প্রিয় পৃথিবী পর্ব-০৪

0
332

#প্রিয় পৃথিবী
জান্নাতুল নাঈমা
পর্ব-০৪

প্রথম প্রেমের অনুভূতি একেক হৃদয়ে একেক ভঙ্গিতে সঞ্চারিত হয়৷ প্রিয়র হৃদয়েও ভিন্ন এক ভঙ্গিতে প্রথম প্রেমের সঞ্চার হয়েছিল৷ প্রথম বারের মত সে অনুভব করেছিল তার বুকের মধ্যস্থলে কিছু একটা দ্রুততার সঙ্গে চলছে৷ নিঃশ্বাস, প্রঃশ্বাস তো আগেও চলেছে৷ কিন্তু আকস্মিকভাবে তার বেগ বেড়ে যাওয়ার কারণটা তখনও উপলব্ধি করতে পারেনি। গুটিকয়েক দিন বন্ধুমহলে প্রচণ্ড অস্থিরতার সঙ্গে সময় কাটল তার। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বন্ধুদের তার সমস্যাটির কথা জানাতেই তারা বলল, উষাকে তুই সত্যি সত্যি ভালোবেসে ফেলিসনিতো? ব্রেকআপ হওয়ার পর পর এমন অস্থিরতা তো ভালো কথা নয়! বন্ধুদের এমন কথা শুনে মন, মেজাজ ক্রমশ বিগড়ে গেল তার। ভালো টালো সে কাউকে বাসেনি। প্রেমটেমও সেভাবে হয়ে ওঠেনি। নিজেকে সে খুব ভালো মতন চেনে। তাই বিরক্তিতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া কমিয়ে দিয়ে ঘরকোনা হয়ে রইল কদিন। ফাতিহা বেগম ছেলের মাঝে বিশেষ পরিবর্তন দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। প্রিয়ও তার স্বভাবের বাইরে গিয়ে ঘর বন্দি সময় কাটাতে লাগল। এগারোদিনের মাথায় হঠাৎ ভোর সকালে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল তার। সেই স্বপ্নটা দেখেই ঘটে গেল অঘটনটি৷ তড়িঘড়ি করে নিজের রুম থেকে ছুটে গেল পূর্ণতার রুমে। দরজা খোলা ছিল বিধায় সহজেই রুমে ঢুকেও পড়ল। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোতে কম্বল গায়ে দিয়ে গুটিশুটি হয়ে পূর্ণতা আর পৃথিবী ঘুমুচ্ছিল। পৃথিবীর ঘুমন্ত সুশ্রী মুখটা দেখতে পেয়েই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সে৷ অনুভব করল তার উত্তপ্ত বুকটায় কেউ যেন প্রশান্তির বাতাস ছেড়ে দিল। লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কটা যেন নিমিষেই তার নিজের সত্তায় ফিরে এলো। দু-হাত কোমড়ে রেখে বুক টেনে লম্বা করে নিঃশ্বাস ছাড়ল প্রিয়। প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে রইল পৃথিবীর দিকে। ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগল হচ্ছে টা কী? তারপর আকস্মাৎ মনে পড়ে গেল পৃথিবীর বলা সেই কথাটি। হৃদস্পন্দনের সহসা ছটফট অনুভূতিটুকু তীক্ষ্ণ বিবেকে টের পেল ঠিক তখনি। কেমন যেন অধৈর্য্য হয়ে অশান্ত রূপে হাঁটু গেঁড়ে বিছানার পাশে বসল৷ দু-হাত বাড়িয়ে পৃথিবীর কোমল গালে প্রথম বারের মতো স্পর্শ করল। উত্তপ্ত ভারি নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ডাকতে শুরু করল,

-” এই মেয়ে এই ওঠ, ওঠ বলছি। ”

ঘুমের ঘোরে এমন ভয়ানক ডাক শুনে ভয়ে তটস্থ হয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসল পৃথিবী। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাঁপতে শুরু করল তার। ঘুমকাতুরে দৃষ্টিজোড়ায় নিমিষেই ভয়কাতুরে ভাব এলো। ভয় ভয় দৃষ্টিতে প্রিয়র দিকে তাকিয়ে শুষ্ক গলায় ঢোক গিলল, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

-” কী হয়েছে ? ”

প্রিয় এক নজর পৃথিবীকে দেখেই দৃষ্টি সংযত করে নিল। আশপাশে বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। কয়েক পল সময় অতিবাহিত হতেই পৃথিবী সংবিৎশক্তি ফিরে পেয়ে প্রচণ্ড লজ্জিত হয়ে উড়না খুঁজতে শুরু করল। কিন্তু হায় লজ্জারা যেন আজ তার পিছু ছাড়বে না। কোথাও পেল না তার লজ্জা সংবরণ করা উড়নাটি। শেষে কম্বল টেনে নিজেকে ঢেকে নিল। প্রিয় চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

-” তাকাচ্ছি না, রিলাক্স। ”

পৃথিবী কাচুমাচু হয়ে বসে রইল। প্রিয় মেঝেতে দৃষ্টি স্থির রেখে একহাত বিছানায় রাখল। অন্যহাতে তার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছল৷ এই শীতেও সে কেন ঘামছিল সেদিন পৃথিবী বুঝতে পারেনি। প্রিয় তার নাজেহাল অবস্থা ঠিক করতে করতেই বলল,

-” দুঃস্বপ্ন দেখেছি তুই এক হাঁদা টাইপ ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছিস। কী সাংঘাতিক স্বপ্ন ভাব, এমন স্বপ্ন দেখতে পারি বল? তোর বাপ, ভাই আস্ত রাখবে আমায়? ”

পৃথিবীর ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল। বোকামনে শুধু প্রিয়র পানে তাকিয়ে রইল। প্রিয় পুনরায় নিজের চুলগুলো আঙুলের ফাঁকে নিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল,

-” দেখতে এসেছিলাম ওটা স্বপ্ন নাকি সত্যি৷ ”

চাপা নিঃশ্বাস ত্যাগ করল পৃথিবী। প্রিয় বোধহয় শুনতে পেল সে নিঃশ্বাসের শব্দ। তাই সহসা তার দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সে দৃষ্টির গভীরে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিগুলো প্রিয় কিন্তু বোঝাতে চেয়েছিল। তাই তো বলেছিল,

-” তোর বর যদি ভাগ্যবান হতে পারে আমি কেন পারব না? ”

পৃথিবী হকচকিয়ে গেল। অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,

-” প্রিয় ভাইয়া, কি বলছো এসব? ”

প্রিয় বুঝল এই মেয়ে এত সহজে বোঝার নয়৷ তাই কোনরকম ভণিতা ছাড়াই সে বলল,

-“তোর লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটি যতবার মনে পড়ছে ততবার প্রবল অস্থিরতায় আমার দেহ নীল হয়ে যাচ্ছে। এই লালকে দেখলেই নীল কেন ফুঁসে ওঠে বলতে পারিস? ”

-” তুমি কী নেশা টেশা করেছো ভাইয়া? ”

আশ্চর্য হয়ে পৃথিবীর দিকে তাকালো প্রিয়। রাগে গটগট করতে করতে বলল,

-” চুপপ। আমাকে তোর নেশাখোর মনে হলো? তাই যদি মনে হয় তাহলে নেশাটা হলি তুই! মেইন কালপ্রিট তুই! কে বলেছিল তোকে অমন লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে বরের ভাগ্যবান হওয়ার খবরটি আমাকে জানাতে? ”

ধমক খেয়ে হতভম্ব পৃথিবীর চোখ দু’টো টলমল হয়ে গেল। প্রিয় একই মেজাজে বলতে লাগল,

-” তোর এই একটা ভুলের জন্যই আজ আমি দিশেহারা। শেষ পর্যন্ত খালাতো বোনের প্রেমে পড়ে গেছি। ভাবতে পারছিস তোর লজ্জার জন্য আমার মত ভদ্র ঘরের ছেলেটার কী দশা হলো! ”
***
অতীতের স্মৃতিগুলোর সমাপ্তি দিয়ে আনমনে হেসে ওঠল পৃথিবী। ইস কী ছিল সেই দিনগুলো। ভদ্রঘরের ছেলেটা তার প্রেমে পড়ে গেল, ভালোও বেসে ফেলল। মাঝরাতে বাড়ি ফেরা ছেলেটা হঠাৎই রাত আটটা, বড়োজোর দশটার পরে বাইরে থাকার কথা ভুলে গেল। তার ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব নিয়ে নিল অতিসন্তর্পণে। সে কী খেতে ভালোবাসে? কী তার পছন্দ, অপছন্দ, তার প্রিয় রঙ, প্রিয় মানুষ, সবটা সবটাই জেনে নিল। বুঝে নিল আগাগোড়া পুরো পৃথিবীটাকেই৷ কঠিন ভালোবাসার বেড়াজালে বন্দি করে নিল খুব কৌশলে।
ধীরে ধীরে ভালোবাসা গভীর হলে, সে ভালোবাসায় যোগ হলো আদর, যত্ন, হারানোর ভয়। প্রেমে যখন আদর, যত্নে ভরপুর থাকে কী একটা মিষ্টি অনুভূতির সৃষ্টি হয় না? তেমনি মিষ্টি প্রেমে আবদ্ধ হলো ওরা দু’জন। প্রেমের অবস্থান মিষ্টত্বে ভরপুর হলে পরিণয়ে বিপর্যস্ত অবস্থান অনিবার্য। আকাশ বাতাস স্বাক্ষী রেখে যে প্রেম গাঁথা হয়েছিল সে প্রেমের পরিণয়ের স্বাক্ষী হতে মাটির তৈরি মানব মন যে বড্ড নারাজ রইল।
.
.
অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে কখন যে চোখদুটি লেগে গেল টেরও পেল না পৃথিবী। কিন্তু যখন ঘুম ভাঙলো তখনকার সময়টি রাতের শেষভাগ। ঘুম ভাঙতেই অনুভব করল তার নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে৷ বুকের ভিতরটা যেন চৈত্রের খাঁখাঁ রোদে পুড়তে পুড়তে মরুভূমির রূপ ধারণ করেছে। কী যে শূন্যতা কী যে ব্যাকুলতা বোঝানো সম্ভব না৷ আকস্মিক এই বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ব্যাগপত্র গুছিয়ে পরিবারের সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ ঘটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো পৃথিবী ৷ কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হলো না। ধরা পড়ে গেল মেজো ভাই সাইফুল্লাহর কাছে। ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে রাগি, জেদি সাইফুল্লাহ। পরিবারের সকলেই জমের মত ভয় পায় তাকে৷ পৃথিবীও ভীষণ ভয় পায় , প্রচণ্ড ভালোওবাসে। সেই ভয় এবং ভালোবাসার প্যাচে পড়েই প্রিয়র সঙ্গে ভয়াবহ বিচ্ছেদ ঘটে তার৷ একমাত্র বোনের জন্য সাইফুল্লাহ বহু পূর্বেই ঠিক করে রেখেছিল তার বন্ধু জায়িনকে৷ জায়িন এ বছরই লেকচারার হিসেবে শহরের একটি সুনামধন্য কলেজে যুক্ত হয়েছে। সাইফুল্লাহর কাছে পৃথিবীর জন্য এরচেয়ে বেটার অপশন প্রিয় হতে পারে না৷ তাই আদরের বোনটির ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার জন্য যত কঠিন হওয়া যায় সে হলো৷ বন্ধুকে দেওয়া কথাটি রক্ষা করার জন্য জঘন্যতম কাজটি সে করল৷ কাগজে কলমে বিচ্ছেদ দেওয়ার পূর্বে হঠাৎই ফারজানা বেগমসহ সু’আদ, সাউদ এবং পৃথিবী চারটে প্রাণই নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সাদমান তাদের পাঁচতলার পুরো এপার্টমেন্ট ভাড়া দিয়ে অন্যত্র চলে গেল। পরেরদিন থেকেই পুরো পরিবারকে আর খুঁজে পাওয়া গেল৷ একমাত্র সাদমান ব্যতীত৷ তার অফিসে গিয়ে প্রিয় যখন হানা দিল। সাদমান তাকে সমস্ত সত্যি ঘটনা খুলে বলল৷ কিন্তু লাভ হলো না৷ কারণ সত্যি এটাই যে সাইফুল্লাহ ইচ্ছেকৃত ভাবেই সাদমানকে তাদের ঠিকানা দেয়নি। নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য শুধু প্রিয়র ধরা, ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে তারা৷

সাইফুল্লাহর করা এই ষড়যন্ত্র প্রিয়র শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনই এক জেদ সৃষ্টি করল যে সে নাওয়া,খাওয়া বাদ দিয়ে তিন মাস বদ্ধ উন্মাদ হয়ে খুঁজল পৃথিবীকে। সে এতটাই উগ্র আর হিংস্র হয়ে ওঠল যে নিজের মা’কে পর্যন্তও গ্রাহ্য করা বন্ধ করে দিল৷ তবে তার বাবা ইশতিয়াক রহমান সব সময় তার পাশে রইলেন। শেষ পর্যন্ত পুত্রবধূর খোঁজে সিআইডির সহায়তাও নিলেন তিনি। যেহেতু বিষয়টা আত্মীয়ের মাঝে তাই তেমন কোন ঝামেলা সে করলেন না৷ শুধু গোপনে পৃথিবীর স্থানটি নিশ্চিত করলেন৷ এবং ছেলেকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করতে বললেন।তিনমাস উনিশ দিনের মাথায় পৃথিবীর নাগাল পেল প্রিয়৷ কিন্তু বুঝতে দেল না কাউকে। যে বুকে শুধুমাত্র পৃথিবীর জন্য ভালোবাসা লালন করত সে বুকে এখন জেদ আর হিংস্রতা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। সেই হিংস্রতা দিয়েও নিজের জিনিসটাকে নিজের কাছে নিয়ে আসার জন্য উদ্যত হয়েছিল সে৷ কিন্তু যতবারই আড়াল থেকে পৃথিবীর হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রীর দর্শন পেয়েছে ততবারই দমে গেছে৷ মায়াযুক্ত ভালোবাসা গুলো বড়ো ভয়ানক হয়৷ সে ভয়ানক অনুভূতিতেই থমকে ছিল সে৷ এদিকে ইশতিয়াক রহমান একদিন ছেলেকে বললেন,

