প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব-১+২

0
464

প্রমত্ত অঙ্গনা
আরোহী নুর
(১)

নিজের ইচ্ছেতে দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রথম স্ত্রীর নিকট বাসর রাতের অনুমতি চাইতে এল আদ্রিশ,ছাঁদের এক প্রান্ত ঘেঁষে অগোছালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আঁখি,চোখে নেই কোনো জলের আকারনিকার,হাসিখুশি মেয়েটা আজ যেনো পাথরে পরিণত হয়ে গেছে।হুট করে এসেই পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল আদ্রিশ আঁখিকে,অতঃপর আহ্লাদী কন্ঠে বলতে লাগল।

রাগ করেছ আমার উপর?জানো তো আমি তোমাকে কত ভালোবাসি।আমি যাই করেছি শুধুই আমাদের ভালোর কথা ভেবে করেছি,আমি তোমাকে কখনো অবহেলা করি নি আর করবও না,আমার তোমার প্রতি ভালোবাসায় কোনো কমতি থাকবে না কখনো,সর্বদা যেমন ছিলো তেমনই থাকবে,শুধু আমাদের জীবনে নতুন একজনের আগমণ ঘটেছে যে আমাদের জীবনের আসল খুশি দান করবে,আমি বাবা ডাক শুনবো আর তুমি মা,তাছাড়া মা ও নাতি নাতনীর মুখ দেখতে চান,তোমার মন খারাপ হবে বলে কখনো বলেন না হয়তোল,কিন্তু আমি বুঝতে পারি।সব দিক বিবেচনায় নিয়েই আমি পদক্ষেপ টা নিয়েছে,সত্যি বিশ্বাস করো আমি শুধু তোমায় ভালোবাসি।আর তাছাড়া ও তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড,ওকে বিয়ে করার মাধ্যমে ওরও সমস্যা দূর হয়ে গেলো আর আমাদেরও।এই অল্প বিষয়ে মন খারাপ করে থাকলে চলবে?আমার লক্ষিটি আমার সাথে রাগ করে থাকতে পারে না আমি জানি,তাই এবার মন খারাপ করে না থেকে আমাকে অনুমতি দাও,বাসর ঘরে অন্য একজন যে আমার অপেক্ষায় বসে আছে।এমনিতেই ও অনেক কিছু সহ্য করেছে জীবনে,এখন যদি তুমি রাগ করে থাকো আর আমি ওকে অবহেলা করি তখন ওর কেমনটা লাগবে বলো?তাই অনুমতি টা দিয়ে দাও।

কথাগুলো শুনে গা জ্ব**লে উঠল আঁখির,কেউ কতোটা বেহায়া ও নির্লজ্জ হলে এমন কিছুর আশা করতে পারে কারো কাছ থেকে,রা**গে,অভি**মা**নে নিজের থেকে ছাড়ালো আদ্রিশকে আঁখি,ধা**ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলে খানিকটা দূরে,অতঃপর মুখে বাণী ফোঁটাল।

″লাইক সিরিয়াসলি আদ্রিশ,তুমি বাসর রাতে যাওয়ার জন্য আমার অনুমতি নিতে এসেছ,অথচ বিয়ে করবে তাও আমি জানতাম না,কাকে বিয়ে করছ সেটা তো আমার জন্য স্যারপ্রাইজ রেখেছিলে,এম আই রাইট বে**বি?কতো ভালো তুমি, সবার কথা ভেবে নিলে,তুমি বাবা ডাক শুনবে সাথে আমাকেও মা ডাক শোনার যোগ্যতা দিয়ে দিলে,মায়ের মুখে বলা কথাও হয়তো তুমি অনেক সময় বুঝতে সক্ষম হও না আজ উনার মনে কথা বুঝে গেলে।কি গ্রেট না তুমি,সবার কথা ভেবে আমাদের জন্য স্যারপ্রাইজ নিয়ে আসলে,সবার সমস্যার সমাধান করলে,রিদিকা কে দিলে তার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীর মর্যাদা, হোক না তার স্বামী এখন নতুন কেউ,হোক না সে অন্য কারো স্বামী। ″

