদের সুরে মাথা চেপে ধরে। আনজুমা ভাব নিয়ে বলে,

‘আরেকবার আবুলমার্কা কথা জিজ্ঞেস করার আগে শতবার ভাববেন যে আমার কাছে একটা সোনামানিক ফ্রাইপেন আছে। উম্মাহ্!’

ফ্রাইপেনের মাথায় গভীর চুমু খেয়ে আরভীক এর দিকে তাকায়। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

‘নিজের স্বামীকে চুমু খেতে রমণীর লজ্জা লাগে অথচ পরপুরুষ ফ্রাইপেনকে চুমু খেতে রমণীর লজ্জা কি কোনো রুপ সংকোচও লাগে না। বলি সংসার কি তুমি ফ্রাইপেনের সঙ্গে করছো হে!’

চোখ রাঙিয়ে তাকায় আনজুমা। আরভীক মাথা চুলকে বলে,

‘না মানে আমাদের আজীব বাপ তো পুরুই বেরসিক,নিরামিষ হয়ছে। মেয়েকে পটানোর কোনো ট্রিক্স জানে না। কাল থেকে বউমাকে পটানোর ট্রিক্স দেব তাকে। দেখো না আমাদের আশফি কত এগিয়ে সে তো তার বাপকেও হার মানিয়েছে।’

আনজুমা শুনে হেসে দেয়। আরভীক ও সে মিলে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে।

চলবে….