প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই পর্ব-০৩

0
340

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-০৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

দরজা খুলে প্রিয়াঞ্জনা দেখে সুমনা ভাবী দাঁড়িয়ে। আকাশে তখন আকস্মিক একটা বজ্রপাত হয়। চমকে উঠে প্রিয়াঞ্জনা।
“শাহবাজ ভাইকে বাবা ডাকছেন।”
“উনি তো খাচ্ছেন ভাবী।”
“খাওয়া শেষ হলে ভাইয়াকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসো। তোমার বাবা-ভাই কথা বলবেন।”

সুমনা চলে যায়। প্রিয়াঞ্জনা পিছন ফিরে চায়। শাহবাজের খাওয়া শেষ। হাত ধুঁয়ে এসে বলে,
“চলো”

কি বলবে বাবা-ভাইয়া! প্রিয়াঞ্জনার মন কু ডাকছে। বের হওয়ার আগে নিজের শাহ্ কে থামায় প্রিয়াঞ্জনা। শাহবাজের ডানহাত নিজের মাথায় রেখে বলে,
“আপনি কসম করুন শাহ্। কখনো আমাকে ছেড়ে যাবেন না।”

চোখে চোখ রাখে শাহবাজ। দৃঢ় কন্ঠে বলে,
“কখনো না প্রিয়াঞ্জনা। যত ঝড় তুফান আসুক না কেন তোমার শাহ্ কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবেনা। তুমি কেবল বিশ্বাস রেখো আমার উপর।”

প্রিয়াঞ্জনা কিছু বলার আগেই সুমনা ভাবী আবার ডাক দিলেন। অর্ধাঙ্গী আর বলতে পারলোনা সে তার শাহ্ কে অনেক অনেক ভরসা করে। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছেন প্রবীর। প্রীতমও পাশে বসা। জোহরা নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। শাহবাজ কে বসতে বলেন প্রবীর। শাহবাজ সোফায় বসে। প্রিয়াঞ্জনা দাঁড়িয়ে আছে ডাইনিং টেবিলের পাশটায়।
“প্রিয়া”
“জ্বি, বাবা।”
“ঘরে যাও।”
“কেন বাবা? আমিও শুনতে চাই আপনাদের কথা।”
“বেয়াদব হইতাছো দিনদিন। বিয়ে করছো নিজের পছন্দে। সংসার করছো নিজের মতো। তাই বইলা কি আদব-কায়দা সব ভুইলা গেছো? আমরা যেই আদব-কায়দা শিখাই দিছিলাম তোমার স্বামী মনে হয় তা ধইরা রাখতে পারে নাই।”
“বাবা আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? নিজের স্বামীর ভালো মন্দ দেখার অধিকার কি আমার নাই?”
“বউমা এই ফাজিলরে ঘরে নিয়া যাও তো মা। আমার হাতে চড় খাইবো মাইয়াটায়।”

শাহবাজ হতভম্ব হয়ে বসে আছে। সুমনা এগিয়ে আসে প্রিয়াঞ্জনার কাছে।
“ঘরে চলো প্রিয়া।”
“না, ভাবী। আমিও শুনতে চাই বাবা কি বলবেন শাহ্ কে।”

“প্রিয়া!”

প্রীতম ধমকে উঠে। সুমনা বারবার আকুতি করে বলে,’ঘরে চলো প্রিয়া।’
“না, ভাবী।”

তখনই জোহরা ছুটে আসেন। চুলের মুঠিতে ধরে আরেকটা চড় বসিয়ে দেন প্রিয়াঞ্জনার গালে। শাহবাজ দাঁড়িয়ে যায়। যেই মেয়েকে ছোট বাচ্চার মতো আগলে রেখেছিলো সে। যার সামান্য হাত
কাঁ ট লেও ছুটে যেতো হসপিটালে। তার গাঁয়ে আঘাত যেন তার কলিজায় লাগে। হাত মুঠো হয়ে আসে তার। প্রিয়াঞ্জনা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। জোহরা বেগমের মুখে যা আসছে তাই তিনি বলে চলেছেন।
“অনেক হয়েছে মা। আপনি আমার সামনে আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে পারেন না।”

শাহবাজের কন্ঠে তেজ প্রখর। জোহরা আরো খেঁপে যান। সুমনা একপ্রকার টেনেই প্রিয়াঞ্জনাকে ঘরে নিয়ে যায়। এমন সময় প্রীতি, প্রাপ্তি স্কুল থেকে ফিরে আসে। তাদের ঘরে যেতে বলে প্রীতম।
জোহরা উচ্চকন্ঠে বলে চলেছেন,
“তোমার মুখে আমাকে খবরদার মা ডাকবা না। একটা দুশ্চরিত্র, লম্পটের সন্তান আর কেমনই হইবো। অন্যের স্ত্রী ভাগায় নিয়ে বিয়া করছে তোমার বাপ। আমাকে তুমি স্ত্রী দেখাতে আসছো? আমার মেয়েরে আমি তোমার ঘরে আর দিবোনা।”

প্রীতমকে ইশারা করেন প্রবীর। জোহরার হাই ব্ল্যাড প্রেশার। বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করলে শরীর খারাপ করবে। প্রীতম মাকে বলে,
“আম্মা আপনে শান্ত হোন। ঘরে যান। আমরা কথা বলতেছি তো।”

“এই এক মাইয়া মাইয়া কইরা আমার জীবন গেলো। কালনাগিনী জন্ম দিছি আমি। মায়ের দুঃখ বুঝলোনা। এক লম্পটের ঘরের বাটপারের নেশায় পড়ছে। বাপ-মা চিনলো না।”

জোহরাকে ঘরে দিয়ে আসে প্রীতম। সেই সাথে দরজাও বাইরে থেকে আটকে দেয়। শাহবাজের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে প্রখর। মানুষের জীবনে কিছু কিছু সময় আসে। সে বুঝতে পারে তার সাথে অন্যায় হচ্ছে। তার প্রিয়জনদের সাথে অন্যায় হচ্ছে। তবে তার করার কিছুই থাকেনা। আঘাতে আঘাতে ভিতরটা জর্জরিত হয়ে গেলেও মানুষকে ভান করতে হয় নির্জীব, জড় বস্তুর মতো। শাহবাজের সেই কঠিন সময়টাই চলছে। সে বরাবরই শান্ত মাথার মানুষ। কঠিন থেকে কঠিন পরিস্থিতিও সে শান্ত ভাবে সামলেছে। আজ সব অগোছালো লাগছে। প্রিয় মানুষটির গাঁয়ে আঘাত হতে দেখে রাগে ভিতরটা ফুঁসে উঠছে বারবার। উপর দিয়ে সে শান্ত, হতভম্ব। সে জানে প্রতিক্রিয়া করে কোনো লাভ কি। পরিস্থিতি তার অনুকূলে নেই। এলাকার দুজন মুরুব্বি এসে পড়েন এর মাঝেই। শাহবাজ চুপচাপ মাথা নিচু করে সোফায় বসে। প্রবীর জিজ্ঞেসা করেন,
“তুমি নাকি কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছো?”

শাহবাজ মাথা তুলে চায় শ্বশুরের পানে। এই শ্বশুরের বাইপাস সার্জারির সময় লাখেরও উপরে টাকা খরচ করেছে সে। শান্ত কন্ঠে উত্তর করে শাহবাজ,
“যদি কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎই করতাম তাহলে কি আমার বউয়ের গহনা, ঢাকার ফ্ল্যাট সব জমিজমা বিক্রি করে মানুষের টাকা পরিশোধ করতাম?”

প্রীতম বলে,
“এতশত বুঝিনা। আপনার বাবুর হাঁটের দুই দোকান, ফ্যাক্টরি সব নাকি ব্যাংকে জমা দিয়ে কোটি কোটি টাকা লোন নিছেন? আবার শুনলাম মানুষের কাছ থেকেও কোটি কোটি টাকা ধার নিয়ে শেয়ার বাজারে দিছেন। এখন লস খাওয়ায় আপনার চাচারা ভারত ভাগছে আপনিও নাকি ভাগবেন?”
“তুমি কিছুটা ভুল শুনছো। টাকা আমি নেই নাই। নিয়েছে আমার চাচারা। আমি এসবের কিছুই জানিনা।”
“ধরা পড়লে সবাই এসবই বলে।”
“মুখ সামলে কথা বলো প্রীতম। তোমার বিপদে কিন্তু আমাকে পাশে পেয়েছিলে।”
“খোঁটা দিচ্ছেন?”
“ধরে নাও তাই।”

আমানুল্লাহ সাহেব নামের এক মুরুব্বি গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
“তুমি কি করছো না করছো হেইডা আমাগো দেহার ব্যাপার না। আমাগো মাইয়ারে আর এসবে জড়াইতে চাইনা। সোজা কতা আমাগো মাইয়ারে তালাক দিয়া দাও। তোমার মতো চোর, বাটপারের কাছে তো আর মাইয়া রাখবার পারুম না।”
প্রবীরও তাল দিয়ে বলেন,
“আমারও একই মত।”

এবার যেন শাহবাজের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। ফাইজলামি পেয়েছে এরা। এত সহজ সবকিছু!
“আপনার কথায় তো আমি আমার বউকে ছাড়বোনা চাচা।”