″আঁখি তুমি ভুল বোঝছো আমায়।আমি কিন্তু সব আমাদের ভালোর জন্যই করেছি।″

″না ভুল কই বোঝলাম এটা বলতে পারো যে আজ প্রথম বোঝতে পারলাম তোমায়,ইশ কথাটা কেনো আগে আমার মাথায় আসলো না,আমিও তো পারতাম তোমাকে এভাবে স্যারপ্রাইজ দিতে,নতুন কাউকে বিয়ে করে নিতে,হয়তোবা তোমার বা**চ্চার মা না হতে পারলেও তার বা**চ্চার মা ঠিকই হতে পারতাম,তখন তুমি বাবা ডাক শুনতে আর আমি মা।″

আঁখি…..

ডন্ট সা**উট আদ্রিশ,যে কথাটা শুনতেও তোমার খারাপ লাগছে, সেই কথাটা মেনে নিতে আমার কতোটা খারাপ লাগছে আন্দাজ করে নিতে পারছো তো?

কথাটা শুনে চু**রে**র মতো চোখ লুকালো আদ্রিশ।

আমাকে বোকা ভাবতে এসো না আদ্রিশ,মা বাবা পরে কেউ যদি আমায় ভালো করে জানে সেটা হলে তুমি,আফসোস একটাই এতো বড় একজন উকিল হয়েও নিজের জীবনের ন্যায় অ**ন্যা**য়ের পার্থক্য টা ভুলে গেলে,শরীরের নতুন চাহিদা মেটাতে পর করে দিলে সব পুরানো সুন্দর সম্পর্ক,সব সুন্দর ভালোবাসার অনুভুতি। আজ একজন ডাক্তার হয়েও আমি একটা বাচ্চার জন্য এমন নাটক দেখতে পাবো কখনো ভাবি নি।জীবনে প্রতিটা ধাপে তুমি আমার সাথে ছিলে আদ্রিশ,প্রতিটা ধাপে নতুনভাবে আমার বিশ্বাস জয় করেছিলে,এমনিতেই তোমার জন্য মা বাবা বংশপরিচয় ছেড়ে চলে আসি নি।কথায় আছে না যে যা করবে তা তার উপরই ফিরে আসবে,আজ আমার টাও ফিরে এলো।তোমারও এমন দিন আসুক তা আমি কখনো চাইবো না।ভালো থাকো দোয়া করি।
আর দাঁড়ালো না আঁখি সেখানে,আদ্রিশের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা যে আর জুটিয়ে উঠতে পারছে না।

ছাঁদ থেকে নেমে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে রইল আঁখি,খেয়াল করলো আদ্রিশও নেমে আসছে,ওর দিকে তাকালে দু’জনেরই চোখে চোখ পরল,চট করে চোখ নামিয়ে ফেললো আঁখি,দরজা লাগানোর শব্দে চোখ তুলে আবারও তাকালো সেদিকে,চোখ ছিটকে এবার বেড়িয়ে এলো জল,সাথে মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি,নতুন সুখের ঠিকানায় চলে গেলো তার ভালোবাসার মানুষটি,যে কি না একটু আগ অব্দি তার কাছে বাসর ঘরে যাওয়ার অনুমতি চাইছিল, তার এখন সেই অনুমতিটাই আর লাগলো না।

আদ্রিশ এসে বিছানায় বসতেই রিদিকা বলে উঠল।

নিশ্চয়ই আঁখি রাগ করেছে তাই না?

করবে না?এমন জিনিস কেউ কিভাবে মেনে নেয়?

