প্রিয় অপরিচিত পর্ব-০৫

0
378

#প্রিয়_অপরিচিত [০৫]

আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না আমার সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে!? এও কি কখনো সম্ভব হতে পারে? মনে করছিলাম অপরিচিতকে পাওয়াটা আমার জন্য আজীবনই কল্পনা, যেটা সবসময় আমাকে সব মানুষের ভীড়ে ছুটতে বাধ্য করবে, শুধু পরখ করতে সেখানে আমার কাঙ্ক্ষিত মানুষটা আছে কিনা!
কিন্তু এখন তো দেখি মেঘের সাথে সাথেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমে পড়েছে, এই বাড়িতে একদম বউ হয়ে এসেছি তার৷

আমাকে এভাবে বিছানার উপর দাঁড়াতে দেখে উনি জোরে বলে উঠলেন,
‘ আরে করছেন কি? করছেন কি? বসুন! এটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ার কি আছে? সেই কবেকার কথা, ভুলেই গেছিলাম আমি৷ কিন্তু আপনার তিলদুটো সব মনে করিয়ে দিলো, কেননা বাস থেকে যখন লোকটা আপনাকে বকাবকি করছিলো তখন আমি আপনার দিকে তাকিয়েছিলাম, আর ভাবছিলাম গালের বড় তিলটা না থাকলেই পারতো ৷ হাহাহা আমার আবার অদ্ভুত একটা স্বভাব আছে,যদিও এটা ঠিক না, তবুও আমি শরীরের বাড়তি কিছু কিছু ব্যপার নিয়ে হিসাব কষি, এটা না থাকলে কেমন লাগতো, এটা এমন হলে কেমন হতো, এই রকম! তো এই কারণেই বোধহয় আপনাকে একটু খেয়াল করে দেখা হয়েছিল! এটা ঠিক যে আপনার এই অতিরিক্ত তিলটা না থাকলে দেখতে বেশি ভালো লাগতো!
না না আপনি দেখতে খারাপ বলছিনা! মানে সত্যিকার মনোভাব ব্যক্ত করাটা আমার কিছুটা বদভ্যাসের সারিতে পড়ে, মিথ্যা মিথ্যা প্রশংসা করা আমার দ্বারা হয়না, বললে ভালো মন্দ দুটোই বলি, আর তার জন্য অতি দুঃখিত।

আমি আমার গালের তিলটার উপর হাত রেখে মুচকি হেসে বললাম,
‘ আরে না, এটা তো আমার জন্য সৌভাগ্য! এটার জন্যই আজ আপনাকে চিনলাম, সেদিন তো আপনাকে ধন্যবাদটুকুও দিতে পারিনি।

আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার মধ্যে উনার ফোনে আসে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে ফোনের লাউড স্পিকার বাড়িয়ে বলে উঠলেন,
‘ কোথায় আছো ভাই?

অপরপ্রান্ত থেকে জবাব আসলো,
‘ অনিক, আমি ঠিকঠাক আছি,কানাডা যাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করতেই ব্যস্ত ছিলাম, তাই সারাদিন আর বাড়ির খবর নেওয়া হয়নি, বাবা শান্ত হয়েছে? আর তোর বউ কোথায়? উল্টা পাল্টা কিছু বলেছে?

আমি হাসলাম, কিন্তু আমার স্বামী যার নাম এখনি জানলাম, সেটা হলো অনিক!
উনি উনার ভাইয়ের কথার জবাবে বললেন,
‘ আমি কারো উল্টা পাল্টা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত না, আমাকে যে ভালোবাসে আমি তাকেই ভালোবাসবো, অন্যের ভালোবাসার উপর আমার লোভ নেই, আর মেয়েকে আমি আগেই চিনতাম তাই অবশ্য এতক্ষণ কথা বলছিলাম, এখন চলে যাবো। আজ এই রুমে আমি থাকছিনা!

ওখান থেকে অনিকের ভাই মানিক বলছে,
‘ আরে শোন মেয়েটা এমন একজনকে পছন্দ করে যে কিনা সেটা জানেই না, চেষ্টা করে দেখতে পারিস মেয়েদের কোমল মন,একটু চাইলেই জয় করে নেওয়া যায়!

মানিকের এই কথা শোনার সাথে সাথে উনি আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে লাউড অফ করে দিলেন আর গটগট করে বেড়িয়ে গেলেন। বোধহয় ভাইয়ের মুখে এমন কথার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।

আমি ভাবলাম আবার আসবে, কিন্তু অনেক সময় চলে গেলো অনিক আর আসলোনা। দরজা খোলে উঁকি মেরেছি কিন্তু দেখিনি। আমি আমার ভেতরকার কথাগুলোও বলতে পারিনি, বলতে পারিনি আমি যাকে ভালোবাসি সে অন্য কেউ নয়, সে নিজেই! তার জন্যই আমি বিয়ে করতে অনিচ্ছুক ছিলাম, অরাজী ছিলাম, অবাধ্য ছিলাম। কি করে বুঝাবো এখন? কি করে বলবো? সব বিশ্বাস করবে তো?

