প্রিয়দর্শিনীর খোঁজে পর্ব-০৪

0
382

#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ৪ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

রাত জাগা মানুষগুলো জানে, তাদের ভিতরে ঠিক কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে। তারা তাদের ভিতরের কষ্টগুলো লুকিয়ে সবার সাথে ভালো থাকার অভিনয় করে৷ কিন্তু আসলেই কি তারা ভালো আছে? তাদের ভিতরের কষ্টগুলো কি কারো চোখে পড়ে না? কেউ কি তাদের বুঝতে পারে না?

পূর্ণিমার সুন্দর এক রাত। চারিদিকে জ্যোৎস্নার বন্যা। ঝিরিঝিরি বাতাশ, আর নিস্তব্ধ চারিপাশ। তারার মেলা বসেছে আকাশ জুড়ে। এমন একটা পরিবেশে কার মন খারাপ থাকে?

কিন্তু একজনের আছে। ওই যে বললাম, রাত জাগা মানুষগুলোর কথা। সেই মানুষগুলোর মধ্যে তাহনা একজন। শরীর সুস্থ থাকলেও মন ঠিক নেই। প্রতিরাতে তানভিরের কথা মনে করে কাঁদে তাহনা। সেটা কারো চোখেই পড়ে না। তবে রিদ খেয়াল করেছিল, তাহনার চোখ ফুলে লাল হয়ে যেতো সকাল হলে। তাহনা কে বলবে বলবে বলেও বলা হয়ে উঠেনি তার। ব্যস্ততার কারণে তাহনার সাথে কথা হয়না তার।

এখন রাত প্রায় দুটো। রাইশা ঘুমিয়ে পড়তেই তাহনা চলে আসে ছাদে। মন খারাপ গুলো তাকে ঘিরে ধরেছে। কিছুতেই শান্তি মিলছে না তার। এই জ্যোৎস্নার রাত কার না ভালো লাগে। কিন্তু তাহনার লাগছে না।

ছাদের দোলনায় বসে ছিল সে। একটু উঠে ছাদের কিনারায় চলে যায়। দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে। তানভিরের কথা মনে হতেই চিৎকার দিয়ে উঠে তাহনা।

‘তানভির…..।’

ঢুকরে কেঁদে উঠে তাহনা। আবার চিৎকার দিয়ে বলে,

‘তানভির…।’

তাহনার চিৎকার কারো কানে পৌঁছাবে কিনা তা তাহনার জানা নেই। ওর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। চোখ দিয়ে শুধু পানিই বের হচ্ছে।

প্রায় অনেক্ক্ষণ কাঁদার পর তাহনার মনে হলো ওর সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তাহনা চট করে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে সেই মানুষটির মুখ দর্শন করে। চাঁদের আলোয় তার মুখ স্পষ্ট।

সামনে রিদ দাঁড়িয়ে আছে। তাহনা দ্রুত গতিতে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে,

‘আ…আপনি?’

রিদ তাহনার দিকে একটা টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘চোখ মুছো আগে।’

তাহনা রিদের হাত থেকে টিস্যু নিয়ে চোখের পানি মুছে। রিদের দিকে তাকাতে তাহনার কেমন যেন লাগছে। তাহনা নিচের দিকে তাকিয়ে ওদের দু’জনের ছায়া দেখছে।

‘তাহনা তুমি প্রতিরাতে কাঁন্না করো তাইনা? না, আমি খেয়াল করেছি। সকালবেলায় তোমাকে দেখে। চোখ লাল হয়ে থাকে। চোখে ফুলে কেমন যেন হয়ে যায়। কেন কাঁন্না করো?’

তাহনা রিদের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও নিচের দিকে তাকায়। তারপর জবাব দেয়।

‘কিছু না ভাইয়া।’

রিদ হেসে বলে,

‘আচ্ছা! তুমি প্রেম ভালোবাসার কি বোঝো? তোমার বয়সে আমি শুধু পড়া নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। আর এখনকার জেনারেশন। ওহ মাই গড! রিলেশন, সোশ্যাল মিডিয়া এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আবেগের বসে রিলেশনে জড়ালে। কোনো দিন এটা উপলব্ধি করেছ যে, আমি এখন এসবে জড়ালে আমার ভবিষ্যৎ কি? আচ্ছা, তোমার যে বয়ফ্রেন্ড ছিল, সে কি করে?’

‘অর্নাস ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।’

‘আল্লাহ! তাহনা শোনো। তোমার সামনে পরিক্ষা। এখন এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করো না। যে তোমাকে সত্যিকারের ভালোবাসবে সে তোমাকে মাঝপথে ছেড়ে কখনওই যাবে না। বুঝলে পিচ্ছি?

‘আমাকে আপনার মোবাইল টা দিবেন? তানভির কে একটা কল দিব।’

রিদের মুখ টা বাংলা পাঁচের মতো হয়ে যায়। এই মেয়েকে যতই না করে এই মেয়ে ততই আগে আগে যায়।

‘কেন? তাহনা। আমি তোমাকে কি বললাম এতক্ষণ হ্যাঁ? কেন ফোন দিবে ওকে?’

‘ওর সাথে দেখা করবো। জানতে চাইবো। কেন আমার সাথে এমন করলো। কেন আমাকে এভাবে কষ্ট দিল?’

‘আমি একটা কথা ভাবছি জানো? সে তোমাকে যদি ভালোই না বাসে। তাহলে বিয়ে থেকে পালিয়ে আসতে বলে ঠিকানা দিল কেন? সে-তো বলেই দিতে পারতো যে না আসতে। এতদূর তোমাকে নিয়ে আসার কারণ কি?’

‘আমি ওকে শাস্তি এটার জন্যই দিব।’

রিদ তাহনা কে মোবাইল টা দিলে তাহনা ওটা নিয়ে তানভিরের নাম্বারে কল লাগায়।

অনেকবার দেওয়ার পরেও রিসিভ হয় না কল। তাহনা শেষবারের মতো কল লাগায়। অনেক্ক্ষণ বাজার পর কল রিসিভ করে তানভির। ওদিক থেকে তানভির বলে,

‘কে? এতো রাতে কেউ কল দিয়ে ঘুম ভাঙায় কারো? অদ্ভুত।’

তাহনা তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

‘আর আপনি যে আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছেন? তার বেলা?’

তানভির বিশ্মিত কন্ঠে বলল,

‘কে? কে বলছেন?’

‘আমি তাহনা। শোনো তানভির। আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। তোমাকে আমার সাথে দেখা করতেই হবে। আমার তোমার সাথে জরুরী কথা আছে। ভেবো না যে আমি আমার জীবনে ফিরে আসার জন্য তোমাকে অনুরোধ করবো। তাহনা অনেক কিছু সহ্য করেছে, কিন্তু আর না। কাল দেখা করবে তুমি আমার সাথে।’

‘এসব কি বলছো? কোথায় দেখা করবো?’

‘কেন? আমরা আগে যেখানে দেখা করতাম।’

‘ঠিকাছে। কাল নয়টায় চলে এসো।’

ফোন কেটে দিল তানভির। তাহনা মন কে শক্ত করার চেষ্টা করছে। কাল তানভির কে একটা উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে তাকে। যাতে আর কোনো মেয়ের ভালোবাসা নিয়ে গেইম খেলতে না পারে।

‘তাহনা।’

রিদের ডাকে পিছন ফিরে তাকায় তাহনা।

‘তোমার বাবা কি আজ সকালে এসেছিলেন?’

‘জ্বি। দেখা করে গেছেন।’

‘মা তোমার জন্য ড্রেস গুলো কিনে দিয়েছে না?’

‘হ্যাঁ। আন্টি আমাকে নিয়ে মার্কেটে গিয়েছিলেন। তখন আর কি এগুলো কেনা হয়েছে। কিন্তু কেন ভাইয়া? এতো কিছু জিজ্ঞেস করছেন কেন?’

রিদ হাই তুলতে তুলতে বলে,

‘কিছুনা। তো কি বলল তোমার বয়ফ্রেন্ড?’

‘এখন সে আমার বয়ফ্রেন্ড নেই। কাল দেখা করতে বলেছি। ভাইয়া আমাকে কাল নিয়ে যাবেন প্লিজ?’

‘কিন্তু বাসায় কি বলব?’

‘বলবেন যে আমাকে কলেজে নিয়ে যাচ্ছেন। কাল আমি কলেজেও যাব। আমার পরিক্ষার রুটিন নিয়ে আসতে। সাথে রেজিষ্ট্রেশন কার্ড আর প্রবেশ পত্র এসব নিয়ে আসতে হবে।’

‘আচ্ছা ঠিকাছে। কাল আমার ব্যস্ততা নেই।’

‘আচ্ছা। নিচে চলুন।’

রিদ আগে আর তাহনা রিদের পিছনে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়।
যে যার রুমে চলে যায়।

.
পরদিন সকালে রিদ তাহনা কে নিয়ে বের হয়ে গেল। বাসায় জিজ্ঞাসা করা হলে তাহনার কলেজে যাচ্ছে বলে দেয় রিদ।
বেশ কিছুক্ষণ পর তাহনা একটা লেকের সামনে থামতে বলে রিদ কে। রিদ গাড়ি থামায়। তাহনা নেমে পড়ে। সাথে রিদ ও গাড়ি থেকে নেমে তাহনার পাশে গিয়ে দাড়ায়। তাহনা রিদ কে ইশারা দিয়ে বলে,

‘এটা আমার খুব পছন্দের একটা জায়গা ছিল ভাইয়া।’

‘ছিল? এখন নেই?’

তাহনা নিচু হয়ে বলে,

‘মানুষটার জন্যই এ জায়গাটা ভালো লাগতো। এখন মানুষটা’ই যখন আমার নয়, তাই এ জায়গার প্রতিও ভালো লাগাটা চলে গেছে।’

‘অহ। তো তোমার বয়ফ্রেন্ড আসছে?’

তাহনা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো, কিন্তু তানভির কে কোথাও দেখতে পেল না।

‘ভাইয়া। আপনার ফোনটা দিন। আমি কল দিয়ে দেখছি।’

রিদ তাহনা কে তার ফোনটা এগিয়ে দেয়। তাহনা কল দেওয়ার আগেই তানভির ওখানে উপস্থিত হয়। তাহনা রিদ কে তার ফোনটা দিয়ে দেয়।
তানভির এসেই তাহনা কে বলে,

‘কি বলবে বল। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

তাহনা কিছুক্ষণ তানভিরের দিকে চেয়ে থাকে। একটা মানুষ এতটা নিখুঁত অভিনয় কি করে করতে পারে? যেভাবে এখন কথা বলছে, মনে হচ্ছে তাহনা কে সে চিনেই না। তাহনা আর কিছু না ভেবেই কষিয়ে একটা থাপ্পড় দেয় তানভির কে। থাপ্পড় খাওয়ার পর তানভির গালে হাত দিয়ে তাহনার দিকে তাকিয়ে থাকে।

এদিকে রিদ অবাক হয়ে তাহনাকে দেখছে। ও যে কাউকে থাপ্পড় দিতে পারে, সেটা রিদের জানা ছিল না।

‘তাহনা? তুমি আমাকে মারলে কেন?’

তানভিরের কথায় তাহনা রেগে দিয়ে তানভিরের কলার চেপে ধরে।

‘তোকে আমি খুন করবো। তোর সাহস কি করে হয় আমার জীবন নষ্ট করার? আমার অনুভূতি নিয়ে খেলার অধিকার তোকে কে দিয়েছে? বল! আমার সাথে কেন এমন করলি তুই? কেন আমাকে বিয়ের আসর ছেড়ে পালাতে বললি? কেন স্বপ্ন দেখালি? তোর জন্য আজ আমি আমার বাবার কাছে ছোট হয়ে গেলাম। আমার আত্মীয় স্বজন আমাকে নিয়ে কটু কথা বলছে, শুধু মাত্র তোর জন্য।’

‘ছাড় তাহনা। আমিতো বলেছি আমাকে ডেয়ার দেওয়া হয়েছিল।’

‘তোর ডেয়ারের কারণে তুই একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবি? আমি তোকে পুলিশে দিব।’

রিদ তাহনার এ অবস্থা দেখে তাহনা কে তানভিরের কাছ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাহনা তানভিরের কলার শক্ত করে ধরে আছে ত আছেই।

‘আই হেইট ইউ তানভির। তুই আমার জীবন টা শেষ করে দিয়েছিস।’

‘তাহনা আমি চলে যাচ্ছি। ছাড় ওকে।’

রিদের কথায় তাহনা তানভিরের কলার ছেড়ে দেয়। তারপর একবার রিদের দিকে তো একবার তানভিরের দিকে তাকায়। তানভির নিজের কলার ঠিক করতে করতে বলে,

‘তাহনা! তুমি সহজ সরল জানতাম। এখন তো দেখি আমিই ভুল ছিলাম।’

‘সহজ সরল মেয়েরা আঘাত পেয়ে কঠিনের চেয়েও কঠিন হয়ে উঠে। মনে রাখবে এটা।’

কথাটা বলে রিদ তাহনা কে নিয়ে চলে যেতে লাগলো। পিছন থেকে তানভির বলল,

‘তাহনা কি আপনার স্ত্রী?’

তাহনা পিছন ফিরে তানভিরের কাছে গিয়ে বলে,

‘না জেনে উল্টো পাল্টা কিছু বলবে না।’

‘তাহলে বল উনি তোমার কে?’

‘তোমাকে উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। আর শোনো। “আমি তোমার থেকে ঠিক ততটা দূরত্বে অবস্থান করতে চাই, যতটা দূরত্বে গেলে তুমি আমার অস্তিত্ব অনুভব করতে না পারো।” মনে রেখো।’

তাহনা রিদের হাত ধরে ওখান থেকে চলে এলো। রিদ গাড়ি চালিয়ে তাহনার কলেজে চলে গেল তাহনার কাছ থেকে কলেজের নাম জেনে। ওখান থেকে পৌঁছে ওরা তাহনার কাগজপত্র সব নিয়ে চলে এলো। কলেজের সব স্যার’রা রিদ কে দেখে প্রথমে ভয় পেয়েছিল। তারপর তাহনা কে রিদের সাথে দেখে অবাক হয়। রিদ ওনাদের কে শান্ত থাকতে বলে তাহনার সব ডিটেইলস জেনে নেয় স্যারদের কাছ থেকে। তাহনা তখন অন্য হলে ছিল সিগনেচার করার জন্য।

বাসায় আসার সময় রিদ তাহনার বাড়িতে গিয়ে তাহনার বাবার কাছ থেকে তাহনার বইগুলো নিয়ে আসে। আর বলে যে, তাহনার পরিক্ষা শেষ হওয়া অব্দি সে রিদের বাড়িতেই থাকবে। তাহনার বাবা কিছু বলতে গেলে তাহনা না করে দেয় ইশারায়। তাহনাও চায় ভরা মানুষের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। একা থাকলে একাকিত্ব টা বেশিই বাড়বে।

রিদের বাসায় এসে ক্লান্ত হয়ে রিদ তাহনা দুজনেই শাওয়ার নিতে চলে যায়। এরপর দুইদিন চলে যায়। রিদের সাথে তাহনার এ দুদিনে আর কথা হয় না।

চলবে….