প্রিয় পৃথিবী পর্ব-০৭(শেষ পর্ব)

0
675

#প্রিয় পৃথিবী
জান্নাতুল নাঈমা
পর্ব-০৭(শেষ পর্ব)

পৃথিবীর জ্বর হয়েছে। এ খবর পেয়ে বাড়ির অনেকেই দেখতে এলো ও’কে। বড়ো’রা বেশি সময় ব্যয় না করে চলেও গেল৷ রুবিনাকে নানি এসে কানে কানে বলল, পৃথিবীকে পাক হয়ে নিতে। রুবিনা নানিকে বুঝিয়ে বলল, আসলে তেমন কিছুই হয়নি৷ কিন্তু নানি নাছোড়বান্দা সে কিছুতেই বিশ্বাস করল না। বাধ্য হয়ে পৃথিবীকে সকাল ন’টার পূর্বেই গোসল করতে হলো৷ তারপর নিজ হাতে ফাতিহা বেগম এসে তাকে খাওয়িয়ে ওষুধ খাওয়িয়ে দিলো। সারাটাদিন প্রিয় আর পৃথিবীর মুখোমুখি হতে পারল না৷ মোটকথা পৃথিবীর কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হলো না তাকে৷ বাড়ির ছোটো সদস্যরা প্রিয়কে দেখলেই বড়ো বড়ো করে তাকালো৷ কেউ আবার অগোচরে ঠোঁট টিপে হাসতে গিয়ে ধরা পড়েও গেল। বড়োদের মনোভাব তেমন স্পষ্ট বুঝতে পারল না। সবমিলিয়ে দম বন্ধকর পরিস্থিতিতে সারাদিন পাড় করল সে৷

ইশতিয়াক রহমান একমাত্র পুত্রের বিয়ের অনুষ্ঠানে বেশ রমরমা আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রিয় জানালো, এ মুহূর্তে এটা করা উচিৎ হবে না৷ দু’পরিবারের এমন দ্বন্দ্বের মাঝে এতবড়ো অনুষ্ঠান করতে সম্মত হলো না প্রিয়৷ নানি রেনুয়ার সঙ্গে আলোচনা করে অনেক ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে৷ তাছাড়া আপাতত সে বেকার। এই একটা অভিযোগ ছাড়া স্ট্রং কোন অভিযোগ পৃথিবীর ভাইরা তার বিরুদ্ধে করতে পারবে না৷ তাই এই অভিযোগটা যেন করতে না পারে সেই চেষ্টা করবে প্রিয় তারপর না হয় অনুষ্ঠানের কথা ভাবা যাবে। ছেলের বুদ্ধিজীবী কথাবার্তা শুনে ইশতিয়াক রহমান বড়োই খুশি হলেন৷ দ্বিমত পোষণ করার বিন্দু পরিমাণ জায়গাও পেলেন না৷

রাত দশটা। প্রিয়র ঘরে পূর্ণতা ছিল৷ পৃথিবীর কাছেই বসে ছিল সে৷ টুকটাক গল্প করছিল তারা। হঠাৎ প্রিয় ঘরে এলো৷ দেখলো গুটিশুটি হয়ে বসে আছে পৃথিবী। মেরুন রঙের একটি থ্রিপিস পরেছে সে। মাথায় মেরুন কালারের জর্জেট উড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া৷ মুখটাতে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। পূর্ণতা কথা বলছে আর সে চুপচাপ শুনছে। পৃথিবী গল্প করার চেয়ে শুনতে বেশি ভালোবাসে৷ জানে প্রিয় তাইতো পূর্ণতাকে বলে দিয়েছে তার পৃথিবীকে সময় দেওয়ার জন্য৷ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো প্রিয়। তাকে দেখে হঠাৎ থেমে গেল পূর্ণতা৷ নড়েচড়ে বসে তৎক্ষনাৎ ওঠেও পড়ল। ধীরে ধীরে রুম থেকে চলে যেতে উদ্যত হলো। অমনি মৃদু ধমক দিলো প্রিয়। বলল,

-” কোথায় যাচ্ছিস যেতে বলেছি আমি? ”