কিন্তু আমরাই বা কি করবো আদ্রিশ?মনের উপর তো আর কারো জোর চলে না,আমরা নিজেদের অজান্তেই একে অপরকে ভালোবেসে ফেললাম।তাছাড়া তোমাদের বাচ্চা হচ্ছে না এর কমতি আমি পূরণ করে দিতে সক্ষম আর তোমরা বদৌলতে সমাজে আমার সম্মান বাঁচালে, এতে তো ওর কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না,আমরা তো একসাথে মিলেমিশে থাকতে পারি,যেমনটা সবসময় ছিলাম,আমার তো এ বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু ও কেনো মেনে নিচ্ছে না?এমনটা জানলে আমি কখনো বিয়ে করতাম না তোমায়।

কথাগুলো বলে শুধু শুধু হেচকি তুলে কান্না শুরু করলো রিদিকা,তাতে বুকে মো**চড় দিয়ে উঠলো তার নতুন স্বামীর।

আরে কাঁদছো কেনো তুমি?সবার মানসিকতা তো একই হয় না,আমি ওকে ঠিকই মানিয়ে নিবো,তুমি চিন্তা করো না।তাছাড়া কান্না করে এতো সুন্দর রাত নষ্ট করতে চাও তুমি?আসো একটু আ*দ*র করে তোমার সব কষ্ট মিটিয়ে দিই।

অতঃপর আদ্রিশ তার নতুন বউকে নিজের কাছে টেনে নিলো।

এখনও সেই বন্ধ দরজার দিকে দৃষ্টি স্থীর রয়েছে আঁখির।ভিতরে হয়তো চলছে এক সুখের খেলা,রঙিন স্বপ্ন বুনছে নতুন দাম্পত্য জীবনের এক জোড়া নর নারী,কিন্তু সেই নতুন স্বপ্নের রঙ আঁখির স্বপ্নের পোঁ**ড়া ছাঁ**ই দিয়ে দিয়ে বানানো তিক্ত এই সত্য কিভাবে মেনে নিবে এই রমণী।চোখ যে আর বাঁধা মানছে না ,মুখ টিপে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে সে।

১৯ বছরের চেনাজানা,এর মধ্যে ৫ বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক আর ৩ বছরের সংসার সবকিছুই আজ কিছু স্বা**র্থ সংবলিত জিনিসের নিচে চাপা পরে গেলো,একেই হয়তো বলে নিয়তির খেলা।রিদিকা আঁখির বেস্ট ফ্রেন্ড,অনেক ভাইবোনের মধ্যে থেকে মধ্যভিত্ত এক পরিবারে বেড়ে উঠেছে সে।রিদিকা আঁখির সাথে কোনো স্কুল কলেজে পড়ে নি,কারণ রিদিকার কখনো সেই যোগ্যতাই ছিলো না আঁখির সমতুল্য মান পাওয়ার,ড.আশরাফ খানের একমাত্র মেয়ে আঁখি,সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম যার,কখনো আভিজাত্যের কোনো কমতি হয় নি,তারই সমবয়সী ছিলো রিদিকা,তাদের এক ড্রাইবারের মেয়ে,প্রায়ই তার বাবার সাথে আঁখিদের বাড়িতে আসতো।সেখান থেকেই আঁখির সাথে তার পরিচয়,আঁখি কখনো কাউকে ছোটো ভাবতো না,তাই রিদিকার সাথে সে নিজের সুন্দর এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলে খুব সহজে।তখন থেকেই রিদিকার সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক,আদ্রিশের সাথে ছোটো বেলা থেকেই পরিচয় আঁখির,আঁখির দুই বছর সিনিয়র ছিল আদ্রিশ তবে তার সাথে ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল সবসময়কার,একসময় তা ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়,আদ্রিশের যথেষ্ট সম্পত্তি থাকলেও আঁখির বাবার তাকে পছন্দ ছিলো না কারণ তার বংশ পরিচয় ভালো ছিলো না,ওর দাদা তিন বিয়ে করেছিলেন,যেটা নিয়ে সমাজে ওর দাদার নামে অনেক দু**র্না**ম রয়ে গেছে,তারপর ওর বাবাও দুই বিয়ে করেন।সেসব বিয়ের পিছনে ছিলো তাদের অনেক কু**কি**র্তি যার ফলস্বরূপ আঁখির বাবা এমন ঘরে নিজের একমাত্র মেয়েকে দিতে চাননি।কিন্তু আঁখি ছোটোবেলা থেকেই স্বাধীন ব্যক্তিত্বের অধিকারি।তাই সে তার পছন্দ নিয়ে নিজের পরিবারের সাথে অনেক দ্বিমত করে,অতঃপর পরিবারকে রাজি করতে না পেরে ভালোবাসার টানে সব ছেড়ে আদ্রিশের কাছে চলে আসে আঁখি,দু’জনে শুরু করে নিজেদের এক সুন্দর সুখের ঠিকানা,যে ঠিকানা আজ বদলে দিলো অন্য কেউ।রিদিকার বাবা অভাবের তাড়নায় মেয়েগুলোকে যেভাবে যেখানে পেরেছেন বিয়ে দিয়েছেন।রিদিকাকেও দিয়েছিলেন কোথাও,বিয়ের পরও আঁখি রিদিকার বেশ খোঁজ রাখতো,রিদিকা প্রায়ই বলতো ওর স্বামী ওর সাথে খা**রা**প আচরণ করে,ওকে ভালো রাখে না কিন্তু আঁখি যখনি তার স্বামীকে দেখত বা তার সাথে কথা বলত তার কখনো এমন কিছুই মনে হত না,বরং ওই লোকটাকে যথেষ্ট ভালো বলে মনে হত,সেদিন হঠাৎ রিদিকা ফোন করে বলে ওর স্বামী ওকে মা**র**ছে,আঁখি আদ্রিশকে নিয়েই ছোটে গিয়েছিলো নিজের বান্ধবী কে বাঁচাতে,ওখানে গিয়ে রিদিকাকে র**ক্তা**ক্ত অবস্থায় পরে থাকতে পায় ওরা,কিন্তু ওর স্বামীকে পায় না,রিদিকাকে ওরা হাসপাতালে নিয়ে যায়,রিদিকা বলে ওর স্বামী যৌতুকের জন্য ওর উপর প্রায়ই জু**লু**ম করে,আজকেও না কি ওকে অনেক মে**রে বেড়িয়ে গেছে,তখন রিদিকা প্রেগন্যান্ট ছিল,সেই মা**রে সে তার বাচ্চা হারায়।আঁখি রেগে গিয়ে ওর স্বামীকে পুলিশে দেয় আর রিদিকাকে ওদের সাথে করে ওদের বাড়িতে নিয়ে আসে,রিদিকার ডি**ভো**র্সও আঁখি নিজ দায়িত্বে করায়।তারপর থেকে রিদিকা ওদের সাথে থাকতে শুরু করে।রিদিকা আসার আগ অব্দি আদ্রিশ আর আঁখির সম্পর্কের ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিল না,দু’জন যতই ব্যস্ত থাকুক না কেনো দিন শেষে দু’জন দু’জনের জন্য ঠিকই সময় বের করে নিত,কখনো দু’জনের ঝগড়া হত না,একে ওপরের সাথে সব কিছু মিলিয়ে নিয়েছিলো ওরা,কখনো কোনো অমিল বা অমত থাকত না ওদের ওকে ওপরের কোনো বিষয়ে।কিন্তু রিদিকা আসার পর থেকেই সব ল*ন্ডভ*ন্ড হয়ে গেলো।বেশ কয়েকদিন ধরে আদ্রিশের মধ্যে খাপছাড়া একটা ভাব লক্ষ্য করতে পেরেছিল আঁখি,সবকিছুতেই আঁখির কোনো না কোনো দোষ খুঁজে বেড়াত,এটা ওটা নিয়ে ঝগড়া শুরু করত,যথারীতি অবহেলা করত ওকে,তাছাড়া যে একসময় নিজেই বাচ্চা নিতে চায়নি সেই হুট করে বাচ্চার আবদার করতে শুরু করল আর ৬ মাসের প্রচেষ্ঠায় সে হাঁপিয়ে গেল,বাচ্চার জন্য তার নতুন বিয়ে করতে হল তাও রিদিকাকে,কথাটা ভাবতেই তাচ্ছিল্যের হাসিটা আরও প্রখড় হল আঁখির ঠোঁটে। চোখে জল নিয়ে পাগলের মতো হাসতে লাগল আঁখি।মা বাবার অবাধ্য সন্তানদের পরিণতি হয়ত এমনই হয়ে থাকে।

