#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭।
‘আপনি তখন কাকীকে ওভাবে বললেন কেন?’
মেহতাব চোখ বোজে শুয়েছিল। তনুকার গলা পেয়ে চোখ মেলে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘কীভাবে?’
তনুকা এগিয়ে এসে খাটের অপর পাশে পা ঝুলিয়ে বসে। তারপর মাথাটা কাত করে মেহতাবের দিকে চেয়ে বলে,
‘আপনার কথা শুনে মনে হলো আপনি কাকীকে হুমকি দিচ্ছেন। সামান্য শাড়ির সাথে কি কারোর জানের তুলনা হয়? তাহলে আপনি কাকীকে ওভাবে কেন বলছিলেন?’
মেহতাব পুনরায় তার ঘন পল্লবে বেষ্টিত চোখের পাতা নিমীলিত করল। বলল,
‘তুমি না বড্ড বেশি প্রশ্ন করো, বিবিজান। এত প্রশ্ন আমার ভাল লাগে না। মাথাডা ধরছে, একটু টিইপা দাও তো।’
তনুকা বিরক্তিতে নাক মুখ সংকুচিত করে। ক্ষিপ্ত সুরে বলে,
‘সবার সাথে তো বেশ সুন্দর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন, আমার সাথে কথা বলতে গেলে এমন শুদ্ধ অশুদ্ধ সব মিলিয়ে ফেলেন কেন?’
‘আবার প্রশ্ন করো? আমার মনে যা চাই আমি তাই করি; এহন এত প্রশ্ন না কইরা আমার কাছে আইয়ো তো। অত দূরে বইসা থাকলে কি আর স্বামীর আদর সোহাগ পাওয়া যাইব?’
তনুকার বিরক্তির মাত্রা তড়ান্নিত হলো। উঠে দাঁড়াল সে। বলল,
‘না, আপনার আদর সোহাগের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি রেনুর ঘরে যাচ্ছি।’
মেহতাব কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। তনুকা বেরিয়ে গেল সেই কক্ষ ছেড়ে। মেহতাব কিঞ্চিৎ হাসল। মনে মনে আওড়াল,
‘আমার এত দিনের জমানো আদর, সোহাগ, ভালোবাসা সব তো কেবল তোমার জন্যই, বিবিজান। তুমি না চাইলেও এগুলো এখন তোমাকে গ্রহণ করতেই হবে।’
_________
রেনুর দরজায় ঠকঠক করে শব্দ হয়। ভেতর থেকে সে গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কে?’
তনুকা মৃদু আওয়াজে বলে,
‘আমি রেনু, আসব?’
‘কে, বউমনি?’
‘হ্যাঁ।’
‘এসো এসো।’
তনুকা ভেতরে প্রবেশ করে। রেনু শোয়া ছেড়ে উঠে বসে। তনুকা জিজ্ঞেস করে,
‘ঘুমাচ্ছিলে বুঝি? আমি কি বিরক্ত করলাম?’
রেনু হেসে বলল,
‘আরে না না, ঘুমাচ্ছিলাম না। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিলাম। ঐ দেখো, আমার বিছানা থেকে কী সুন্দর আকাশ দেখা যায়।’
তনুকা মৃদু হাসল। বলল,
‘বসব?’
রেনু চকিত স্বরে বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বসোনা; অনুমতি নিচ্ছ কেন?’
তনুকা বসল। রেনু জিজ্ঞেস করল,
‘আমাদের এখানে তোমার ভালো লাগছে তো?’
তনুকা ম্লান হেসে বলল,
‘হ্যাঁ, জমিদার বাড়ি, ভালো না লেগে উপায় আছে।’
‘আর আমার জমিদার ভাইজানকে কেমন লাগছে?’
তনুকা প্রশ্ন শুনে চাইল। রেনুর চোখে মুখে দুষ্টুমির রেশ। হাসল তনুকা। বলল,
‘তোমার ভাইজানকে আমার একটুও পছন্দ হয়নি।’
রেনুর মুখ চুপসে গেল। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কেন কেন, আমার অমন সুন্দর ভাইকে তোমার কেন পছন্দ হয়নি? আমার ভাইজানের গায়ের রং একটু চাপা বলে?’
তনুকা অস্বস্তির সুরে বলল,
‘না না, কী বলছো? আমি গায়ের রং দেখে মানুষ বিচার করি না। আমার কাছে মনুষ্যত্ব আগে তারপর সব। আচ্ছা, তোমার ভাইজান কি খুব বদমেজাজি মানুষ বা অহংকারী?’
রেনু একটু নড়ে চড়ে বসল। তারপর আমোদ গলায় বলল,
‘তুমি ভাইজান সম্পর্কে কিছু জানো না তো, তাই এমন ভাবছ। তুমি জানো, এই গ্রামের মানুষের কাছে আমার ভাইজান একজন ফেরেশতা সমতুল্য। গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষ ভাইজানকে ভীষণ ভালোবাসেন। আর ভাইজানের কাছেও এই গ্রাম তাঁর একটা পরিবার। এই গ্রামের এইটুকু ক্ষতিও তিনি বরদাস্ত করেন না।’
তনুকা এক পল ভেবে বলল,
‘তবে, তখন ঐ মানুষটাকে এভাবে কেন শাস্তি দিচ্ছেলেন? এমন কী অন্যায় করেছিলেন উনি?’
রেনু ভরাট গলায় বলল,
‘তুমি জানো না বউমনি, ঐ লোকটা কত জঘন্য। ও একটা মেয়েকে ধ’র্ষণরত অবস্থায় গ্রামের লোকদের কাছে ধরা পড়ে। গ্রামের লোকরাই তো তাকে ধরে ভাইজানের কাছে নিয়ে আসে। এখন তুমি বলো, একজন ধর্ষকের ঠিক কী শাস্তি হওয়া প্রয়োজন? ভাইজান কি ভুল কিছু করেছেন?’
তনুকার মুখে রা নেই। না জেনে, না বুঝে ভুল করে ফেলেছে সে। একজন ধর্ষককে বাঁচাতে এগিয়ে গিয়েছিল? ছি!
তনুকার এবার নিজের উপরই ঘৃণা হচ্ছে। সে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,
‘আমি আগে জানলে কখনোই এমন করতাম না। একজন ধর্ষকের শাস্তি সবথেকে জঘন্যতম হওয়া উচিত।’
‘ভাইজান তুমি বলে কিছু বলেননি; অন্যকেউ হলে আজ মেরেই ফেলতেন।’
‘কেন? উনার বিচারমহলে মহিলাদের যাওয়া নিষেধ কেন?’
রেনু দুই কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
‘কী জানি? আমি তো জানি না। তবে ভাইজান বিচারমহলে বসার পর থেকেই এই নিয়ম দেখে আসছি। এর কারণ ভাইজান’ই ভালো বলতে পারবেন।’
তনুকা ভাবল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর বলল,
‘আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বলো তো, জমিদারী প্রথা তো এখন বিলুপ্ত; গ্রামে এখন নির্বাচন হয়, চেয়ারম্যান হয়, গ্রাম পরিচালিত হয় তাঁর দ্বারা। সেখানে তোমাদের গ্রামে এখনও এই জমিদারী প্রথা কেন চলছে? গ্রামের কেউ কিছু এই নিয়ে বলে না?’
