প্রিয় অপরিচিত পর্ব-০৩

0
376

#প্রিয়_অপরিচিত [০৩]

আচ্ছা এই যুগের কোন বর তার হবু স্ত্রীর সাথে গায়ে হলুদের রাতেও একটু কথা বলেনা?
অন্তত আমাকে কি কয়েকটা প্রশ্ন করার সুযোগ দিবেনা? এতো জটলা রেখে মানুষ কীভাবে বিয়ে করবে?
বুঝতেই পারছিনা উনি কেন এতোগুলো প্রশ্ন জমা রেখে দিলো ? আর আমিই বা কি করে মানসিকভাবে স্থিরতা বজায় না রেখে বিয়ের মতো একটা কাজে কি করে ঠিকঠাক সম্মতি দিবো?

পরদিন…

আমার হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাচ্ছে, আমাকে সবাই সাজানোতে ব্যস্ত । অথচ এখনো আমি আমার ভেতরকার শ খানেক প্রশ্নের একটারও উত্তর পাইনি।

গ্রাম থেকে আমার চেনা অচেনা অনেক আত্মীয় স্বজনরা আমার বিয়ে উপলক্ষে এখানে জমায়েত হয়েছে। আমার দিকে তাদের আগ্রহ বেশিই ছিলো, অন্য দিকে ঘুম থেকে উঠার পর ফোন হাতে নেওয়ার সুযোগ মিলেনি আমার। আমার বড় বোন,কিংবা কোনো কাছের ভাবিও নেই,যার কাছে অন্তত মন খোলে কিছু বলা যেতে পারে! মাকে অন্য সময় সবকিছু বলেই অভ্যস্ত, কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে মাকে কিচ্ছু বলা যাবেনা।
পুরোপুরি দম বন্ধ অবস্থাতেই আমার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো।
সেদিন সারারাতের হৈহল্লায় আমার অপরিচিতকে ভাবার মতো কোনো সময়ই পাইনি। শুধু সকালের দিকে অল্প ঘুমানোর সময় রুমালটা জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলাম। হাহাকার বাড়ছিলো, কিন্তু সেটা দীর্ঘ হওয়ার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখি আশেপাশে অনেক মানুষ, বিয়ের সব জমজমাট আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। আমাকে আবার সাজগোজের জন্য বসতে হবে।
ছোটবেলা থেকে এই সাজ নিয়ে কতো রোমাঞ্চকর পরিকল্পনা ছিলো, অথচ আজ সবকিছু ফিকে লাগছে৷ এইজন্যই বোধহয় মানসিক প্রশান্তির জন্য হলেও ভালোবাসার মানুষকেই বেছে নেওয়া উচিত।

শাড়ী থেকে শুরু করে কনের যাবতীয় সরঞ্জাম ইতোমধ্যে এসে গেছে। গ্রাম থেকে আগত এক বড় আপু আমাকে গোসলের জন্য নিয়ে গেলো। তাড়াহুড়ো করে রুমালটাকে বালিশের নিচে রেখেই উঠে পড়লাম।
গোসল করে এসে অল্প নাস্তার সাথে সাথেই বসে পড়তে হলো মেকাপের জন্য। এর মধ্যে বাবা একবার এসেছিলেন, এসে জিজ্ঞাসা করেছেন আমার খারাপ লাগছে কিনা! খুব জোরপূর্বক হেসে বলছি নাহ লাগছেনা। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে ফের বের হয়ে গেলেন।

কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করছিলো বলে ফেলি, বাবা এই বিয়ে তুমি থামিয়ে দাও, আমি ভালো মতো এখনি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা। পরে তো সম্পূর্ণই শ্বাসরূদ্ধ হয়ে মারা যাবো।
আমাকে যখন একের পর এক মেকাপের প্রলেপ দিচ্ছিলো, তখন আমার চোখের জল সেগুলোকে বারবার নষ্ট করে ফেলতেছিলো। বারবার আমাকে বুঝাচ্ছিলো যেন কান্না না করি। কিন্তু কি করে বুঝাই যার যেখানে রুচিবোধ নেই,সেখানে কান্নাটাই একমাত্র সম্বল। আমি জানি আমাকে যতই জোরপূর্বক সাজাক, শেষ পর্যন্ত আমাকে ভূতের মতোই লাগবে। সবকিছু আমি নষ্ট করে ফেলবো!
রাতে ততটা কষ্ট অনূভুত হয়নি, এখন যতটা হচ্ছে। হয়তো সময়টা পিঠে এসে ঠেকেছে বলে!

দুনিয়ার মানুষ এতো নির্বোধ হয় কি করে? আর পাত্র? কি করে ভাবলো তার প্রয়োজনে বিয়েটা করলেই সেটা সম্পন্ন হয়ে যাবে? তার মতো বিশ্বাসঘাতককে আমি কোনোভাবে সমর্থন করবো? কি এমন দরকারের কথা উল্লেখ করেছিলো? নিশ্চয়ই কোথাও পছন্দ আছে, যেটা পরিবারে বলার সাহস নেই, তাই আমার মতো একজনকে পেলে সেটাকে সহজে হাতে পাবে। না না, আমি জীবন গেলেও উনার ভালোবাসাকে পেতে সাহায্য করবোনা, যেখানে আমার জীবনটাকে তেজপাতা বানিয়ে দিচ্ছে! ইচ্ছে করে আমাকে ফাঁসাচ্ছে!

ভাবনার মধ্যে আবার ভাবনা আসলো, এমন কিছু তো নাও হতে পারে। অন্য কিছু হবে হয়তো! উফফ তাহলে ওই এসএমএসটার মধ্যে আর কি রহস্য?
আচ্ছা আমি কি পালিয়ে যাবো? ওই নাটক সিনেমার মতো! কনে সাজে সজ্জিত হয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে গেলে কেমন হবে? কিন্তু আমার তো কেউ নেই, আর না আমি আমার সেই অপরিচিত ছাড়া অন্য কাউকে চাই! তাহলে আমার জন্য কি বিয়েটাই উত্তম পন্থা?
লোকটার মতিগতির উপর কি একটু ভরসা করবো? এভাবে দুশ্চিন্তা করলেও তো কিছু হবে না! ঘুরপাক খাওয়া হাজারখানেক ভাবনাকে ছুটিতে পাঠিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। যা হবার হবে!

প্রায় আধঘন্টা পর আমাকে ডেকে বলা হলো এবার সোজা হতে, সাজ শেষ। এবার শাড়ী পরাবে। আমিও বাধ্যমতো উঠলাম। এবার আর কাঁদলাম না। খুব চুপচাপ সয়েরয়ে যেতে থাকলাম। শুধু কনের সাথে হালকা ফটোশুটের পর্ব আসলো,শেষ হলো, দুপুর আড়াইটা বেজে গেলো তবুও পাত্রপক্ষ কেউ এলোনা। বাবা এদিক ওদিক পায়চারী করছে আর বারবার ফোন দিচ্ছে। বেশিরভাগ সময় ফোন রিসিভ হচ্ছেনা, হলেও অপরপাশ থেকে জ্যামে আটকা বলে কেটে দিচ্ছে৷ আমি তো এই অবস্থা দেখে সবার সামনেই বারবার হেসে ফেলতেছি, এই যাত্রায় আমার বাসনা সার্থক হোক, পাত্রপক্ষ একদম না আসুক, এই জ্যাম আজীবন থাকে যেন। এদিকে বাবা পাত্রের বাসা থেকে আমাদের বাসা পর্যন্ত পুরো রাস্তার সংবাদ নিতে শুরু করলেন, একে ওকে ফোন করে করে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন সত্যিই কোনো যানজট লেগেছে কিনা, কিন্তু সবাই বলছে রাস্তায় এমন কিছুই নেই। বাবার কপালের ঘাম আরো তীব্র হচ্ছে, তিনি ব্যস্ত পায়ে শুধু ফোনে তাকাচ্ছেন আর দৌঁড়ে দৌঁড়ে বাইরে যাচ্ছেন, বাবার অস্থিরতা দেখে কেন জানি আর খুশি হতে পারছিনা, সত্যিই মেয়ের বাবাদের কতো চিন্তা থাকে!

বিকেল ৩.৪৫ বাজে। আমাদের এখানকার সবাই মোটামুটি খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে আলাপ আলোচনা করছে। কেউ কেউ রসিকতার ছলে বলছে, মুনাইম সাহেব কি মেয়ের বিয়ের কথা বলে এমনিতেই আমাদের খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন নাকি?
আবার অনেকে বলছে, ছেলের বাপ মনে হয় জোর করে দিয়ে করাতে চাচ্ছিলো কিন্তু ছেলে এখন রাজী না, আর ছেলেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আনতেই এতো বেলা পড়ে যাচ্ছে৷
বাবা সবার কথার জবাবেই নিশ্চুপ। বেশ লজ্জাও পাচ্ছেন উনি।

আমিও ভাবছি কেন আসছেনা? পাত্র কি অবেলায় আমাকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে মনস্থির করতে পারলো? এতো কম বুদ্ধি তার? নাকি অন্য ঝামেলা?

৪ টা বাজে..
অপেক্ষা করতে করতে অর্ধেক মেহমান বিদেয় হয়ে গেছে। অল্প সংখ্যক মানুষ এখনো অপেক্ষা করছে বর আসে কিনা, আর বাকিরা আমাদের গ্রামের মেহমান, যারা এমনিতেও আজকে এখানে থাকতো। সময় যাচ্ছে আর আমার ভেতরটা হালকা লাগছে, তবে বাকিদের অবস্থা যে করুণ তা স্পষ্টই বুঝতে পারছি। বাবা ফোন করা বন্ধ করে দিয়েছেন৷ এখন একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে মুখের উপর হাত রেখে বসে আছেন।
মা বারবার পানি নিয়ে যাচ্ছে, আর শান্ত রাখার যথাযথ চেষ্টা চালাচ্ছে।
পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট, বাইরে গাড়ীর আওয়াজ শোনা গেলো। বাবা এক প্রকার পাগলের মতোই বাইরে ছুটে গেলেন। আমার ভেতরে একটা অদ্ভুত শিহরণ হলো, তাহলে কি এসেই গেলো?

মূহুর্তেই একটা চিৎকার চেঁচামেচি শুনলাম, একটা পিচ্চি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বলছে নতুন জামাই এসে গেছে, এসে গেছে৷
কিন্তু পরক্ষণেই সব বন্ধ হয়ে গেলো। আমি ভেতর থেকে চুপ করে যাওয়ার কারণ ধরতে পারলাম না, একদুইজন ছাড়া সবাই-ই বাইরে চলে গেছে, কেউ কোনো সংবাদ নিয়ে ভেতরে আসছেনা৷ তাদের তো এতক্ষণ বাইরে থাকার কথা না।

প্রায় ১৫ মিনিট পর চুপচাপ চেহেরায় আমার গ্রামের এক ভাবি আমার পাশে এসে দাঁড়ালো, উনার সাথে এতো পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও উনাকে বললাম,
‘ বাইরে কি হচ্ছে?

উনি শুকনোমুখে বললেন,
‘ ওই তোমার হবু জামাই নাকি আজ সকালে পালিয়ে গেছে, সম্পূর্ণই বেপাত্তা। তার বদলে তার ছোট ভাইকে বর সাজিয়ে আনা হয়েছে। তারা দুই ভাই নাকি তিন বছরের ছোট বড়। সমস্যাটা হলো এই ছেলের এখনো কোনো চাকরি হয়নি, তাই এটা নিয়ে বাইরে তোমার বাবাসহ আরো অনেকে দেরির কারণ এবং এই ছেলের ক্যারিয়ার নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে। জানিনা বিয়েটা হয় কিনা, এখন তোমার বাবার উপরে সবকিছু। মনে হয়না রাজী হবেন বলে! তার উপর দেরির জন্য অনেক অপমানিত হয়েছেন তিনি।
তবে শুনলাম ছেলে নাকি পড়ালেখায় খুব ভালো, চাকরিবাকরি কোনো একটা হয়ে যাবে শীগ্রই।

আমি ভ্রু কুঁচকালাম! বর পালিয়ে গেছে, ছেলেরাও এমন করে নাকি? তাও আবার বিয়ের দিন! হুট করে এভাবে পালানোর কারণ কি কে জানে?
তারপরই আমার মাথায় আসলো এই পাত্র ওই পাত্রের তিন বছরের ছোট? মানে আমার অপরিচিত’র বয়স তো এমনই হতে পারে। আমার কি সন্দেহপ্রবণতায় হলেও ছেলেটাকে বাবা ফিরিয়ে দেওয়ার আগে একবার দেখা উচিত? যদি আমার প্রিয় সে হয়?

চলবে….

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার