প্রাণেশ্বর পর্ব-০২

0
203

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২।

বাইরে হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। আজ সকালেই তো কাঠফাটা রোদ্দুর ছিল। আর রাত হতেই এমন বৃষ্টি যেন কারোর কাম্য নয়। বৃষ্টির সাথে সমান বেগে বইছে বাতাসও। বাতাসের দাপটে বারান্দার পর্দা খুলে আসবে বোধ হয়। দক্ষিণের জানলাটা ধরাস ধরাস শব্দ করে বারি খাচ্ছে। তনুকা বীতঃস্পৃহ। আর এইসব শব্দে আরো বেশি বিরক্ত সে। তার পাশে বসে থাকা নির্লিপ্ত মানুষটা এবার উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বন্ধ করল, বারান্দার দরজা আর জানলাটা। ফের এসে বসল তনুকার অতি নিকটে। তনুকা দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শক্ত করে বলল,

‘আমার বাবা নিশ্চয়ই কিছু জানতেন না, জানলে এমন বিবাহিত এক লোকের গলায় কখনোই আমাকে ঝুলিয়ে দিতেন না। আপনি আমাকে আর আমার বাবাকে ঠকিয়েছেন। আপনার পুরো পরিবার আমাদের ঠকিয়েছে। এমন একটা ঠকবাজ মানুষের সাথে আমি কখনোই সংসার করব না।’

‘আহা বিবিজান, তুমি না বড্ড বেশি কথা কও। এত কথা না কইয়া এহন শুইয়া পড়ো তো। কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হইব।’

বলেই লোকটি অপর পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তনুকা হতভম্ব। লোকটির ব্যবহার অদ্ভুত। কেমন রহস্যময়। এত বড়ো একটা ঘটনা কী নির্দ্বিধায় লুকিয়ে বিয়ে অবধি করে ফেললেন। তনুকা মাথা চাপড়ে বসল। তার সুন্দর গোছানো জীবনটা এমন ভাবে উলোট পালোট হয়ে যাবে সে কখনো ভাবেনি। বর্তমানে এই মানুষটাকে বড্ড কুৎসিত লাগছে তার কাছে। চার চারটা বিয়ে করলেন, শুধুমাত্র বউ মরে যায় বলে। আর আশ্চর্য, উনার এতগুলো বউ মরল কী করে? এতসব চিন্তায় এবার মাথাব্যথা শুরু হয় তার। চোখ বোজে নিশ্বাস ছাড়ে। কাল সকালেই তার শাশুড়ির সাথে কথা বলতে হবে। তাঁদের অবশ্যই এর জবাবদিহিতা দিতে হবে, কেন তাকে আর তার বাবাকে ঠকানো হয়েছে।

তনুকা শোয়ার প্রস্তুতি নিয়ে পাশ ফিরে চাইল। দেখল, লোকটার ওপাশে এত জায়গা রেখে তার দিকে চেপে শুয়েছে। মাত্রাধিক বিরক্তিতে কপাল কুঁচকাল সে। বলল,

‘এই যে শুনছেন, আরো ওপাশে যান। যেই পরিমাণ ফাঁকা রেখেছেন, ঐদিকে তো আরেকজন শুতে পারবে।’

সাড়াশব্দ নেই কোনো। তাই ফের সে ডাকল,

‘শুনছেন আপনি? শুতে শুতেই ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?’

লোকটি নড়ল। মাথা ঘুরিয়ে আবার শু’লো অন্যপাশে। এরপর বলল,

‘আমার একখান সুন্দর নাম আছে, বিবি। আগে নাম ধইরা ডাকো, তারপর জবাব দিমু।’

তনুকা নাক মুখ কুঁচকাল। কয়েক পল ভেবেও লোকটার নাম সে মনে করতে পারল না। কিন্তু এইটুকু মনে আছে, “ম” দিয়েই একটা নাম ছিল। অনেকক্ষণ ভাবল সে। হঠাৎ মনে পড়ল। মেহতাব, মেহতাব মজুমদার। সে অপ্রসন্ন সুরে বলল,

‘শুনুন মেহতাব মজুমদার, আমার সাথে নাটক করা বন্ধ করে নিজের জায়গায় যান। আমি এইটুকু জায়গাতে শুতে পারব না।’

মেহতাব মাথা উঁচু করে চাইল তার দিকে। অদ্ভুত সম্মোহনী এক জোড়া চোখ দেখে খানিকটা ভড়কাল তনুকা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে কড়া সুরে বলল,

‘এভাবে তাকিয়ে না থেকে যা বলেছি তাই করুন। আমার জায়গা ছেড়ে আরো ঐদিকে চেপে শু’ন।’

মেহতাব মাথা বালিশে রেখে হাসল। চিৎ হয়ে শুয়ে দু’দিকে দু হাত মেলে দিয়ে আমোদ গলায় বলল,

‘এই প্রশস্ত বক্ষ শুধুমাত্র তোমার জন্য, বিবিজান? তোমার কি আরো জায়গা লাগবে?’

লোকটা এবার শুদ্ধ বলছে। তনুকা নিঃস্পৃহ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। লোকটার ভাবভঙ্গি তার সহজ মস্তিষ্কে শক্ত এক প্রভাব ফেলছে। সে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘শুদ্ধ জানলে এমন অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন কেন?’

‘আমার ইচ্ছা।’

তনুকা আর কথা বাড়াল না। যতটুকু বুঝল, লোকটা মাত্রাতিরিক্ত ত্যাড়া। এর সাথে কথা বলে সে পারবে না। শুয়ে পড়ল সে। মাঝখানে রাখল একটা কোলবালিশ। তবে কিছুক্ষণ পরই সে খেয়াল করল, তার পাশের সেই কোলবালিশটা আর নেই। সেটা অতি অযত্নে পড়ে আছে মেঝের এক কোণে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই সে তার কোমরের উপর আবিষ্কার করে একখানা শক্ত পোক্ত হাতের স্পর্শ। পেছনে না ঘুরলেও টের পেল, মানুষটা তার অতি নিকটে। ঘাড়ের উপর উপছে পড়া তপ্ত শ্বাস তারই জানান দিচ্ছে। তনুকা হাতখানা সরিয়ে দিতে যায়। কিন্তু সেটা আরো দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে তাকে। তনুকা ক্রোধ নিয়ে বলে উঠে,

‘কী সমস্যা আপনার? বিয়ে হয়েছে বলে যা খুশি করবেন?’

মেহতাব ঘুম জড়ানো সুরে বলে,

‘এই রাতের জন্য কত অপেক্ষা করেছি, তোমার কোনো ধারণা নেই বিবিজান। শুধুমাত্র তোমার কথা রাখতে তোমাকে সময় দিয়েছে কিন্তু, দূরে যাওয়ার অনুমতি দেইনি; আর কখনো দিবও না। তাই অযথা আমার মাথা গরম না করে ঘুমি পড়ো। আমার কথা শুনলে তোমারই মঙ্গল।’

কেমন এক শিহরণ দিল তনুকার পুরো অঙ্গ জুড়ে। লোকটার কথাবার্তা অতিশয় বিস্ময়কর। এক কথার সাথে অন্য কথার মিল নেই। তনুকা কিছু মেলাতে পারছে না। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে তাও ঠাহর করতে পারছে না। কেবল মনে হচ্ছে, তার পাশে শায়িত মানুষটা এক আস্ত রহস্যের খোরাক। যাকে এক রাতে কোনোভাবেই সে বুঝতে পারবে না।

_________

দরজায় ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ছুটে তনুকার। চোখ কচলে উঠে বসে। পাশ ফিরে দেখে, মেহতাব নেই। শাড়িটা ঠিক করে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়। তারপর আস্তে ধীরে গিয়ে দরজা খুলে। দরজা মেলতেই প্রস্ফুটিত হয়, একটা সুন্দর, চঞ্চল, হাসিমাখা মুখ। তা দেখে সহসাই তনুকার ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে। ষোড়শী মেয়েটি তার বেণী দুলাতে দুলাতে বলে,

‘বউমনি, শুভ সকাল। আম্মা বলেছেন, মুখ হাত ধুয়ে নাস্তা খেতে আসার জন্য।’

তনুকা মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘আচ্ছা, আসছি।’

মেয়েটি চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তনুকা জিজ্ঞেস করে,

‘তোমার ভাই কোথায়?’

মেয়েটি ফিরে তাকায়। জবাবে বলে,

‘ভাইজান তো বিচার মহলে।’

‘বিচার মহল?’

