প্রাণেশ্বর পর্ব-০৬

0
200

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬।

মেহতাব ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘এখানে তোমার ছবি? কই দেখি?’

তনুকা লকেট’টা মেলে ধরল। মেহতাব শাণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর গম্ভীর সুরে বলল,

‘এই ছবিগুলোর সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।’

তনুকা ক্ষিপ্ত হলো। বলল,

‘আপনি আবারও মিথ্যে বলছেন।’

মেহতাব স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করল,

‘তোমাকে মিথ্যে বলে আমার লাভ?’

‘সেটা তো আপনিই ভালো জানেন। এই চেইন লকেট সমেত আপনি দিয়েছেন, অথচ এই দুটো বাচ্চার ছবি সম্পর্কে আপনি অবগত নন; এটা কি আদৌ বিশ্বাস করার যোগ্য?’

মেহতাব শ্বাস ছাড়ল। বলল,

‘দেখো বিবিজান, এই লকেট সমেত পুরো চেইন আমাকে আম্মা দিয়েছেন; তাই এই চেইনে কী আছে না আছে সেই সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে এইটুকু বলতে পারি, পাশের ছেলে বাচ্চাটা আমি। হয়তো আম্মা তোমার বাবার কাছ থেকে তোমার ছোটবেলার ছবি নিয়ে এই লকেট বানিয়েছেন। এটা আমার ধারণা কেবল, বাকিটা আম্মা’ই ভালো জানেন।’

তনুকা ভাবল কিয়ৎক্ষণ। না, হিসাব মিলছে না। এই অংক বড্ড জটিল, এত সহজে এর সমাধান পাওয়া যাবে না। তনুকা ভাবনার পর্ব চুকিয়ে বলল,

‘ঠিক আছে, রাতে আমি মা’র সাথে এই ব্যাপারে কথা বলব।’

মেহতাব হেসে মাথা হেলাল। এরপর বলল,

‘এবার গিয়ে গোসলটা সেরে নাও। আলমারিতে দেখো, একটা সফেদ রং এর শাড়ি আছে, সেটা পরবে।’

তনুকা জবাবে কিছু বলল না। রান্নাঘর ছেড়ে চলে গেল নিজ কক্ষে। রান্নাঘরে তখন মেহতাব একাই। পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে নিজের রান্নার ঘ্রাণ শুঁকছে। মোহনীয় সব রান্নার ঘ্রাণ। নিজেই নিজেকে বাহবা দিয়ে বলে উঠে,

‘মেহতাব মজুমদার, জমিদারী ছেড়ে তোমার এবার শেফ হওয়া প্রয়োজন। দূর্দান্ত রাঁধো তুমি।’

বলেই শব্দ করে হাসল সে। ঢাকনা দিয়ে পাতিল ঘুরে সেও বেরিয়ে গেল।

গোসল সেরে বের হলো তনুকা। মেহতাব যেন তার অপেক্ষাতেই ছিল। তবে তাকে দেখা মাত্রই বিরক্ত হলো সে। ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘তোমাকে না সফেদ রং এর শাড়িটা পরতে বলেছিলাম, পরোনি কেন?’

তনুকা চুল মুছতে মুছতে বলল,

‘শাড়িটা একদম সাদা, কোনো কাজ নেই। ওটা পরলে আমাকে বিধবা মনে হতো, তাই পরিনি।’

মেহতাব অসন্তোষ হলো ভীষণ। নিরস মুখে বলল,

‘কে বলেছে, সাদা পরলে বিধবা মনে হয়? সাদা মানে শুভ্র আর শুভ্র মানেই শরৎ। আমার শরৎ পছন্দ, শুভ্র পছন্দ। আর আমার বিবিজান সাদা জড়িয়ে হবে আমার একমাত্র শুভ্রতা। শাড়িটা পাল্টে সাদাটাই পরে এসো।’

মেহতাবের মুখের উপর আর না করতে পারল না তনুকা। অগত্যাই সাদা শাড়ি হাতে নিয়ে চলল গোসলখানায়। কিছুক্ষণের মাঝেই পরে বের হলো। মেহতাবের তীক্ষ্ণত্ব দৃষ্টি নিমজ্জিত হলো সেদিকেই। ভীষণ চিত্তাকর্ষক সেই দৃষ্টি, এক কঠিন রমণীর মনকে পিষে ফেলতে যথেষ্ঠ। তনুকা খানিকটা লজ্জা পেল বোধ হয়। মাথা নুইয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘এভাবে কী দেখছেন?’

