প্রাণেশ্বর পর্ব-৪+৫

0
212

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪।

মেহতাবের হুংকারে বিচারমহল যেন কেঁপে ওঠে। বাড়ির বাকি দুই কর্তাও এখানে। তাঁরাও যেন সিঁটিয়ে আছেন ভয়ে। ইশফাক বিলম্ব করল না। মেহতাবের সবথেকে ধারাল তলোয়ারটা এনে এগিয়ে দিল তার দিকে। মেহতাব হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করল সেটা। তার নিগূঢ়, কঠিন দৃষ্টি এখনও তনুকার উপরেই নিবদ্ধ। তনুকা নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে কেবল। কালকের রাতের সেই মেহতাবের সাথে এই মেহতাবের মিল পাচ্ছে না সে। দুজন যেন দুই ভিন্ন সত্তা।

হাতে ধারাল তলোয়ার আকড়ে ধরে সেই অপরাধী লোকটির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াল মেহতাব। অপরাধী অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার পায়ের কাছে। ক্ষমা চাইল অনেক। কিন্তু, কঠিন হৃদয়ের মেহতাবের মন গলল না। সে ততক্ষণাৎ তার ধারাল তলোয়ার দিয়ে চির বসাল সেই অপরাধীর পিঠে। সঙ্গে সঙ্গেই গগনবিদারি চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। উপস্থিত জনতা এসবে অভ্যস্ত। তাই তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। তবে তনুকার শরীর ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে ওঠল। লোকটার একেকটা চিৎকারে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে তার। দোরের বাইরে রেনু দু হাতে কান চেপে দাঁড়িয়ে আছে। তনুকা নিষ্পলক চেয়ে মেহতাবকে দেখছে কেবল। মেহতাব স্বাভাবিক, অত্যন্ত নির্লিপ্ত তার ভাবমূর্তি; যেন কিছুই হয়নি। অথচ মাটিতে পড়া লোকটি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। মেহতাব তলোয়ারটি ইশফাকের হাতে তুলে দেয়। আদেশের সুরে বলে উঠে,

‘তাকে এখন ভেতরে নিয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখবে। আমার বিবিজান তাকে অন্যভাবে শাস্তি দিতে বলেছেন, তাই ওর দম যতক্ষণ না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত ওকে ওভাবেই ঝুলিয়ে রাখবে। আর পিঠের আঘাতে লবণ মরিচ দিতে ভুলো না, তাহলে মৃত্যু’টা একটু তাড়াতাড়ি আসবে।’

তনুকার মাথা ঝিমঝিম করছে। তরতর করে ঘামছে সে। এই লোকটা মানুষ না অন্যকিছু? সে জায়গায় স্থির থাকতে পারছে না। ঢুলছে শুধু। মেহতাব একপলক তনুকাকে পরখ করে নিয়ে গলা উঁচিয়ে ঘোষণা দেয়,

‘বিচার কার্য আজ এখানেই শেষ। আপনারা আসতে পারেন।’

সবাই জায়গা ছেড়ে যার যার গন্তব্যের দিকে ছুটল। বাড়ির দুই কর্তা তখন এগিয়ে এলেন। মেহতাবের মেঝো কাকা চিন্তিত সুরে বলে উঠলেন,

‘মা, তুমি এখানে কেন এসেছ?’

তনুকা ভীত চোখে তাকায়। এই সবগুলো মানুষকেই এখন তার ভয় করছে। মেঝো কাকা ফের প্রশ্ন করেন,

‘তোমাকে কেউ এই বাড়ির নিয়ম কানুনগুলো বলেনি। এই রেনু কই? ও তোমাকে কিছু বলেনি।’

এমনিতেই ভয়ে বেচারি রেনুর মরমর অবস্থা, এখন আবার কাকার ক্রোধে আরো বেশি কুন্ঠিত সে। মেহতাব এগিয়ে এল। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ধীর আওয়াজে বলল,

‘আপনারা যান, কাকা। আমি তনুকে নিয়ে আসছি।’

মেহতাবের মেঝো কাকা, রমেজ মজুমদার বিধ্বস্ত চোখে চেয়ে রইলেন এক পল। ছেলেটাকে চেনেন তিনি। তাই ঠিক ভরসা করতে পারলেন না। বললেন,

‘নতুন এসেছে তাই অত কিছু বোঝেনি। তুমি আর কিছু বলো না।’

মাথা নাড়িয়ে মেহতাব বলল,

‘কিছু বলব না, আপনারা নিশ্চিন্তে অন্দরে যান। আর যাওয়ার সময় বাইরে থেকে রেনুকেও নিয়ে যাবেন।’

সবাই চলে গেল। একা দাঁড়িয়ে রইল কেবল তনুকা। মেহতাব এগিয়ে এল তার দিকে। তনুকার নাকের ডগায় প্রস্ফুটিত বিন্দু বিন্দু ঘামের কণাগুলো বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে মুছে দিয়ে শুধাল,

‘ভয় পাচ্ছো?’

তনুকা ঢোক গিলল। এরপর মাথা নাড়াল। মানে, ভয় পাচ্ছে না সে। মেহতাব হাসল। শ্যামবর্ণ পুরুষের এই হাসি অতিশয় চমৎকার ঠেকল তার নিকট। মেহতাব তার দিকে ঝুঁকে এসে বলল,

‘সাহস ভালো, তবে অতিরিক্ত সাহস ভালো না। চলো, একটু ঘাটের কাছে গিয়ে বসি।’

দুদিন ধরে আকাশটা যেমন থেকে থেকে আচমকা রং পাল্টাচ্ছে, ঠিক তেমনি এখন মেহতাবও রং পাল্টাচ্ছে। কয়েক ক্ষণ পূর্বের সেই ভয়ংকর মেহতাব মজুমদার এখন পাল্টে গিয়ে হয়ে পড়েছেন নিত্যান্তই এক রসিক পুরুষ। ঠোঁটের কোণে লেপ্টে থাকা ঐ হাসি দেখলে কেউ জীবনেও ঠাহর করতে পারবে না, এই মানুষটা যে এত ভয়ংকর।

তনুকার নীরবতা দেখে মেহতাব ফের প্রশ্ন করল,

‘ঘাটে যাইবা, বিবিজান?’

তনুকা কেবল মাথা কাঁত করে সম্মতি জানাল। হাসল মেহতাব।মেয়েটা যতই বলুক, ভয় পাচ্ছে না; চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে ভয়ে ঠিক কতটা সংকুচিত সে।

বিচারমহলের পাশেই এক বিশাল পদ্ম ঝিল। দুধারে ঘাট বাঁধানো তার। ঝিলের চারিধারে আবার সারি সারি নারকেল গাছ। পানি পরিষ্কার। জায়গাটাও বেশ পরিপাটি। বিকেলে বসে চায়ের আড্ডা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত এক জায়গা।
তনুকাকে নিয়ে মেহতাব ঝিলের পানিতে পা ভিজিয়ে বসল। ঝিলে এখন খুব একটা পদ্ম নেই। যেই কয়টা আছে, সব মজে গিয়েছে। এই তপ্ত দুপুরে বাতাসও নেই তেমন। তাও যেন তনুকার বেশ শান্তি পাচ্ছে জায়গাটাতে বসে। অন্তত একটু আগের বিদঘুটে সেই দৃশ্যগুলো যে চোখের সামনে ভাসা বন্ধ হয়েছে, সে’ই ঢের।

মেহতাব অনেকক্ষণ নীরবে বসে ঝিলের পানি দেখল। তনুকার দৃষ্টিও সেইদিকেই। মুখে যতই বলুক না কেন, লোকটাকে সে ঠিকই ভয় পাচ্ছে। কী নির্দয় লোকটা! একটা মানুষকে মা’রতে একটুও বুক কাঁপে না। অথচ, তনুকা একটা পিপড়া মারতেও হাজারবার ভাবে।
দীর্ঘক্ষণের নীরবতার পর এবার মেহতাবের গলার স্বর পাওয়ার গেল। সে খানিক রয়েসয়ে গম্ভীর সুরে বলল,

‘এই বাড়ির কেউ আমার কথা অমান্য করেন না। আমার আম্মাও না। আব্বাজান অসুস্থ হবার পর থেকেই তাঁর জমিদারী আমি সামলাচ্ছি। আমার কাকারা আর ছোট ভাই হাসি মুখে মেনে নিয়েছেন এই সিদ্ধান্ত। যদিও ভেতরের কথা আমি জানি না। আর এই বিচারমহল আমার দালান, আমার গোপন মহল; এখানে বাড়ির মহিলাদের আসা নিষেধ। আম্মা ব্যতিত কারোর অনুমতি নেই, এমনকি তোমারও না। তুমি নতুন বলে মাফ পেয়েছ। পরবর্তীতে এমন কিছু করলে অবশ্যই শাস্তি পাবে। আর আমার শাস্তি ঠিক কতটা কঠোর, তা তো দেখেছ’ই।’

সব শুনে তনুকার কেবল একটা কথা’ই মনে হলো, বাবা তার শেয়ালের ঘরে মুরগী দিয়েছে; হয়তো প্রাণ নিয়ে আর ফেরা হবে না।

তনুকা নিশ্চুপ রইল। শব্দবহল হারিয়েছে যেন। কী বলবে সে? কী বলা উচিত? নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল কেবল ঝিলের ঢেউ খেলিত পানির দিকে।
অনেকক্ষণ সময় কাটল এহেন নীরবতায়। একপর্যায়ে মেহতাব উঠে দাঁড়াল। তনুকার উদ্দেশ্যে বলল,

‘উঠে পড়ো, বিবিজান। আইজ তো দুপুরে আবার তোমার রান্ধার কথা, তা রানতে পারো তুমি?’

তনুকা হাত ঝেরে উঠে দাঁড়ায়। তারপর একপলক মেহতাবকে দেখে চোখ নামায়। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠে,

‘না।’

মেহতাব ঈষৎ হাসল। বলল,

‘হায় হায়, বিবির রান্ধা খাওয়ার সৌভাগ্যও আমার হইল না। কিন্তু, আম্মাজানরে কী কইবা? আম্মাজান তো অধির আগ্রহে তাঁর পুত্রবধূর হাতে রান্ধা খাওয়ার জন্যে বইসা আছেন।’

তনুকা নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না তার। কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। এই মানুষটাকেও পছন্দ হচ্ছে না। এখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কেমন যেন দম বন্ধ একটা পরিবেশ। অদ্ভুত এই মহল আর এই মহলের মানুষ। তনুকার চিন্তাধারার সাথে এই মানুষগুলোর মিল নেই। এখানে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব না তার পক্ষে।
তনুকার চিন্তিত, ভয়ার্ত চোখ মুখ দেখে তার মাথায় হাত ঠেকায় মেহতাব। কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করে,

‘এখনো ভয় পাচ্ছো, তনু?’

তনুকা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। লোকটা কী নিদারুণ মায়া নিয়ে “তনু” বলে ডাকে তাকে। শুনলে যেন চিত্তপটে প্রশান্তির স্রোত বয়ে যায়। কিন্তু, পরক্ষণেই আবার লোকটার সেই বিদঘুটে রক্তিম অক্ষিযুগলের কথা স্মরণে আসলেই চিত্তপটের সেই প্রশান্তির স্রোত ততক্ষণাৎ মরুভূমির রূপ নেয়।

তনু রুদ্ধশ্বাস ফেলে। ক্ষীণ সুরে বলে,

‘আমি এই পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব না। আমি এইভাবে বড়ো হয়নি। আপনাদের সাথে মানিয়ে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।’

কথাগুলো বলে দু কদম পিছিয়ে দাঁড়ায় সে। ভয় পায়, লোকটা পুনরায় অগ্নি মূর্তি ধারণ করবে না তো?

কিন্তু মেহতাব তেমন কিছুই করল না। নির্নিমেষ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তনুকার সুশ্রী মুখশ্রীর পানে। অতঃপর স্মিত সুরে বলল,

‘পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই, তনু। মানুষ চাইলেই সব পারে। আর তুমি না চাইলেও এইখানে থাকতে বাধ্য। মেহতাব মজুমদারের অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছ তুমি; মৃত্যু ব্যতিত এই অস্তিত্ব আর কেউ মুছতে পারবে না।’

চলবে…..

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫।

অন্দরমহলের পরিবেশ থমথমে। তনুকাকে নিয়ে মেহতাব ভেতরে এসে দাঁড়াতেই কয়েক জোড়া চোখ বিস্ময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তাদের উপর। বাড়ির কর্তী আম্বিরা বেগম দ্রুত এগিয়ে এলেন। বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলেন,

‘বৌমা, তুমি আমাকে না বলে বিচারমহলে কেন গেলে?’

তনুকা চোখ নামায়। দৃষ্টি তার মাটিতেই নিমজ্জিত। অস্বস্তি আর ভয় হচ্ছে তার। এতগুলো মানুষও কি এখন তাকে কথা শোনাবে?
মেহতাব তনুকাকে খেয়াল করল। অতঃপর চাইল মায়ের দিকে। বলল,

‘আম্মা, এই নিয়ে আমার তনুর সাথে কথা হয়েছে। আর কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।’

আম্বিরা বেগম ক্ষান্ত হলেন। ছেলের মুখের উপর কথা তিনি বলেন না। পেছন থেকে তার ছোট কাকী রাহীলা, বিদ্রুপের সুরে বলে উঠলেন,

‘নিজের বউ বলে জমিদার সাহেব মাফ দিয়েছেন, এখন আমাদের মধ্যে কেউ হলে তো গর্দান নিতেন।’

আম্বিরা বেগম চোখ মুখ কুঁচকে বললেন,

‘আহ ছোটো, চুপ কর না।’

রাহীলা আঁচল চেপে মুখ ভেংচালেন। মেহতাব বিরক্ত হলেও কথা বাড়াল না। বলল,

‘আম্মা, আজ দুপুরে তো তনুর রান্নার কথা?’

‘হ্যাঁ, এটাই তো বাড়ির নিয়ম।’

‘তবে, আজ থেকে নিয়মে কিছু বদল আসুক। তনুর সাথে আজ আমিও রাঁধব।’

মেহতাব কথাখানা পাড়তে দেরি হয় আর উপস্থিত জনতার মাঝে হৈ চৈ বাঁধতে দেরি হয় না। সকলে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। আম্বিরা বেগম অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে উঠেন,

‘এটা কেমন কথা, বাবা? মহলের ছেলেরা রান্নাঘরে যায় না।’

‘আমি যাই, আম্মা। এই মহলের বর্তমান জমিদার আমি, তাই আমার কথাতেই সব হবে। তুমি লতাকে খবর দিয়ে সব বাজার রান্নাঘরে পাঠাতে বলো।’

আম্বিরা বেগমসহ সকলের মুখের রা বন্ধ। বউয়ের প্রেমে কি ছেলেটা অন্ধ হয়ে গিয়েছে? নাকি মেয়েটা কোনো যাদুটোনা করেছে?

মেহতাব তনুকার একহাত আঁকড়ে ধরল। হেসে বলল,

‘চলো বিবিজান, আইজ আমরা এক লগে রান্ধুম।’

সবাইকে বিশাল বিস্ময়ের সাগরে রেখেই মেহতাব তার বিবিকে নিয়ে ছুটল রান্নাঘরে। তনু নির্বাক চেয়ে আছে। এই লোক তো কেবল ক্ষণে ক্ষণে রূপ’ই বদলিয়ে যাচ্ছেন। কোনটা আসল, কোনটা নকল এখন কেমন করে বুঝবে সে?

___________

বিশাল রান্নাঘর। একপাশে সাজানো হরেক রকম তৈজসপত্র। অন্য এক পাশ পুরোটা জুড়ে নানানরকম বাজার। রান্নাঘরের সামনের ফটকের বাইরে দেখা যায় প্রকান্ড এক বাগান। ফুলের নয়, শাক সবজির বাগান।
তনু এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। লতা সবগুলো সবজি খুলে খুলে মেহতাবের পায়ের সামনে রেখেছে। মেহতাব ভালোমতো সব পরখ করে বলল,

‘এবার তুই যা। বাইরে গিয়ে জানিয়ে দে, আগামী দুই ঘন্টার ভেতর যেন এই রান্নাঘরে কেউ প্রবেশ না করে।’

লতা মাথা হেলিয়ে প্রস্থান ঘটাল। মেহতাব চাইল তনুকার দিকে। আদর করে ডাকল,

‘বিবিজান।’

তনুকা পূর্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মেহতাবের উপর। মেহতাবের চোখ মুখ উচ্ছ্বেসিত। সে এগিয়ে এল তনুকার দিকে। জিজ্ঞেস করল,

‘কও, কী রানবা?’

তনুকা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘শুদ্ধ জানলে অশুদ্ধ ভাষা বলার কী দরকার? একেকবার একেক ভাষা ব্যবহার করছেন, শুনতে বিরক্ত লাগে।’

ঈষৎ হাসল মেহতাব। বলল,

‘তোমার বিরক্তিতে আমার কিছু যায় আসে না; এখন এত কথা না কইয়া, যা জিগাইছি তার উত্তর দাও। কী রানবা?’

তনুকা অন্যদিকে ফিরল। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘আমি কিছু রাঁধতে পারি না।’

মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘তা আমি জানি কিন্তু, পছন্দের খাওনের নাম তো কইতেই পারো। তোমার পছন্দের সব খাওন রান্ধুম, কও কী কী খাইবা?’

তনুকা মৃদু আওয়াজে বলল,

‘আপনার যা খুশি তাই রান্না করুন, আমি সব খাই।’

হাসল মেহতাব। নিচ থেকে মুরগীর ব্যাগটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘কখনও মানুষের মাংস খেয়েছ?’

ভড়কে যায় তনুকা। এটা কেমন প্রশ্ন? ফ্যালফ্যাল করে তাকায় সে। তার তাকানো দেখে মেহতাব এবার শব্দ করেই হেসে ফেলে। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে মেহতাবের এই চমৎকার হাসি যেন রান্নাঘরের প্রতিটি দেয়ালে গিয়ে বারি খাচ্ছে। অদ্ভুত এক সুর আছে এই হাসির। হাসি থামাল মেহতাব। তনুকা এখনও আগের মতোই চেয়ে আছে। মেহতাব এগিয়ে আসে তার দিকে। ফিসফিসিয়ে বলে,

‘জানো বিবিজান, মানুষের মাংসের খুব স্বাদ। একবার যে এই মাংসের স্বাদ নিয়ে ফেলে, সে আর কখনোই অন্য কোনো মাংস খেতে পারে না।’

তনুকার কেমন যেন করে। আকস্মিক গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। এক কদম পিছিয়ে যায়। মেহতাব তার আপাদমস্তক পরখ করে। ক্রূর হেসে বলে,

‘ডরাইতেছ কেন, বিবিজান? আমি মানুষের মাংস খাই নাই, একটা আর্টিকেলে পড়ছিলাম। তুমি আমারে যেমনে ডরাইতেছ, মনে হয়তেছে আমিই মানুষের মাংস খাইছি।’

ফের হাসল মেহতাব। তনুকার হাত টেনে বলল,

‘এহানে আইয়ো, তোমারে রান্ধা শিখাই। পরের বার তুমি রানবা।’

তনুকা এক পা এগুল। কেন যেন ভয় কমছে না তার। কীসের একটা শঙ্কা যেন বক্ষঃস্থলে চেপে বসেছে। কিছুতেই কমছে না। মেহতাবের এহেন আচরণও তার সেই ভয় আর শঙ্কাকে আরো তড়ান্নিত করছে।

তনুকা দাঁড়িয়ে রইল। মেহতাবের গায়ে পরিচ্ছদ-রক্ষক বহিরাবরণ (এপ্রোন)। সে খুব যত্ন সহকারে একটা চাপাতি দিয়ে মুরগীটাকে টুকরো টুকরো করছে। তনুকা মনোযোগের সহিত দেখছে সেটা। এসব কাজ সে পারে না। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় বাড়ির ভৃত্যরাই এসব করেছে; আর বিদেশে তো তৈয়ারি’ই পাওয়া যেত। তাই এসবে খুব একটা ধারণা তার নেই। মুরগীর টুকরোগুলো কেটে একটা বাটিতে নিয়ে তনুকার দিকে এগিয়ে দিল। তারপর বলল,

‘নেও, এবার এগুলা পরিষ্কার করে ধৌও।’

তনুকা ইতস্তত ভঙিতে কোনোরকমে সেগুলো পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করল। মেহতাবকে দিতেই সে বলল,

‘হয় নাই, বিবিজান। আবার ধৌও।’

তনুকা আবার ধু’লো। তাও মেহতাবের পছন্দ হলো না। বলল,

‘উঁহু, আবার ধৌও।’

তনুকা দাঁতে দাঁত চেপে ফের পরিষ্কার করল। মেহতাবকে দেখাল। মেহতাব হেসে বলল,

‘এবার হইছে।’

জিজ্ঞেস করল,

‘পেঁয়াজ কাটতে পারো?’

তনুকা উপর নিচ মাথা নাড়াল। তারমানে পারে। মেহতাব বলল,

‘ঠিক আছে। বারো থেকে পনেরোটা পেয়াজ কাটো।’

তনুকা অবাক হয়ে বলল,

‘কেবল এক মুরগীর তরকারিতেই এত পেঁয়াজ।’

‘না, বাকি সব তরকারির জন্য।’

হতাশ হয়ে পেঁয়াজ কাটতে আরম্ভ করল তনুকা। দুইটা শেষ করতে না করতেই চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে আরম্ভ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু করল নাক টানতে। সাতটা পেঁয়াজ কোনোরকমে কেটে বলল,

‘আমি আর পারছি না।’

মেহতাব চেয়ে দেখল, বেচারি ইতিমধ্যেই নাক মুখ লাল করে ফেলেছে। সে মাথা নাড়াল। আফসোসের সুরে বলল,

‘তোমারে দিয়া দেখি কিছুই হইব না, বিবিজান।’

তনুকা নাক টেনে বলল,

‘দেশী পেঁয়াজের ঝাঁঝ বেশি, তাই পারছি না।’

‘আচ্ছা আর পেঁয়াজ কাটতে হবে না। এই সবজি গুলো কেটে দাও, তাহলেই হবে।’

______

রান্না প্রায় শেষের দিকে। তনুকা পুরোটা সময় বিস্ময় নিয়ে মেহতাবকে দেখেছে। একজন পুরুষ এত নিঁখুত ভাবে রাঁধতে পারে, ব্যাপারটা ভীষণ আশ্চর্যের লেগেছে তার। মেহতাবের রান্না দেখে মনে হলো, এই কাজে সে ভীষণ পারদর্শী, অনেক বছরের অভিজ্ঞতা আছে হয়তো। প্রতিটা রান্নার শেষে তনুকাকে একটু করে টেস্টও করিয়েছে। সবগুলো রান্নাই যেন অসাধারণ। তনুকা শিখে নিয়েছে সব। পরেরবার সে একাই রাঁধতে পারবে।

মেহতাব ভালোমতো হাত ধুয়ে তনুকার সম্মুখে এসে দাঁড়াল। তারপর এক হাত বাড়িয়ে তার শাড়ির আঁচল টেনে, হাত মুছল তা দিয়ে। তনুকা এতে বিরক্ত হলো খুব, কিন্তু কিছু বলল না। তার জন্য এতকিছু করেছে, সে না হয় এইটুকু একটা ব্যাপার মুখ বুজে সহ্য করে নিল।

এতসবের মাঝেই তনুকার হঠাৎই স্মরণে এল তার গলার চেইনের কথা। ততক্ষণাৎ বলে উঠল,

‘একটা প্রশ্ন করব?’

মেহতাব হাত মুছে সরে দাঁড়াল। বলল,

‘না করলে কি করবে না?’

‘তাও করব।’

‘তাহলে করে ফেল।’

হাতের স্পর্শে সেই লকেটটা ছুঁলো সে। জিজ্ঞেস করল,

‘এটা আপনি দিয়েছেন, তাই না?’

মেহতাব খেয়াল করে দেখল কিছুক্ষণ। এরপর বলল,

‘না তো।’

‘আবার মিথ্যে বলছেন। অবশ্য রেনু বলেছে, আপনি নাকি খুব সুন্দর মিথ্যে বলতে পারেন, কেউ নাকি ধরতে পারে না। তবে, আমাকে মিথ্যে বলে লাভ নেই। আমি ঠিক ধরতে পারব।’

ফিচেল হাসল মেহতাব। বলল,

‘শুনে খুশি হলাম; অবশেষে তো কেউ একজন এসেছে যে, আমার মিথ্যে ধরতে পারবে।’

‘হু। তাই এখন সত্যিটাই বলুন; এটা আপনি দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, দিয়েছি।’

‘এই লকেটে আমার বাচ্চাকালের ছবি আছে; এই ছবি আপনি কোথায় পেলেন?’

চলবে…..