ঠিক বুঝল না তনুকা। মেয়েটা হেয়ালির সুরে বলে উঠল,

‘যেখানে ভাইজান মানুষের গর্দান নেন।’

তনুকা ঘাবড়ে যায়। তার ভয়ার্ত চোখ মুখ দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে মেয়েটি। হাসতে হাসতে বলে,

‘মজা করছিলাম, বউমনি। ভাইজান সেখানে বিচার করেন। আব্বাজান অসুস্থ বলে এখন সব দায়িত্ব ভাইজানের।’

তনুকা আর কথা বাড়াল না। বলল,

‘আচ্ছা, তুমি যাও আমি আসছি।’

মেয়েটি হেলতে দুলতে চলে গেল। দরজা আটকে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল তনুকা। একপলক উঁকি দিয়ে বারান্দার দিকে তাকাল। বাইরে ভীষণ রোদ। রাতের এমন একটা বৃষ্টির পর আকাশ জুড়ে এহেন জমকালো রোদ চোখে লাগছে যেন। আয়নায় নিজেকে খুব নিঁখুত ভাবে পরখ করে তনুকা। হঠাৎ খেয়াল করে, গলায় একটা অপরিচিত বস্তু। তনুকা ভ্রু কুঁচকে জিনিসটাকে ভালো মতো দেখে। এই চেইনটা কবে তার গলায় এল? এমন কিছু তো কাল রাত অবধি তার গলায় ছিল না। তার মানে কি ঐ ভদ্রলোক, মানে মেহতাব তাকে এটা পরিয়েছে? তনুকা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেইনটার দিকে তাকিয়ে থাকে। চেইনের নিচে একটা লাভ সেইপের লকেট ঝুলছে। সেটা হাতে নিয়ে একটু দেখতেই সে খেয়াল করল, এটা খোলা যায়। আরেকদফা অবাক হয়ে সেটা খুলে সে। ভেতরে ছোট ছোট দুইটা বাচ্চার ছবি। একটা বাচ্চাকে সে চিনে। এটা তারই ছোটবেলার ছবি। কিন্তু পাশের জন কে? দেখে মনে হচ্ছে একটা ছেলে। কে এটা? মেহতাব? তনুকার চিন্তার মাত্রা আরো গভীর হয়। মেহতাবের কাছে তার ছোটবেলার ছবি এল কী করে? বিরাট এক প্রশ্নে মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সে জানে, এর উত্তর কেবল ঐ মেহতাব মজুমদারের কাছেই আছে।

তনুকা তাই আর দেরি করল না। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রুম ছাড়ল। বসার ঘরে যাওয়ার আগে মাথায় টানল বিরাট এক ঘোমটা। কাল থেকে আসা অবধি দেখেছে, এই বাড়ির মেয়েদের মাথা থেকে কাপড় পড়ে না। ছোট্ট রেনু বাদে প্রত্যেক মেয়ে বউয়ের মাথায়’ই ঘোমটা টানা। তনুকাও তাই সেই প্রথা মেনে, নিজের মাথা ঘুরল। বসার ঘরের দোর অবধি এসে দাঁড়াল সে। এই বাড়ির কাউকেই সে তেমন চেনে না। এক দেখাতেই বিয়ে, চেনা জানার সুযোগও হয়ে ওঠেনি। শাশুড়ি আর ননদের মুখটা মুখস্থ তার। বাকি কাউকেই চিনতে পারছে না। তনুকাকে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় রেনু খেয়াল করে। ছুটে আসে সে। তনুকার এক হাত আগলে ধরে বলে,

‘বউমনি, দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো না।’

তনুকা রেনুর সাথে সাথে হেঁটে সেই কক্ষে পদার্পণ করল। বাড়ির বউরা আপ্লুত চোখে দেখল তাকে। তনুকা সুন্দর, তাকে দেখলে চোখ ফেরানোর জো নেই। বাড়ির কর্তী ঠোঁটের কোণে চমৎকার এক হাসি ঝুলিয়ে সেখানে হাজির হলেন। তনুকা
চিনল তাঁকে দেখে। উনিই তার শাশুড়ি মা। সে এগিয়ে গিয়ে সালাম করল। আম্বিরা বেগম দুহাতে আগলে নিলেন তাকে, কপালে চুমু খেলেন। বললেন,

‘বেঁচে থাকো, মা।’

তনুকা স্মিত হাসল। তিনি তাঁর হাত হতে এক জোড়া বালা খুলে সহসা তা পরিয়ে দিলেন তনুকার হাতে। কাল থেকে এখন অবধি অনেক গহনা পেয়েছে তনুকা। যেই দেখতে আসছে, কিছু না কিছু দিচ্ছি তাকে। এসব গয়না-গাটি খুব একটা পছন্দ না তার। তাও এখন হাসি মুখে গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। তনুকা পূর্বের ন্যায় এটাও গ্রহণ করল। এরপর শাশুড়ির মুখপানে চেয়ে ম্লান হেসে বলল,

‘আমার আপনার সাথে একটু কথা আছে, মা।’

তিনি তনুকার গালে হাত ঠেকালেন। কোমল স্বরে বললেন,

‘হ্যাঁ বলো মা, কী বলবে।’

তনুকা এক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে প্রশ্ন করল,

‘আপনারা আমাকে কেন ঠকালেন?’

চলবে….