-” এবার তোমার নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিৎ। তারপর আমি সাইফুল্লাহর মুখোমুখি হতে চাই। ”

বাবাকে সমর্থন জানিয়ে সেই চেষ্টাই করতে লাগল প্রিয়। দিন পেরিয়ে রাত আসে, রাত পেরিয়ে দিন৷ সূর্যকে বিদায় জানিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে কালো ছায়া। আকাশে দীপ্তি ছড়ায় নক্ষত্রেরা। সূর্যের আগমনে চন্দ্র লুকায়, চন্দ্রের আগমনে সূর্য। পৃথিবীর এই গোলকধাঁধায় নিজের জীবনটাও ধাঁধাময় লাগতে শুরু করে প্রিয়র৷ তবে মাথায় রাখে আঁধার শেষেই আলো আসে। তার এই বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণিত করে বিয়ের বয়স এক বছর একদিনের মাথায় বাড়িতে ডিভোর্স পেপার আসে৷ যেখানে স্পষ্ট পৃথিবীর করা সাইন রয়েছে! চেয়ারম্যান বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এলেও প্রিয় সেদিন ডিভোর্স পেপারটি হাতে নিয়ে প্রাণখুলে হাসলো। তার সাদাটে দৃষ্টিজোড়ার বীভৎস রঙটি কিন্তু ঠিক দেখতে পেল ইশতিয়াক রহমান। তাই ছেলের পাশে গিয়ে বসে স্বান্তনা দিতে উদ্যত হলেই প্রিয় তর্জনী উঁচিয়ে নিজের ঠোঁটযুগল চেপে ধরল। বলল,

-” চুপ, একদম চুপ। ”

ইশতিয়াক রহমান দমবন্ধ করে বসে রইল৷ সুক্ষ্ম নজরে ডিভোর্স পেপারে চোখ বোলালো প্রিয়।সাইনটায় আবেগি হয়ে হাত বোলালো৷ অনুভব করার চেষ্টা করল কতখানি ব্যথা লুকিয়ে আছে তাতে। তারপর আনমনে হেসে ওঠল৷ কলম হাতে নিয়ে সাইনের উপর দাগ টানলো৷ যেমনটা আমরা পরীক্ষার খাতায় ভুল বানান লিখলে দাগ টেনে দেই ঠিক তেমনটা। ইশতিয়াক রহমান স্তব্ধ হয়ে বসে রইল৷ ফাতিহা আর পূর্ণতা আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কিন্তু প্রিয় হাসতে হাসতে সাইনের নিচে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দিল,

– ” পাক্কা সেয়ানা মেয়ে তুই! বিয়ের সময় কবুল বলতে গিয়ে তো ভুল করিসনি, এক ঢোক গিলে সময়ও নিসনি। অথচ ভাইদের প্ররোচনায় ডিভোর্স পেপারে সাইন করে পাঠালি! তবুও ভুল সাইন। যদি ইচ্ছে করে ভুল করে থাকিস তাহলে বড্ড সেয়ানা হয়ে গেছিস। আর যদি না-জেনে ভুল করে থাকিস তাহলে বলব তোর কংস ভাইদের থেকে একটু বুদ্ধি টুদ্ধি ধার টার নিস। ”

এ পর্যন্ত লিখে পেপারগুলো বাবার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল,

-” সোজা আঙুলে ঘি ওঠবে না জেনেও আঙুল বাঁকাতে চাইনি। শুধুমাত্র আমার মায়ের বড়ো বোনটার জন্য। কিন্তু আঙুল কীভাবে বাঁকিয়ে কীভাবে ঘি ওঠাতে হয় এবার সাইফুল্লাহ বুঝবে!”
..
সমস্ত পরিকল্পনা করেই প্রিয় বাড়ি থেকে বের হয়৷ কিন্তু যথাস্থানে গিয়ে পায় না কাউকেই৷ বাড়িওয়ালার কাছে খবর পায় তারা এয়ারপোর্টে গেছে৷ এ’কথা শুনে বুকটা ধক করে ওঠে প্রিয়র৷ দেহ থেকে যেন প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কিন্তু যখন শুনল সাইফুল্লাহ একাই আমেরিকাতে পাড়ি জমাচ্ছে তখন কিছুটা শান্ত হলো৷ সে আগেই জানতো সাইফুল্লাহ আমেরিকায় জবের ট্রাই করছে প্রায় তিন বছর যাবৎ৷ তার সে দীর্ঘদিনের চেষ্টা সফল হওয়াতে নিশ্চয়ই আর দেরি করেনি৷ কিন্তু এত সহজে মা, বোনকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে? বিষয়টা সহজে হজম করতে না পেরে অপেক্ষা করতে লাগল সে। রাত প্রায় এগারোটার দিকে পৃথিবী, ফারজানা বেগম আর সাউদ ফিরল। তাদের সঙ্গে অপরিচিত একজন যুবকও ছিলো৷ প্রিয় বাড়ির সামনে কয়েকজন ছেলেপুলে নিয়ে বাইকের ওপর বসে ছিল সে। এমন সময় সাদা ঝকঝকে একটি গাড়ি এসে থামলো ওদের সামনে৷ গাড়ি থেকে প্রথম নামলো সাউদ আর ফারজানা। তারপর সহসা সামনের ডোর খুলে নামল পৃথিবী। ড্রাইভিং সিটে সেই অপরিচিত যুবকটিকে দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেল প্রিয়র৷ তড়াক করে বাইক থেকে নেমে এসে পৃথিবীর এক বাহু চেপে ধরল৷ হিংস্র কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

-” ও কে? ”

স্তম্ভিত হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল পৃথিবী। তাকিয়ে রইল প্রিয়র পানে৷ প্রিয় পুনরায় দাঁত কিড়মিড় করে প্রশ্ন করল,

-” ও কে? ”

পৃথিবীর গলা কেঁপে ওঠল। কাঁপা কণ্ঠেই মৃদুস্বরে বলল,

-” ফিয়ন্সি!”

কথাটি শোনামাত্রই ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পৃথিবীর গালে কষিয়ে একটি থাপ্পড় মারল প্রিয়৷ ফলাফল সরূপ ঠোঁটের কোণা বেয়ে তিরতির করে রক্তের স্রোত নামতে শুরু করল৷ এমন ঘটনায় হতবাক হয়ে জায়িন দ্রুততার সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে এসে প্রিয়র কলার চেপে ধরল। বলল,

-” হাউ ডেয়ার ইউ! আমি তোমাকে পুলিশে দেব৷ ”

প্রিয়ও একইভাবে কলার চেপে ধরে চিৎকার করে বলল,

-” শালা, আমার বউকে নিয়ে গাড়ি চড়ে বেরাস আবার আমাকেই হুমকি দেস৷ ”

এটুকু বলেই ফারজানা আর সাউদের দিকে ক্রুর চোখে তাকালো। বলল,

-” তোমরা যা করলে না? খুব একটা ভালো করলে না৷ এবার আমাকে আঁটকে দেখিও। ”

সেই রাতেই পৃথিবীকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গেল প্রিয়৷ সাদমানকে ফোন করে ফারজানা বেগমের ঠিকানাও দিলো। যাতে সে এসে তার মাকে নিয়ে যায়। পাশাপাশি জায়িনকে বেশ হুমকি ধামকি দিয়ে বলে গেল,

-” পারলে আমার বাড়ি থেকে আমার বউকে নিয়ে আসিস৷ দেখি কতবড়ো বুকের পাটা তোর। ”

জায়িন অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল,

-” দেখুন আপনাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। ডিভোর্সের পর এটা অন্যায়। ”

প্রিয় যেহেতু ডিভোর্স পেপারে সাইন করেনি সেহেতু সে নিশ্চিন্ত মনে পৃথিবীকে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে ফারজানাকে বলে গেল,

-” তোমার মেয়েকে আমি ছাড়ব না। ছাড়ব না তোমার মেয়েকে আমি! আজকের পর তুমি ভুলতে বাঁধ্য তোমার কোন মেয়ে আছে, তোমার ছেলেদের কোন বোন আছে৷ ”

চলবে…