কিন্তু আমি উনাকে ঠিক মিলাতে পারছিনা, কেন মিলাতে পারছিনা? উনি কি আসলেই সেই অপরিচিত? এমন অদ্ভুত চুল, যদিও ভালোই লাগে দেখতে। তারপর আবার গোঁফসহ দাঁড়ি,এটা সম্পূর্ণই আলাদা লাগছে। আমার মনে হচ্ছে না এক বছর পর উনি এমন রূপ ধারণ করতে পারেন। আবার হতেও পারে, মানুষের তো মর্জির ঠিক নেই!
কিন্তু এভাবে চলে গেলো কেন? কাউকে ভালোবাসি বলে? উনার ভাই কি তাহলে সম্পূর্ণ কাহিনী খোলে বলেনি? শুধু বলছে যে আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি?
আর উনিই বা কানাডা যেতে চাচ্ছেন কেন? কি আছে কানাডায়?
একটু আগে ভাইকে কি সুন্দর বুদ্ধি দিলো মেয়েদের মন কোমল, চেষ্টা করলেই পটে যাবে, তাহলে নিজে এটার উপর ভরসা না করে ভাইকে কেন চাপিয়ে দিলো? উনার তাহলে প্রিয় কেউ আছে! হুম হুম নিশ্চয়ই আছে!

এখন শুধু আমার উনাকে আমার ব্যপারটা খোলে বলা উচিত।
বলা উচিত গত এক বছর ধরে এই মানুষটার জন্য আমার ভেতরটা ঠিক কতটা উতলা ছিলো, কতটা ভালোবাসা সঞ্চয় করেছে সেখানে! শুধু তাকে একটাবার বলবো বলে আমার বহুদিন বাঁচার ইচ্ছে ছিলো, এরপর মৃত্যুতেও আমার আফসোস নেই।
যাক সমস্যা নাই, আমারই তো সে! খুব দ্রুত বলে দিবো, আর আমার করে নেবো আমার ভালোবাসাকে!

দু হাত চোখেমুখে চেপে আনন্দের সহিত লজ্জামাখা হাসিতে বিভোর হলাম।
বালিশে মুখ গোঁজে আরো একগাদা সুন্দর কল্পনাকে আঁকড়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম!

কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো ভোর চারটায়, কিছু কিছু মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসছে, তাকিয়ে দেখলাম দরজা ভেতর থেকে লক করা, কিন্তু আমি তো লক করে ঘুমাইনি। বাইরে থেকে কেউ এসে লক করে দিয়ে গেছে। অনিক তাহলে আবার এসেছিলো? আর আমি কিনা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
উঠে রুমের এদিক ওদিক পায়চারী করতে লাগলাম, মনে মনে আওড়াতে লাগলাম কি করে ওকে সবকিছু খোলে বলবো?

পায়চারী করতে করতে হঠাৎ আমার মাথায় আসলো রুমালটার কথা। হ্যাঁ বাড়িতে গিয়ে সবার আগে রুমালটাকে বের করবো, তারপর ওটা দেখিয়েই তবে বিস্তারিত বলবো। তাছাড়া আমার পরিবারের সবাই-ই তো জানে আমার রুমালওয়ালার কথা, এমনকি উনার ভাইও জানে।
আমি একদম মনস্থির করে বসলাম, এটাই করবো। আজকে বাড়িতে গিয়েই সব বলবো তাও প্রমাণসহ!
অতঃপর আমি ফ্রেশ হয়ে ফজর পড়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কবে ভোরের আলো ফুটে৷ একটু দেরিই মনে হচ্ছে, সময় যেন কাটছেনা। আমার ভেতর তাড়া করছে কবে সকাল দুপুর পেরিয়ে বিকেল হবে, আর আমি বাড়িতে যাবো!
কিন্তু রুমালটা? ওটা কোথায় আছে?
প্রশ্ন জাগছে, মাকে কি ফোন দিয়ে জানতে চাইবো? আমার কাছে ফোনও নেই, আর মাকে জিজ্ঞাসা করলেও বিস্তারিত বলতে হবে, ফোনে এসব কি করে বলা যায়?
কিন্তু ওটা হারিয়ে গেলে আমি তো প্রমাণ দেখাতে পারবোনা? যদি ভাবে ভালোবাসা নয় বরং বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এখন বাধ্য হয়ে ওর দিকে দৃষ্টি দিয়েছি এবং বানিয়ে ওইদিনের ঘটনা দিয়ে মিথ্যে গল্প সাজিয়েছি তাহলে কি করবো? কি করেই বা বিশ্বাস করবে? মাত্র কয়েক মিনিটে কি কাউকে ভালোবাসে মানুষ? আমি তো একটা পাগল, কৃতজ্ঞতা থেকে ভাবনার ঘোরে তার মোড় ঠেকেছে গিয়ে ভালোবাসায়। এমনটা কি দেখা যায়?

সময় কচ্ছপের গতিতে যেতে লাগলো। দু একবার অনিককে আমি দেখেছি, কিছু কাছাকাছি না, দূরে দূরে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত অবস্থায়। দেখলেই আমি একদৃষ্ট হয়ে যাই, তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি সে আমার অপরিচিত তো? কেমন অবিশ্বাস্য যেন!

দুপুর হলো,কনেপক্ষ থেকে মানুষজন আসলো খাওয়াদাওয়া করলো, বাড়িঘর ঘুরেফিরে দেখলো এবং অবশেষে আমাকে ও অনিককে একসাথে নিয়ে ফেরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। অনিক গাড়ীতে বসেই আমাকে বললো,
‘ অনেক খুশি?

আমি ঠোঁটে অজান্তে লেগে থাকা হাসিটা আড়াল করার চেষ্টা করে বললাম,
‘ হ্যাঁ বাবার বাড়ি গেলে সব মেয়েরাই খুশি থাকে।

অনিক মুখ বাঁকিয়ে বললো,
‘ মনে হচ্ছে যেন কয়েক বছর পর যাচ্ছেন!

আমি হাসলাম। হাসিখুশির আসল কারণ তো কেবল আমিই জানি!
বাড়ি পৌঁছে প্রথমেই আমি দৌঁড়ে সেই বিছানার কাছে গেলাম যেখানে বিয়ের দিন আমি শুয়েছিলাম আর তার নিচে রুমালটা রেখেছিলাম। মা পেছন পেছন আসলো, মাকে কেমন আছে কথাটাও জিজ্ঞাসা করিনি। বিছানা উল্টে পাল্টে দেখলাম, নেই! আমি অস্থির হয়ে মার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ মা আমার হলুদ রুমালটা কোথায়?

মা একটু অবাক হয়ে বললো,
‘ আমি কি জানবো?

সেসময়ই রুমে অনিক প্রবেশ করলো। মা সাথে সাথে বের হয়ে গেলো। অনিকের পুলকিত চেহেরা, আমার প্রতি টান আছে এমন একটা ভঙ্গিমা তার দৃষ্টির মধ্যে স্পষ্ট। যদিও কাল রাতে রুমে না থাকার কারণ আমি জানিনা, কিন্তু ওর চোখ কেমন যেন ভিন্ন কথা বলে, সবকিছু না জেনেও যেন অদ্ভুত একটা আকর্ষণ আমার প্রতি। এইতো এখন দুইহাত বুকে ভাঁজ করে আমার দিকে নেশা নেশা চোখে তাকিয়ে আছে, আমার অনূভব হচ্ছে সেটা আমি আর কিছুক্ষণ দেখলে খুন হয়ে যাবো।

চোখ নামিয়ে ধীরে বললাম,
‘ বসুন!

অনিক দাঁড়িয়েই রইলো। আমি কথা না থামিয়ে ওর দিকে আবার তাকিয়ে একনাগাড়ে বললাম,
‘ আপনার পকেটের রুমালটা দেখাবেন?

অনিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো, তারপর পকেটে হাত দিয়ে বললো,
‘ আমি তো রুমাল ব্যবহার করিনা।

আমি চমকে উঠলাম! বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকালাম৷ অনিক হাসতে হাসতে বললো,
‘ এমনকি কালকে আমি বর বেশেও মুখে হাতে রুমাল না নিয়ে বিয়ে করেছি।

আমার সারা মুখ কেমন যেন চুপসে গেলো। তবুও কষ্টের সাথে আলতো হেসে বললাম,
‘ আগে তাহলে করতেন?

অনিক চেয়ার টেনে উল্টোদিকে পা বের করে বসে বললো,
‘ নাহ ম্যাম,আমি কখনোই রুমাল নামক অদ্ভুত জিনিসটা ব্যবহার করিনি,করলে টিস্যু ব্যবহার করি, যেটা একবার ব্যবহারে ফেলে দেওয়া যায়। কেন বলেন তো? উপহার দিতে চান নাকি? না না দিলে অন্যকিছু দেন, এসব নয়।

আমি এবার ব্যপক চমকে গেলাম। তাহলে আমার সেই হলুদ রুমালওয়ালা? উনি নন!
রাস্তার গল্প কি করে বলছিলো? উনার ভাই পুরো গল্প বলে আমার দূর্বলতাকে কাজ লাগানোর কথা শিখিয়ে দেয়নি তো? আমি তো চিনতেও পারছিনা, আর রাস্তার সেই সামান্য গল্প তো মিথ্যার ছলেও বলতে পারে, কারণ সবাই জানে আমি সেই মানুষটা চিনিনা।
অচেনা কেউ দাবী করলেও তাকে বিশ্বাস করে নিতে পারি!
আমার চারপাশ বেশ উঞ্চ লাগছে, আমি ব্যপকভাবে ঘামছি আর পিছাচ্ছি, অনিক অবাক চোখে আমাকে দেখছে!

চলবে……

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার