প্রাণহন্ত্রী পর্ব-০৭

0
196

#প্রাণহন্ত্রী(৭)
গাঁয়ে শাল জড়িয়ে গ্রামের প্রধান সড়কে আসে এক রমনী। দু চোখে তীব্র বিতৃষ্ণা। পায়ের গতি যেন দৌড় সম। এমন অসাধারণ নারীর দিকে হাসি মুখে তাকানো কুশল। হাতে বেলি ফুলের মালা। কিছুটা এগিয়ে আসে সে। বলে ” মামুনি। ”

” কাজটা ঠিক করো নি তুমি। ”

” কোন কাজ? ”

” সমস্ত কাজ ই তোমার ভুল। এখনো পৃথিবী চিনো না তুমি। নিজের টগবগে মস্তিষ্ককে দমিয়ে রাখো। সেদিন দেখা করতে এসেছিলে তাই না? ”

” হুমম। তাই ভুল করে তলোয়ার ফেলে গিয়েছিলাম। আমি পারছি না নিজেকে দমাতে। ”

” কালু কে মা/রা উচিত হয় নি তোমার। কেন নিজ হাতে এভাবে খু/ন করছো। ”

” ক্ষমা করবে মামুনি। আমি জানি আমি কি করছি। পূর্ব পুরুষের র#ক্ত আমার মাঝে। এটা কোনো অন্যায় হতে পারে না। আমি নরপশু কে খু/ন করেছি। ”

” উফফ কুশল। প্রতিশোধের আগুনে তুমি পাগল হয়ে গেছো। ”

কোনো কথা বলে না কুশন। ছেলেটা কে বকা দিয়ে নিজে ও কষ্ট পায় রুমানা। কুশলের বাহু চেপে ধরে ঘন ঘন শ্বাস নেয়। বলে ” তুমি আমার আমানত বাবা। তোমাকে আমি হারাতে চাই না। ”

” আমি হারাবো না মামুনি। তুমি পাশে আছো আমার। সময় হয়েছে ধ্বংস করার। ”

” এটা সঠিক সময় নয়। এখন তো শুধু প্রথম পদক্ষেপ গ্রহন করেছি। ”

” কি পদক্ষেপ? ”

” জমিদারের রঙমহল পুরিয়ে দেওয়া ব্যবস্থা করেছি আমি। ”

” মামুনি! তুমি জমিদার মহলে গিয়েছিলে? ”

মাথা ঝাঁকায় রুমানা। কুশলের দৃষ্টিতে চিন্তা। রুমানার হাত ধরে বলে” সে যদি জেনে যায় তুমি ই সে। ”

” জানবে না। আমার মুখ ঢাকা ছিলো। ”

তবু ও যেন চিন্তা মুক্ত হয় না কুশল। রুমানার দিকে বেলি ফুলের মালা এগিয়ে দেয়। বলে ” বাগানের স্বচ্ছ ফুল। ”

বেলি ফুল গুলোকে স্পর্শ করে রুমানা। চোখ দুটো ছলছল করে তাঁর। নিজের হাতে করা বেলি গাছের বেলি ফুল। রুমানার হাত দুটো মুঠো বন্দী করে কুশল। ঝাপসা চোখে বলে “পরবর্তী সুযোগটা হারাতে চাই না আমি।”

” অপেক্ষা করো কুশল। সময়ের অপেক্ষা। সামনের পূর্নিমাই হবে জমিদারের শেষ রাত। ”

মৃদু হাসে কুশল। ছেলেটার চোখে মুখে হাত বুলিয়ে দেয় রুমানা। কিছু দূর থেকে চাঁপা স্বর কানে আসে। সর্তক হয়ে যায় দুজনেই। মন্টুর অবয়ব চিনতে অসুবিধা হয় না রুমানার। সে বুঝতে পারে না এই গভীর রাতে মন্টু কোথায় যাচ্ছে। কুশল আর রুমানা মন্টুর পিছু নেয়। প্রথমে ভেবে ছিলো মন্টু হয়তো বোনের বাসাতে যাচ্ছে। কিন্তু নাহ, রুমানার ঘরের দিকে আগাচ্ছে। বুকের ভেতর হু হু করে উঠে রুমানার। একা মেয়েকে ফেলে যাওয়া উচিত হয় নি।