চলবে……

প্রমত্ত অঙ্গনা
(২)

সোফাতে বসেই রাত কাটালো আঁখি,নিদ্রা অল্প মুহুর্তের জন্যও তার সাথী হলো না আজ রাতে,যাবে কোথায় সে,তার ভালোবাসার মানুষটাকেই নিয়ে নিলো অন্য কেউ সেখানে কক্ষের বড়াই সে করবে কিসে!আদ্রিশ তো তাকে কক্ষ থেকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই নিয়ে যাওয়ার সুযোগটা দেয় নি,হয়তো নতুন জীবন শুরুর তাড়ায় তা নিয়ে ভাবা বড় কিছু মনে করে নি।নতুন সুখের দোলায় পুরাতন টান মনে থাকার কোনো মানেও হয় তো নেই আদ্রিশের কাছে।তাই পাথরের মতোই সোফাতে বসে রাত্রী যাপন করল সে।সকাল প্রায় ৮ টার দিকে আদ্রিশের রুম থেকে দরজা খোলার শব্দ পেল আঁখি, প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আনতে হবে তাকে তার রুম থেকে,তাই বেহায়ার মতো এগিয়ে গেল সেদিকে,নক করতে গেলে দরজার ফাঁক দিয়ে চোখে গেল আদ্রিশ ওয়াসরুমে ঢুকছে গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে, শাওয়ার নিবে বুঝা যাচ্ছে,বিষয়টা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই খক করে উঠল আঁখির মন,কিছু আর না ভেবে রুমে প্রবেশ করল আঁখি,অগোছালো হয়ে শুয়ে আছে রিদিকা,শরীর ওর সাদা চাদরে ঢাকা,সেদিকে চোখ যেতেই হৃদয়ের ক্ষ**ত**টা কতো পরিমাণ বেড়ে গেল তার সেটা কোনো বাক্যে বলে বোঝানো দায়,তাও নিজেকে শ**ক্ত করলো আঁখি,এগিয়ে গিয়ে ওয়্যারড্রোবের ড্রয়ার থেকে ওর প্রয়োজনীয় কিছু নিয়ে রুম ত্যাগ করল।

শাওয়ার নিয়ে নীল রঙের একটা শাড়ি পরে চুল মুছতে মুছতে বেড়িয়ে আসল রিদিকা,আসতে আসতে চোখ গেল ওয়্যারড্রোব এর উপর রাখা দুটি গিফট বক্সের উপর,দু’টোই একই রঙের গিফট পেপারে আবৃত।রিদিকা বেশ আগ্রহ নিয়ে সেই বাক্স দু’টি হাতে নিল, এদিকে সদ্য বিয়ে করা বউয়ের সকালের এমন মাতোহারা রূপে দিশেহারা হল তার স্বামী, পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো রিদিকাকে,ঘাড়ে জমে থাকা ফোঁটা ফোঁটা জল ঠোঁ**ট দিয়ে পান করতে লাগল, অতিলজ্জায় যেন নুয়ে পরছে রিদিকা।

″কি করছ এসব ছাড়ো!″

″ছাড়ার জন্য ধরি নি।″

″তুমিও না,অনেক সকাল হয়ে গেছে,তাছাড়া দরজাও খোলা,তাই এসব বন্ধ করো আর বলো এগুলো কি?″

″বোঝতে পারো না গিফ্ট এগুলো,খুলে দেখোতে পছন্দ হয় কি না।″

রিদিকার ঘাড়ে থুতনী রেখে বলল আদ্রিশ কথাটা,রিদিকা বেশ খুশি হয়ে প্রথম বাক্সটা খুলল,একটা কালো রঙের শাড়ি,রিদিকার কালো রং তেমন একটা পছন্দ না,তবে শাড়িটা সুন্দর, তাই অতিরিক্ত খুশি হয়ে আদ্রিশের গালে চুমু কেটে দিল।

অনেক সুন্দর হয়েছে গিফটটা,আপনি সত্যিই অনেক ভালো,তা ওপরটাতে কি?খুলে দেখি তাই না?

অতঃপর রিদিকা ওপর উপহার খুলতে গেলে তাতে বাঁধা দিল আদ্রিশ।

ওটা তোমার জন্য নয়।

আমার জন্য নয় মানে!পানসে মুখ করে বলল রিদিকা।

ওটা আঁখির জন্য।

″ওর জন্যও এনেছ?″

″হুম,কেনো?বউ তো শুধু তুমি একা নও আমার,আঁখিও তোমার সমান ভাগীধারিতে আছে বুঝতে পারছ মায়াবতী।তা রেডি হয়ে নিচে চলে আসো দু’জন ব্রেকফাস্ট করে বাইরে বেড়াতে যাব।

কথাগুলো বলে রিদিকার গালে চু**মু দিয়ে উপহারটা হাতে নিয়ে রুম ত্যাগ করলো আদ্রিশ।মুহুর্তেই রিদিকার চেহারাতে যেনো কা**লো মেঘ এসে জড়ো হলো,কিছু না বললেও মুঠো শক্ত করে তিক্ত কিছু অনুভুতি মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো।

হাসপাতালে যাওয়ার আগে রোজ সকালে নিজের হাতে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে সবাইকে খাওয়ানো আঁখির রোজকার অভ্যেস,কাজের লোক থাকলেও এসব করতে ওর ভালোই লাগে,তাই আজও তার ব্যতীক্রমে গেল না কিছু,অতি স্বাভাবিক হয়ে সবার জন্য ব্রেকফাস্ট বানাল,ওর হাবসাব দেখে কেউ বলতে পারবে না যে ওর জীবনে এত কিছু হয়ে গেছে।আঁখির কথা ভেবে তো কাজের লোকগুলোরও চোখ থেকে জল শুকোয় না সেদিকে আঁখি এতোটা স্বাভাবিক কেউ কিভাবে তা মেনে নিবে,আঁখি নাস্তা সাজিয়ে কাজের লোকদের বলল সবাইকে ডেকে নিয়ে আসতে আর নিজে হাঁটা ধরলো ঘরের বাইরের দিকে।

