#পদ্মফুল
#লেখিকা_জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
#সূচনা_পর্ব
‘স্যার, ইমারজেন্সিতে একজন পেশেন্ট এসেছে। অবস্থা ভালো নয়, মনে হয় এক্সিডেন্ট কেইস।’
‘ইমাজেন্সিতে কি কোনো ডক্টর নেই?’
‘না স্যার। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন, পেশেন্টের অবস্থা খুবই খারাপ।’
‘ঠিক আছে, চলুন।’
ড. আদিদ স্টেথোস্কোপ’টা গলায় পরে নার্সের পেছন পেছন ছুটল ইমারজেন্সি রুমে। গিয়ে দেখল স্ট্রেচারে একটি মেয়েকে রাখা হয়েছে। যার মাথার চারপাশ’টা র/ক্তে র/ক্তা/ক্ত হয়ে আছে। সে দ্রুত মেয়েটার কাছে গেল। হাতের পালস্ চেক করে দেখল, বেঁচে আছে। কিন্তু ব্লিডিং হয়েছে অনেক। এক্ষুণি র/ক্ত পড়া বন্ধ না করতে পারলে সিরিয়াস কিছু হয়ে যাবে। আদিদ নার্সকে তাড়া দিয়ে বললো,
‘এক্ষুণি উনাকে ও.টি তে নিয়ে যান। অবস্থা ভালো নেই। মাথায় অনেকটা চোট পেয়েছে। সেলাই করতে হবে বোধ হয়।’
আদিদের কথা মতো নার্স মেয়েটিকে নিয়ে ও.টি তে ঢুকল। আদিদ তখন আশে পাশে তাকিয়ে বললো,
‘উনার সাথে কে এসেছে?’
একজন মধ্যবয়স্ক লোক তখন জবাবে বললো,
‘জ্বি আমি। আসলে আমার গাড়ির সঙ্গেই মেয়েটির এক্সিডেন্ট হয়। তবে আমার কোন দোষ ছিল না। মেয়েটি’ই ইচ্ছে করে এসে আমার গাড়ির সামনে পড়েছে।’
‘আচ্ছা, সেসব নিয়ে পড়ে ভাবা যাবে। এখন আপনি আগে গিয়ে রিসিপশনে একটা ফর্ম ফিল আপ করুন। বাকিটা আমি দেখছি।’
.
কপালের পাশটা ড্রেসিং করার পর আদিদ দেখল অনেকটাই কেটে গেছে। সেলাই না করে উপায় নেই। তিন থেকে চারটা সেলাই লাগল। হাতে আর পায়েও অল্প কিছু অংশ ছিলে গিয়েছে। সেগুলোও সে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিল। কপাল থেকে অনেকটা র/ক্ত যাওয়ায় তার এক ব্যাগ র/ক্ত ও লেগেছে।
মেয়েটাকে কেবিনে দিয়ে আদিদ রিসিপশনে গেল। সেই লোকটি সেখানের একটি চেয়ারে বসে আছে। আদিদ তাকে গিয়ে জিগ্যেস করলো,
‘মেয়েটির সাথে কিছু ছিল? উনার পরিবারের সাথে তো যোগাযোগ করতে হবে।’
লোকটি তার পকেট থেকে একটি বাটন ফোন বের করে বললো,
‘এই ফোন’টা ছিল বোধ হয়। কিন্তু এটা তো এখন চালু হচ্ছে না।’
‘দিন আমার কাছে। আর আপনি এখানে বসেই অপেক্ষা করতে থাকুন মেয়েটার জ্ঞান ফেরার আগ অবধি। এক্সিডেন্ট কেইস তো, অনেক সময় অনেক ঝামেলা হয়।’
‘ঠিক আছে, আমি আছি এখানে। আর মেয়েটা এখন সুস্থ তো?’
‘জ্বি। আশা করছি কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে।’
আদিদ কথা শেষ করে ফোনটা নিয়ে তার কেবিনে চলে গেল। ফোনটাও ভেঙে গিয়েছে। আদিদ তাই ফোনটা থেকে সিম কার্ড’টা খুলে নিজের ফোনে ঢুকাল। তারপর সে ফোনের কন্টাক্ট নাম্বারে গিয়ে দেখল কেবল একটাই নাম্বার সেইভ করা, “মামা” দিয়ে। আদিদ সেই নাম্বার’টাই কল লাগাল। সঙ্গে সঙ্গে কল’টা রিসিভও হয়ে গেল। আদিদ কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে কেউ ঝাঁঝাল গলায় বলে উঠল,
‘কোথায় তুই? কোন নাগরের হাত ধরে পালিয়েছিস? এই দিন দেখার জন্য তোকে খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছি। কই তুই, কিরে মুখপুড়ী কথা বলছিস না কেন? মান সম্মান তো সব শেষ করলি, পাড়ায় মুখ দেখানোর উপায় রাখলি না আর।’
আদিদ ভীষণ রকম বিরক্ত হলো। এইভাবে কেউ কথা বলে নাকি? ভদ্রলোক তাকে একটা বার কথা বলার সুযোগ দিচ্ছেন না। লোকটার ব্যবহার এত খারাপ কেন, আশ্চর্য!
আদিদ ভারি গলায় বলে উঠল,
‘দয়া করে আমাকে একটু বলার সুযোগ দিন।’
ওপাশ থেকে আবারও ঝাঁঝাল কন্ঠ শোনা গেল। লোকটি বলে উঠল,
‘এই আপনি কে? পদ্মর ফোন আপনার কাছে কেন? ওহ, আপনিই কি তবে সেই নাগর, যার হাত ধরে পদ্ম পালিয়েছে?’
‘এক্সকিউজ মি! ভদ্র ভাবে কথা বলুন। আমি একজন ডক্টর, হসপিটাল থেকে কথা বলছি। এই নাম্বারটি যার তিনি এখন হসপিটালে আছেন। আপনি যদি উনার বাড়ির লোক হয়ে থাকেন তবে দয়া করে এক্ষুণি হসপিটালে চলে আসুন।’
লোকটি তখন আঁতকে উঠে বললো,
‘মেয়েটা মরে টরে গেছে নাকি?’
আদিদ বুঝে উঠতে পারে না কী বলবে। এই লোকটা ঐ মেয়েটার কী হয়, সেটাই এখন সে ভাবছে। সে বিরক্ত কন্ঠে জবাব দিল,
‘না, উনি বেঁচে আছেন। আপনি আর কথা না বাড়িয়ে পেশেন্ট কেয়ারে চলে আসুন। রাখছি।’
আদিদ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কলটা কেটে দিল। তার কাছে আগেও এমন অনেক এক্সিডেন্ট কেইস এসেছে। যখনই সে পেশেন্টের বাড়ির লোকদের খবর দিত, তারা তখন পাগলের মতো ছুটে আসতো। কিন্তু, এই লোকটা কী অদ্ভুত! এইভাবে কেউ কারোর মরার কথা জিগ্যেস করে নাকি? আদিদ তখন ভাবে, মেয়েটা মনে হয় পারিবারিক ভাবে অনেক সমস্যাতে আছে; নয়তো এই বয়সের একটা মেয়ে আত্মহত্যা কেন করতে যাবে।
প্রায় এক ঘন্টা পর একজন নার্স এসে বললো,
‘একশো তিন নাম্বার রুমের পেশেন্টের বাড়ির লোক এসেছেন, স্যার। উনারা পেশেন্টের সাথে দেখা করতে চাইছেন।’
আদিদ গম্ভীর গলায় বললো,
‘উনাদের আগে আমার কেবিনে পাঠান।’
‘ঠিক আছে, স্যার।’
কিছুক্ষণ পর আদিদের কেবিনে এক জন মধ্যবয়স্ক পুরুষ আর এক জন মহিলা ঢুকল। তারা কোনরূপ অনুমতি না নিয়েই সরাসরি আদিদের ডেস্কের সামনে এসে বললো,
‘কই, আমাদের মেয়ে কই? আপনি’ই কি আমাদের কল দিয়েছিলেন?’
আদিদ বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। শান্ত কন্ঠে বললো,
‘জ্বি। আপনারা পেশেন্টের কী হোন?’
‘মামা, মামি।’
কথা’টা শোনে আদিদ তাদের আপাদমস্তক একবার পরখ করলো। তারপর বললো,
‘চলুন আমার সাথে।’
আদিদ বেরিয়ে একশো তিন নাম্বার রুমে গেল। পেছন পেছন উনারা দুজনও গেল। কেবিনের ভেতরের নার্স বললো,
‘স্যার, পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।’
‘ঠিক আছে, আপনি যান আমি দেখছি।’
আদিদ মেয়েটির কাছে গিয়ে তার পালস্ চেক করতে হাত’টা স্পর্শ করতেই মেয়েটি মিট মিট করে তাকানোর চেষ্টা করলো। চোখের সামনে সবকিছু ঘোলা লাগছে তার। মাথাটা ভীষণ ভার লাগছে। আদিদ জিগ্যেস করলো,
‘ঠিক আছেন আপনি?’