ওর সে ধমকে পূর্ণতা যতটা না ভয় পেল পৃথিবী তার চেয়েও দ্বিগুণ ভয় পেল৷ মৃদু কেঁপেও ওঠল। প্রিয় এক নজর পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আবার বোনের দিকে তাকালো। বলল,

-” তুই এখানেই থাকবি ওর সাথে৷ ও’কে বলে দিস আমার দায় পড়েনি যে জোর করে, ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওর সঙ্গে সংসার পাতবো।”

পৃথিবীর মনোভাব ঠিক কী হলো বোঝা গেল না৷ কিন্তু ভাইয়ের ভয়াবহ কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল পূর্ণতা৷ সে অবস্থায়ই ভাইকে প্রশ্ন করল,

-” তাহলে আপুকে এভাবে কেন নিয়ে এলে? সত্যি সংসার করবে না তোমরা! ”

অধর কামড়ে ধরল প্রিয়। বোনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। মেয়েটা সব সময় উচিৎ কথা বলবে। এ মুহূর্তে উচিৎ কথা না বললেই কী হচ্ছিল না৷ ভীষণ রকম বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল প্রিয়। রাগে গটগট করতে করতে বলল,

-” তোর আপুকে নিয়ে এসেছি শাস্তি দেওয়ার জন্য। তোর আপু আমাকে ঠকিয়েছে বুঝেছিস। প্রিয়কে ঠকানোর শাস্তি কত ভয়ংকর হয় এবার তোর আপু হারে হারে টের পাবে!”

পূর্ণতা থতমত খেয়ে গেল৷ এক পলক তাকিয়ে দেখলো পৃথিবীকে। সে মাথা নিচু করে রেখেছে। পুনরায় পূর্ণতা তাকালো প্রিয়র দিকে৷ প্রিয় পুনরায় বলল,

-” জোর করে কাউকে বউ করার ইচ্ছে আমার নেই। যে স্বেচ্ছায় আসবে তাকেই বউ করব আমি। ”

বিস্মিত কণ্ঠে পূর্ণতা বলল,

-” তুমি আবার বিয়ে করবে? ”

-” অবশ্যই কেন নয়? এরপর যে এ বাড়িতে আসবে সে তোর ভাবি হয়ে আসবে আপু নয়৷ ”

আর দেরি করল না প্রিয়। পূর্ণতার কোন উচিৎ কথাও শুনলো না সে। নিজের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। পৃথিবীর ছলছল দু’টো চোখ দেখতেও পেল না সে। দেখল শুধু পূর্ণতা৷ সঙ্গে সঙ্গে সে টের পেয়ে গেল অনেক কিছু। বুঝে নিলোও সবটা। তাই ভাইয়েরও মত সেও দেরি করল না। ছুটে চলে গেল মায়ের কাছে। জানিয়ে দিলো সবটা। তার পৃথি আপুর ছলছল চোখ দেখেই সে বুঝে গেছে প্রিয়র প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা।

কেটে গেল তিনটে দিন৷ এই দিনগুলোতে প্রিয় একবারও পৃথিবীর কাছে আসেনি। বাড়িতে থাকলেও সেভাবে তার সামনে পর্যন্ত আসেনি৷ বাড়ির কারো এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা দেখা গেল না৷ ইশতিয়াক রহমান ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পৃথিবীর এডমিশন নিয়ে। ভাইদের ষড়যন্ত্রের চক্করে পড়ে মেয়েটা অনার্সে এডমিশনও নিতে পারেনি। একটা বছর মিস হয়ে গেছে তার। প্রিয়র কাকাতো ভাইকে পৃথিবীর বাড়িতে পাঠিয়েছিল। পৃথিবীর মায়ের থেকে সমস্ত কাগজ পত্র আনা হয়েছে। সামনে সপ্তাহেই এডমিশন শুরু৷ ইশতিয়াক রহমান পৃথিবীর এডমিশনের সমস্ত দায়িত্ব প্রিয়কে দিলো৷ সে সময় পৃথিবী তার সামনেই ছিলো। প্রিয় কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

-” ওর পড়াশোনার কী প্রয়োজন? ওর তো পড়াশোনার চেয়েও আমাকে বাঁশ দেওয়া বেশি জরুরি! ”

সকলের সামনে এমন কথা বলাতে লজ্জা পেল পৃথিবী, অপমানিত বোধও করল। তাই তার মাথা নিচু হয়ে গেল। ড্রয়িংরুমে সকলেই হা করে তাকিয়ে রইল প্রিয়র দিকে। হঠাৎ প্রিয়র মাঝে আবার এ কী পরিবর্তন! এই ছেলে চাইছে টা কী? কিছুই বোধগম্য হলো না করো৷ ইশতিয়াক রহমান প্রিয়কে ধমক দিলেন৷ বললেন,

-” এখন ছেলেমানুষি করার সময় নয় প্রিয়৷ যা বলেছি তাই করো। ”

আর কিছু বলল না প্রিয় শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। ফাতিহা বেগম লক্ষ করলেন প্রিয়কে। লক্ষ করলেন পৃথিবীকেও। রোজ রাতে পৃথিবী প্রিয়র রুমেই ঘুমায় তবুও ঘরে ফিরে না প্রিয়৷ হঠাৎ করে আবার কী হলো ছেলেটার? প্রচণ্ড টেনশনে পড়ে গেল সে। তাই পৃথিবীর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল সে। পরেরদিন রাতেই প্রিয়র ঘরে গেল ফাতিহা বেগম। দেখলো চোখ বুজে শুয়ে আছে পৃথিবী। সে ধীরপায়ে পৃথিবীর কাছে গিয়ে পাশে বসে মাথায় হাত রেখে ডাকল,

-” পৃথি ঘুমিয়ে পড়েছিস? ”

সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকালো পৃথিবী। বলল,

-” খালামুনি! ”

ওঠে বসল সে। মলিন হেসে পুনরায় বলল,

-” কিছু বলবে? ”

-” তোর সঙ্গে তো আমার অনেক কথা আছে পৃথি। ”

থমথমে মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলো পৃথিবী। ফাতিহা বেগম কোন প্রকার ভণিতা ছাড়াই বলল,

-” তুই তো প্রিয়কে ভালোবাসিস। যাকে ভালোবাসিস তার অভিমান বুঝতে পারিস না? ”

পৃথিবী নিরব, নিস্তব্ধ হয়ে ঠায় বসে রইল। ফাতিহা বেগম বললেন,

-” আমার ছেলেটাকে তুই অনেক কষ্ট দিয়েছিস পৃথি। আর কষ্ট দিস না৷”

মাথা নিচু করে ফেলল পৃথিবী। মুহূর্তেই ঝরঝর করে কেঁদেও ফেলল। ক্রন্দনরত কণ্ঠেই বলে ওঠল,

-” আমি প্রিয় ভাইয়াকে কষ্ট দিতে চাইনি বিশ্বাস করো খালামুনি। কীভাবে কী হয়ে গেছে আমি বুঝতেও পারিনি। ”

-” আমি তোকে খুব ভালো করে চিনি পৃথি। তুই শুধু আমাকে সত্যিটা বল। কেন তুই ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছিলি? ”

ফুঁপিয়ে ওঠল পৃথিবী। বলল,

-” একটা বছর দূরে সরে থাকার পর যখন বুঝতে পারলাম আমার ভাগ্য প্রিয় ভাইয়া নেই। তখন নিরুপায় হয়েই ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছি। তাছাড়া ভাই…”

অতিরিক্ত কান্নার ফলে বাকিটুকু বলতে পারল না পৃথিবী। ফাতিহা বেগম সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,

-” ব্রেইন ওয়াশ করেছে তাইতো? ঠিক কী কী বলেছে বল তো? ”

পৃথিবী কিছুই বলতে পারলো না। শুধু অশ্রুবিসর্জন দিয়ে গেল। ফাতিনা বেগম ওকে বুকে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বোলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

-” আমায় সবটা বল মা। ”

-” আমি কখনো সুখী হবো না খালামুনি। যে বিয়েটা হতে গিয়েও ভেঙে গেল সে বিয়েটা পুনরায় জোড়া লাগানো ভুল ছিল আমার। উপরওয়ালা চায় না বলেই বিয়েটা হয়নি আমরা পরিবার ছাড়া বিয়ে করে উপরওয়ালাকে অসন্তুষ্ট করেছি। এসবই বলেছিল। কিন্তু যখন আম্মু সহ পুরো পরিবার একদিকে রেখে আরেকদিকে প্রিয় ভাইয়াকে রাখা হলো, তখন আমি স্বার্থপরতাও করেছিলাম। কিন্তু শেষ অবধি স্থির থাকতে পারিনি। আম্মুর অসুস্থতা ভাইদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। সে সময়ই ভাইয়া আমাকে আর আম্মুকে নিয়ে চলে গেল। প্রিয় ভাইয়াকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য কত কিছুই করল৷ শেষে আম্মুকে দিয়ে কসম করিয়ে অন্যের বাগদত্তা বানিয়ে ছাড়ল। এতকিছুর পর যখন প্রিয় ভাইয়া হুট করে আমাকে ছিনিয়ে আনলো। একটু আশার আলো আমি সত্যি দেখেছিলাম খালামুনি। সেই আলোটাও নিভে গেল। সবাই আমাকে ইচ্ছে মত ব্যবহার করে করে শেষ করে দিচ্ছে খালামুনি। আমি আর পারছি না, বিশ্বাস করো পারছি না আমি৷ আমার চেয়ে একটা কাঠের পুতুলও বোধহয় ভালো থাকে৷ একটা পুতুলকে নিয়েও এত কাড়াকাড়ি চলে না। আমি কী করব খালামুনি, আমি কী করব। আমি যে পারি না, আর সবার মত আমিতো পারি না। তোমরা তো ছোটোবেলা থেকে দেখছো আমাকে। পৃথিবীতে সব মানুষ সমান হয় না। আমিও আর সবার মত নই৷ আমি জোর গলায় কিছু বলতে পারি না। চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই বার বার। ”

বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল পৃথিবী। দুচোখ বেয়ে অশ্রুপাত ঘটতে শুরু করল ফাতিহা বেগমের। মেয়েটা যে এমনই। খুবই সরলসোজা। অত্যাধিক ভীতু, পরিবারের প্রতি খুবই সেনসেটিভ। এই কান্নার মাঝেই পৃথিবী ভেঙে ভেঙে শেষে একটি কথাই বলল,

-” আমি তোমার ছেলেকে ভালোবাসি খালামুনি বিশ্বাস করো। কিন্তু ভালোবাসাকে ধরে রাখার যে ক্ষমতা প্রয়োজন সেটা আমার নেই, একটুও নেই। ”

ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মত ফোপাঁতে লাগল পৃথিবী।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয় শেষ কথাটা শুনতেই চমকে ওঠল। তার পৃথিবী! তার লজ্জাবতী! তার ভীতুরানিটা তার মা’য়ের কাছে তাকে ভালোবাসার কথা বলছে! এও সম্ভব। কথায় আছে ভালোবাসার মানুষের জন্য সাত খু/নও মাফ করা যায়। প্রিয়তো পৃথিবীকে কবেই ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু তার বোকা পাখিটাকে আবার যেন কেউ ভুলিয়ে ভালিয়ে তার থেকে ছিনিয়ে না নেয় সেজন্যই তো এই কষ্টটা দিচ্ছে সে। পৃথিবীর কান্নাগুলোকে আর নিতে পারলো না প্রিয়। চোখ বন্ধ করে লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর দ্রুতপায়ে চলে গেল সেখান থেকে৷

এরপর একটা দিন চলে গেল। হুট করেই পৃথিবী কেমন স্বাভাবিক হয়ে ওঠল৷ তবে তার এই স্বাভাবিকতার পেছনে অনেক বড়ো অবদান ফাতিহা বেগমের খুব করে টের পেল প্রিয়৷ কিন্তু কিছুই বলল না৷ সে তার মত দিব্যি পৃথিবীর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগলো। তবে এই দূরত্ব রেখে চলার মাঝেও ছিল এক বুক অপেক্ষা। সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েই উপস্থিত হলো পৃথিবী।

জোছনার মৃদু আলোতে মুখরিত চারপাশ। ছাদে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল ছিল প্রিয়। প্রত্যেকের হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট। ঠোঁটের কোণায় সিগারেট চেপে রেখে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে হঠাৎ প্রিয় গান ধরল,

-” চলে গেছো তাতে কী নতুন একটা পেয়েছি সে তো তোমার চেয়েও বেশি সুন্দরী! ”

একটিমাত্র লাইন গাইতেই সহসা শাড়ি পরিহিত পৃথিবীর উপস্থিতি দেখে কেঁপে ওঠল প্রিয়৷ কেঁপে ওঠল ওর আশপাশে থাকা বন্ধুরাও৷ আতঙ্কিত হয়ে প্রিয় চিল্লিয়ে ওঠল,

-” এই তোরা এখানে কী করছিস দূর হো দূর হো। ”

প্রিয়র বলতে দেরি কিন্তু বন্ধুদের ছুটতে দেরি হলো না। অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটে যাওয়াতে সকলেই হতবাক হয়েই ছুটে পালালো। প্রিয়ও বসা থেকে ধপ করে ওঠে দাঁড়ালো। দ্রুত আঁধ খাওয়া সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল৷ পৃথিবী নাক টেনে নিচু কণ্ঠে প্রশ্ন করল,

-” কী গান গাইছিলে ওটা? ”

বাঁকা হাসলো প্রিয়৷ পরোক্ষণেই হো হো করে হাসতে হাসতে ছাদের একদম কার্নিশে চলে গেল। পৃথিবী নাক ফুলিয়ে মৃদু পায়ে প্রিয়র পেছনে দাঁড়ালো। আচমকাই দু’হাতে নিজের কান দু’টো ধরে চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলল,

-” এই কান ধরে বলছি আর কক্ষনো তোমায় ছেড়ে যাব না৷ এই প্রমিজ করে বলছি এখন থেকে আমি চালাক হয়ে যাব। আর আমি সহজসরল থাকব না। আমি সত্যি প্রমিজ করে বলছি আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসবো। ”

কথাগুলো বলতে বলতে গুলিয়ে ফেলল পৃথিবী। আর যেন কী কী বলার কথা ছিল? কিচ্ছু মনে পড়ল না তার৷ উপায় না পেয়ে চোখ মুখ খিঁচে পেছন থেকে শক্ত করে প্রিয়কে জড়িয়ে ধরল৷ ত্বরিতবেগে বলতে লাগল,

-” আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও প্রিয় ভাইয়া। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। ”

পুরো শরীরে শীতল শিহরণ বইয়ে গেল প্রিয়র। দুচোখ বন্ধ করে স্বস্তি ভরে শ্বাস নিলো সে। কোনক্রমে নিজেকে স্বাভাবিক করে রুদ্ধশ্বাসে বলে ওঠল,

-” পৃথি ছাড়। ”

সহসা ছেড়ে দিলো পৃথিবী। পেছন ঘুরতেই পৃথিবীর লজ্জায় নত হওয়া মুখটি দৃষ্টিগোচর হলো প্রিয়র৷ সেই সঙ্গে প্রিয়তমার দেহের মৃদু কম্পনও টের পেলো। মুচকি হেসে দু-হাত বাড়িয়ে লজ্জায় নত হওয়ার পৃথিবীর মুখটি দু’হাতের আঁজলে ভরে নিলো। মোহভরা কণ্ঠে বলল,

-” সব ঠিক আছে কিন্তু শাড়িতো ঠিক নেই! ”

সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠলো পৃথিবীর। ভীতিগ্রস্ত হয়ে তাকালো প্রিয়র দুষ্টুমিতে ভরপুর দৃষ্টিজোড়ার পানে। নিমিষেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে কেঁপে ওঠল তার ওষ্ঠদ্বয়। জোছনার মৃদু আলোতে সে ওষ্ঠাধরে মৃদু কম্পন কতখানি দিশেহারা করে দিলো প্রিয়কে বোঝানোর উপায় নেই৷ তবুও প্রিয় নিজেকে সংযত করলো। শুঁকনো গলায় ঢোক গিলল। তারপর সন্তর্পণে পৃথিবীর কপালে ভালোবাসাময় একটি চুমু খেল। চোখ বুজে ফেলল পৃথিবী। হৃৎস্পন্দন ছুটতে শুরু করল বেগতিক ভাবে৷ প্রিয় কপালে বিন্দু,বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করল। প্রিয় টের পেল এবার সে কন্ট্রোললেস হয়ে পড়ছে। পুনরায় ঢোক গিলল প্রিয়। ধীরে ধীরে পৃথিবীর কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল৷ ফিসফিস কন্ঠে বলল,

