প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব-৭+৮

0
207

প্রমত্ত অঙ্গনা
(০৭)

দেখতে দেখতে রাত গড়ালো, আঁখি যাওয়ার পর আদ্রিশ প্রচন্ড রা*গে তার কক্ষের জিনিস ভাং*চুর করেছে তারপর বাইরে কোথাও চলে গিয়েছিল,কাজের লোক দিয়ে কক্ষ পরিষ্কার করিয়েছে রিদিকা,এবার আদ্রিশ ঘরে ফিরল,রিদিকা আদ্রিশের জন্য অপেক্ষা করছিল তার কক্ষেই আদ্রিশ আসতেই হাসিমুখে তার পাশে গেল এগিয়ে।

″তুমি এসেছ,কোথায় গিয়েছিলে?সেই সকালে বের হয়েছিলে আর এখন আসছ,এত কল দিলাম একটাও ধরলে না,আমার চিন্তা হয় না বুঝি তোমার জন্য?ফ্রেস হয়ে নাও আমি খাবার নিয়ে আসছি,খাবে।″

″খাব না খিদে নেই,তুমি একটু একা ছেড়ে দাও আমায়,প্লিজ।″

কথাটা বলে আদ্রিশ রিদিকাকে পাশ কাটিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পরল চিৎ হয়ে,রিদিকা এবার ওর মাথার পাশে এসে বসল,আদ্রিশের মাথায় হাত বুলিয়ে বেশ আদুরে স্বরে বলল।

″আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি দেখবে খুব জলদি ঘুম চলে আসবে।″

″প্লিজ তুমি যাও,আমি ঠিক আছি।″

″আমি কোথাও যাব না তোমাকে ছেড়ে,তাছাড়া আঁখি তো চলেই গেছে,এখন তো আর ফিরবে না,তাই এখন এখানে আমি থাকলে তো কোনো সমস্যা নেই।″

″আঁখি ফিরবে,ওকে ফিরতেই হবে।আর ও আসুক না আসুক,ওর অবস্থান ওরই থাকবে আমার জীবনে।″

″ওর জন্য এত ভাবো আর আমার জন্য কোনো ভাবনা নেই তোমার মধ্যে, ওকে তো আমি বা তুমি যেতে বলি নি,ও নিজে থেকেই গেছে,আমি তো বলছি না ওকে ফিরিয়ে এনো না,ওর জায়গাও আমাকে দিতে বলছি না,তবে আমার জায়গা তো আমাকে দেওয়া যায়,না কি এক রাতেই মন ভরে গেল।″

″রিদিকা তোমাকে চলে যেতে বলেছি চলে যাবে,এত প্যাচাল করছ কেন?″

রিদিকা বেশ অভিমান নিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে কথাগুলো বললে তার কথার প্রতিক্রিয়ায় গর্জে উঠে আদ্রিশ উক্ত কথা বলে উঠল।রিদিকা আর কিছু না বলে বেশ শব্দ করে কেঁদে ছুটে কক্ষ ত্যাগ করল।

বেশ বিরক্তিকর একটা অনুভুতি খেলিয়ে গেল মুহুর্তেই আদ্রিশের মনের ভিতর,তবে সেই বিরক্তিটা আসলো নিজের উপর,তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর মনে সে এভাবে পী*ড়াদা*ন করতে চায় নি,অল্পসময় কথাটা নিয়ে অনেক গভীর ভাবনায় তলালো সে অতঃপর উঠে এগিয়ে গেল রিদিকার কক্ষের পানে।

