প্রিয়দর্শিনীর খোঁজে পর্ব-০৮

0
280

#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ৮ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

আজ তাহনার পরিক্ষা শেষ হলো। একটা ভারি বোঝা নামল ওর উপর থেকে। এবার কয়দিন রেস্ট নিবে। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিবে।

ও বাড়ি থেকে তাহনা চলে এসেছে। রিদের মা, বাবা আর রাইশা অনেক বলেছিল থাকার জন্য। কিন্তু তাহনা তার বাবার অজুহাত দিয়ে চলে আসে। বাবাকে দেখার কেউ নেই। রিদের মা বুঝেছেন কেন তাহনা চলে গেছে। তাহনা আসার আগে বলে এসেছে, ও যে নেই তা যেন রিদকে না বলে। তারাও আর রিদকে বিষয়টা জানায়নি। রাইশার সাথে ফোনে তাহনার মাঝে মাঝে কথা হতো।

তাহনা আজ তাদের বাড়ির ঘরগুলো পরিষ্কার করছে। তার বাবা অফিসে গেছেন। কোমরে ওড়না পেচিয়ে পুরো ঘর ঝাড় দিল। বিছানার কাপড় বালিসের কাপড় সব ধুয়ে তাদের ছাদে শুকাতে দিল। দুটো বেজে গেছে এখনো ফ্রেশ হয়নি। পরিক্ষা দিয়ে এসেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। টাইলস মুছে পরিষ্কার করেছে। বিপত্তি ঘটলো তখনই। পানি শুকায়নি টাইলসের। তাহনা হাটতে নিলে হঠাৎই স্লিপ খেয়ে পড়ে যায়। প্রচন্ড ব্যথা পায় তাহনা কোমরে। চিৎকার দিয়েছিল হালকা। জোরে দেয়নি মানুষ কি ভাববে তা ভেবে। তাহনার মৃদু চিৎকারের মাঝে এসে একজন তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল৷ তাহনা ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখে যে তার সামনে রিদ দাঁড়িয়ে আছে। এক মুহুর্তের জন্য তাহনা ভুলে গেল তার ব্যথার কথা। সে দ্রুত ওড়না কোমর থেকে খুলে মাথায় দিল।
রিদকে এসময়ে আশা করেনি তাহনা।
তাহনা বলে,

‘আপনি?’

তাহনা নিজেই উঠে গেল। কিন্তু সে উঠতে ব্যর্থ হয়। আবারও পড়ে যেতে নেয়। এবার রিদ তাহনার হাত ধরে ফেলে। তাহনাকে ধরে আস্তে করে সোফায় বসায়। তাহনার কেমন যেন লাগছে। হঠাৎ রিদ তার বাসায় কি করছে? এই প্রশ্নটা নিজেকে করে চলেছে সে। রিদ বলে,

‘তাহনা তুমি ঠিকাছ? ব্যথা পাওনিতো বেশি?’

তাহনা রিদের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলে,

‘জি, আমি ঠিকাছি। আপনি এসময়ে?’

রিদ অন্য একটা সোফায় বসে তাহনার উদ্দেশ্যে বলে,

‘এসেছি কালই। শুনলাম তুমি নাকি চলে এসেছ! তাই তোমাকে দেখতে এলাম। কেমন আছো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। আপনি?’

‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ।’

তাহনার খুব অস্বস্তি হয়, রিদ এভাবে তার সামনে বসে আছে। কোমরে ব্যথা নিয়ে সে বলে,

‘বসুন! আমি আপনার জন্য কফি নিয়ে আসছি।’

এ কথা বলেই তাহনা চলে গেল রান্নাঘরে। রিদ তাহনাদের সোফায় বসে আছে। তাহনা রিদের জন্য কফি নাশতা সব রেড়ি করে। সারাদিন সে নিজেও কিছু খায়নি, তাই শরীর টাও দুর্বল বেশ। এরি মাঝে তাহনার বাবা এসে উপস্থিত। রিদকে দেখে তিনিও সোফায় বসে রিদের সাথে কথা বলছিলেন। তাহনা দুজনের জন্যই কফি বানিয়ে নিয়ে আসছে।

তাহনা দুজনকে কফি দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। শাওয়ার নিয়ে জলদি বের হলো। নামাজের সময় দেখে নামাজ আদায় করে নিল। নামাজ পড়ে নিচে আসতে আসতেই দেখে রিদ নেই। তাহনার বাবা ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন তাহনার জন্য।
তাহনা এসেই জিজ্ঞেস করে,

‘রিদ ভাইয়া কোথায়?’

তাহনার বাবা বললেন,

‘অনেক্ষণ আগেই চলে গেছে। খুব খিঁদে পেয়েছে মা।’

তাহনা জলদি খাবার বেড়ে বাবাকে দিল। নিজেও বসে পড়লো অন্য একটা চেয়ারে। খেতে খেতে দুজন মিলে টুকটাক কথা বলতে লাগলো।
~
বাড়ি ফিরে রিদ নিজের রুমে শুয়েছিল মাত্র। তখনই রিদের মা এসে রিদের পাশে বসে। রিদ তার মা’কে বলে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে। রিদের মা মিসেস ফাবিহা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তিনি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কোথায় গিয়েছিলি?’

‘তাহনাদের বাড়িতে।’

তাহনাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনেই রিদের মা চমকে উঠে বললেন।

‘ওদের বাড়িতে? হঠাৎ কেন ওদের বাড়িতে গেলি?’

রিদ বলে,

‘এমনি গেলাম। আচ্ছা মা, তাহনা হঠাৎ চলে গেল কেন?’

মিসেস ফাবিহা চুপ করে রইলেন। এখন যদি ছেলেকে উনি বলেন সত্যিটা, তাহলে তার ছেলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করবে। তাই তিনি ভেবে বললেন,

‘তাহনার বাবা একা তো, তাই সে চলে গেছে। আরো কয়েকদিন থেকে যাওয়ার কথা বলেছিলাম, কিন্তু শোনেনি।’

রিদ চোখ বুঝলো। চোখ বুঝতেই তাহনার পড়ে যাওয়ার পরের মুহুর্তটা ভেসে উঠল রিদের চোখে। রিদ ধ্যান দিল না। ঘুমিয়ে পড়ল।

.
বিয়ের দিন পালিয়ে যাওয়ায় তাহনাকে পাড়ার লোক কম কথা শোনায়নি। বাড়ি ফেরার পর থেকেই লোকে তাকে বাড়ির ভিতরে ঢুকেই আজে বাজে কথা বলে গেছে। পরিক্ষা দেয়ার সময় বের হলেই রাস্তায় যে বা যারা দেখে তারাই মন্দ কথা বলতে শুরু করে। এসব তাহনার মনটাকে বিষিয়ে দিয়েছে। একেই ধোকা খেয়েছে, তারউপর তার বাবার কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। তারমধ্যে এসব কথা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো। তাহনার বাবাকেও কম কথা শুনতে হয়নি এসবের জন্য।

তাহনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে কিছুদিনের জন্য বাড়ির বাইরে থাকবে। তার মামার বাসায় যাবে। যদিও তার নিজের মামা না। কিন্তু, তারা কখনোই তাকে পর ভাবেননি। কখনো জানানওনি যে সে তাদের রক্তের নয়। তাহনার মামার বাসা বান্দরবান। একটাই মামা তার। মামার একটা ছেলে ও একটা মেয়ে। মেয়েটা তারই বয়সি। তবে ছেলেটা কয়েক বছরের বড় হবে।
.
দুইদিনের মাথায় তাহনার বাবা তাকে বান্দরবান পাঠিয়ে দিলেন। তাহনার এখন মন ভালো নেই। তাই তিনি ভাবলেন ঘুরে আসলে মেয়েটার মন ভালো থাকবে। বাড়ি থেকে তাহনাকে নিয়ে বাস স্টেশন পর্যন্ত এলেন তাহনার বাবা। মেয়েকে উঠিয়ে দিলেন বান্দরবানের বাসে। তাহনা হাত নাড়িয়ে বাবাকে বিদেয় জানালো।
.

পূরবী বাসে করে ৩:৪৫ মিনিট সময় নিয়ে তাহনা বান্দরবান সদরে পৌঁছায়। বান্দরবান সদরেই তার মামার বাসা। সে একা দাঁড়িয়ে আছে বাস থেকে নেমে। আশেপাশে কাউকে খুঁজতে লাগলো। একজন আসার কথা ছিল তাকে নেওয়ার। সে হচ্ছে তার মামাতো ভাই। তাহনা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পাঁচ মিনিট পর একটা বাইক এসে থামলো তাহনার পাশে। তাহনা একটু পিছনে সরে গেল৷ অচেনা একটা জায়গা। তারউপর ভিষণ ভয় করছে তার। বাইকে হেলমেট পড়া একটা ছেলে ছিল৷ ছেলেটা হেলমেটটা খুলতেই তাহনার সব ভয় উড়ে গেল। এই ছেলেটাই তার মামার ছেলে। ছেলেটা বাইক থেকে নেমে তাহনার সামনে গিয়ে বলল,

‘সরি তাহনা। আ’ম লেট। একটু কাজ ছিল তাই আসতে দেরি হয়ে গেল৷ কখন এসেছ? নিশ্চয়ই অনেক্ক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছি তাইনা?’

ছেলেটা এক নাগাড়ে বলেই যাচ্ছে। তাহনাকে বলার সুযোগই দিচ্ছে না। তাহনা কিছুক্ষণ পর বলে উঠে,

‘সমস্যা নেই অনিক ভাইয়া। চলুন বাসায় যাই।’

তাহনা অনিকের বাইকে উঠে একটু দূরত্ব রেখেই বসেছে। কালো বোরকা, কালো নিকাব আর মুখে মাক্স লাগানো ছিল তাহনার। অনিক মুখ বাধা অবস্থাতেও তাহনাকে চিনে ফেলেছে। কারণ আসার সময় তাহনার বাবা অনিককে বলেছিল তাহনা কি পড়ে থাকবে।

বাইকে করে আরো পাঁচ মিনিটের মতো লাগলো তাদের বাসায় পৌঁছাতে। তাহনাকে দেখে পরিবারের সবাই খুব খুশি হয়। তাহনা তার মামা মামিকে সালাম করে। অনু (তাহনার মামাতো বোন) এসেই তাহনাকে জড়িয়ে ধরে। অনিক তাহনার ব্যাগ বাসার ভিতরে নিয়ে যায়।

.
রিদের জন্য পাত্রী খুঁজে চলেছেন রিদের মা। রিদের বাবা তার বন্ধুর মেয়ের কথা বলেছেন মিসেস ফাবিহাকে। রিদের মার বেশী আধুনিক মেয়ে পছন্দ নয়। ওনার পছন্দ ভালো আচার-আচরণ জানা ভদ্র ঘরের শিক্ষিত মেয়ে। তাই ওই মেয়েটাকে তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। কিন্তু যার জন্য এতকিছু, তার কোনো খবর নেই। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে রিদ৷ আগের মতো তেমন একটা কথাবার্তা বলেনা কারো সাথে। অফিসে যায়, আসে, আর খাবার সময় খেয়ে নিজের রুমে শুয়ে থাকে। পরিবারের সবাই এই নিয়ে চিন্তায় আছেন।

.
রাইশার আজ প্রথম পরিক্ষা ছিল৷ পরিক্ষা দিয়ে সে বান্ধবীদের সাথেই ফুসকা খাচ্ছিল। হঠাৎ করে কেউ তার হাতটা টেনে ধরলো। রাইশা অবাক চোখে সেদিকে তাকাতেই ঠাস করে একটা থাপ্পড় পড়লো রাইশার গালে। রাইশা হতভম্ব। তার বান্ধবীরা মুখে হাত দিয়ে আছে। কি হচ্ছে তাদের মাথায় ঢুকছে না। রাইশার সামনে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সে রাইশাকে বলল,

‘কলেজে আসো কি মাস্তানি করতে? লজ্জা করেনা একটা জুনিয়র স্টুডেন্ট হয়ে সিনিয়র ভার্সিটির ছেলেকে মারতে?”

রাইশা আরো অবাক। সে কখন কাকে মারলো? রাইশাও তেড়ে এসে বলল,

‘একেই তো আমাকে থাপ্পড় দিয়েছেন। আবার আমাকেই শাসাচ্ছেন? কে আপনি হ্যাঁ?’

ছেলেটা এবার তার শার্টের হাতা গুটিয়ে নিল। রাইশাও ভয় পেয়েছে। এবার কি মারবে নাকি?

ছেলেটা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আর একটা ছেলে এসে ছেলেটাকে বলল,

‘দোস্ত, এই মেয়েটা নাতো। তুই কাকে মারলি? সেটা তো অন্য একটা মেয়ে।’

ছেলেটা থমকে দাঁড়ালো। রাইশার দিকে তাকাতেই দেখে অলরেডি কান্না শুরু করে দিয়েছে সে। রাইশার মা বাবাও তাকে কোনো দিন মারেনি। কিন্তু এখন কোত্থেকে একটা ছেলে এসে ওকে থাপ্পড় দিল। তাও এত জোরে যে ওর গাল ব্যথা করছে। রাইশার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

ছেলেটা ‘অহ শিট।’ বলে রাইশার কাছে গেল।

‘সরি মিস। আপনাকে ভুলে থাপ্পড় দিয়ে ফেলেছি। আসলে যাকে দেওয়ার কথা ছিল সে আপনি নন। আমি ভুল করে সে ভেবে আপনাকে…’

রাইশা আর কিছু শুনলো না। দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেল। একটা রিক্সা করে বাসায় ফিরলো সে।

বাসায় ফেরার পর শুধু কান্নাই করে গেছে। শুধু শুধু বিনা অপরাধে থাপ্পড় খেল। তার মা এতো ডাকলো, কিন্তু সে দরজা বন্ধ করেই ছিল, আর খোলেনি।

চলবে…