মেয়েটা জবাব না দিয়ে চেয়ে রইল। পেছন থেকে তার মামি চেঁচিয়ে উঠে বললো,
‘এই মাইয়া, ঢং করতাছোস কেন? মুখ দিয়া কি কথা বের হয় না?’
আদিদ ব্রু কুঁচকে মহিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আস্তে কথা বলুন, এটা হসপিটাল। আর উনি অসুস্থ, তাই হয়তো কিছু বলতে পারছেন না।’
মহিলা’টা কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার স্বামী তাকে ইশারা দিয়ে থামিয়ে দিলেন। তারপর তিনি হাসি হাসি মুখে বেডে শোয়ানো মেয়েটার কাছে গেলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
‘মা, এখন সুস্থ আছিস তো? তোর জন্য আমরা কত চিন্তা করেছি তুই জানিস? এইভাবে কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়? একবার তো আমাদের কথাটা তোর ভাবা উচিত ছিল। শুধু শুধু এত বড়ো একটা বিপদ ডেকে আনলি। একটা কথাও তুই আমাদের শুনিস না।’
“পদ্ম” নামের মেয়েটা তার মামার দিকে অনেকক্ষণ পলকহীন চোখে চেয়ে রইল। তারপর সে ঠোঁটগুলো হালকা ফাঁক করে একটু বাতাস বের করে আস্তে করে বললো,
‘কে আপনি? আর আমা-আমার কী হয়েছে?’
মেয়েটার কথা শুনে উপস্থিত সবাই ভীষণ অবাক হলো। আদিদ ব্রু কুঁচকে ফেলল। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ তার। সে পদ্মকে বললো,
‘উনি আপনার মামা হোন। আপনি কি উনাকে চিনতে পারছেন না?’
পদ্ম অস্থির হয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘না।’
আশ্চর্য! মেয়েটা কপালে ব্যাথা পেয়েছে। তার এফেক্ট কোনোক্রমেই মস্তিষ্কে পড়েনি সেটা নৈরিথ জানে। তবে মেয়েটা এমন ব্যবহার করছে কেন?
পদ্ম মেয়েটা তখন কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
‘আ-আমি কাউকে চিনতে পারছি না। আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না। কী হয়েছে আমার? আমি এখানে কেন?’
‘আপনি অস্থির হবেন না। আপনার ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল তাই আপনি এখানে। রেস্ট নিন কিছুক্ষণ, আস্তে আস্তে সব মনে পড়বে।’
পদ্ম’র মামি তখন ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে উঠলেন,
‘আরে, মাইয়ার সব মনে আছে। আমাদের দেইখা ঢং করতেছে। এই মাইয়া, তুই কী ভাবছিস তোর এসব নাটক আমরা বুঝি না। কানের নিচে একটা দিলে পরপরাইয়া সব মনে পইড়া যাইবো।’
‘আহ, থামুন। আমার পেশেন্টের সাথে ভদ্র ভাবে কথা বলুন। উনি এখন অসুস্থ, তাই এমন হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনারা বাইরে গিয়ে বসুন। আমি উনার সাথে কথা বলছি।’
পদ্ম’র মামা মামি তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে গেল। উনারা বেরিয়ে যেতেই আদিদ পদ্মকে জিগ্যেস করলো,
‘আপনার কি সত্যিই কিছু মনে পড়ছে না?’
পদ্ম’র চোখ দুটো ভিজে উঠল। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে সে আদিদের দিকে তাকাল। কিছু বলতে চাইছে সে। কিন্তু পারছে না, কথাগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে। নিশ্বাস ফেলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে তার। তার উপর আবার মাথাটাও যন্ত্রণা করছে ভীষণ। সে চোখ বুজে ঘনঘন কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে বললো,
‘আমি মিথ্যে বলেছি, ডাক্তারবাবু।’
চলবে..?
#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।২।
‘আপনি মিথ্যে কেন বললেন?’