‘আমার বিবিজানকে। তোমাকে শরতের এক ফালি শুভ্র কাশফুল লাগছে, যাকে ছুঁয়ে দিলেই মিইয়ে যাবে। সত্যিই কি এমনটা হবে, বিবিজান? একবার ছুঁয়ে দেখব?’

বলেই এগোল সে। তনুকা অস্বস্তিতে পড়ল ভীষণ। পিছিয়ে গেল। তবে বেশি দূর যেতে পারল না, তার আগেই এক জোড়া পুরুষালী শক্ত পোক্ত হাতের বাঁধন আটকে দিল তাকে। মেহতাবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হলো। তনুকা জড়তাই জমে কাঠ। মেহতাবের শক্ত হাতের স্পর্শে শরীরে বিদ্যুৎ বইছে যেন। মেহতাব এগিয়ে আসে। ততক্ষণাৎ তার কৃষ্ণাভ অধর ঠেকায় তনুকার ললাটে। কম্পিত হয়ে সে আঁকড়ে ধরে মেহতাবের পাঞ্জাবী। মেহতাব গাঢ় এক চুম্বন বসিয়ে সরে আসে। তনুকার কম্পন থামে না। পঁচিশ বছরের জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেয়ে শরীর অস্থির হয়ে উঠেছে তার। চিত্তপটে অন্যরকম এক শিহরণের স্রোত বইছে।

মেহতাব ফিচেল হেসে বলে,

‘কিছু করেনি, বিবিজান; কাঁপাকাঁপি বন্ধ করো।’

লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠে তনুকার গাল যুগল। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বারান্দায় চলে যায়। ইতস্তত সুরে বলে উঠে,

‘আপনি নিচে গিয়ে সবাইকে খেতে ডাকুন, আমি আসছি।’

‘উঁহু, এই দায়িত্ব আমার না। তুমি যাবে, গিয়ে মহলের প্রত্যেক সদস্যকে ডেকে আনবে; নিজে বেড়ে খাওয়াবে সবাইকে।’

তনুকা মাথা নাড়াল। চুলগুলো অতি দ্রুত মুছে নিজের কক্ষ ছাড়ল। মাথায় বড়ো ঘোমটা টেনে সে প্রথমেই গিয়ে দাঁড়াল, তার শ্বশুর শাশুড়ির কক্ষের সামনে। রেনু আজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবার কক্ষ দেখিয়েছে বলে, চিনতে আর অসুবিধা হয়নি। দরজায় ছোট করে টোকা দিল সে। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,

‘ভেতরে এসো।’

তনুকা আরো একবার নিজেকে ঠিকঠাক করল। অতঃপর পা রাখল তাঁদের কক্ষে। তনুকাকে দেখে সহসাই হাসি ফুটল আম্বিরা বেগমের অধর কোণে। আবার পরক্ষণেই হাসি মিইয়েও গেল। একপলক তাকে পরখ করে তিনি বললেন,

‘একী মা, তুমি একদম সাদা শাড়ি পরলে কেন? কোনো রঙিন শাড়ি পাওনি?’

তনুকা জানতো, শাশুড়ি তাকে ঠিক প্রশ্ন করবে। তাই উত্তরও সাজানো ছিল তার। মুখস্থ’ই বলে দিল,

‘আপনার ছেলে বলেছে, মা।’

আম্বিরা বেগম বিরক্ত হলেন হয়তো। কপাল কুঁচকে বললেন,

‘থাক তবে, স্বামীর পছন্দ মতোই সব করো।’

‘জি, আপনারা এবার খেতে চলে আসুন। আমি বাকিদেরও ডেকে আসছি।’

‘না, তোমার ডাকতে হবে না। ঘড়ির কাটায় দুটো বাজলে এমনিতেই খাবার টেবিল পূর্ণ হয়ে যাবে। তুমি বরং খাবার সব টেবিলে সাজিয়ে রাখো, আমরা আসছি।’

তনুকা সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেই আবার কী ভেবে ফিরে চাইল সে। মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘রেনু বলেছিল, বাবা নাকি অসুস্থ। উনি কোথায়, মা? এখানে আসার পর তো একবারও দেখা হলো না।’

‘উনি আমাদের বিশেষ কক্ষে আছেন। সময় হলে মেহতাব তোমাকে উনার সাথে দেখা করিয়ে দিবে। চিন্তা করো না।’

তনুকা খানিকটা অবাক হলো। অসুস্থ মানুষের জন্য আবার বিশেষ কক্ষ?

সে চলে এল রান্নাঘরে। লতাকে নিয়ে সব রান্না টেবিলে সাজাল। ততক্ষণে শুরু হয়ে গেল ঘন্টার ঢং ঢং শব্দ। খাবার টেবিলের এক কোণেই এক বিশাল ঘড়ি রাখা। তনুকা সেদিকে চেয়ে দেখল, ঠিক দুটো বাজে। তখনই খেয়াল করল মহলের সব কক্ষের দরজা খুলে গিয়েছে। একে একে বেরিয়ে এসেছে সবাই। বাড়ির অন্য দুই পুরুষ সদস্য চেয়ারে এসে বসে পড়লেন। উপস্থিত হলো মেহতাবও। অন্য এক চেয়ারে এসে বসল রেনু। উর্মি আর রাহীলাও আজ বসল। বসল না কেবল আম্বিরা বেগম। তনুকা তখন প্রসন্ন হেসে বলল,

‘মা, আপনিও বসে পড়ুন; আজ খাবার আমিই পরিবেশন করে দিব।’

তার সাথে তাল মিলিয়ে রাহীলা বলে উঠল,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাবি বসে পড়ো। রান্নাটা তো আর বউকে করতে হয়নি, অন্তত পরিবেশনটাই করুক।’

আম্বিরা বেগমও বসলেন। টেবিলে অনেক খাবার। চারদিক সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে। তনুকা পোলাও তুলে দিল সকলের পাতে। তারপর একে একে সবাইকে দিল গরু মাংসের টিকিয়া কাবাব। সাথে সালাত দিতেও ভুলল না। কাবাব শেষ করতেই মুরগীর রোস্ট দিল সকলের পাতে। সবাই আমোদ করে খাচ্ছে। তনুকা তৃপ্তি পাচ্ছে তা দেখে, যদিও সে কিছুই রাঁধেনি। তাও শান্তি পাচ্ছে সে। রোস্ট শেষ করে রাহীলা বললেন,

‘আমাকে একটা বোয়াল মাছ তুলে দাও তো।’

তনুকা এগিয়ে মাছ দিতে গিয়ে ঝোল ফেলে দিল রাহীলার শাড়িতে। চমকে উঠলেন রাহীলা। চেঁচিয়ে বললেন,

‘এটা কী করলে? আমার এত দামি শাড়ি।’

তনুকা ভীত হয়। বলে,

‘দুঃখিত, ছোট কাকী। অসাবধানতাবশত পরে গিয়েছে, আমি বুঝতে পারেনি।’

তাও খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি। বললেন,

‘অসাবধানতা নাকি ইচ্ছে করেই? কী ভেবেছ, বুঝি না কিছু? সকালে ওভাবে বলেছি বলে এখন শোধ নিয়েছ, তাই না?’

‘না না, কী বলছেন? তা কেন হতে যাবে? আমি ইচ্ছে করে করিনি, ভুলে হয়েছে।’

তাতেও যেন ক্ষান্ত হলেন না তিনি। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে উঠলেন,

‘বুঝি আমি, সব বুঝি।’

লোকমাটা গলাধঃকরন করল মেহতাব। মনোযোগ দিয়েই কাকীর কথা শুনছিল। মুখ খালি হতেই সে বলল,

‘কাকী, শাড়ি দাবি নাকি নিজের জান, বলোতো?’

রাহীলা ভড়কালেন এমন প্রশ্নে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী বলতে চাইছো তুমি?’

‘তেমন কিছুই না। সহজ কথা, শাড়ি একটা গেলে হাজারটা আসবে কিন্তু, জান একবার গেলে আর ফিরে আসবে না। তাই ভেবে দেখো, কোনটা প্রিয়, শাড়ি নাকি জান।’

তনুকা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। মেহতাবের কথার মানে বোধগম্য হলো না তার। রাহীলার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে ইতিমধ্যেই। এই কথার মানে অনুধাবন করতে খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি তার। বাড়ির সকল সদস্য নির্লিপ্ত। রেনু বাদে সকলের মস্তিষ্কেই মেহতাবের এহেন শাণিত বাক্যবাণের অর্থ গেঁথে গিয়েছে। তাও নির্লিপ্ত তারা। মেহেতাবকে চেনে। অযথা অশান্তি চায় না বলে, চোখ মুখ বুজে কেবল খেয়ে যায়।

চলবে….