প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই পর্ব-০৪

0
299

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-০৪
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

ভোরবেলা। আকাশের অবস্থা তেমন ভালো না। কেমন নিস্তব্ধতা চারপাশে। ঝড় শুরু হতে পারে যেকোনো সময়। নরসিংদী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে বাস প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। প্রিয়াঞ্জনাদের আগামীকাল থেকেই কলেজে ক্লাস শুরু হবে। বাসার পরিস্থিতি খুব বাজে। ভাইয়া বাবা-মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে না করে নিজের প্রেমিকা কে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে। জোহরা তিনদিন হসপিটালে ভর্তি ছিলেন। প্রাপ্তি, প্রীতি তো ছোট। এমতাবস্থায় বাবা আর তার সাথে ঢাকা যেতে পারেন নি। ভোরে এসে বাসে উঠিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। প্রিয়াঞ্জনা এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। তার বয়সী মেয়েরা তো বাচ্চার মাও হয়ে গিয়েছে। আর প্রিয়াঞ্জনা নরসিংদী থেকে ঢাকা যেতে পারবেনা! বাবার শেষ বলা কথাগুলো ছিলো এমনই। হাতে হাজার টাকার দুটো নোটও গুঁজে দিয়ে গিয়েছেন। প্রিয়াঞ্জনার পাশের সিটটা খালি। প্রিয়াঞ্জনা জানালার পাশে উদাস হয়ে বসে আছে। বাবা যে রিকশায় বসে ছিলেন সেটি চলে গিয়েছে সে কখন! টিপটিপ বরষার আনাগোনা শুরু হচ্ছে। বাসে মানুষ আছে বেশ। তবে প্রিয়াঞ্জনার পাশে কেউ নেই। বাস ছুটে চলছে। বরষার প্রকোপ বাড়ায় জানালা আটকে দেয় প্রিয়াঞ্জনা। পাঁচদোনা মোড়ে বাস থামে। দুজন যাত্রী উঠেন। বৃষ্টিতে প্রায় ভিজেই গিয়েছেন দুজনে। প্রিয়াঞ্জনা ততক্ষণে বই পড়ায় মন দিয়েছে। দূর যাত্রায় ঘুম আসেনা তার। তাই সে গল্পের বই পড়ে। তখনই পাশে বসে একজন। ভিজেই গিয়েছেন প্রায়। তার ভেজা হাত প্রিয়াঞ্জনার হাতে লাগে। প্রিয়াঞ্জনা একটু দূরে সরে বসে।
“সরি, কিছু মনে করবেন না। আমার জন্য আপনার সমস্যা হচ্ছে।”

অনেকটা অপরাধী গলায় বলে উঠে শাহবাজ। হুট করে বৃষ্টি শুরু হলো। সে ছাতাও আনেনি। যাত্রী ছাউনি থেকে বাসে উঠতে উঠতে পুরো কাকভেজা হয়ে গেলো। প্রিয়াঞ্জনা বই থেকে চোখ তুলে চায় পাশের সিটে বসা যাত্রীর পানে। চমৎকার হেসে বলে,
“না, না। সমস্যা হচ্ছেনা।”

মেয়েটা বেশ মিষ্টি দেখতে। বয়সও অল্প মনে হয়। ভাবতে ভাবতেই হাঁচি শুরু হয়ে যায় শাহবাজের। প্রিয়াঞ্জনা ব্যাগ খুলে টিস্যু বের করে দেয়। শাহবাজ নাক মুছতে মুছতে বলে,
“ধন্যবাদ।”

প্রিয়াঞ্জনা হালকা হেসে বই পড়ায় মন দেয়। শাহবাজ কিছু সময় পর জিজ্ঞেস করে,
“আপনার বাসা কি নরসিংদীতে?”

শাহবাজ কখনো অপরিচিত কাউকে অযাচিত প্রশ্ন করেনা। তবে আজ কেন যেন মেয়েটার সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা সুন্দর বলে নয় মেয়েটার কন্ঠ বেশ রিনরিনে। কেবল শুনতেই ইচ্ছে করে। শাহবাজ নিজে অবাক হয়। কারণ জীবনে এমন কখনো হয়নি।

“জ্বি, আমার বাসা নরসিংদী। আগামীকাল থেকে কলেজ খোলা তো তাই আজ ঢাকা যাচ্ছি।”
“কোন কলেজে পড়েন আপনি?”
“হলিক্রসে”
“বাহ্, তাহলে তো বেশ ভালো স্টুডেন্ট? সাইন্সে?”
“হ্যাঁ। আপনার বাসা কি নরসিংদী?”
“হুম। শেখের চড়।”
“ধনীদের শহর।”

হা হা করে হেসে উঠে শাহবাজ। মেয়েটা তো পাকনা বুড়ি।
“এই যে দেখুন তো আপনারা আমাদের আপন মানুষ। আপনারাই যদি এসব বলেন তাহলে অন্য শহরের মানুষ কি বলবে!”
“কথাটা অবশ্য আমার নয়। আমার মায়ের মুখে শুনেছি।”

প্রিয়াঞ্জনা বই বন্ধ করে। ব্যাগ থেকে বাদাম বের করে। বাসা থেকে পলিথিনে করে বাদাম ভেজে এনেছে। আসলে প্রিয়াঞ্জনা সচরাচর কোনো পুরুষের সাথে কথা বলেনা। তবে এই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের লোকটার চেহারায় কেমন যেন মায়া আছে। মা বলেছে কখনো কোনো পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করবিনা। ঘরের পুরুষকেও না। কিন্তু মায়ের কথা প্রিয়াঞ্জনার মানতে ইচ্ছে করছেনা। এতদিন একটা খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ছিলো প্রিয়াঞ্জনার জীবন। আজ মনে হচ্ছে সে খাঁচা ছেড়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। অবাধ স্বাধীনতা।
সন্তানদের ভালো চাইতে গিয়ে বাবা-মা অনেক সময় তাদের খারাপ করে ফেলেন। পড়াশোনা, সীমাবদ্ধ জীবনে সেসকল পরিবারের শিশুরা অনেকটা খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ভিতর ভিতর ছটফট করে। আবার হুট করে স্বাধীন জীবন পেলে তারা হয়ে উঠে উশৃঙ্খল। স্বাধীনতার স্বাদে মত্ত হয়ে তারা বেশ কিছু ভুল করে ফেলে। ভয়ে বাবা-মাকে বলতে পারেনা। হয়তো অপরাধী হয়ে উঠে নয়তো আত্ম হ ত্যার পথ বেছে নেয়। তবে যেসব সন্তানেরা ছোট থেকেই একটি সুন্দর পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। যাদের বাবা-মা বন্ধুর মতো তারা ভুল পথে খুব কমই যায়। প্রিয়াঞ্জনার চোখে এখন স্বাধীনতার রঙ্গিন চশমা।

“বাদাম খাবেন?”
“খাওয়া যায়।”

টুকটাক অনেক গল্পই হয় দুজনের। হুট করেই থেমে যায় সব। বাস এ ক্সি ডেন্ট করেছে। প্রিয়াঞ্জনা জ্ঞান হারায়। শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনাকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যায়। সেই তো শুরু।

