প্রাণহন্ত্রী পর্ব-০৫

0
187

#প্রাণহন্ত্রী (৫)
এক মাস পর,
পরীক্ষা নিয়ে ভীষন ব্যস্ত দীপ্তি। স্কুলে স্যারদের কাছে বেশ প্রশংসায় রয়েছে। শত অবজ্ঞার পর দিন শেষে দীপ্তিই স্কুলের দীপ্তি হয়ে জ্বলে। ওর জন্য ই স্কুলের নাম হয়েছে। মুখিয়ে আছে পুরো ইউনিয়ন। দীপ্তির ইচ্ছে একটাই উপজেলা ভিত্তিক প্রথম হয়ে রুমানার স্বপ্ন পূরন করা। একজন পুলিশ অফিসার হয়ে মানুষ রূপী প/শুর বিরুদ্ধে লড়াই করা। রুমানা অসুস্থ বেশ। রুগ্ন দেহে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি অব্দি নেই। মায়ের কপালে চুমু খায় দীপ্তি। বলে ” আসছি আম্মা। আজ থেকে নতুন লড়াই গড়বো। ”

” সাবধানে যাস। রান্না করতে পেরেছিলি মা? ”

” হ্যাঁ আম্মা। তুমি চিন্তা করো না তো। ”

চলে যায় দীপ্তি। কাঁথার নিচে গুটি শুটি মেরে শুয়ে থাকে রুমানা। শরীরে বল নেই বললেই চলে।

মাঝ রাস্তায় এসে কিছু বখাটে লোকের দৃষ্টিতে পরতে হয় দীপ্তিকে। তীক্ষ্ম চোখে তাকায় মেয়েটি। যে চোখের দীপ্তিতে তুচ্ছ হয় সব। মাতব্বরের ডান হাত কালু বলে
” কি রে মাইয়া , আগের থন অনেক সুন্দর হইছোস দেহি। রূপ যৌবন বাড়ছে খুব। তা যাবি নি আমার লগে? ”

শরীরের প্রতিটি শিরা জেগে উঠে। কিছু বলে না দীপ্তি। শুধু এক দলা থু থু ফেলে এগিয়ে যায়। তাতেই যেন আগুনের ফুলকির মতো জেগে উঠে কালু। দীপ্তির পথে বাঁধা হয়। বলে ” তোর বাপে তো আমার সাথেই বিয়া ঠিক করছিলো। তর সৎ মা দিলো সব কিছু তে পানি ধাইলা। তা মাইয়া এতো তেজ কেন? আর কতো থাকবি এইভাবে। এহন তো যাওয়া দরকার। আরে টাকা দিমু তরে।আয় আমার লগে।”

” সাবধানে কথা বলুন। ”

” মাইয়া কয় কি। আমি আর সাবধানতা।আরে মাইয়া আয় আমার সাথে। দেখবি সব সুখ লাগবো।কত রঙিন সব। ”

দীপ্তির হাত ধরতেই জ্বলে উঠে দীপ্তি। নিজের শরীরে সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয় কালুকে। মাটিতে পরে ব্যথা পায় কালু। অকথ্য ভাষায় গা/লি গালাজ করে। কোনো কথা বলে না দীপ্তি। ছুটে আসে স্কুলের পথে।

ক্লাস করছিলো দীপ্তি। হঠাৎ করেই স্কুলের হেড মাস্টার এসে বলেন ” দীপ্তি তোমার সাথে মাতব্বর সাহেব দেখা করতে এসেছেন। ”

” আমার সাথে কেন দেখা করতে এসেছেন? ”

” সে তো জানি না। দ্রুত আসো। ”

ধীর পায়ে এগিয়ে যায় দীপ্তি। মাতব্বরের কাছে এসে বলে ” আসসালামু আলাইকুম ”

” ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি কালুকে আঘাত করেছো কেন? ”

” সে আমার সাথে অসভ্যতামু করেছে। ”

” মিথ্যে কথা কইতেছে মাতব্বর সাহেব। ”

কালুর দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় দীপ্তি। থতমত খায় কালু। মাতব্বর তাকিয়ে থাকে দীপ্তির দিকে। বলে
” আমার লোকের সাথে এমন করা উচিত হয় নি তোমার। ক্ষমা চাও। ”

” মাফ করবেন, ক্ষমা চাইবো না। কারণ কোনো অন্যায় করি নি আমি। ”

” দেখছেন মাতব্বর সাহেব। মাইয়ার চপা কতো , আপনার সাথে গলা উঁচিয়ে কথা কয়। ”

” আহহ কালু থাম তুই। দীপ্তি ক্ষমা চাও তুমি। ”

” কখনো না। ”