রেনু হেসে বলল,
‘সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার পেলেই সন্তুষ্ট। সেখানে এই গ্রামের মানুষদের আমার আব্বা আর ভাইজান তার থেকেও বেশি দিয়ে এসেছেন। আব্বাও উনার বিচার আমলে একজন সত্যবান, নিষ্ঠাবান মানুষ ছিলেন। এই গ্রামের এত উন্নয়ন সব উনার হাত ধরেই। তুমি জানো, করোনার সময় যখন কোনো গ্রামে ঠিক মতো ভ্যাকসিন পাঠানো হচ্ছিল না, তখন আমাদের গ্রামে সর্বপ্রথম ভ্যাকাসিন আনা হয়। গ্রামের অসুস্থ মানুষদের সেবার জন্য ভাইজান নিজ উদ্যোগে শহর থেকে ডাক্তার আনেন। যেখানে নিজের প্রিয় জনেরা মৃত্যুর পর একে অন্যের জানাযা পর্যন্ত পড়তে আসছিল না, সেখানে ভাইয়া নিজের দাঁড়িয়ে থেকে সবার জানাযা পড়েছেন, কবর দিয়েছেন। গ্রামের প্রতিটা বিপদে আমাদের পরিবার সকলের ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও তোমার মনে হয়, এই গ্রামের মানুষ এই জমিদারী প্রথা চাইবে না? সবাই নিজ খুশিতে এই জমিদারী চায়। ভাইজান যেদিন দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেদিন বলেছিলেন, গ্রামবাসী যদি কোনোদিন বলে এই জমিদারী তারা চায় না, তবে সাথে সাথেই এই জমিদারী বন্ধ হয়ে যাবে। তবে আজ পর্যন্ত কেউ এই কথা মুখেও আনেনি। তাদের কাছে আমাদের পরিবার এক সম্মানজনক ভরসা। যাদের চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়।’
থামল রেনু। তনুকা নিমিষ চেয়ে শুনল সব। অতঃপর বলল,
‘ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও কি কোনো বাঁধা আসে না। সরকারী ভাবে তো এই জমিদারী তুলে দেওয়া হয়েছে, তবে তোমরা কী করে অনুমতি পাচ্ছো?’
রেনু ঠোঁট উল্টে ভেবে বলল,
‘আব্বাজান আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আর এই গ্রামেও নির্বাচন হয়, চেয়ারম্যান ও আছে; তবে নামমাত্র। সব তো আমার আমার আব্বাজান’ই করে এসেছেন আর এখন ভাইজান করছেন। গ্রামের মানুষের কোনো বাঁধা নেই বলে, বাইরে থেকেও তেমন কোনো বাঁধা আসে না।’
তনুকা সব শুনে তপ্ত শ্বাস ফেলে। মনে প্রশ্নের পাল্লা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে। রেনু হঠাৎ প্রশ্ন করে,
‘তোমার কি ভাইজানকে পছন্দ হয়নি? ভাইজান কিন্তু খুব ভালো মানুষ, আর তোমাকেও খুব ভালোবাসেন।’
তনুকা অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘ভালোবাসেন?’
‘হ্যাঁ, অনেক ভালোবাসেন। তোমার আর ভাইজানের বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই আমি ভাইজানের আরেক রূপ দেখেছিলাম। আমার বুঝ হবার পর থেকে আমি ভাইজানকে কোনোদিন কোনো মেয়ের প্রতি আগ্রহ দেখাতে দেখিনি। প্রথম সেই আগ্রহ আমি তোমার জন্যই দেখেছিলাম। জানো, গ্রামের কত মেয়ে ভাইজানের প্রেমে দিশেহারা। আমার বান্ধবী নিলুও ভাইজানের উপর চরম পরিমাণে দূর্বল। তোমার তো নিজেকে নিয়ে গর্ব করা উচিত যে, তুমি আমার সুদর্শন ভাইজানকে তোমার স্বামী হিসেবে পেয়েছ।’
তনুকা হাসে। বলে,
‘তা যা বলেছ, তোমার ভাইজান সুদর্শন বটে। তবে ভালোবাসা কি এত সোজা? উনি আমাকে এক দেখাতেই কী করে ভালোবেসে ফেললেন? ব্যাপারটা কিন্তু খুব চিন্তার। তোমার ভাইজানের সাথে কথা বলতে হবে।’
রেনু বেশ আগ্রহ সমেত বলে উঠে,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনই একবার গিয়ে এই কথাটা জিজ্ঞেস করে এসো না।’
তনুকা সায় দিল। উত্তর তার এখনই চায়। মেহতাব মজুমদারের মতো এমন একজন সুদর্শন, বিত্তবান জমিদার ছেলে হঠাৎ এত মেয়ে রেখে তাকেই কেন পছন্দ করল? আবার বিয়ের আগেই তার প্রতি এত দূর্বলতা? এটা কি নিত্যান্তই স্বাভাবিক কিছু, নাকি এর পেছনের গল্পেও রয়েছে বিশাল গভীরতা?
চলবে….
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৮।
রুমে ফিরে আসে তনুকা। উদ্দেশ্য তার, এক্ষুনি মেহতাবের সাথে কথা বলা। কিন্তু রুমে এসেই দেখল, রুম শূণ্য। মেহতাব নেই। তনুকার এই মুহুর্তে মেহতাবের অনুপস্থিতিটা ঠিক মনঃপূত হলো না। এই সময় আবার কোথায় গেল লোকটা? তনুকা ভাবতে ভাবতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তার বারান্দা থেকে মহলের প্রধান ফটক দৃশ্যমান। সেখানেই মেহতাবকে দেখা যাচ্ছে; এক লোকের সাথে কথা বলছে সে। লোকটা মেহতাবের সাথে কথা বলার মুহূর্তেই একবার চাইল সেইদিকে। বারান্দায় দাঁড়ানো তনুকাকে ততক্ষণাৎ চোখে পড়ল তার। হেসে বলল,
‘ভাইজান, ভাবি সাহেবা নাকি?’
লোকটার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে বারন্দায় তনুকাকে পরখ করল মেহতাব। তনুকা সেইদিকেই চেয়ে ছিল বলে চোখে চোখ পড়ল। মেহতাব দৃষ্টি অতিশয় গম্ভীর। তনুকা কী ভেবে যেন ভেতরে চলে আসে। বসে থাকে বিছানায়।
কিছুক্ষণ পর সেই কক্ষে এসে উপস্থিত হয় মেহতাব। তনুকা গভীর চিন্তায় মগ্ন। মেহতাবের উপস্থিতি তাই প্রথমে টের পায়নি। মেহতাব তার পাশে বসতেই সম্বিৎ ফেরে তার। মেহতাবের দিকে দৃষ্টি নিমজ্জিত করে। তবে মেহতাবের চোখের দৃষ্টি মেঝেতে। কী যেন ভাবছে সে। দু জোড়া ভ্রু’র মাঝে ভাঁজ পড়েছে তিনখানা। তনুকা তাই রয়ে সয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু কি হয়েছে?’
মেহতাব চাইল। বলল,
‘না।’
‘আপনাকে দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছে।’
মেহতাব একটু সময় নিয়ে বলল,
‘কালকে বারান্দায় থাই গ্লাস লাগাতে হবে।’
তনুকা ভ্রু কুঁচকাল খানিক। জিজ্ঞেস করল,
‘কেন?’
মেহতাব চাইল কিয়ৎক্ষণ, তবে জবাব দিল না। তনুকা ফের কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেহতাব বলল,
‘প্রশ্ন করো না। এখন কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না।’
তনুকা নিমিষ চেয়ে রইল। বোঝার চেষ্টা করল লোকটার ভাবমূর্তি। কিন্তু পরাস্ত হলো সে। এই লোকটাকে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তনুকা নিশ্বাস নিল। বলল,
‘আপনি নাকি আমায় ভালোবাসেন?’
মেহতাব কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘কে বলল?’
‘রেনু বলেছে। কথাটা সত্যি?’
মেহতাব মৃদু হাসল। হাসির রেশ এতই ক্ষীণ যে গালের একটা অংশেও ভাঁজ পড়ল না। বলল,
‘প্রত্যেক স্বামীই তার স্ত্রীকে ভালোবাসে, এটাই স্বাভাবিক।’
‘কিন্তু, বিয়ের আগেই কোনো মেয়ের জন্য এত উতলা হয়ে উঠা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। আপনি তো আমাকে চিনতেনও না। আর আমিও তো আপনাকে বাসর রাতেই প্রথম দেখেছি, তবে বিয়ের আগেই এত দূর্বলতায় কীভাবে পড়লেন?’