আঁখি নিজের গাড়িতে করে নিজের করা বাড়িতে চলে আসলো,আঁখির সপ্ন মহল নাম রাখা বাড়িটার।বাড়িটা আঁখির নিজের টাকায় গড়া,স্বামী সন্তান নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজন থেকে আলাদা হওয়ার চিন্তা আঁখির কখনো ছিল না,কিন্তু আঁখির সেই ছোটবেলা থেকেই সপ্ন ছিল নিজের টাকায় একটা বাড়ি করবে,সেই সপ্নটা এই তো একমাস আগেই পূরণ হল,আঁখি ভেবেছিল বাড়িটা করলে কখনও কখনও বেড়াতে আসবে এখানে সবাইকে নিয়ে কিন্তু এটাই টার স্থায়ী আশ্রয় হবে ভাবনাটা কল্পনাতেও টোকা দেয় নি আঁখির কবুও,বাড়ির একটা কক্ষ বানিয়েছিল ওর আর আদ্রিশের জন্য,যেখানে তাদের সব রকমের ছবি টাঙানো ছিল,তাছাড়া আদ্রিশের পছন্দ অনুযায়ী বাড়িটা ডেকোরেট করেছিল আঁখি,ভেবেছিল ভালো একটা ছুটির দিন দেখে আদ্রিশকে এখানে নিয়ে এসে স্যারপ্রাইজ দিবে,সাথে সবাইকে নিয়ে এসে হৈ-হুল্লোড় করবে সারাদিন,কিন্তু কই হল তার আশা পূরণ,সুন্দর স্বপ্নগুলো সপ্ন রয়ে যাবে জানা থাকলে হয়ত তা কখনও ওভাবে সাজাত না আঁখি,ভা*ঙা এই অনুভুতির সাথে মানিয়ে নেওয়া যে কত দূরুহ হচ্ছে তা শুধু আঁখিই জানে,বাড়িতে এসেই কাজে লেগে গেল আঁখি,মন ভেঙে চু*র্ণবিচু*র্ণ তবে মনের সক্ষমতা এক চুলও কম হয় নি তার,শক্ত মানবীরুপে সরিয়ে নিল সব ছবি তার আর আদ্রিশের,সেগুলো ঠাই পেল স্টোররুমে এক কোণে,বাড়ির গার্ড আর কাজের লোক দিয়ে দিনে দিনে সব কিছুর সাজগোজ পাল্টে নিজের পছন্দ অনুযায়ী সাজাল সব আসবাবপত্র।এই বাড়ির দেখাশোনার জন্য সে কয়েকজন গার্ড আর কাজের দুজন লোক আগেই রেখেছিল।যাক সবকিছুই তার কাজে দিল,আজকে নিজে থেকেই আঁখি কাজে যায় নি,নিজের সাথে একান্ত কিছু সময় কাটাতে চাইল আজ সে।

হাতে আঁখির ছবি নিয়ে আজও বসে আছে আদৃত নামক সেই গম্ভীর পুরুষ,সবার কাছে তার গম্ভীর এই রুপখানা অটল থাকলেও আঁখির জন্য তার মন যে সবসময় এক পা*গ*ল উতলা প্রেমিক,কখনও তার সেই অ*কৃ*ত্রিম অসীম এই ভালোবাসা উপলব্ধি করানোর ক্ষমতা তার হয়ে উঠে নি সেই কাঙ্ক্ষিত রমণীকে,আদৃত যে বড্ড দেরি করে ফেলেছিল আর তার মাসুল প্রতিক্ষণে তাকে দিয়ে যেতে হচ্ছে। বর্তমানে আঁখির ছবি নিয়ে প্রায় দিনের মতই গল্পতে মশগুল আদৃত।

কি দেখছ এংরি বার্ড?দেখছ আমাকে?ঘৃ*ণা হচ্ছে না আমাকে দেখে বড্ড?হওয়ারই তো কথা, কখনও তোমার ভালোবাসার মর্ম দিতে পারি নি আর যখন দিতে চাইলাম তখন তুমি অন্য কারও হয়ে গেলে,জীবনের কাঙ্ক্ষিত সুখটা তুমি অন্যতে পেয়ে গেলে,আমাকে নিজের প্রেমে আবদ্ধ করে দূরে চলে গেলে তুমি অনেক,অনেক সুখি আছো তাই না?হয়ত বিয়ে করে নিয়েছ,স্বামী সন্তান আছে তোমার।খুশি আছো তুমি আদ্রিশকে নিয়ে,তবে আমি যে সুখি নেই প্রিয়তমা,তোমার শোকে রোজ যে পোঁড়ে ম*র*তে হয় এই পা*ষা*ণ হৃদয়কে।

রিদিকা নিজের কক্ষের এক কর্ণে এসে দাঁড়িয়ে গেল,অতি আবেগ আর অভিমানে আবৃত হয়ে দুইহাতে মুখ চেঁপে বেশ শব্দ করেই কাঁদতে লাগল,আদ্রিশ পিছনে এল তার,নতুন বউকে এভাবে কাঁদতে দেখে বেশ বিচলিত হল তার মনখানা,বুকের ভিতর আফসোসের এক সুর জাগ্রত হলো,তাই এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল রিদিকাকে,তার কানের কাছে মুখ নিয়ে আলত করে বলল।

ক্ষমা করা যায় না আমায়?ভালোবাসি বলেই তো ধমক দিলাম,আমার কি একটু রা*গারও অধিকার নেই?

রিদিকা এবার মুখ থেকে হাত সরালো,পিছন ফিরে জড়িয়ে ধরল আদ্রিশকে,তার বুকে মাথা রেখে আহ্লাদি কন্ঠে বলল।

″সত্যিই ভালোবাসো?″

″হুম,ভালোবাসি।″

″তাহলে দূরে ঠেলে কেন দাও?″

উত্তরে আদ্রিশ কিছু বলল না।রিদিকা আবার বলল।

″এর মানে আমাকে পাশে রাখতে চাও না,ঠিক আছে কালকেই আমি আমার মা বাবার কাছে চলে যাব।″

″একদম বাজে বকবে না,তুমি কোথাও যাচ্ছো না।″

″এভাবে দূরত্ব আমি সহ্য করতে পারছি না আদ্রিশ,হয়ত নিজের কাছে রাখো নয়ত দূরে পাঠিয়ে দাও।″

″আমি তোমাকে কোথাও দূরে পাঠাচ্ছি না।″

″তাহলে আপন করে নাও,ভালোবাসো আমায় যাতে আমি চাইলেও দূরে যেতে না পারি তোমার থেকে।″

রিদিকার আদ্রিশের বুক থেকে মুখ তুলে আহ্লাদী স্বরের উক্ত আবদার যেন ভুলিয়ে দিল আদ্রিশের সকল দুশ্চিন্তা,মাথায় চড়ল এক অদ্ভুত মোহের খেলা,রিদিকার নে*শা*ক্ত ডাকে সারা না দিয়ে পারল না আদ্রিশ,মুছে দিল হাত তুলে রিদিকার চোখের জল,দু’হাতের মধ্যেখানে রিদিকার মুখখানা আগলে নিয়ে এগিয়ে গেল তার অধরের ছোঁয়া পেতে।

একদিকে আদ্রিশ সুখের রাত্রী যাপন করছে ওপরদিকে আঁখি যাপন করছে বিনিদ্র রজনী,একা এই জীবনে আজ যে কাঁদতেও নেই কোন বারণ,একা দূর্বল পরারও তো কোনো ভয় নেই,কেউ অবলা বলে তো তাচ্ছিল্য করার থাকবে না, তাই একা এই ঘরে আজ বেশ শব্দ করেই কাঁদতে মগ্ন হল আঁখি,মা বাবার আদরের মেয়ে যার কান্নার সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না কখনও দূর দূর অব্দি, দুঃখ যাকে কখনও ছুঁতেও পারে নি,তার বাবা যে ঢাল ছিল তার,তার নামে তার বাবার ছিল পৃথিবীর সকল সুখ।আজ সেই বাবার মেয়ে চিৎকার করে করে হেঁচকি টেনে কাঁদছে আর বলছে।

মা বাবা,দেখ না আজ তোমাদের এই পা*গ*ল মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদছে, আজ নেই কেউ তার চোখের পানি মুছে দেওয়ার মত,যার মধ্যে সকল সুখের আশ রেখেছিলাম,যার জন্য তোমাদের ছাড়তেও পিছপা হইনি সেই আজ আমায় কাঙাল করে ছেড়ে দিল,আজ তোমাদের কথা বড্ড মনে পরছে বাবা মা,তোমাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ারও কোনো সামর্থ্য নেই আমার,কোন মুখে যাব তোমাদের কাছে,আমি যে আমার ভাগের সাজাটা আজ পেয়ে গেছি বাবা দেখ,তুমি আর মা হলে হয়ত আজ আমার এ হাল হত না,কখনই এতটা ভেঙে পরতাম না আমি,আগলে নিতে তোমরা,কি করব নিজের দোষে সব হারিয়েছি,হারিয়েছি তোমাদের,পারলে ক্ষমা করে দিও আমায়,এই অভাগীকে আর অভিশাপ দিও না তোমরা সে যে আর সইতে পারবে না।

ফোনের রিংটনে বেশ বিরক্ত হল আদৃত,আঁখির ছবি থেকে চোখ হটিয়ে ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি স্থির করল,মা লেখাটা চোখে ভেসে আসায় বিরক্তি দূর হল মুহুর্তেই,ফোনটা রিসিভ করে বলল।

আসসালামু আলাইকুম আম্মু, কেমন আছো।

ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছিস বাবা?

এইতো আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?আর বাবা?

আমি আর তোর বাবা দু’জনই ভালো আছি। বলছিলাম কি ইশিকার তো একটা মেয়ে হয়েছে,তুই তো ছবিতে দেখেছিস ওকে,সামনাসামনি দেখতে বুঝি মন চায় না ওকে তোর?তুই আবারও মামা হয়েছিস,এবার তো চলে আয় দেশে আর কতদিন পরিবার থেকে দূরে থাকবি,ইশিকা বড্ড করে চাইছে তোকে দেখবে।

আসলে মা এখানে কাজের অনেক চাপ,চাইলেও আসতে পারি না,তা এখন রাখি একটা সার্জারি আছে ফ্রি হয়ে কল করব তোমায়।

কথাটা বলেই কল কেটে দেয় আদৃত,মায়ের সাথে জোর দিয়ে কখনও মিথ্যে বলার ক্ষমতা বা অভ্যেস কিছুই তার নেই,সর্বদা সত্য বলা আদৃত আজ দেশে ফিরার নামে নিজের জননীর সাথেই মিথ্যে বলে,কী বা করার আছে এই কঠিন পুরুষের,দেশে ফিরার নামে যে তার বুকের ভিতরের মোচড়ের পরিমাণটা হাজারগুণ বেড়ে যায়।

সুখের অনেকক্ষণ কাটানোর পর শান্তির এক নিদ্রা যাপন করছে রিদিকা তবে পাশে শুয়ে থাকা শ্যামবর্ণের সেই মায়াবী চেহারার অধিকারী পুরুষের ঘুম নেই,হাতে নিয়েছে ফোন,সুখের ক্ষণ পেরিয়ে গেলে মাথায় আবারও ভর করল আঁখির দুঃ*চিন্তা, তাই তাকে হুটহাট কিছু ম্যাসেজ করবে ভাবল।তবে এ কী! কোনোভাবেই আঁখির সাথে যোগাযোগ
করতে সক্ষম হল না আদ্রিশ,সবকিছুতেই আঁখি ব্লক করেছে তাকে,বন্ধ করেছে তার আঁখির খোঁজ নেওয়ার সকল রাস্তা, যা ক্ষণিকে মনে অস্থিরতার যোগান দিল আদ্রিশের।

সাত সকালে আরিয়ান মির্জা সাহেবের কপালে চিন্তার বেশ কটা ভাজ পরল,উক্ত অবস্থা তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে সাতসকালে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখে হল উনার,উনি জানেন তার স্ত্রীর কান্নার কারণ,এটা যে এখন প্রায় দিনেরই কান্ড মিসেস শায়লা মির্জার,বেশ নিরাশতা নিয়ে উনি শায়লা মির্জার কাছে এসে বসে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন।

″কেন কাঁদো শায়লা?ছেলে কাজ করে ওখানে,ওর ওখানে কাজ করতে পছন্দ তাই, করতে দাও না তাকে তার কাজ,এমনি তো সারাদিন কথা বলো,কখনও কখনও মধ্যরাতে উঠে কল দাও কাল রাতে যেমনটা দিলে,এভাবে ওর সাথে কথা বল প্রায় সারাদিনই আর কি চাই তোমার?″

″আমার আর কিছু চাই না,আমার শুধু আমার ছেলেকে চাই।সেই ৬ বছর আগে হঠাৎ করে কেন চলে গেল!আর কেন আসে না ফিরে বাড়িতে! বাবা হয়ে কি কখনও জানার চেষ্টা করেছ?আমি কিছুই জানি না তুমি যে করে পার আমার ছেলেকে এনে দাও,নইলে আমি কি করব আমি নিজেও জানি না।″

কথাটা বলে শায়লা মির্জা বেশ রাগ দেখিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।আরিয়ান মির্জা ব্যার্থতায় ভরা এক দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

চলবে…….

আরোহী নুর……….।

প্রমত্ত অঙ্গনা
(০৮)

চারিপাশেই গাছগাছালি, পাখির কিচিমিচির ধ্বনি যেন আঁখির সব ক্ষ*ততে অল্পের জন্য ওষুধের কাজ করল ,বাড়ি থেকে অল্প দূরে একটা সুন্দর জায়গা,বেশ একটা বন্য পরিবেশ কিন্তু ওতো গভীর না,আশেপাশ জনশূণ্য,কোলাহলমুক্ত পরিবেশ,সকালের সিগ্ধ বায়ু তার সাথে করে যেন নিয়ে যাচ্ছে আঁখির মনের সব তি*ক্ত ঘ্লানি,বেশ ভালোই লাগছে আঁখির পরে থাকা শুকনো পাতার উপর দিয়ে হাঁটতে,আঁখির কদমে সেগুলোর ম্যাচম্যাচ করে উঠা শব্দে আঁখির মনে বেশ আনন্দের খেলা মাতিয়ে তুলেছে,তাই আপন মনেই হাঁটছে সেগুলোর উপর দিয়ে, সাত সকালে এমন পরিবেশে হাঁটা যে আঁখির নিত্যদিনেরই পছন্দ, হঠাৎ আঁখি আশেপাশে কারো উপস্থিতি আন্দাজ করতে পারল,কারণ সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরও অন্য স্থানও থেকে শুকনো পাতার ম্যাচম্যাচ শব্দটা তার কানে এলো, মানে তার আশেপাশে কেউ আছে যে আঁখির সাথে এখানে বিচরণ করছে,চারপাশেই বিচক্ষণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল আঁখি,না কাউকে পেলো না,হয়ত কোনো ব্যাং বা ছোটো কোনো প্রজাতির পশু হবে যা পাতার উপর দিয়ে গেছে তাই সেদিকে আর ভ্রুক্ষেপ করল না আঁখি,কারন শব্দটা একবারই কানে এসেছে তার,আবারও হাঁটায় মন দিলে আঁখি,কিন্তু না কেন যেন মনে হচ্ছে কেউ ওর উপর নজর রেখে চলেছে,ছোটোবেলা থেকে আঁখির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা প্রচুর,সবকিছুতেই সহজে অভিজ্ঞতা অর্জন করে নেওয়ার আলাদা প্রতিভাসম্পন্ন সে।তাই নির্দিদায় বলতে সক্ষম হচ্ছে কেউ ওর পিছু করছে,এবার বেশ জোর গলায় চারপাশ কাঁপিয়ে বলল আঁখি।

কে?কে আমার পিছু নিচ্ছে? সাহস থাকলে সামনে আয়।

আঁখি নিজের প্রশ্নের কোনো উত্তর পেল না,দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হলো বড্ড, কেউ ওর পিছু করছে এটা নিশ্চিত আঁখি,তবে কে সে?

আঁখি হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় ৮ টা বেজে গেছে,বাড়ি থেকে বেশ দূরে চলে এসেছে সে,এবার তাকে বাড়ি যেতে হবে,তাছাড়া আজ হাসপাতালেও যেতে হবে।তাই বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল।

বড় একটা গাছের পিছন থেকে আঁখির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল কালো হুডি পরিহিত কেউ একজন,মুখে কালো মাস্ক সাথে হাতে কালো রঙের হাতমোজা,পায়েও কালো সু।

হোয়্যাট্সআপে আজকেও আঁখির নাম্বার চেক করছে আদৃত,একদিন এই নাম্বার থেকেই যে সবথেকে বেশি নোটিফিকেশন আসত।

ডা.সাহেব কেমন আছেন?মিস করছেন আমায়?জানি তো করছেন,হিটলার আঁখিকে ভোলা এত সহজ নয়।

ডা.সাহেব আমি আপনার বাড়ির বাইরের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছি,আপনি নিচে আসেন নইলে আমাকে উপরে এসে আঙ্কেল আন্টিকে ঘুম থেকে উঠাতে হবে।

ওই ডাক্তার সাহেব কোথায় আপনি?রিপ্লাই কেন করেন না?আপনার কোন পাঁকা ধানে মই দিলাম আমি?জানেন তো পাকা ধান কখনও স্ব চোখে দেখিও নি মই কি করে দিব!

কথাগুলো ভেবে প্রায়ই দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে আদৃত,না আঁখি তাকে ব্লক করল আর না তো সে,তবে হুট করে যে সেই ছয় বছর আগে ম্যাসেজ দেওয়া বন্ধ করল আঁখি আজও দেয় না,সারাদিন তো এই নাম্বারে অনলাইন পায় আদৃত আঁখিকে, চেক করে যে বার বার,যদি এখন একটা ম্যাসেজ আসে সে আশে,তবে আঁখির হয়ত তাকে মনেই নেই যে ম্যাসেজ করবে,কথাটা মেনে নেওয়া কতটা ক*ষ্টসাধ্য তা শুধু আদৃত জানে।

কেন চলে গেলে আঁখি?আজ তোমার সুখের জন্য তোমাকে ছেড়ে চলে আসলাম,তবে আমি যে ভালো থাকতে পারছি না আঁখি,আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা,সেই প্রথম নারী তুমি আর তোমাতেই যে এই মনের সমাপ্তি আঁখি,তুমি কি তা আদোও জানো?

শত চেষ্টার পরেও রাতভর চোখে নিদ্রা জোটাতে ব্যার্থ হলো আদ্রিশ,শরীরকে তো সুখের ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছিল সে তবে মনের প্রশান্তি আনতে অক্ষম হলো,রাতে রিদিকার পাশ থেকে আবার নিজ কক্ষে চলে এসেছিল আদ্রিশ,দেয়ালে টাঙানো আঁখির ছবি দেখে গিয়েছিল রাতভর,আঁখি সত্যিই ওকে ছেড়ে চলে গেছে ভাবতেও বুক কেঁপে উঠছে তার বার বার,না আঁখি তাকে কখনও ছেড়ে যাবে না,আঁখি নামক রমণী যে তার প্রেমে বদ্ধ উ*ন্মা*দ, যে এক আদ্রিশের জন্য সকল কিছু ত্যাগ দিল সে আদ্রিশকেই ছেড়ে যাবে ভাবাও দূরুহ,তবে আঁখি যে সত্যিই বাড়ি ত্যাগ করে গেল,ব্লক করে দিল আদ্রিশকে সকল জায়গা থেকে,বন্ধ করল আঁখিকে পাশে পাওয়ার সমস্ত রাস্তা, আঁখি তো আদ্রিশকে চোখে হারাত,অল্পক্ষণের দূরত্ব তার মনে বড্ড অভিমানের যোগান দিত।মনে পরল আদ্রিশের এমনই একদিনের ঘটনা।সেদিন আদ্রিশ কাজ থেকে তাড়াতাড়ি আসবে বললেও জরুরি কাজে পরে গিয়ে বাড়ি ফিরল দেরিতে,এদিকে তার অপেক্ষায় আঁখি অভিমানে ভরপুর হয়ে বসে রইল নিজের কক্ষে,আদ্রিশ বাড়ি ফিরে বুঝতে পারল তার ভালোবাসার কাঙাল, তার প্রেমে প্রমত্ত অঙ্গনার তার অপেক্ষায় মনে বেশ অভিমান জমেছে।তাই পিছন থেকে হাসিমুখে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল বেশ অধিকারত্ব নিয়ে,কানের লতিতে চুমু দিয়ে বলল।

″সরি সুইটহার্ট, আর কখনও দেরি হবে না।″

″আমি কারও সুইটহার্ট না,ছাড়ো আমায়, কাজে ছিলে কাজে যাও আমার কাছে আসলে কেন?আমি তো পা*গল সব কাজ কর্ম ফেলে এসে তোমার জন্য অপেক্ষা করি।″

″বললাম তো সরি,আর কখনও হবে না এমন,শেষবারের মতো ক্ষমা প্রার্থী তোমার প্রেমে এই ব্যাকুল হৃদয়।″

আঁখি অতি অভিমানে কিছুই বলছে না।

″কথা বলবে না আমার সাথে?″

″না″

″সত্যিই বলবে না?″

″না″

″শিওর তো তুমি?″

″শিওর″

″ঠিক আছে চলে যাচ্ছি, যতক্ষণ না ফিরার কথা বলবে ততক্ষণ আর ফিরব না″

অতঃপর আদ্রিশ চলে গেল তার এক বন্ধুর বাসায়,সে জানত তার আঁখি তার উপর পাহাড় সমান অভিমান করে থাকলেও তার দূরত্ব সইবে না,আর আঁখির সাথে এমন মজা করা যে তার প্রায় দিনেরই প্রিয়,তাই সেদিন লুকিয়ে গিয়েছিল,আধ ঘন্টার মধ্যেই আঁখির ফোন দেওয়া শুরু হলো আদ্রিশকে,আদ্রিশ মজা করে ওর ফোন ধরছিল না যার ফলস্বরূপ আঁখির মনের অস্থিরতা প্রবল বেগে বেড়ে কান্নায় পরিণত হয়েছিল,ভয়েস ম্যাসেজ করে কেঁদে কেঁদে বলছিল আদ্রিশকে ফিরে আসতে,তার কান্নার ধ্বনি উতলা করেছিল আদ্রিশের মন তখন,তাই ছুটে এসেছিল সেদিন তার হৃদহরণীর কাছে,আঁখি ঝাপটে ধরেছিল তাকে কাছে পেয়ে,বুকে লেপ্টে কান্না মিশ্রিত আধুরি স্বরে বলেছিল।

″কোথায় চলে গেছিলে?আর কখনও এভাবে গেলে কি করব জানি না।″

″আরে তুমিই তো বললে কথা বলবে না,আর তুমি কথা না বললে আমি কি করে থাকি বলো?″

″তাই বলে দূরে চলে যাবে?খবরদার আর যদি এমন করেছ তো,রাগ হোক বা অভিমান আমরা একে ওপরের সাথে থেকে মানিয়ে নিব কিন্তু কখনও দূরে যাব না।″

″কখনই যাব না,লাভ ইউ ফুলপরি।″

″লাভ ইউ মো*র আমার উকিল সাহেব।″

মেনে নিতে পারছে না আদ্রিশ,আঁখি তো কখনও ওকে ছাড়া থাকতে পারে না তবে আজ কেমনে চলে গেল!কেমনে থাকতে পারছে ওকে ছাড়া!

ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছিল আদ্রিশ হঠাৎ বাহির থেকে দ্রুত পাশে রিদিকাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখল।সোজা প্রশ্ন করল তাকে।

রিদিকা কোথায় গিয়েছিলে এতো সকাল সকাল।

ঘরে ঢুকার ক্ষণে আদ্রিশকে প্রথম খেয়াল করে নি রিদিকা,আদ্রিশের হঠাৎ প্রশ্নে বেশ হকচকিয়ে উঠল– কিছুটা থেমে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে জবাব দিলো।

ওই তো একটু হাঁটতে মন চাইছিল সকাল বেলা তাই হাঁটতে বেড়িয়ে ছিলাম,তুমি কখন উঠলে?টেবিলে বসো আমি নাস্তা দিই।

আদ্রিশ আর ওতো না ভেবে নাস্তার টেবিলের একটা চেয়ারে বসে পরল,একদৃষ্টিতে নাস্তার টেবিলের দিকেই তাকিয়ে ছিল,মনে চলছিল তখন আঁখির স্মৃতি,হঠাৎ কেউ সামনে এনে একটা পায়েশের বাটি রাখল,পায়েস দেখেই ঠোঁটে এক জলক হাসি টেনে আঁখি নামটা বলে উঠল,আশায় নয়ন ভরে হুটহাট চোখ তুলে তাকালে সামনে দাঁড়ানো উক্ত ব্যক্তিকে দেখে হাসিটা মলিন হল তার।মন টা যে এই সুন্দর সকাল বেলা আঁখির দর্শন করতে চাইছিল খুব করে,আঁখি প্রায় দিনই ব্রেকফাস্ট এ আদ্রিশের জন্য পায়েশ বানাত তাই আজকে আশাটা রাখা ভুল ছিল না আদ্রিশের,এক পলকের জন্য মনে হয়েছিল তার আঁখি ফিরে এসেছে।রিদিকা এবার হাসিমুখে বলল।

″পায়েশ বানিয়েছি খেয়ে নাও।″

″খাব না,কাজ আছে।″

আর না বসে টেবিল থেকে উঠে বাহিরের দিকে প্রস্থান করল আদ্রিশ,রিদিকা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পানে তাকালেও বাম হাতে পায়েশের বাটির গায়ে শক্ত করে ধরে রাখল যেন হাতের জো*রে বাটিটা এখনই ভেঙে দিবে।

নিজের জন্য নতুন জিনিসপত্র কালকেই কিনে নিয়ে এসেছিল আঁখি,একটাও শাড়ি কিনে নি,আদ্রিশ ওকে শাড়িতে দেখতে বেশি পছন্দ করত,নিজের কখনও মন না থাকলেও আদ্রিশের জন্যই রোজ শাড়ি পরার অভ্যেস গড়েছিল আঁখি,এখন সে অভ্যেসটাও ছেড়ে দেওয়ার দিন চলে এসেছে,আজ আর কাঁদে নি আঁখি,দুই দিনেই চোখের তলায় কালি পরেছে,মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে,ফর্সা মুখে ফ্যাকাশে ভাবটা কেমন জানি বেমানান লাগছে,তবে কেন তাকে বেমানান লাগবে?আদ্রিশ যখন নতুন বউকে নিয়ে খুশি থাকতে পারে তবে আঁখি কেন একাকিত্বে পারবে না,আবারও সিঙ্গেল জীবনের মজা নেওয়ার সুযোগ এসেছে এটা কি কম পাওনা,হাজারও দুঃখের মধ্যে একটা খুশি থাকার কারণ খুঁজে যদি সত্যি ভালো থাকা যায় তবে মন্দ কিসে।কথাটা ভেবে মুখে একটা প্রশান্তিময় হাসি ফোটালো,জিন্সের সাথে লং টপস পরে নিল,চোখে কাজল টানল,চুলগুলো ছেড়ে দিলো,কানে হালকা দু’টো দুল পরেছে,ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে পাতলা এক আবরণ তৈরি করেছে,সবশেষে এপ্রোন টা গায়ে দিলো,অনেকদিন পর পুরাতন ফর্মে ফিরে এসে আঁখি প্রাণবন্ত একটা হাসি দিলো আয়নায় নিজেকে দেখে।সাজটা অনেকাংশেই তার শরীর ও মনের ফ্যাকাশে ভাবটা যে ঢেকে দিয়েছে।খুশি মনে ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল আঁখি।

হঠাৎ আরিয়ান মির্জা আদৃতকে কল দিয়ে বসলেন,আদৃত ফোন উঠাল।

″আসসালামু আলাইকুম বাবা,কি করছ?

″আদৃত তোর মা হঠাৎ হার্ট এ্যা*টাক করেছে,আমি বুঝে উঠতে পারছি না কি করব!আমরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি,ও বার বার তোকে দেখতে চাইছে,প্লিজ বাবা তুই চলে আয় এবার।″

″কী….!মা এখন কেমন আছেন?″

″ডাক্তার এখনও কিছু জানাননি।″

″তুমি চিন্তা করো না বাবা আমি এখনই আসছি আর্জেন্ট ফ্লাইটে।″

″তুই জলদি আয় বাবা,রাখছি।″

ফোনটা কেটে দিয়ে বেশ গুমরো মুখ করে আরিয়ান মির্জা স্ত্রী শায়েলা মির্জার দিকে তাকিয়ে বললেন।

″এত বড় মিথ্যে না বলালে হত না?″

″তোমার মিথ্যে যদি আমার ছেলে আমার বুকে ফিরাতে সক্ষম হয় তবে এমন মিথ্যে আমি তোমায় রোজ বলাব।″

কথাটা বলে ফিক করে হেসে দিলেন শায়েলা মির্জা,আরিয়ার মির্জাও স্ত্রীর এমন কথায় মুচকি হাসলেন।

চলবে…….

আরোহী নুর……