রুমানা বলে
” তুমি বাইরেই থাকো কুশল। আমি ঘরে যাচ্ছি , মেয়েটা জেগে গেল নাকি তা ও জানি না। ”

” কিন্তু মামুনি। ”

” আমি আবার আসবো। ”

বাড়ির পেছনের জঙ্গলে চলে যায় কুশল। ঘরে প্রবেশ করে রুমানা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দীপ্তি। হবেই না কেন? ঘুমের ঔষধ দিয়েছেন কি না। তবু ও ভয় কাজ করে। আজ যদি মন্টু ঘরে প্রবেশের চিন্তা করে তবে ক’ল্লা যাবে নিশ্চিত।

ঘরের দরজার কাছে ছুঁ/ড়ি নিয়ে বসে থাকে রুমানা। যেই ভাবা সেই কাজ। মন্টু ঘরে প্রবেশের চেষ্টা চালায়। দীপ্তির কথা মনে হতেই পিছিয়ে যায় রুমানা। ঘর থেকে বেরিয়ে যায় রান্না ঘরের দিকে। মন্টু কিছু একটা বুঝতে পারে। বহু দিন ধরে রুমানার প্রতি বাজে দৃষ্টি তাঁর। রান্না ঘরের দিকে আগাতেই পেছন থেকে ছুঁ/ড়ি মে/রে দেয় রুমানা। চোখে মুখে ছিটে আসে র/ক্ত। মন্টুর মুখ থেকে গোঙানির আওয়াজ আসে। পা দিয়ে পিষে ধরে মন্টুর মুখ। মিনিট খানেক পর মন্টু থেমে যায়। অর্থাৎ ম/রে গেছে। তৃপ্ত হাসেনরুমানা। এমন জানো/য়ারদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।

ব্যস্ত পায়ে ছুটে আসে কুশল। চাঁপা কন্ঠে বলে” মামুনি! এটা কি করলে?”

” একে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করো কুশল। ”

” কিন্তু। ”

” দামিনী আমি। আর তুমি আমার আমানত। আমি থাকতে তোমার হাত নোংরা করতে দিবো না আর। ”

কথা বাড়ায় না কুশল। মন্টুকে টেনে নিয়ে যায় ডোবার ধারে। ডোবাতে স্রোত প্রচুর। তাছাড়া ময়লা আবর্জনার স্তূপ এখানে। আগামী সাত দিনে ও কেউ খুঁজে পাবে না মন্টুকে।

মন্টুকে ফেলে দেয় কুশল। উঠানে এসে দেখে সমস্ত র/ক্তের চিহ্ন মুছে ফেলেছেন রুমানা। কুশলের দিকে তাকিয়ে বলে ” ভয় পেও না কুশল। এটা আমার প্রথম খু/ন নয়। এর আগে ও আমি দুটো খু/ন করেছি। ”

” সেটার জন্য অনুমতি ছিলো মামুনি। মহল কে রক্ষা করা প্রতিটা সদস্যের দায়িত্ব ছিলো। কিন্তু এবার ”

” ভুলে যাও এসব। ”

কথা বলে না দুজনের কেউ ই। হাত মুখ ধুয়ে নেয়। পর পর কয়েক বার মুখে পানির ঝাপটা দেয় কুশল। রুমানা কে যতো দেখে ততোই অবাক হয় ছেলেটা। একমাত্র জমিদার আনন্দ কে ভয় পান রুমানা। সেই নিকৃষ্টতম জা/নোয়ারের আচারন এতো টাই মারাত্মক যে এখনো গাঁয়ে কাঁটা দেয়।
.

মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙে দীপ্তির। সন্ধ্যা বেলায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পরেছিলো সে। রুমানা কে নামাজ শেষ করতে দেখে উঠে পরে। অযু করে নিজে ও নামাজ আদায় করে। আজকাল বড্ড ঘুম পাচ্ছে তাঁর। সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পরে। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। রুমানা রান্না ঘরে চলে যান। হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসে দীপ্তি।
আধ ঘন্টা পর খাবার নিয়ে আসেন রুমানা। দীপ্তির পাশে বসে বলে ” খাবার খেয়ে পড়তে বোস। খালি পেটে পড়া হয় না। ”

” অনেক পড়া বাকি আম্মা। কয়েক দিন যাবত শুধু শুধু ঘুমিয়ে যাই। ”

” কিছু হবে না। খেয়ে পড়তে বস। ”

খাবার মুখে তুলে আবারো পড়ায় মনোনিবেশ করে দীপ্তি। হঠাৎ করেই সেই পুরুষের কথা মাথায় আসে। সুদর্শন পুরুষের দুই চোখ যেন হৃদয়ে দাগ কেঁটে নিয়েছে। রুমানার ডাকে ঘোর কাঁটে ওর। বলে
” হুমম খাচ্ছি। ”

উঠানে এসে চেঁচিয়ে ডাকে পিয়ন। সাইকেল এর হর্ন কানে আসতেই ছুটে যায় দীপ্তি। বলে ” কিসের চিঠি এসেছে চাচা? ”

” মিনতি ম্যাডাম এর বাসা থেকে চিঠি এসেছে। ”

” ম্যাডাম এর বাসা থেকে চিঠি? ”

চোখ চকচক করে উঠে দীপ্তির। ঘোমটা টেনে এগিয়ে আসেন রুমানা। দীপ্তির মুখোমুখি হয়ে বলেন ” কে পাঠালো চিঠি? ”

” মিনতি ম্যাডাম এর বাসা থেকে। ”

চিঠি মেলে দীপ্তি। পুরো চিঠিটা পরে যেন সে স্তব্ধ হয়ে যায়। দু চোখে কার্নিশে জমে যায় পানি। কেঁদে উঠে মেয়েটা। হঠাৎ করেই দীপ্তির কান্নার কারন বুঝতে পারে না রুমানা। ব্যগ্র হয়ে বলে ” কি হয়েছে? ”

” মিনতি ম্যাডাম আর নেই আম্মা। ওনার সাথে সাথে তোমার দেওয়া স্বপ্ন ও শেষ হয়ে গেল। এখন তো স্কুল থেকে অনুদান ও দিচ্ছে না আমায়। আমি কি করে তোমার স্বপ্ন পূরন করবো আম্মা? ”

মাটি হাতরে কান্না করে দীপ্তি। যেন সমস্ত সুখের মাঝে দুঃখ গুলোই গলায় এসে গেছে। রুমানার হাত ধরে ক্রন্দনরত অবস্থা তেই বলে ” আমি তোমার স্বপ্ন পূরন করতে পারলাম না আম্মা। আমি বড় অফিসার হতে পারলাম না আর। ”

” শান্ত হ আম্মা। কিচ্ছু হয় নি। আমি তোকে পড়াবো। তোকে অনেক বড় অফিসার বানাবো। ”

” এতো টাকা পাবে কোথায় আম্মা। ”

উত্তর করতে পারে না রুমানা। হু হু করে উঠে তাঁর মন। দীপ্তির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখ বন্ধ করে।

সন্ধ্যা বেলায় কুশল এসে হাজির। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরেছে দীপ্তি। সারা দিন আজ কান্না করেছে। রুমানা বলে ” শেষ মেশ আমি হেরে গেলাম কুশল। ভেবেছিলাম মেয়েটাকে নিজের সামর্থ্য দিয়ে অফিসার করে তুলবো। গড়ে তুলবো শক্ত ভাবে। পারলাম না আমি , ওর জন্য যে সুযোগ ছিলো সেটা ও শেষ হয়ে গেল। ”