মেহতাব ভ্রু যুগল কুঁচকে চাইল তার দিকে। জিজ্ঞেস করল,
‘এসব তোমায় কে বলেছে?’
‘রেনু বলেছে। আপনার আমার বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই নাকি ও আপনার মধ্যে এক অন্যরকম বদল দেখেছে। আমার প্রতি দূর্বলতা দেখেছে, যেটা আগে কখনো অন্য মেয়ের প্রতি দেখেনি সে।’
মেহতাব হাসল। হাসিতে শব্দ হলো। তনুকা বিমোহিত হলো যেন সেই শব্দ। মেহতাব বলল,
‘ঐটুকু একটা মেয়ে এতকিছু বুঝে? ও তো তাহলে খুব পেঁকে গিয়েছে, বিয়ে দিয়ে দিতে হবে দেখছি।’
‘কী বলেন? বিয়ে কেন দিবেন? সবে তো ওর ষোল বছর, এইটুকু মেয়ের আবার বিয়ে হয় নাকি?’
‘হয় হয়, আমার আম্মার তো ঐটুকু বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। তারপর দু বছরের মধ্যে আমি হয়েছি। এখন দেখো, আমার ত্রিশ চলছে, অথচ আমার আম্মা কত যুবতী। কম বয়সে বিয়ে হলেই ভালো, সময় থাকতেই সব মুহূর্ত উপভোগ করে যাওয়া যায়।’
তনুকার ভ্রু যুগলের কুঁচকানো ভাব আরো দৃঢ় হলো। সে প্রশ্ন করল,
‘আপনি কতটুক পড়াশোনা করেছেন?’
মেহতাব চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল। জিজ্ঞেস করল,
‘হঠাৎ এর মাঝে আমার পড়াশোনার কথা আসল কোথ থেকে?’
‘কোনো শিক্ষিত মানুষের চিন্তাভাবনা এমন হয় না, তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
হাসল মেহতাব। বলল,
‘তা যা বলেছ। আমার মতো এইট পাশ ছেলের চিন্তাভাবনা আর কতটুকুই বা উন্নতি হবে।’
তনুকা অবাক হলো ভীষণ। কেবল এইট পাশ? বাবা যে বললেন, ছেলে ভীষণ শিক্ষিত? তবে কি এটাও মিথ্যে? বুক চিরে বেরিয়ে এল গভীর এক দীর্ঘশ্বাসের স্রোত। মনটা ভীষণ ব্যথিত হলো তার। অন্তত, একটু শিক্ষিত ছেলে চেয়েছিল সে। অথচ অবশিষ্টে সে কিছুই পেল না। তনুকা মন খারাপ করে ফের জিজ্ঞেস করল,
‘বললেন না তো, আমাকে এত পছন্দ করার কারণ কী? মেয়ে তো নিশ্চয়ই অভাব পড়েছিল না আপনার; তবে আমিই কেন?’
মেহতাব মাথা নোয়াল। কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ। অতঃপর গভীর চোখে চাইল তনুকার পানে। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,
‘মেয়ের অভাব পড়েছিল না, তবে একটা তনুকার বড্ড অভাব ছিল। যখন সুযোগ পেয়ে গেলাম, তখন আর তা হাতছাড়া করতে পারলাম না। তনুকাকে নিজের করে নিলাম, একান্তই নিজের। এখন আর চাইলেও সেই তনুকা আমার থেকে হারাতে পারবে না। সেই পথ বন্ধ তার; আর আজীবন বন্ধ’ই থাকবে।’
তনুকা কপালের ভাঁজ সোজা করে নিল। মেহতাব সহজ ভাষায় কথা বলতে জানে না হয়তো। আবার হতে পারে সেই আজকাল বড্ড মূর্খ হয়ে ওঠেছে। বাংলা কথারও ঠিকঠাক অর্থও সাজাতে পারছে না। মেহতাব বরাবরের ন্যায়’ই নির্লিপ্ত। সে একপলক তনুকাকে দেখে বলল,
‘সবকিছুর উত্তর পাইছো তো, বিবিজান? আর কোনো প্রশ্ন থাকলে এখনই কইরা ফেলাও, পরে আর উত্তর দিতে পারমু না কিন্তু।’
তনুকা উঠে অপর পাশে গিয়ে বসল। এরপর বলল,
‘না, আমার আপনার থেকে আর কিছু জানার ইচ্ছে নেই।’
________
সন্ধ্যার পর রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হয় তনুকা। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত, শাশুড়ি আম্বিরা বেগমকে পায়। আম্বিরা বেগম তাকে দেখে মৃদু হাসলেন। বললেন,
‘কিছু লাগবে, মা?’
তনুকা কিঞ্চিৎ হেসে জবাব দিল,
‘না মা, কিছু লাগবে না। চা নাস্তা আমাকে কিছু বানাতে হবে?’
‘চা বানাতে পারো?’
তনুকা মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘জি, পারি।’
আম্বিরা বেগম একটু সরে দাঁড়ালেন। বললেন,
‘ঠিক আছে তবে, বানাও দেখি।’
তনুকা এগিয়ে এল। একপাশে রাখা সবগুলো পাতিল নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখে বুঝতে পারল না, কোনটাতে পানি বসাবে। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইল শাশুড়ির দিকে। আম্বিরা বেগম সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝলেন। বললেন,
‘ঐ যে ঐ পাতিলে পানি বসাও।’
উত্তর পেয়ে চট করে পাতিল নিয়ে পানি বসায় তনুকা। আম্বিরা বেগম বললেন,
‘মেহতাবকে চিনি ছাড়া চা দেবে, ও চিনি খায় না।’
‘একদমই চিনি দিব না?’
‘না।’
তনুকা অবাক হয়ে ভাবল, চিনি ছাড়া অমন বেস্বাদের চা কারোর মুখে জুটে কী করে?
_____
চায়ের পানি ফুটছে। আম্বিরা বেগম একপাশে দাঁড়িয়ে আটা মেজে কী যেন বানাচ্ছেন। তনুকা চায়ের পানিতে চা পাতা দিতে দিতে বলল,
‘মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
আম্বিরা বেগম একপলক তাকে দেখে বললেন,
‘করো।’
তনুকা চায়ের পাতা ঢেলে একটু সরে দাঁড়াল। আম্বিরা বেগমের শিউরে অবস্থান করল। জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি আমার ছোট বেলার ছবি কোথায় পেলেন?’
আম্বিরা বেগম অবাক হয়ে চাইলেন। বললেন,
‘মানে?’
তনুকা এগিয়ে গিয়ে তার গলার লকেট মেলে ধরে। জিজ্ঞেস করে,
‘এই যে, এই ছবিটা আপনি কোথায় পেলেন?’
আম্বিরা বেগম বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। জিজ্ঞেস করলেন,
‘এটা যে আমি পেয়েছি, সেটা তোমাকে কে বলল?’
‘আপনার ছেলে।’
আম্বিরা বেগম কপাল কুঁচকালেন। কী যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ। তনুকা ধরতে পারল না ব্যাপারটা। সে নির্নিমেষ চেয়ে দেখল তাঁকে। আম্বিরা বেগম একটু সময় নিয়ে বললেন,
‘তোমার বাবার কাছ থেকে নিয়েছি। চা হয়েছে? তাড়াতাড়ি করো, আমার নাস্তা বানানো শেষ।’
অযথাই তাড়া দিলেন তিনি। তনুকার দৃষ্টির গভীরতা আরো প্রকট হলো। চট করেই মনে হলো, ভদ্রমহিলা মিথ্যে বলছেন, লুকাচ্ছেন কিছু। তনুকার যথেষ্ঠ সন্দেহ হলেও আপাতত ব্যাপারটা আর সে ঘাটাল না। এই বাড়ির সবগুলো মানুষ’ই বড্ড জটিল। এত সহজে তাদের ভাবমূর্তি ধরা যাবে না। সে তাই অতঃপর মনোযোগ দিল চা বানাতে।
চলবে…..