দীপ্তির কথায় রেগে যায় মাতব্বর। এমন বেয়াদব মেয়ে কখনো দেখেন নি তিনি!তৎক্ষনাৎ হেড মাস্টারকে ডাক পাঠান। হেড মাস্টারকে উদ্দেশ্যে করে বলেন ” এই মাইয়া টানা দশ দিন দাঁড়ায় দাঁড়ায় ক্লাস করবো। আর শোনো স্কুল থেকে যে অনুদান দেওয়া হতো সে অনুদান বন্ধ। ”

” মাতব্বর সাহেব!এ অন্যায়,আপনি এই অন্যায় করতে পারেন না। সরকার থেকে আমায় অনুদান প্রদান করা হয়। এর উপর আপনার জোর চলে না। ”

” দীপ্তি চুপ করো তুমি। ”

” কিন্তু স্যার। ”

” আহহ। ”

দু চোখ থেকে অশ্রু গড়ায় মেয়েটার। মাতব্বর চলে যায়। কালুর মুখে তাচ্ছিল্য। ব্যঙ্গ হাসে সে। সাথে বাজে দৃষ্টিতে অবলেকন করে ওকে। গা কেঁপে উঠে ওর। তীক্ষ্ম দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে। হেড মাস্টারের ভেতর থেকে আসে দীর্ঘশ্বাস। সামান্য বেতন ভুক্ত কর্মচারী সে। মাতব্বরের উপর কথা বলার সাহস কোথায় তাঁর?

.

সারা রাত নির্ঘুম কাঁটে দীপ্তির। শেষ রাতের দিকে চোখ লেগেছিলো তবে চারপাশের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। বাহির থেকে তুমুল ঝগড়ার আওয়াজ কানে আসে।রুগ্ন শরীরে উঠে দাঁড়ায় রুমানা। দীপ্তির ঘরে এসে বলে” ভয় পাস না আম্মা। আমি দেখছি কি হয়। ”

” তুমি একা যাইয়ো না আম্মা। আমারে নিয়া যাও।”

দীপ্তিকে সাথে নিয়েই যায় রুমানা। এখনো ভোরের আলো ফুটে নি। অদূরের মাঠে লম্বা মানুষের লাইন। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রুমানা। দীপ্তি বলে ” আম্মা আমি ও যাই ”

” না তুই থাক। আমি দেখে আসি। ”

” আম্মা তুমি অসুস্থ। তোমারে একা যাইতে দিমু না আমি। ”

” আহ দীপ্তি। ”

” আমার কথা শোনো আম্মা। ”

” দীপ্তি! ”

রুমানার ধমক খেয়ে দমে যায় দীপ্তি। ধীর পায়ে এগোয় রুমানা। ভীর ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ দুটো স্তব্ধ হয়ে যায়। কারন মাটিতে পরে আছে কালুর লা/শ। এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না সে। ছুটে যায় দীপ্তির কাছে।
” আম্মা কি হয়েছে , এভাবে টেনে নিয়ে যাচ্ছো কেন? ”

” কথা কইস না দীপ্তি। দ্রুত ঘরে চল। ”

পেছন ফিরে দীপ্তি। মানুষের হৈ হুল্লর এখনো বিদ্যমান। একে একে সকলে সাইট হয়ে যায়। কালুর গাঁয়ের শার্ট দেখতে পায় দীপ্তি। কয়েক মুহুর্তের জন্য চোখ দুটো স্থির হয়। পরক্ষণেই কেঁদে উঠে। বট গাছের ডালে র/ক্তের ছোপ ছোপ দাগ। ” আম্মা , র/ক্ত র/ক্ত। ”

” কোথায় র/ক্ত ? ”

” গাছে। ”

দীপ্তির কথা মতো গাছের দিকে তাকায় রুমানা। বট গাছের ডালে র/ক্ত দিয়ে হাতের থাবার ছাপ। ভয় পেয়ে যায় রুমানা।বুকের ভেতর চিন চিন ব্যাথা। দীপ্তির গা গুলিয়ে আসে। মাঠে দাঁড়িয়ে বমি করে। রুমানার দৃষ্টি এলোমেলো , চারপাশে চোখ বুলাতে থাকে।
.