বোরহান নামের আরেক মুরুব্বি প্রবীরকে বলেন,
“আপনার মেয়ের জামাই তো আস্ত বেতমিজ।”

প্রীতম অনেকটা হুমকি মাখায় গলায় বলে,
“আমার বোনকে ডিভোর্স দিয়ে দেন। আপনার জীবনের কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। আমরা চাইনা আপনার এমন জীবনে আমাদের মেয়ে থাকুক।”

শাহবাজ কোনো উত্তর না দিয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। জীবনে সে অকৃতজ্ঞ দেখেছে। তবে এদের মতো কৃতঘ্ন দেখেনি। বাইরে তখন বেশ ঝড় শুরু হয়েছে। বাতাস বইছে প্রচন্ড।

এদিকে প্রিয়াঞ্জনাকে একপ্রকার ঘরে আটকে রেখেছে সুমনা।
“ভাবী, আপনি এমন নিষ্ঠুর কি করে হলেন!”

ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে প্রিয়াঞ্জনা। বাইরে কি কথা হচ্ছে সে জানেনা। মানুষটা কি আবার রাগ করে এই ঝড়ের মাঝেই বাইরে বেরিয়ে পড়েছে কিনা!
প্রিয়াঞ্জনা নিজের ইন্টারের পড়াশোনা শেষ করেছে ঢাকা হলিক্রস কলেজ থেকে। মা শর্ত দিয়েছিলেন যদি ঢাকা মেডিকেলে চান্স না পায় তাহলে বিয়ে দিয়ে দিবে তার। অনেক পরিশ্রম করেও কোথাও চান্স পায়নি প্রিয়াঞ্জনা। জোহরা এক কথার মানুষ। তিনি প্রিয়াঞ্জনাকে বাসায় নিয়ে আসলেন। শুরু হলো পাত্র খোঁজা। তখন শাহবাজের সাথে তার আড়াই বছরের প্রেমের সম্পর্ক। ভয়ে ভয়ে ভাইয়াকে বলেছিলো। সবাই অবশ্য মেনেও নিয়েছিলো। প্রতিষ্ঠিত ছেলে। পড়াশোনাও ভালো জায়গা থেকে করেছে। কোনো বাঁধাই ছিলোনা। তবে বিপত্তি ঘটলো এক জায়গায়। শাহবাজের খোঁজ খবর নিতে গিয়ে জানা গেলো তার বাবা তিন বিয়ে করেছেন। তাও শাহবাজের তৃতীয় সৎ মা ছিলেন জোহরা বেগমের বড় ভাইয়ের বউ। বউ পালিয়ে যাওয়ায় আত্মহ’ত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন জোহরার ভাই। এরপর জোহরা বেঁকে বসলেন। এই ছেলের সাথে কোনো ক্রমেই মেয়ের বিয়ে দিবেন না। জোহরার কথার উপর প্রবীর কিংবা প্রীতম কেউই কথা বলেনা। হলোও তাই। বিয়ে ভেঙে দিলেন তারা। প্রিয়াঞ্জনা চেয়েছিলো বাসা থেকে পালিয়ে যেতে তবে শাহবাজ কখনো চোরের মতো ভালোবাসার মানুষকে পেতে চায়নি। প্রিয়াঞ্জনার কান্না, অভুক্ত থাকা কোনোকিছুই জোহরাকে টলাতে পারেনি। শেষে আত্মহ’ত্যার পথ বেছে নেয় প্রিয়াঞ্জনা। গলায় প্রায় দড়ি বেঁধে ফেলেছিলো। তখনই সুমনা বুঝে ফেলে। দরজা ভেঙে উদ্ধার করা হয় তাকে। জোহরা সে রাতেই শাহবাজের সাথে প্রিয়াঞ্জনার বিয়ে দেন। বড়ই জটিল পরিস্থিতিতে আছে শাহবাজ আর প্রিয়াঞ্জনার সম্পর্ক। প্রিয়াঞ্জনা কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে।

শাহবাজ অনেকটুকু পথ হেঁটে এসেছে। চায়ের দোকানের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চিতে বসে সে। দোকান বন্ধ। সে কাকভেজা প্রায়। দু’হাত বেঞ্চে রেখে মাথা নিচু করে বসে থাকে অনেকক্ষণ। অতঃপর মাথা তুলে অন্ধকার আকাশপানে চায়।
“আমাকে এই শাস্তিটা দিবেন না আল্লাহ। আমি আমার প্রিয় মানুষটার কাছে পরপুরুষ হতে চাইনা আল্লাহ।”

চিৎকার করে কাঁদে শাহবাজ। চোখের জলে বৃষ্টির জলে মিশে একাকার। মনে পড়ে সেই প্রথম দিনের কথা। সেদিনও তো এমনই ঝড় ছিলো!

(চলবে)…