” চিন্তা করছো কেন মামুনি। আমি তো অনেক আগেই বলেছি, দীপ্তির পড়াশোনার খরচ আমি দেই। কিন্তু তুমি কোনো কথাই শুনলে না। ”

” হেরে গেলাম আমি। ”

” ছেলের উপর ভরসা রাখো মামুনি। আমি যদি হই তোমার আমানত তবে তোমার প্রতি ও তো আমার কর্তব্য আছে। কি আছে না?”

কথা বলেন না রুমানা। এবার আর উপায় নেই। কুশলের থেকে সাহায্য গ্রহন করতেই হবে।

রজনী দীর্ঘ হয়। সাথে গাঢ় হয় দীর্ঘশ্বাস। রুমানার মন কাঁদে, নিজের স্বপ্ন গুলো দীপ্তির মাঝে দেখেছে সে। দীপ্তি কে গড়ে তোলার স্বপ্নেই তো কাঁটালো প্রায় দুটো বছর।

দীপ্তির পাশে বসে আছে কুশল। মেয়েটার নাম শুনেছে বহুবার তবে দেখে নি কখনো। অবশ্য কখনো আগ্রহ ও হয় নি। পরিকল্পনা ছিলো একটাই। জমিদার আনন্দ পাঠান কে শেষ করে দেওয়া। প্রতিশোধের আগুনেই তো বেড়ে উঠেছে ছেলেটা। গুনে গুনে তেইশ বছরে পা দিলো আজ। গরম গরম পিঠে নিয়ে হাজির হয় রুমানা। কুশলের দিকে বাড়িয়ে বলে
“এর থেকে বেশি আয়োজন করতে পারলাম না তোমার জন্য। সকালের খবর টা পুরো দিন টাকেই মাটি করে দিয়েছে। ”

” তোমার মেয়ে উঠে যাবে মামুনি। ”

“ঔষধ দিয়ে অজ্ঞান করে রেখেছি। ”

” সামনে তো ওর পরীক্ষা। ”

” হুমম। ভাবছি পরীক্ষার পর পুরো সত্যি টা জানাবো ওকে। প্রচন্ড ভীতু প্রকৃতির। তবে জানিস কি হয়েছে। একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে কে ধরে নিয়ে এসেছিলো মন্টু। সেটা দেখতে পেয়ে ওর মাথা ফাঁ/টিয়ে দিয়েছে।”

” সেকি কথা। তাহলে ভীতু কি করে হলো?”

” ভীতু ই বটে। আসলে আমি তো কখনো মায়ের মতো ভালোবাসি নি ওকে। কিংবা ওর আব্বার আদর টুকু ও পায় নি। যেদিন ওর আব্বা ওর বিয়ে ঠিক করলো সেদিন যেন আমি ওর মাঝে আমাকে দেখতে পেয়েছিলাম। যদি ও আমাদের পেক্ষাপট ভিন্ন তবে খুব মায়া ধরে ছিলো। তাই তো সমস্ত কিছু ভুলে ওকে নিজের করে নিয়েছি। যদি ও এটা কিছুটা স্বার্থপরতাই বটে। তবে সত্যি ই আমি ওকে ভালোবাসি।”

রুমানার কথায় হাসে কুশল। পিঠে মুখে দিয়ে বলে
” তোমার হাতের রান্না বরাবর ই ভালো। আর পিঠে তো লা জাবাব। ”

” কৃতার্থ হলাম জনাব। ”

দুজনেই হেসে উঠে। রুমানার সাথে খোশগল্প করে কুশল। সাথে আড় চোখে তাকায় দীপ্তির দিকে। কেন যেন প্রচন্ড আকর্ষন পাচ্ছে। এই আকর্ষন কে কি নামে ডাকবে কুশল?

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