প্রিয়দর্শিনীর খোঁজে পর্ব-০৩

0
402

#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ৩ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

এলোমেলো পায়ে রাস্তায় হেটে চলেছে তাহনা। একমনে ভেবে যাচ্ছে তার সাথে ঘটা ঘটনাগুলো। তাহনা আজ বড্ড অসহায়। ভালোবাসার মানুষটি তাকে ফিরিয়ে দিল। বাবার কাছে “আশ্রিতা” উপাধি টা পেল। এই পৃথিবীতে তাহনার নিজের বলতে কেউই নেই। ও এখন কোথায় যাবে? পালিয়ে যাওয়ার আগে একবার বাবার কথা তার ভাবা উচিৎ ছিল। কেন সে তানভিরের কথায় বাড়ি ছেড়ে চলে এলো? নাহলে এতকিছু আজ হতোই না।

একটা চলন্ত বাইকের সাথে ধাক্কা লেগে যায় তাহনার। সে দু’হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। সাথে সাথেই তাহনা জ্ঞান হারায়।

তাহনার ঠিক কিছুদূর পিছনে দৌড়ে আসছিল রিদ। দূর থেকেই সে লক্ষ্য করলো তাহনা বাইকের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। এটা দেখার পর রিদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।

রিদ দৌড়ে গেল তাহনার কাছে। তাহনা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রাস্তায়। রিদ তাহনাকে নিজের দিকে ফেরায়। তাহনার কপালে বেশ চোট লেগেছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রিদ “তাহনা” “তাহনা” বলে কয়বার ডাকে তাহনাকে। কিন্তু তাহনার কোনো রেসপন্স না পেয়ে ঘাবড়ে যায় সে।

রিদ সামনে থাকা বাইকে বসা ছেলেটা কে জিজ্ঞেস করল,

‘এভাবে একজন কে ধাক্কা মেরে দিলেন? কমনসেন্স নাই?’

বাইকে থাকা ছেলেটা বাইক থেকে নেমে রিদ কে বলল,

‘দেখুন। উনি নিজেই আমার বাইকের সামনে এসেছেন। এভাবে রাস্তার মাঝখানে কেউ হাটে? ওনার কমনসেন্স নাই?’

রিদের এবার প্রচুর রাগ উঠে।

‘আপনি ব্রেক ধরলে কি হতো?’

‘আপনি এতো কথা বলেন কেন? ওনাকে এখন হস্পিটালে নিয়ে যাওয়া দরকার। চলুন।’

রিদ তাহনা কে কোলে নিল। ছেলেটার বাইকের পিছনে তাহনা কে নিয়ে বসলো সে। ছেলেটা আর দেরি না করে বাইক স্টার্ট দিল। বাইকের দ্রুত গতির কারণে তাহনা পড়ে যেতে নেয় বারবার। রিদ তাহনা কে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে।

.
এদিকে রিদের বাবা মা টেনশন করছেন তাদের ছেলে আর তাহনার জন্য। ছেলে মেয়ে দুটো কোথায় চলে গেল? রিদের বাবা মিস্টার আফজাল শেখ। মা মিসেস ফাবিহা শেখ। মিস্টার আফজাল শেখ খুব বড় বিজনেসম্যান নন! তবে তিনি তার ব্যবসায় সফল। ওনার গার্মেন্স ফ্যাক্টরি। বর্তমানে তিনটি ফ্যাক্টরি আছে ওনার। একটা বড় হেড অফিস আছে। যেখানে তাহনার বাবা কাজ করেন।

তাহনার বাবা এহসান আহমেদ। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে। স্ত্রী মারা গেছেন আজ থেকে আট বছর আগে। একটাই মেয়ে তাহনা। তাহনার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করেননি উনি। তাছাড়া তাহনার মা’কে খুব ভালোবাসতেন।

এহসান আহমেদ কাঁদছেন। কি থেকে কি হয়ে গেল। আজ যদি তাহনা কিছু একটা করে বসে তাহলে কি করে নিজেকে ক্ষমা করবেন উনি? এহসান আহমেদ কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

‘স্যার। আমি রাগের মাথায় কি বলে ফেলেছি আমার মেয়েটা কে। আমি এমন টা করতে চাইনি। আমার মেয়েটা কে ফিরিয়ে দিন না।’

মিস্টার আফজাল শেখ একটু গম্ভীর হয়ে বললেন,

‘আমি তোমাকে কি ওকে কথা শোনানোর জন্য এখানে নিয়ে এসেছিলাম? ওকে বুঝিয়ে অভিমান মিটিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এনেছি। আর তুমি কি করলে এটা?’