আঁখির লাগানো গোলাপের চারাতে আজ ফুল ফোটেছে এতেদিন পর,খারাপ লাগার মধ্যেও যে এক ভালোলাগার দোলা গায়ে মেখে গেল ফুলগুলোর সতেজ রূপ নজরে আসতেই,ঠোঁটের কোণে ঠাই পেলো কিঞ্চিৎ হাসি,কিন্তু অল্পক্ষণে তাও উদাও হয়ে গেলো যখন আঁখি দেখতে পেলো সতেজ দু’টি গোলাপের ঠিক মধ্যেখানে একটা আ**ধম**রা গোলাপ,সতেজ দু’টি গোলাপের মধ্যে এই আ**ধম**রা গোলাপটাকে কেমন জানি বেমানান লাগছে,কু**ৎসি**ত এই গোলাপটা বাকি দুইটা সতেজ গোলাপের সৌন্দর্য নষ্ট করে তুলছে,ঠিক যেন রিদিকার মতো সেই গোলাপটাও সুন্দর সেই গোলাপ দয়ের সুন্দর জীবনের মধ্যাকার বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে,বড্ড ইচ্ছে করল আঁখির সেই কুৎ**সিত গোলাপটাকে ছিঁ*ড়ে ফেলতে তার বোঁটা থেকে, পায়ের তলায় পিষে ফেলতে তাকে।কিন্তু পরক্ষণেই ভাবনায় অন্য ধারণা ধরা দিলো তার,এখানে কি শুধু সেই কু**ৎসিত গোলাপেরই সব দোষ,সেই সতেজ দু’টি গোলাপ তো ওর পাশে না থাকলেও পারতো,ওরা তো নিজেরা পারতো আলাদা অবস্থান নিয়ে ফুটে উঠতে,জীবনে কু*ৎ**সিত কোনো ছায়া পরতে না দিতে।ভাবনার এ জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হতে পারছে না আঁখি,সব অনুভতি তার কেমন জানি গুলিয়ে গেছে আজ,হঠাৎ করে সেখানে কারো উপস্থিতি টের পেল,পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলো আদ্রিশ একটা গিফ্ট বক্স হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মুখ ভর্তি হাসি,ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল আঁখি তার প্রেমিক পুরুষকে,অন্য নারীর নিকট থেকে আসার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে সে।মাথার চুল এখনও বেশ ভেজা দেখাচ্ছে,হাতে ঘাড়ে খামচির স্পষ্ট দাঁগ বুকের জ্ব**ল**নের পরিমাণ আরও তে**জি করলো আঁখির।আঁখির সুপ্ত এই অনুভুতির আর কোনো খোঁজ করতে মনোনিবেশ করতে চাইল না আদ্রিশ,বরং হাসিমুখে বললো।

″আরে আঁখি,তোমার গাছে দেখি ফুল ফোঁটেছে,অনেক খুশি হয়েছো না তুমি?তা নাও তোমার খুশি আরও দ্বিগুণ করে দিই।এই নাও গিফ্ট তোমার জন্য এনেছি।তোমার কালো রঙের শাড়ি অনেক পছন্দ না?এটাতে একটা কালো রঙের শাড়ি আছে।এটা পরে রেডি থেকো, আজকে তো সরকারি ছুটি আছে সন্ধ্যায় তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাব।″

″হুম ভালো,তা রিদিকাকে নিবে না।ও ও তো এখন তোমার স্ত্রী। ″

″ওকে নিয়ে এতো ভেবো না তো তুমি, আমি এখন যাব ওকে নিয়ে বেড়াতে,তারপর সন্ধ্যায় তোমাকে নিয়ে।এবার যাও শাড়িটা পরে আসো দেখি কেমন লাগে তোমায়।″

″লজ্জা করে না আদ্রিশ তোমার?তুমি যে হিতাহিত জ্ঞানহীন আগে জানলে কখনো তোমার জালে পা ফেলতে আসতাম না।ছিঃ, তোমাকে বেশি কিছু বলতে চাই না শুধু একটা কথা বলবো।
কখনো একসাথে দুই নৌকায় চড়া সম্ভব হয় না,দুইটা নৌকা নিয়েই ডোবার সম্ভাবনা থাকে,কথাটা মাথায় রেখো।পথ ছাড়ো আমার কাজ আছে অনেক।″

″তোমার মনে হয় না তুমি একটু বেশি রিয়াক্ট করছো আঁখি?″

″শুকরিয়া করো শুধু রিয়াক্ট করেছি অন্য কিছু এখন অব্দি করি নি,নইলে এখন নতুন বউয়ের সাথে না থেকে জেলে ক**য়ে**দি**দের সাথে থাকতে।ভ*য় পেয়ো না কে**স করবো না তোমার উপর আমি,কারণ কোনো সাজা দিয়ে তোমার ভুলের পরিমাণটা করানো যাবে না, তোমার সাজা তো সেদিন যথার্থ হবে যেদিন নিয়তি তোমাকে তোমার টা ফিরিয়ে দিবো আর আমি নয় তো কোনো অবলা আর না তো কোনো বে**হা*য়া যে দিনশেষে বিশ্বাস ঘা**তক ও স্বার্থপরের প্রেমে গড়াগড়ি খাব।এখানে আছি কিছু নির্দিষ্ট কাজে,কাজ শেষ হলেই আমি চলে যাবো আর কাল সকাল অব্দি ডিভোর্স পেপারও চলে আসবে চিন্তা করো না।″

