প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই পর্ব-০৭

0
278

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-০৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

শাহবাজের হাতের বন্ধন ছিন্ন করে সামনে চলে যায় প্রিয়াঞ্জনা। শাহবাজ সেদিক পানে তাকিয়ে হাসে। অর্ধাঙ্গীর লজ্জায় রাঙা গাল দুটো দেখতে তার বেশ লাগে। হঠাৎ করেই স্বচ্ছ আকাশ অস্বচ্ছ হয়ে উঠে। আকাশে কালো মেঘের দল ভিড় করে। হুট করেই হামলে পড়ে বরষা। আশেপাশের সবাই ছুটোছুটি শুরু করেছে। শাহবাজও নিজের রমণীকে নিয়ে ছুটতে গিয়েও থেমে যায়। তার অর্ধাঙ্গী দু হাত মেলে দাঁড়ায়। আকাশ পানে চেয়ে আছে। রঙধনুর রঙ মিশেলে গোল কুর্তি। ছেড়ে রাখা কোমড় ছুঁইছুঁই চুল। বৃষ্টির প্রত্যেকটা স্পর্শ মাঝ রাস্তায় দু হাত মেলে ঘুরে ঘুরে উপভোগ করছে প্রিয়াঞ্জনা। আর শাহবাজ চেয়ে আছে নিজের অর্ধাঙ্গীর দিকে। তৃষ্ণার্ত চোখে, ঘোর লাগা নয়নে। শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনার কাছাকাছি এসে শান্ত কন্ঠে বলে,
“I just want to kiss you and make your heart beat a little faster.”

লাজুক দৃষ্টিতে প্রিয়াঞ্জনা তাকায় নিজের অর্ধাঙ্গের পানে। তার দৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ ভয়। এত মানুষের সামনে না জানি এই লোক কি করে বসে! না, তেমন কিছুই হয়নি। তারা গাড়িতে উঠে হোটেলের দিকে রওনা দেয়। ভিজে চুবচুবে দুজনে। তারা যখন হোটেল রুমে পৌঁছায় তখন ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে বাইরে। প্রিয়াঞ্জনাকে বুকে মিশিয়ে শাহবাজ বলে,
“তো এখন?”
“এখন কি?”

সত্যি! শাহবাজের কথাই ঠিক। প্রিয়াঞ্জনার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়েছে। বেশ দ্রুত হয়েছে। ঝড়ের সাথে তাল মিলিয়ে তৃষ্ণার্ত দুটো প্রাণ মেতে উঠে। প্রিয়াঞ্জনা বহুদিন বাদে খুঁজে পায় নিজের শান্ত, স্থির, ধৈর্য্যশীল প্রেমিক পুরুষ শাহবাজকে। তার শরীরের প্রতিটি অংশে সেই প্রমাণই দিয়ে চলেছে শাহবাজ।

পরদিন সকাল সকালই বেরিয়ে পড়ে দুজনে। আজ দুজনেই কালো পরেছে। কালো রঙটা আবার শাহবাজের বেশ পছন্দ। তাই প্রিয়াঞ্জনা জিন্স প্যান্ট, লং কালো শার্ট পরেছে। শাহবাজ ভেবে রেখেছে আজ তারা যাবে লোভাছড়া। যার জন্য তাদের প্রথমে যেতে হবে কানাইঘাট। সিলেট শহর থেকে তিনটি সড়কে কানাইঘাট সদরে পৌঁছার সুযোগ আছে। শাহবাজ সিদ্ধান্ত নেয়
অটোরিক্সায় সরাসরি দরবস্ত-চতুল হয়ে কানাইঘাট সদরে যাবে। অটোরিকশায় বসে দুজনে।
“লোভাছড়া নাকি বাংলাদেশের সুইজারল্যান্ড? ভালোই হলো প্রিয়াঞ্জনা আমরা আমাদের দ্বিতীয় হানিমুন…

প্রিয়াঞ্জনা আস্তে করে চিমটি কাটে শাহবাজের ডানহাতে।
“এই এটা কি হলো?”
“আপনার লাগামহীন কথাবার্তার শাস্তি।”

বলেই প্রিয়াঞ্জনা মুখ ঘুরায়। শাহবাজ অর্ধাঙ্গীর মুখখানা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“একদিন আমরা সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ করবো প্রিয়াঞ্জনা। তুমি আমার সত্তার অংশ অর্ধাঙ্গী। যত ঝড় আসুক কখনো ছেড়ে যাবোনা তোমাকে।”

প্রবল সুখের মাঝেও যেন কেমন খারাপ লাগা দানা বাঁধে। কি হবে পরে? এরপর কি তাদের ভবিতব্য? শাহাবাজ অর্ধাঙ্গীর বেদনা দূর করতে গান ধরে,
“চলো না ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে”

“কি যাবেতো অজানাতে?”

চোখে জল নিয়ে হেসে উঠে প্রিয়াঞ্জনা। মানুষটাকে তার চাই। সারাজীবনের জন্য চাই। সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা, একেবারে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বালুভরা বেশ কিছু স্বচ্ছ পানির নদী। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লোভাছড়া নদী। কানাইঘাট থেকে লোভাছড়া চা বাগানে যেতে লোকাল ট্রলারে করে লোভাছড়া নদী পাড়ি দিতে হবে। বেশ লম্বা নদীপথ। প্রিয়াঞ্জনা সাঁতার জানেনা। ট্রলারে বসার পর শাহবাজ পিছন থেকে প্রিয়াঞ্জনাকে আঁকড়ে ধরে বসে।
“ভয় পাচ্ছো?”
“উঁহু”
“ভয় না পেয়ে আশেপাশে তাকিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করো প্রিয়াঞ্জনা। আমি আছি তো।”

‘আমি আছি তো’ এই লাইনটাই প্রিয়াঞ্জনার ভয় দূর করার জন্যে যথেষ্ট ছিলো। প্রিয়াঞ্জনা তাকায় চারপাশে। নীল রঙা আকাশ। স্বচ্ছ বিশাল নদীতে নিজস্ব গতিতে ট্রলার ছুটে চলেছে। দূরে মেঘালয় পাহাড়। সবুজে আবৃত। মনকাড়া সবুজ। পাহাড়টা কেমন যেন অন্তরকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। মৃদু মাতাল বাতাস। সাদা রঙের মেঘেরা উড়ে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের উপর। কি যেন এক সুরে পাহাড় ডাকছে।
“প্রিয়াঞ্জনা”
“হু”
“পাহাড়ের ডাক শুনতে পাচ্ছো?”
“পাচ্ছি, শাহ্। মনকাড়া ডাক। পাখিগুলোর মতো আমরা সেখানে উড়ে যেতে পারলে ভালো হতো তাই না শাহ্?”

অর্ধাঙ্গীর ছেলে মানুষিতে শাহবাজ মজা পায়। তবে দীর্ঘশ্বাসও বের হয়। সত্যি ডানা মেলে উড়ে যেতে পারলে বেশ হতো। লোভাছড়া চা বাগানে ট্রলার থামে। বাকিটা পথ হেঁটে যেতে হবে। শাহবাজের হাতে প্রিয়াঞ্জনার হাত। কিছুদূর সামনে আগানোর পর তারা প্রবেশ করে কাঠ বাগানে। দুইপাশে কাঠগাছ লাগানো। মাঝে মাটির রাস্তা। বৃষ্টি হওয়ায় খানিক ভিজে আছে মাটি। এত মধুর ঘ্রাণ! হাঁটতে গিয়ে ভিজা মাটিতে পা পিছলে যায় প্রিয়াঞ্জনার। শাহবাজ ধরে ফেলে। একটু চোখ রাঙায়।
“লাফাতে মানা করেছিলাম। সাবধানে হাঁটো।”
একটু শক্ত কন্ঠেই বলে। প্রিয়াঞ্জনার অভিমান হয়। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে একটা কাঠ গাছের সামনে।
“কি হলো?”
“যাবোনা”

এত বাচ্চামো করে মেয়েটা! ম্যাচিউর মেয়েগুলো বোধহয় প্রিয় মানুষের কাছেই এসে আহ্লাদী হয়ে যায়। একটু শক্ত কন্ঠতেও তারা অভিমান করে। শাহবাজ ফিরে এসে কোলে তুলে নেয় নিজের রমণীকে। নাকে নাক ছুঁইয়ে বলে,
“এত অভিমানী কেন তুমি?”
“আপনিই তো বদভ্যাস করেছেন।”
“তাই না?”

বলেই আলতো করে ছুঁয়ে দেয় অর্ধাঙ্গীর ঠোঁট। চোখ বুজে প্রিয়াঞ্জনা। এত সুখ কেন ভালোবাসাতে?
রাস্তার উভয় পাশে চা বাগান। বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে সতেজ হয়ে আছে তারা। ছোট ছোট লক্ষ, কোটি সবুজ পাতা। একখানা সমুদ্র। সবুজ সায়র যেন। কিচির মিচির পাখির আওয়াজ। মানুষজন কম। শান্ত, নিরিবিলি চারপাশ। ছোট একটি খালের উপর ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে এসে থামে শাহবাজ।
“নামিয়ে দিন শাহ্। বাকিটুকু যেতে পারবো আমি।”

ব্রিজের নিচ দিয়ে দুজন যাত্রী সমেত একটি ছোট নৌকা যাচ্ছে। দূরে ভারতের পাহাড়।
“সাবধানে, প্রিয়াঞ্জনা। পড়ে যাবে।”

প্রিয়াঞ্জনা পিছন ফিরে হেসে বলে,
“আমার আপনি আছেন না?”

চা বাগানের দূরে ছুটে চলেছে হরিণ। শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনাকে থামায়। আঙুল উঁচিয়ে বলে,
“ঐ দেখো প্রিয়াঞ্জনা”

দুটো হরিণ ছুটে চলেছে নির্ভয়ে। আপনমনে। চিন্তাহীন হয়ে। এত সুন্দর কেন সবকিছু? নাকি প্রিয় মানুষ পাশে থাকলে সব ভালোলাগে? ছোট একটি ঢিবি বেয়ে উপরে উঠে শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনা। দূর্বাঘাসের উপরে বসে তারা। সামনে পাহাড় আর নদী। তাদের সৌন্দর্যের বর্ণনা কি কলমে ফুটিয়ে তোলা যায়! এত অকৃত্রিম সৌন্দর্য লেখনীতে ফুটিয়ে তোলার সাধ্য স্বয়ং লেখকেরও নেই। প্রিয়াঞ্জনা মাথা রাখে শাহবাজের কাঁধে। শাহবাজ আঁকড়ে ধরে অর্ধাঙ্গীর কোমড়। সময়টা এখানেই থেমে যাক! ঘড়ির কাঁটা ভুলে যাক নিজের ঘূর্ণন। এতটা অভূতপূর্ব কেন ভালোবাসা? এতটা স্নিগ্ধ!

(চলবে)…