প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই পর্ব-০৬

0
273

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-০৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

বাস ছেড়ে দিয়েছে। ঝড়ো হাওয়া বইছে। আকাশ হয়ে আছে মিশকালো। বরষার তেজও বেশ। সপ্তম সারির সিটে বসে আছে দুই কপোত-কপোতী। সব পিছুটান ছেড়ে। দুঃখ, কষ্টকে একপাশে রেখে তারা দুদিনের জন্য পালিয়ে যাচ্ছে। শাহবাজের কাঁধে প্রিয়াঞ্জনার মাথা রাখা। কখন থেকে বৃষ্টির ছিটকে আসা জলে তার রমণীর হাতের কাছটা ভিজে যাচ্ছে। তার রমণী সেই যে বাইরে তাকিয়ে আছে। জানালা বন্ধও করতে দিচ্ছেনা। শাহবাজ যতবার জানালা বন্ধ করতে গিয়েছে ততবার ডাগর ডাগর আঁখি মেলে মোলায়েম সুরে বলেছে, “খোলা থাকুক না শাহ্।”

এবারে আর রমণরীর কথাকে গুরুত্ব দেয়নি শাহবাজ। বন্ধ করে দিয়েছে জানালা। প্রিয়াঞ্জনা কিছু বলতে চেয়েছিলো তবে তার শাহ্ এর চোখ রাঙানো দেখে কিছু বলেনি। শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনার বামহাত নিজের হাতে তুলে নেয়।
“প্রিয়াঞ্জনা, তুমি ভিষণ নরম মনের মানুষ। তোমাকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। কিছু কথা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনবে।”

প্রিয়াঞ্জনা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেয় শাহবাজের পানে।
“সিলেটে দুদিন থাকার পর আমি জানিনা পরে কি করবো।”
“আমি আর ফিরে যেতে চাইনা শাহ্।”
“আমিও চাইনা প্রিয়াঞ্জনা। তুমি তো আমার জেদ জানো। তোমার পরিবার যা শুরু করেছে তা কি মনুষ্যত্বের মধ্যে পড়ে? আমি জানি তোমার শুনতে খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি একজন এতিম মানুষ। তোমার বাবা-মাকে নিজের ভেবেছিলাম। তারা আমার প্রাণপাখিটাই ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে। আমার আত্মসম্মানে লাগে প্রিয়াঞ্জনা। ভিষণ আত্মসম্মানে লাগে। শত্রুগুলো যদি না থাকতো তাহলে আমি বস্তিতে ছোট ঘর ভাড়া করে হলেও তোমাকে নিয়ে থাকতাম। আমার নিজেকে এতটা অসহায় লাগে! আজ আমার পাশে কেউ নেই। আজ বিজনেসম্যান শাহবাজ চৌধুরী ফতুর।”
“আমি আছি তো শাহ্। সবসময় থাকবো আপনার পাশে।”

প্রিয়াঞ্জনা শাহবাজকে জড়িয়ে ধরে। শাহবাজ অধর ছুঁয়ায় অর্ধাঙ্গীর কপালে। চুপ থাকে দুজনে।
“বাসায় যদি ফিরে যেতে হয় তাহলে একটা কাজ ভুলেও করবেনা।”
“কি কাজ?”
“কখনো না পড়ে কোনো কাগজে সাইন করবেনা। আমি আমার চাচাদের বিশ্বাস করে ঠকেছি। আমার সরলতাকে নিজেদের হাতিয়ার বানিয়ে তারা খুব খারাপ একটা গেম খেলেছে আমার সাথে। আমি এতটা বোকা প্রিয়াঞ্জনা! তারা যা দিতো তাতেই সাইন করে দিতাম। তুমি এই কাজ করবেনা কিন্তু! কাগজ ডিভোর্সের হতে পারে। কাউকে বিশ্বাস করবেনা প্রিয়াঞ্জনা।”
“হুম”

বাস কেবল ভৈরব নদীর পাড় রোড পাড় হয়েছে। আরো বেশ সময় লাগবে সিলেট পৌঁছাতে। বাসস্ট্যান্ডের কাছের এক হোটেল থেকে দুজনেই রুটি ভাজি খেয়েছে। কিছু খাবার কিনে নিয়েছে সাথে। প্রিয়াঞ্জনা দূর যাত্রা পথে টুকটাক এটা সেটা খেতে ভালোবাসে। চার বছরের সংসার। শাহবাজ এতটুকু তো বুঝেই। তবে শাহবাজের অর্ধাঙ্গীর খাবারের কোনো খেয়ালই নেই। তিনি নিশ্চিন্তে শাহবাজের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন। শাহবাজ মন ভরে দেখছে নিজের রমণীকে। কতটা নিশ্চিন্তে, ভরসায় শাহবাজকে আঁকড়ে ধরে আছে প্রিয়াঞ্জনা। আচ্ছা, এমন কোনো মিরাকেল কি হতে পারেনা? আবার সবকিছু হয়ে উঠবে আগের মতন?

শাহবাজ যখন প্রিয়াঞ্জনাকে বিয়ে করে তখন প্রিয়াঞ্জনা কেবল এইচএসসি পাশ করেছে। গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া মেয়েটার কোথাও চান্স হয়নি। তারউপর পরিবারের চাপ। সবমিলিয়ে আত্মহ’ত্যার পথ বেছে নিয়েছিলো প্রিয়াঞ্জনা। এই কথাটা শাহবাজ জানতো না। প্রিয়াঞ্জনা জানায়নি। বিয়ের পর সুমনার কাছ থেকে জেনেছে। শাহবাজ থাকতো বসুন্ধরায় নিজের কিনা ফ্ল্যাটে। প্রতিদিন ব্যবসার কাজে নরসিংদী আসা-যাওয়া করতো। প্রিয়াঞ্জনা বিয়ের পর বলেছিলো আর পড়াশোনা করবেনা। তবে শাহবাজ তা চায়নি। ও সর্বদাই চেয়েছে প্রিয়াঞ্জনা জীবনে অনেক ভালো করুক। এডমিশন পরীক্ষার সময় তো নিজেই ব্যস্ততা দেখাতো। যেন প্রিয়াঞ্জনা পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারে। বিয়ের পর শাহবাজ নিজ উদ্যোগে প্রিয়াঞ্জনাকে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করায়। তাও সাইন্সের কোনো সাবজেক্টে পড়তে রাজি হয়নি মেয়েটা। ইংরেজি সাবজেক্টে ভর্তি হয়। ওর ইচ্ছে ও সংসার করবে। অনেকগুলো বাচ্চা-কাচ্চা হবে।

বাচ্চার কথা মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাহবাজ। কম তো চেষ্টা করেনি দুজনে। তাও সৃষ্টিকর্তা সন্তানের মুখ দেখায়নি। এমনিতে দুজনেই সুস্থ। তাও কিছুতে কিছু হয়নি। এক সময় প্রিয়াঞ্জনা বেশ ভেঙেও পড়েছিলো। শাহাবাজ কেবল চোখে চোখ রেখে বলেছিলো,
“সৃষ্টিকর্তা আমাকে তোমায় দিয়েছে প্রিয়াঞ্জনা। আমার আর কাউকে চাইনা। কেবল তুমিটাই আমার থেকো সারাজীবন।”

শাহবাজ এখন বুঝে। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আজ সে যে পরিস্থিতিতে রয়েছে তাতে কষ্ট পাচ্ছে কেবল দুজন। তাও প্রিয়াঞ্জনাকে কেউ ক্ষীণ আঘাত করে কথা বললেও কলিজায় লাগে শাহবাজের। তৃতীয় যে আসতো সেও তো এখন কষ্ট পেতো। তন্দ্রায় বুজে আসে শাহবাজের দুচোখ। সিটে হেলান দিয়ে নিজেও পাড়ি জমায় ঘুমের দেশে। অর্ধাঙ্গীকে বুকে নিয়ে আজ যেন সকল গ্লানি, ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছে তার।

_________________

সকাল দশটায় জানাজানি হয়ে যায় প্রিয়াঞ্জনা বাড়িতে নেই। আগামীকাল সকালে ফাহিমদের আসার কথা। এমনিতেই দাওয়াত করেছিলেন জোহরা। যদিও মূল উদ্দেশ্য প্রিয়াঞ্জনার সাথে ফাহিমকে দেখা করানো। এখন কি করবেন! সোফায় বসে আছেন শান্ত হয়ে। প্রিয়াঞ্জনার ফোন বন্ধ। ঐ আপদটারও মোবাইল বন্ধ। তিনি যা ভাবছেন সেটাই কি ঠিক? ঐ আপদের হাত থেকে কি নিজের মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না তিনি! কম তো চেষ্টা করেননি। প্রীতম তার পাশেই বসে।
“প্রীতম, সুমনাকে ডাক দে।”
“জ্বী, আম্মা।”

সুমনা রান্না করছে। প্রীতমের ডাক শুনে ড্রয়িং রুমে ছুটে আসে। উড়না দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলে,
“কি, বলো।”

শাশুড়ীকে খেয়াল করেনি প্রথমে। প্রীতম ইশারা করে সেদিকে।
“সুমনা, সত্যি করে বলোতো প্রিয়া তোমাকে জানিয়ে যায়নি?”
“মা, বিশ্বাস করুন প্রিয়া আমাকে কিছু জানায়নি।”
“এই বাড়িতে তো তোমার সাথেই ওর খাতির বেশি। মায়ের চাইতে মাসিরই দরদ বেশি এখন ওর কাছে। তাও কিচ্ছু জানায়নি? ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য সুমনা?”

“তুমি যদি কিছু জানো তাহলে আম্মাকে বলে দাও সুমনা। প্রিয়া কি শাহবাজ ভাইয়ের কাছে গেছে?”

স্বামী-শাশুড়ীর জিজ্ঞেসাবাদে অনেকটা চাপের ভিতরেই পড়ে সুমনা। সে জানে প্রিয়াঞ্জনা সিলেটে গিয়েছে শাহবাজ ভাইয়ের সাথে। রাতেই তাকে বলেছিলো প্রিয়াঞ্জনা। কিন্তু জীবনেও এই কথা ফাঁস করবেনা সুমনা।
“বিশ্বাস করো প্রীতম আমি কিছু জানিনা। আমার সাথে প্রিয়া রাগ করেছিলো। বিগত দুদিন যাবতই কথা বলেনা।”
“আচ্ছা, তুমি যাও।”

প্রীতি চিরকুট নিয়ে আসে ড্রয়িং রুমে।
“মা, আপার বালিশের নিচে এইটা পেয়েছি।”

জোহরা চিরকুট ছিনিয়ে নেয় প্রীতির হাত থেকে। তাতে লেখা, “আমাকে খুঁজাখুঁজি করো না। আমি স্বেচ্ছায় যাচ্ছি। এবং আমার স্বামীর সাথে আমি নিরাপদই থাকবো।”
জোহরা যা ভেবেছিলেন তাই। রাগে ভিতরটা কেঁপে উঠে তার।

সিলেট এসে বাস থামে ঠিক সাড়ে এগারোটায়। বৃষ্টি নেই বাইরে। আকাশও একদম পরিষ্কার। প্রিয়াঞ্জনা আর শাহবাজ হোটেল হিল টাউনে উঠেছে। গতবার তারা বেশ কয়েকটা দর্শনীয় স্থানই ঘুরেছিলো। তাই এবার শাহবাজ নতুন কিছু জায়গা ঘুরবে বলে ভেবে রেখেছে।

হোটেলে উঠে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নেয় দুজনে। সারা রাস্তা ঘুমিয়ে আসলেও বাস থেকে নামার পর শরীর অবশ হয়ে আসছিলো প্রিয়াঞ্জনার। হোটেল ঘরে ঢুকে কোনোমতে ফ্রেশ হয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো আবার। শাহবাজ ডাকেনি। নিজেও অর্ধাঙ্গীকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। প্রায় দুপুরের দিকে প্রিয়াঞ্জনাকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে শাহবাজ। ওর ভিষণ ক্ষুধা লেগেছে।
“প্রিয়াঞ্জনা, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। পানসি তে যাবো।”

পানসি রেস্টুরেন্টের খাবার বেশ পছন্দ করে শাহবাজ। দুপুরের দিকে খেতে বের হয় দুজনে। সিম ভর্তা, মাছ ভর্তা, শুটকি ভর্তা, সাতকরা দিয়ে গরু মাংস, ডাল আর চিকন চালের ভাত। সাতকরা দিয়ে গরু মাংস রান্নাটা ভিষণ ভালোলাগে শাহবাজের। খেতে খেতে একটা মিষ্টি স্মৃতির কথা মনে পড়ে প্রিয়াঞ্জনার।
“শাহ্, আপনার মনে পড়ে আমি যে গতবার সিলেট থেকে গিয়ে সাতকরা দিয়ে গরুর গোশত রান্না করেছিলাম?”
“হুম”

শাহবাজ ভাতের প্লেটের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
“তিতা হয়ে গিয়েছিলো আপনি তাও খেয়েছিলেন। আর বলেছিলেন বেশ ভালো হয়েছে প্রিয়াঞ্জনা। আমি চাইলাম খেতে। আপনি আমাকেও খেতে দিলেন না। আমি মন খারাপ করবো তাই। আপনি এত ভালো কেন শাহ্?”

প্রিয়াঞ্জনার মুখে এক লোকমা ভাত পুরে দিয়ে শাহবাজ বলে,
“তুমি অনেক ভালো তাই।”

খাবার শেষে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় প্রিয়াঞ্জনার কানে কানে শাহবাজ ফিসফিসিয়ে বলে,
“আমি কি আজ তোমাকে একটু আদর করতে পারি প্রিয়াঞ্জনা?”

(চলবে)…