পদ্ম ঢোক গিলল। বললো,
‘আ-আমি উনাদের চিনতে চাই না। আমি চাই না ঐ মানুষগুলোর কাছে আবার ফিরে যেতে, চাই না আমি। প্লীজ ডাক্তারবাবু, আমাকে উনাদের কাছ থেকে বাঁচান। প্লীজ, আমায় সাহায্য করুন।’
“ডাক্তারবাবু” সম্বোধন’টা শুনতেই আদিদের বুকের ভেতরটা হঠাৎ যেন কেমন করে উঠল। অনেক দিন পর সে আবার “ডাক্তারবাবু” নাম’টা শুনল। মস্তিষ্কে তখন ভেসে উঠল কিছু সুন্দর পুরোনো স্মৃতি। বুকের বা পাশ’টাই তীব্র ব্যথা অনুভব করলো সে। আদিদ নিজেকে সামলে নিল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘কী সাহায্য চান আপনি? আর কেনই বা আপনি মিথ্যে বলেছেন?’
‘ডাক্তারবাবু, আমি আমার মামা মামির কাছে যেতে চাই না। উনারা খুব খারাপ, আমার উপর খুব অত্যাচার করেন। সেই যবে থেকে আমার মা বাবা মারা গিয়েছে ঠিক তখন থেকেই। কখনো উনাদের থেকে আমি এইটুকুও ভালোবাসাও পাইনি। আর..আর এখন উনারা চাইছেন এক মধ্যবয়স্ক লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দিতে। ঐ লোকটাও ভালো না। আমাকে প্রথম দিন দেখতে এসেই আমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিল। আমি ঐ লোকটাকে বিয়ে করবো না ডাক্তারবাবু। প্লীজ, আমাকে একটু সাহায্য করুন। দয়া করে আমাকে কোনো অনাথ আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করে দিন। আমি অনাথ আশ্রমে চলে যাবো। আমি ঐ মানুষগুলোর সাথে থাকতে চাই না।’
পদ্ম’র গাল গড়িয়ে উষ্ণ জল পড়ছে। আদিদ বিস্মিত চোখে চেয়ে আছে। তার এখন কী করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারছে না। অনেকক্ষণ ভেবে সে বললো,
‘এটা তো হয় না। আপনার মামা মামি আপনার গার্ডিয়ান, উনাদের অনুমতি না নিয়ে কী করে আমি আপনাকে কোনো অনাথ আশ্রমে নিয়ে যাবো। চাইলেই তো আর সবকিছু করা যায় না। সবকিছুর’ই একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়মের বাইরে আমি কিছু করতে পারবো না। সেই অধিকার আমার নেই। তবে আপনি যদি চান তাহলে আমি পুলিশের সাহায্য নিতে পারি।’
‘লাভ নেই, আমি গিয়েছিলাম পুলিশের কাছে। আমার মামা মামি তাদের উল্টো বুঝিয়েছে, উনারাও আমাকে তেমন কোনো সাহায্য করতে পারেননি। কিন্তু তার ফল হয়েছিল ভয়াবহ। মামি আমাকে খুব মারে। মামা যা নয় তা বলে অপমান করে। তারপর থেকে আর সাহস হয়নি পুলিশের কাছে যাওয়ার।’
আদিদ নরম সুরে বলে,
‘তবে আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব না। আপনি রেস্ট নিন। আমি নার্সকে পাঠাচ্ছি।’
‘ডাক্তারবাবু!’
পদ্ম’র কন্ঠস্বর আটকে আসে। এত যন্ত্রণা তার আগে কখনো হয়নি। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যথায়। আদিদ ঘুরে তাকায়। পদ্ম’র অক্ষি কোণে টলমল করা জল দেখে আদিদের ও মায়া হয়। তবে তারও তো কিছু করার নেই। ডক্টর হিসেবে পেশেন্টকে সুস্থ করা ছাড়া আর কী দায়িত্ব থাকতে পারে তার প্রতি। কিন্তু মেয়েটার জন্য কিছু করতে পারলে হয়তো তার ভালো লাগতো। কিন্তু..
‘কিছু বলবেন?’
‘একটা লাস্ট অনুরোধ। এইটুকু অনন্ত আমার জন্য করবেন প্লীজ। বাইরে আমার মামা মামিকে গিয়ে বলবেন সত্যি সত্যিই আমার কিছু মনে পড়ছে না। আমি সবকিছু ভুলে গিয়েছি। কিচ্ছু মনে নেই আমার, কারো কথা মনে নেই। প্লীজ, ডাক্তারবাবু এইটুকু আমার জন্য করুন। অনুরোধ করছি আমি আপনাকে, প্লীজ।’
আদিদ খানিক ভেবে বললো,
‘ঠিক আছে।’
আদিদ কেবিন থেকে বের হতেই পদ্ম’র মামা মামি তাকে ঘিরে ধরলো। মামি কর্কশ গলায় বললো,
‘মাইয়ার কী হইছে? ও কী আসলেই সব ভুইলা গেছে? নাকি সব নাটক?’