পুকুর পাড়ে পা ভেজাচ্ছে দীপ্তি। সকালের ঘটনা এখনো মাথায় এঁটে আছে। কালুর মৃ/ত্যুতে যেন মেয়েটা পাথর হয়ে গেছে। অথচ ওর ই সব থেকে বেশি খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু খুশি হতে পারছে না। পাশের ঝোপঝাড় থেকে খচখচ শব্দ আসে। ভয়ে ছিটকে দূরে সরে যায় ওহ। চোখ দুটো বড় হয়ে আছে। শুকনো ঢোক গিলে ঝোঁপের দিকে এগোয়। সবুজ পাতা সরাতেই কিছু একটা প্রানী লাফিয়ে পরে ওর মুখে। চেঁচিয়ে উঠে দীপ্তি। চোখ বন্ধ করেই ছুট লাগায় ডোবা তে। পঁচা ডোবাতে ঝাঁপ দেওয়াতে পুরো শরীরে পানা লেগে যায়। গাঁ থেকে বোটকা গন্ধ আসে। দীপ্তি মাথা থেকে লাফিয়ে পরে ব্যাঙ। ভয় কাঁটে মেয়েটার। কিন্তু নিজের আচারনের জন্য দুঃখী হয়। ভয় যেন ওকে অতিরিক্ত জড়িয়ে নিয়েছে। কালুর মৃ/ত্যু টা ভয়ঙ্কর। চোখ দুটো খু/বলে নিয়েছে কেউ। জ্বিভের মাথা কাঁ/টা। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য মনে করতে পারে না দীপ্তি। মনে মনে শয়েক গা/লি দেয় নিজেকে। রুমানার থেকে লুকিয়ে কালুর লা/শ দেখতে গিয়েছিলো ওহ। দুপুরে বাড়ি ফিরেই অদ্ভুত অনুভব হয়। যেন কেউ ওর পিছু নিচ্ছে। সাধারন শব্দে ও চমকে যায়। পুকুর ঘাট থেকে হাত মুখ ধুয়ে নেয় ওহ। মাথায় এখনো ময়লা লেগে আছে। উঠানে প্রবেশ করতেই রুমানার মুখোমুখি হতে হয়।
” দুপুর থেকে কোথায় ছিলি দীপ্তি। ”

” পুকুর পাড়ে ছিলাম আম্মা। ”

” ভিজলি কি করে? শরীর থেকে পঁচা গন্ধ কেন আসছে, দেখি। ”

” পাশের ডোবাতে পরে গিয়েছিলাম। ”

কথাটা বলেই মাথা নিচু করে ফেলে দীপ্তি। রুমানার তীক্ষ্ম দৃষ্টি যেন কিছু আঁচ করতে পারে। তিনি বলেন
” কল পাড় থেকে পরিষ্কার হয়ে আয়। ভাত খাওয়া হয় নি। তোর প্রিয় শাক পাতার ঝোল করেছি। ”

” শাক পাতার ঝোল? ”

” হুম। ”

চোখ চকচক করে উঠে দীপ্তির। রুমানাকে পাশ কাঁটিয়ে ছুটে যায় কল পাড়ে। মৃদু হাসে রুমানা। শাক পাতার ঝোল বড্ড প্রিয় মেয়েটার। ভাতের থালায় ভাত নিয়ে মাখিয়ে নেয় রুমানা। জামা বদলিয়ে নেয় দীপ্তি। রুমানা বলেন” হা কর। ”

” কতো দিন পর খাইয়ে দিলে তুমি। ”

” সেদিন ও তো খাইয়ে দিলাম। ”

” সেটাই তো কতো ঘন্টা পর। ”

মেয়ের কথায় তৃপ্ত হয় রুমানা। চোখ দুটো বুজে আসে। ছলছল নয়নের ফাঁকে চোখ যায় দীপ্তির ডান হাতে। ঘাড়ের নিচের অংশ টুকু ছেঁড়া। ভাতের প্লেট রেখে সেখানে মনোযোগ দেয় রুমানা। দীপ্তি বলে ” এটা কিছুই নয়। ছিড়ে গেছে আর কি। ”

” আমাকে বলিস নি কেন? ”

” তুমি তো অসুস্থ। ”

” সে যাই হোক। তাই বলে বলবি না? খাবার খেয়ে আমার সেলাই দেখবি। হাতে হাতে শিখে রাখবি কাজে দিবে। ”

” আচ্ছা। ”

ভাতের লোকমা তুলেন রুমানা। দীপ্তি বলে ” তুমি তো খেলে না আম্মা। ”

” আমি পরে খাবো। এখন তুই হা কর তো।”

খটকা লাগে ওর। রুমানার কথা বিশ্বাস হয় না। তাই উঠে যায়। ” কোথায় যাচ্ছিস তুই? দীপ্তি আমার কথা শোন। ”

রুমানার কথায় পাত্তা দেয় না ওহ। চলে যায় রান্না ঘরে। ভাতের হাঁড়ি মেলে চোখ দুটো চিক চিক করে উঠে। এক মুঠো ভাত ও নেই তাঁতে। হৃদয়ে জ্বালা হয়। ভীষন জ্বালা। সৎ মা হয়ে কি করে পারে এমন টা করতে! নিজে না খেয়ে সৎ মেয়ের জন্য খাবার রাখা। পেছন থেকে রুমানার স্পর্শ পেতেই ঝমঝমে কেঁদে উঠে দীপ্তি। জড়িয়ে ধরে বলে ” তুমি কি মানু/ষ আম্মা?কি করে পারো এতোটা ভালোবাসতে। আমি এতোটা ভাগ্যবতী কেন আম্মা। এতো ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা আমার কি আছে?”

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