-” ক্ষমা করব পৃথি তবে একটি শর্ত রয়েছে। ”

পৃথিবী একটু চমকালো প্রিয় বলল,

-” আমার পারমিশন ব্যতীত ও বাড়ির কারো সঙ্গে দেখাতো দূর যোগাযোগও করতে পারবি না৷ খালামুনির সঙ্গেও নয়। ”

আঁতকে উঠল পৃথিবী। প্রিয়র থেকে কিঞ্চিৎ সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। মুহূর্তেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠল প্রিয়। আচমকাই ওর ঘাড়ে গাঢ় ভাবে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো। পৃথিবী আর সরতে পারলো না। দু-হাতের শক্ত বাঁধনে আঁটকে ফেলল প্রিয়। গভীর থেকেও গভীরতর ছোঁয়া মত্ত করে ফেলল পৃথিবীকে। এক সময় পৃথিবী একেবারেই শরীর ছেড়ে দিলো। প্রিয় যত্ন সহকারে আগলে নিলো ওকে। বাঁকা হেসে বলল,

-” আমাকে ভালোবাসার বিনিময়ে এইটুকু পরীক্ষা তোকে দিতেই হবে। ”

চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো পৃথিবীর। প্রিয় সে কান্নাকে পাত্তা না দিয়ে ওর ওষ্ঠদ্বয় নিজের ওষ্ঠের দখলে নিয়ে নিলো। এক সময় ওষ্ঠাধর ছেড়ে কোলে তুলে নিলো পৃথিবীকে। পৃথিবী চোখ বন্ধ করে আছে৷ ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠছে তার দেহ৷ প্রিয় পুনরায় পৃথিবীর কপালে চুমু খেল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-” আজ আমি আমার পৃথিবীকে জয় করে নেবো। কারো বাপের সাধ্য নেই আমাকে আটকানোর। ”

সহসা চোখ মেলে তাকালো পৃথিবী। কিছু বলার জন্য উদ্যত হলো সে৷ কিন্তু প্রিয় তাকে থামিয়ে দিল। বলল,

-” উহুম কোন কথা বলবি না। শুধু শুনবি৷
তুই হচ্ছিস আমার পৃথিবী আমার পৃথিবীকে প্রিয় করার জন্য কেবল আমাকেই প্রয়োজন। শোন না, আমি প্ল্যান করেছি চাকরি বাকরি পেলে নিজের টাকায় একটা বাড়ি বানাবো নাম দেব প্রিয় পৃথিবী।
বাচ্চা গাচ্চা নিয়ে তুই আর আমি প্রিয় পৃথিবীতে সংসার পাতবো। তোর আর আমার নামের কম্বিনেশন টা দারুণ না? প্রিয় পৃথিবী। জামাই, বউয়ের নাম প্রিয় পৃথিবী। বাড়ির নাম প্রিয় পৃথিবী। আমাদের বাচ্চা, গাচ্চা বড়ো হবে প্রিয় পৃথিবীতে। আজীবন বাস করবেও প্রিয় পৃথিবীতে। নাতি নাতনিরাও প্রিয় পৃথিবীতে প্যান প্যান করবে। আহা তোর আর আমার জীবন তো স্বার্থকরে পৃথি। আমার পুরো বংশটাই প্রিয় পৃথিবীময় হয়ে যাবে।

কান ধাঁধানো প্রিয়র কথাগুলো শুনে সন্তর্পণে প্রিয়র বুকে মাথা ঠেকালো পৃথিবী। চোখজোড়া নিবদ্ধ করে বুকভরে শ্বাস নিলো সে। তারপর ধীরসুরে বলে ওঠল,

-” বাচ্চার কথা বলো না আমার খুব লজ্জা করে। ”

বিস্মিত হয়ে গেল প্রিয়। হাসি পেল খুব। আরেকটুখানি লজ্জা বাড়াতে তাই ফিসফিসিয়ে বলল,

-” আজ আমি কিচ্ছু শুনব না শুধু তোর লজ্জা দেখব। ”

মুহূর্তেই ধপাধপ পা ফেলে ছাদের সিঁড়ি ডেঙিয়ে নিজের বেডরুমে চলে গেল প্রিয়….

সমাপ্ত,,,,,