হঠাৎ করে একটা বজ্রপাতে ধ্যান ভাঙে শাহবাজের। বেঞ্চিতে বসে বসে নিজেদের প্রথম দেখার কথাগুলো মনে করছিলো সে। ঝড় থেমে গিয়েছে। সে উঠে দাঁড়ায়। শহরে এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। সেখানেই যাবে এখন। চাচারা যে এরকম একটা বিশ্বাসঘাতকতা করবে কস্মিনকালেও ভাবেনি শাহবাজ। সব সম্পত্তি শাহবাজের নামেই ছিলো। এসব কাগজপত্র দিয়ে চাচারা কখন কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে শাহবাজ এখনো হিসাব মিলাতে পারেনা। তার বাবা প্রায়ই বলতেন, “ব্যবসায় খোদার পর কাউ রে বিশ্বাস করন যায়না। এই ব্যবসা হইলো নিজেরই চরম শত্রু। কখনো আসমানে উঠায় আবার কখনো একবারে মাটির মইধ্যে আছাড় দিয়া ফালায়। আশেপাশের মানুষ গুলাই থাকে একেকটা ছদ্মবেশী ডাকাত।” তখন না বুঝতে পারলেও এখন শাহবাজ বাবার কথা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
ব্যাংক না হয় দোকান আর ফ্যাক্টরি নিলামে তুলে নিজেদের টাকা উসুল করে নিবে তবে এই যে লোকজনের কাছ থেকে তার কথা বলে টাকা নেওয়া হয়েছে সেসব কোথ থেকে পরিশোধ করবে শাহবাজ! ইতিমধ্যে ঢাকার ফ্ল্যাট, জমি, জমানো টাকা, প্রিয়াঞ্জনার গহনা বিক্রি করে কিছু টাকা পরিশোধ করেছে সে। কোনো দোষ শাহবাজ করেনি। কিন্তু কেউ তো তার কথা বিশ্বাস করছেনা। যেহেতু চাচারা পালিয়ে গিয়েছে। মানুষজন ভাবছে শাহবাজও পালিয়ে যাবে। টাকা পরিশোধ করা ছাড়া কোনো উপায় তো শাহবাজ পায়নি। প্রতিদিন ঢাকা ফ্ল্যাটে মানুষ আসতো। তারপর সন্ত্রাস নিয়ে আসা শুরু করলো। শাহবাজ তখন কেবল অবাকই হচ্ছিলো। একেকজন বড় বড় ব্যবসায়ী। মামলায় শাহবাজ কখনোই ওদের সাথে পারবেনা। প্রিয়াঞ্জনার জীবনও এখানে জড়িয়ে। নিজের একার জীবন নিয়ে শাহবাজের ভয় নেই। তারা যে প্রিয়াঞ্জনার ক্ষতি করতো! তাই আর একটা জমি বিক্রির আশায় ঘুরছে শাহবাজ। তারা এত এত মানুষ আর সে একলা। মামলা সে যদি করেও তাহলেও তার অনুকূলে কিছু যাবেনা। মানুষজন সোজা খু ন করবে তাকে। তাদের কাছে কাগজ আছে। আর লোকেরা যেভাবে ক্ষেপে আছে সে যদি মামলায় জড়াতে যায় তাহলে তারা প্রিয়াঞ্জনারও ক্ষতি করবে। দেশ ছেড়ে যদি পালিয়ে যেত তাহলে তো সবাই ভেবে নিতো সেও চোর। আর মামলা মানে নিজ হাতে নিজেকে ও নিজের প্রিয় মানুষটাকে খু ন করা। মূল কথা দেশে থাকতে হলে তাকে টাকা ফেরত দিতেই হবে। জটিল। বড়ই জটিল শাহবাজের পরিস্থিতি। একূল ঐকূল দুকূলই নাই। যে সকল প্রভাবশালীগণ একসময় বন্ধু ছিলো তার, তারা কেউই তার বিপদে এগিয়ে আসছেনা। আজ শাহবাজ একা। একদম একা। প্রিয়াঞ্জনা নিজের বাবার বাসায় নিরাপদ থাকবে। শাহবাজের নিজের জীবনেরই নিরাপত্তা নেই। সে কোথায় নিয়ে রাখবে নিজের অর্ধাঙ্গীকে?

শাহবাজের স্কুল কালের বন্ধু রিমন। দরিদ্র ঘরের ছেলে। নরসিংদী শহরে দুইরুমের ছোট বাসা নিয়ে ভাড়া থাকে। ইন্টারে উঠে আর পড়াশোনা করেনি। স্থানীয় এক দোকানে কারেন্ট মিস্ত্রীর কাজ করে। প্রিয়াঞ্জনাকে বাবার বাড়ি রেখে শাহবাজ যখন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছিলো। স্টেশনে বসেছিলো অনেকক্ষণ। তখনই রিমনের সাথে দেখা। যেখানে আপন মানুষেরা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো সেখানে সেই স্কুল কালের এক বন্ধু আশ্রয় দেয় শাহবাজকে। এত বড় মনের মানুষও আজকাল আছে!

দুইদিন যাবত প্রিয়াঞ্জনা আর শাহবাজের যোগাযোগ নেই। বিকেলের দিকে শাহবাজকে ফোন করে প্রিয়াঞ্জনা। শাহবাজ ফোন ধরতেই বলে,
“আমাকে আপনার কাছে নিয়ে চলুন, শাহ্। আমি এই মানসিক চাপ আর সহ্য করতে পারছিনা।”

(চলবে)…