ডিভোর্সের কথা শুনে আদ্রিশের বুকটা কেমন কম্পন করতে শুরু করলো।হুটহাট জবাব দিল।

″আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব না।″

″কেনো তা শুনতে পারি?″

″কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি,তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না,তুমি আমার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে,এমন এক অভ্যেস যাকে চাইলেও বদলাতে পারবো না কখনো আমি।″

″বদলে তো তুমি ফেলেছ আদ্রিশ অনেক আগেই।এখন তার প্রতিদান আমায় দিতে হবে।আর আমি তার থেকে কখনো পিছপা হব না চিন্তা করো না।″

আদ্রিশতের পাশ ঘেষে তাকে তাচ্ছিল্য করে চলে আসলো আঁখি।

শুভ্যতা আঁখির ভাসুরের স্ত্রী, আঁখির সাথে জা এর কম বোনের সম্পর্কই তার বেশি।ও কখনো ভাবে নি আদ্রিশ এমনটা করে যাবে আঁখির সাথে,যে জায়গাতে ও অনেক সময় বেশ অভিমাণ করতো তার স্বামীর সাথে,আদ্রিশ আঁখিকে এত ভালোবাসে,ওর জন্য কত ভাবে,সব কিছুতে ওকে সাপোর্ট করে,ওর কিছু হয়ে যাওয়ার আগে ঘর মাথায় তুলে ফেলে,ওর জন্য কত না স্যারপ্রাইজ প্লান করে,নিজের স্বামীকে আদ্রিশের কাছ থেকে এসব কিছু শিখে নেওয়ার অভি**মা**নী আবদার করত শুভ্যতা,আদ্রিশ এমন কিছু করে যাবে কখনো কল্পনাতেও ভাবে নি কেউ।কাল রাতে নিজের স্বামীকে ঝাপটে ধরলো শুভ্রতা,ক্ষমা চাইলো তার কাছে।খুব করে চাইলো সে যেনো কখনো আদ্রিশের মত না হয়।ও যেভাবেই আছে শুভ্রতার কাছে তার সবকিছু, সে যে আঁখির মতো এত শ**ক্ত মানসী নয়,এমন কিছুর বিপরীতে নিজেকে যে সামলে নেওয়া তার ক্ষমতার বাইরে।তার স্বামী তখন তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিল,তাকে ভরসা দিল তার কাছে তার স্ত্রী পৃথিবীর এক অমুল্য সম্পদ।বাগানের দোলনাতে বসে আছে আঁখি,একধ্যানে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে,অনেক সাহস করে শুভ্রতা এলো তার সাথে কথা বলবে বলে।আঁখির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেললো শুভ্রতা,আঁখির সাথে কথা বলারও যে ভাষা হারিয়ে গেছে সে।এমন এক অবস্থায় কাউকে সান্ত্বনা স্বরুপ কিছু বলতে যাওয়াও হাস্যকর বলে মনে হয় শুভ্রতার কাছে।কোনো নারী তার স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না কখনো,এমন কিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়া নারীদের মহীয়সী নারী ব্যতীত কোনো উপাধী হয়ত মানাবে না।তাই শুভ্রতা চাইলেও যে আঁখির সাথে কথা বলার সামর্থ্য জুটিয়ে উঠতে পারছে না,কি করবে সে বা তার স্বামী, শ্বাশুড়ি।হ্যাঁ ওদের তিনজনের কাছেই আদ্রিশের থেকে আঁখির মর্ম বেশি হলেও তিনজনই আদ্রিশের কাছে এক প্রকার বা**ধ্য।

চলবে…..

আরোহী নুর…..