মিসেস ফাবিহার ফোন বেজে উঠলো হঠাৎ। সবার নজর সেই দিকে। মিসেস ফাবিহা নিজের ফোন টা হাতে নিয়ে বললেন,

‘রিদ কল দিয়েছে।’

মিস্টার আফজাল তাড়াহুড়ো করে বললেন,

‘রিসিভ করো। কি হয়েছে দেখো।’

মিসেস ফাবিহা ফোন টা রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে কি বলছে তা কেউই শুনতে পাচ্ছে না, শুধু রিদের মা ব্যাতিত। কিছু শোনা না গেলেও সবাই খেয়াল করছে, মিসেস ফাবিহার চোখে মুখে কেমন অস্থিরতার ছাপ।

মিস্টার আফজাল শেখ স্ত্রী কে বললেন,

‘কি হয়েছে ফাবু? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

রিদের মা ফোন টা রেখে বললেন,

‘আমাদের এক্ষুনি হস্পিটালে যেতে হবে। তাহনা অ্যাকসিডেন্ট করেছে।’

মুহুর্তেই যেন সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। এহসান সাহেব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।

‘আমার মেয়ে! কোথায় আমার মেয়ে? সব আমার জন্য হয়েছে। স্যার আমায় নিয়ে চলুন। আমি আমার মেয়ের কাছে যাবো।’

ওনারা আর কেউই দেরি করলেন না। সবাই মিস্টার আফজাল শেখ এর গাড়ি করে বেড়িয়ে পড়লেন হস্পিটালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

.
তাহনা কে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হস্পিটালের বাইরে পায়চারি করছে রিদ। মেয়েটা এতো কেয়ারলেস কেন সে বুঝে না। একটার পর একটা আঘাত আজ পেয়েই চলেছে সে। রিদের দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে সেই ছেলেটা। যে তাহনাকে বাইক দিয়ে ধাক্কা দিয়েছে।

‘ব্রো। আপনি এতো অস্থির হচ্ছেন কেন? ঠিক হয়ে যাবে সব।’

রিদ হাটা থামিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ইউ ব্লাডি বিচ। একজনের রক্তান্ত অবস্থা করে আপনি বলছেন আমি অস্থির হচ্ছি কেন?’

‘ইচ্ছে করে তো ধাক্কা দেয় নি।’

‘গেট আউট। আপনার আর কোনো প্র‍য়োজন নেই এখানে। আসুন আপনি।’

‘আরে, ওনার একটা খবর নিয়ে যাবো না।’

‘কোনো প্রয়োজন নেই।’

জরুরি বিভাগ থেকে একজন নার্স বেড়িয়ে এলেন।

‘এক্সকিউজ মি। রোগীর বাড়ির লোক কি আপনারা?’

রিদ নার্সের দিকে ফিরে বলল,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। বলুন, তাহনা কেমন আছে এখন?’

‘দেখুন। ওনার শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণের ব্লাড বের হয়ে গেছে। আমাদের এখানে এখন সেই গ্রুপের ব্লাড নেই। আপনারা এক্ষুনি ব্যবস্থা করুন।’

‘ব্লাড গ্রুপ কি?’

‘বি পজেটিভ।’

রিদ হতাশ হয়ে বলে।

‘আমার তো এ।’

নার্স বিরক্তি নিয়ে বলে,

‘যান। গিয়ে কোথাও থেকে নিয়ে আসুন প্লিজ।’

তখনই ছেলেটা দাঁড়িয়ে বলে,

‘আমার ব্লাড গ্রুপ বি পজিটিভ। চলুন। আমি রক্ত দিচ্ছি।’

কিন্তু রিদ এতে নারাজ। রিদ কড়া গলায় বলে,

‘দরকার নেই। আমি ব্যবস্থা করছি।’

নার্স বেকুব বনে গেল।

‘আপনার মাথা ঠিকাছে? একজন ব্লাড দিতে চাইছে আর আপনি মানা করে দিচ্ছেন? আপনি কি সিউর আপনি ব্লাড এরেঞ্জ করতে পারবেন? সময় খুব কম৷ যা করার এক্ষুনি করুন। আমি যাচ্ছি।’

‘নার্স চলুন। আমি দিচ্ছি। একজন কে বাঁচাতে হবে। এখন রাগারাগি করে কি লাভ। চলুন।’

ছেলেটা নার্স এর সাথে চলে গেল। রিদ আর কিছুই বলল না। এখন এতো কিছু ভাবলে চলবে না। আগে তাহনা কে সুস্থ করতে হবে।

.
এদিকে রিদের বাবা মা, রাইশা আর তাহনার বাবা হস্পিটালে এসে উপস্থিত হন। ওনারা সোজা রিদের কাছে চলে যান।

তাহনার বাবা রিদের হাত ধরে বলেন,

‘আমার মেয়ে কোথায় রিদ বাবা?’

‘ভেতরে। রক্ত দেওয়া হচ্ছে।’

.
ছেলেটা রক্ত দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। সাথে ডাক্তারও। ডাক্তার বেড়িয়ে রিদ কে বলে,

‘আলহামদুলিল্লাহ্। উনি এখন বিপদমুক্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে। জ্ঞান ফিরলে ওনার সাথে দেখা করে নিবেন। এখন যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’

ডাক্তার চলে গেলে রিদ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।

.
প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে যায় তাহনার জ্ঞান ফিরতে। সবার আগে তাহনার বাবা ছুটে যান সেখানে। তাহনা নিজের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। তাহনার বাবা গিয়ে মেয়ের হাত ধরে কান্নাকাটি শুরু করেন।

‘আমাকে ক্ষমা করে দে মা। আমি রাগের বসে তোকে ওসব কথা বলেছি। তুই আমার মেয়ে। আমার নিজের মেয়ে। তোকে আমি আর বিয়ের জন্য কিচ্ছু বলবো না। তুই পড়িস। ক্ষমা করে দে।’

তাহনা নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। ছোট বাচ্ছাদের মতো কান্নাকাটি করছে তার বাবা। তাহনার এখন মনে হচ্ছে না যে সে এতিম।

‘প্লিজ বাবা। তুমি এভাবে কান্নাকাটি করো না। আ’ম সরি। আমার তোমাকে এভাবে কষ্ট দেওয়া উচিৎ হয়নি। ওই ছেলেটার জন্য আমি নিজের বাবার কথা একবারও ভাবিনি।’

‘তোর কোনো দোষ নেই মা। তুই তো আবেগের বসে এটা করেছিস। সব দোষ ওই ছেলেটার। ও তোর মন নিয়ে খেলেছে।’

তাহনা চারপাশে এক নজর তাকিয়ে বলে,

‘আমাকে হস্পিটালে কে নিয়ে এলো বাবা?’

‘রিদ বাবা নিয়ে এসেছে। রিদ বাবা না থাকলে তোকে তো খুঁজেই পেতাম না।’

‘উনি কিভাবে?’

‘তুই বের হওয়ার পরেই তোর পিছনে রিদ বাবাও বের হয়ে যায়।’

.
রিদ ছেলেটার কাছে গিয়ে বলে,

‘ধন্যবাদ। আপনার নাম?’

ছেলেটা মুচকি হেসে বলে,

‘আমার নাম রাফি। আর ধন্যবাদ দেওয়ার কিছুই নেই। ভালো থাকবেন। ওনার খেয়াল রাখবেন। বায় দ্যা ওয়ে। উনি আপনার কে হন?’

‘কেউ না।’

ছেলেটা একটু অবাক হয়ে বলে,

‘কেউ না কিন্তু আপনি উনার জন্য এতোটা অস্থির হয়ে গেলেন?’

‘আসুন আপনি এবার।’

রিদ ওখান থেকে কেবিনে চলে যায় তাহনার কাছে।

তাহনা রিদ কে দেখে একটু তাকিয়ে তার বাবার দিকে তাকায়। রিদ এগিয়ে গিয়ে তাহনার বাবাকে বলে,

‘আচ্ছা আংকেল। আপনি ওকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে কেন দিচ্ছিলেন?’

‘আমার বোনেরা আমাকে চাপ দিয়েছে খুব তাই।’

‘তাহনা? তুমি… সরি আপনি কিসে পড়েন?’

রিদের কথায় তাহনা হালকা হেসে বলে,

‘আমি আপনার ছোট। আমাকে তুমি বলতে পারেন। এইচ এস সি দিব এবার।’

‘আংকেল। ওর বয়স তো ১৮ হয়নি।’

‘নাহ। আমার বয়স ১৮ হয়ে গেছে।’

‘আচ্ছা। তাহলে পড়ালেখা চালিয়ে যাও।

এমন সময় রিদের মা বাবা কেবিনে ঢুকলেন। রিদের বাবা তাহনার বাবা কে বলেন,

‘তাহনা আমাদের বাসায় থাকবে যতদিন না ও সুস্থ হয়। আমি এ নিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাইনা এহসান।’

.
রিদের বাসায় তাহনা কে নিয়ে আসা হলো। রিদের মা নিজের হাতে তাহনা কে খাইয়ে দেন।

.
পরেরদিন সকালে রিদ এক নজর তাহনা কে দেখে চলে যায় তার অফিসে।
রাইশা এসে তাহনার সাথে গল্প করতে থাকে।

‘আচ্ছা, তুমি কিসে পড়ো?’

‘আমি এবার এইচ এস সি দিব। আর তুমি? তোমার নাম কি?’

‘অহ, আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছি। আমার নাম রাইশা। আর আমার ভাইয়া রিদ।’

‘তোমার ভাইয়া কি করেন?’

‘আমার ভাইয়া তো ইঞ্জিনিয়ার। ভাইয়া এখন অফিসে গেছে।’

তাহনা একটা ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘অহ।’
তাহনা আবার বলে উঠে।

‘তোমাদের পরিবারের সবাই খুব ভালো।’
রাইশা খুশি হয়ে বলে।
‘তুমিও খুব ভালো। আমি তোমাকে আপু ডাকবো?’

‘হ্যাঁ। ডাকতে পারো।’

___
একনিয়মে কয়েকদিন কেটে গেল এভাবে।

চলবে….