আদিদ শান্ত গলায় বললো,
‘উনি মিথ্যে বলছেন না। মাথায় আঘাত পাওয়ার জন্য এমন হচ্ছে। চিন্তা করবেন না খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে। কিছুদিন উনাকে রেস্টে রাখলেই হবে।’
আদিদের কথা যেন মামির পছন্দ হলো না। তিনি চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলেন। আদিদ তাদের পাশ কাটিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেল। এই এক পেশার খাতিরে কত ধরনের মানুষ যে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। আর এইসব কিছুর পর তার এখন একটাই কথা মনে হয়, মানুষের চেয়ে বিচিত্র আর ভয়ানক প্রাণী আর একটাও হয় না।
পদ্ম কাঁদছে। তার এই একুশ বছরের জীবনে মা বাবা যাওয়ার পর এমন একটা দিনও যায়নি যেদিন সে একটু প্রাণ ভরে হেসেছে। সে হয়তো ভুলেই গিয়েছে লাস্ট সে কবে একটু আনন্দ করেছিল। প্রত্যেকটা মুহূর্ত এখন তার মৃত্যু যন্ত্রণার মতো কাটে। বার বার কেবল মনে হয় মা বাবা কেন তাকে একা এই পাষাণ দুনিয়ায় রেখে চলে গেল। তাকে কি সাথে নিয়ে যেতে পারলো না। মা বাবা যদি তাদের সাথে তাকেও নিয়ে যেত তাহলে কি আর তাকে এত কষ্ট পেতে হতো? হতো না। সে ভালো থাকতে পারতো। সুখে থাকতে পারতো। এইভাবে তাকে কাঁদতে হতো না।
পদ্ম’র খুব মাথা ধরায় সে চোখ বুজল। তখনই কেউ তাকে এক ঝটকায় শোয়া থেকে টেনে তুলল। পদ্ম’র আঁতকে উঠল। চোখ খুলে মামির মুখটা দেখে বুক কেঁপে উঠল যেন তার। মামি তার ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
‘তোর আমাদের কথা মনে পড়তেছে তাই না? কেন রে কেন মনে পড়তেছে না? এত দিন যে তোকে এত টাকা খরচ কইরা খাওয়াইয়া পরাইয়া বড়ো করলাম সেই সব তুই ভুইলা গেলি। না, ভুললে তো চলবো না। আমাদের কষ্টের ফল তো তোকে দিতে হইব। ঐ সুলাইমানরে বিয়ে কইরা তোর আমাদের ঋণ মিটাইতে হইব। এসব ভুইলা যাওয়ার নাটক বন্ধ কর। কালই আমাদের সাথে বাসায় যাইবি। তারপর ঐ সুলাইমানরে বিয়ে করবি। আর যদি কোনো নাটক করছিস, একেবারে মেরে তোর ঐ মরা বাপ মা’র কাছে পাঠাই দিমু।’
পদ্ম ভয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। তার মাথা ঘুরাচ্ছে ভীষণ। চোখের সামনে সবকিছু যেন ঝাপসা দেখছে। সে মৃদু গলায় বললো,
‘হাতটা ছাড়ুন, ব্যথা লাগছে।’
মামি তার কথা শুনল না, উল্টো আরো জোরে চেপে ধরলো। পদ্ম তখন গোঙ্গিয়ে উঠল। কেবিনে তখন একটা নার্স ঢুকে এসব দেখে সে জোরে বলে উঠল,
‘কী করছেন কী? হাত ছাড়ুন উনার। উনি অসুস্থ, উনাকে রেস্ট নিতে দিন।’
মামি চেতে উঠে বললো,
‘আমাদের মেয়ের সাথে আমরা যা খুশি তাই করমু। আপনার কী তাতে?’
‘আরে অদ্ভুত! উনি ব্যাথা পাচ্ছেন, দেখছেন না? ছাড়ুন আপনি উনাকে। নয়তো আমি স্যারকে ডাকবো।’
স্যারের কথা শুনে মামি পদ্ম’র হাতটা ছেড়ে দিল। তবে নাক মুখ ফুলিয়ে বললো,
‘ঐসব স্যার টারের ভয় দেখাইয়া লাভ নাই। আমরা ঐসব দুই টাকার ডাক্তাররে ভয় পাই না বুঝছেন। তাড়াতাড়ি মেয়েরে সুস্থ করেন, কালকে যেন আমরা ওরে বাড়ি নিয়া যাইতে পারি।’
নার্সের ভীষণ রাগ হলো। এত অভদ্র কেন মহিলা’টা। ইচ্ছে করছে দু চার কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু এটা হসপিটাল আর সে ডিউটিতে আছে বলে আর কথা বাড়াল না। শান্ত কন্ঠে বললো,
‘স্যারের অনুমতি ছাড়া এখান থেকে একটা পেশেন্টকেও রিলেজ দেওয়া হয় না।’
মামি ফোঁস ফোঁস করতে তার স্বামীকে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়ে বললো,
‘যাও ঐ ডাক্তাররে বইলা আসো আমরা যে কালকে ওরে নিয়া যামু।’
‘আরে কালকের অনুমতি দিবে না বোধ হয়। অন্তত দুই দিন থাকতেই হবে। তার উপর ও আবার সবকিছু ভুলে গেছে। ওকে এই অবস্থাতে ডাক্তার ছাড়বে বলে তো মনে হয় না। আর তাছাড়া..’
‘তুমি না বড্ড বেশি বুঝো। তোমার ভাগ্নী এখানে পইড়া থাকলে তার চিকিৎসার দায় ভার কে নিবে? নিবা তুমি? এত টাকা নাই আমাদের। চুপচাপ গিয়া ডাক্তাররে বলো, আমরা কালকেই ওরে বাসায় নিয়া যামু।’
মামা বিরক্ত হয়ে বললো,
‘ঠিক আছে, বলছি।’
মামা আদিদের কেবিনে গিয়ে দেখলেন কেবিনে কেউ নেই। তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেন। কিন্তু তাও ডাক্তারের কোনো হদিস না পেয়ে তিনি আবার তার বউয়ের কাছে ফিরে গিয়ে বললেন,
‘ডাক্তার তো কেবিনে নেই।’
মামি ব্রু কুঁচকে ফেললেন। বললেন,
‘উফফ, আচ্ছা যাকগে কালকেই এসে একেবারে বইলা নিয়া যামু। এখন চলো বাসায় যাই। আমার ছুটকি দুইটা একা বাসায় ভয় পাইতেছে মনে হয়।’
‘আচ্ছা, চলো।’
আদিদ রিসিপশনে গিয়েছিল। পদ্ম’র যার গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট হয়েছিল তাকে সে চলে যেতে বলেছে। তবে সেই লোকটা ভালো ছিল, যাওয়ার আগে পদ্ম’র কাছে গিয়ে তাকে আর এমন করতে বারণ করেছেন। পদ্মও তখন উনার কাছে ক্ষমা চায়। ওর জন্য অযথা একটা মানুষকে এইভাবে পেরাশানিতে পড়তে হয়েছে ভেবে তার তখন খুব খারাপ লাগছিল।
আদিদ আবার ফিরে এসে খোঁজ নিয়ে দেখল পদ্ম’র মামা মামি চলে গিয়েছেন। কিন্তু এইদিকে পদ্মকে যে একা থাকতে হবে সেটা তারা একবারও ভাবেননি। ওর ঔষধের প্রয়োজন, খাবারের প্রয়োজন, কাছের মানুষদের যত্নের প্রয়োজন এই মানুষগুলো সেটা বুঝলো না। কী নির্দ্বিধায় ওকে একা ফেলে চলে গেল। মানুষ এতটা নিষ্ঠুর কী করে হয়?
আদিদ পদ্ম’র কেবিনে গিয়ে দেখল সে চোখ বুজে আছে। সে নার্সকে ডেকে বললো,
‘উনাকে খাবার দিয়ে ঔষধগুলো দিয়ে দিন। উনার বাড়ির লোকেরা চলে গিয়েছেন।’
কথাটা পদ্ম’র কানে যেতেই সে যেন প্রাণ ফিরে পেল। অসুস্থ গলায় বললো,
‘ডাক্তারবাবু, কাল কি আমি চলে যেতে পারবো?’
‘কোথায় যাবেন আপনি?’
চলবে..