প্রিয় বেলা পর্ব-২৪+২৫

0
388

প্রিয় বেলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
২৪.+২৫

দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ-ই হোঁচট খেয়ে পরে যেতে নিলো বেলা। বাম পায়ের বুড়ো আঙুল কেমন বেঁকে যাচ্ছিল। কোনোমতে নিজেকে সামলালো সে। বেখেয়ালি শরীরটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলো। তড়িৎ গতিতে রুপাও অতি ভীতু মনে বেলার বাহু টেনে ধরলো। কটমটে গলায় ধমকের সুরে বললো,
—“এত হুলস্থুল কান্ড ঘটাচ্ছিস কেন বেলা? কোথাকার কোন ট্রেন ছুটে যাচ্ছে? আস্তে হাঁট!”

কাঁধের ব্যাগটা ঢিলে হয়ে পরে যাচ্ছিল। তা ঠিক করে এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজলো বেলা। অনভ্যস্ত কণ্ঠে মিথ্যা বললো,
—“বাড়িতে মেহমান আসবে। তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে।”
রুপা বড় বড় চোখে তাকালো,
—“মেহমান বলতে? তোকে আবার দেখতে আসবে নাকি?”
—“নাহ্। এমনিই আসবে।” ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো বেলা।

রুপা শুনলো। সামান্য ‘ওহ্।’ বলে চুপ হয়ে গেল। হাতে থাকা ফোন চালু করলো। ইউটিউবে ঢুকে কি যেন টাইপ করলো সে। উৎফুল্ল মনে একটা ভিডিও ছেড়ে বেলাকে দেখাতে দেখাতে বললো,
—“দেখ বেলা, আমাদের কুমিল্লার নতুন এমপি। আদ্র ইয়ানিদ। সুন্দর না দেখতে?”

বেলা শান্ত নেত্রে তাকালো। ফোনের স্ক্রীনে ঘর্মাক্ত আদ্রকে দেখা যাচ্ছে। চোখ-মুখ কুঁচকে ভাষণ দিচ্ছে সে। রোদে জ্বলজ্বল করছে মুখশ্রী। বরাবরের মতোই কঠিন তার কণ্ঠের তেজ, গা শিরশির করে কাঁপিয়ে তোলার মতো। বেলা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। রুপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলতেই রইলো,
—“উনাকে যে আমার কি ভালো লাগে! উনার একটা ভাইও আছে জানিস? আয়াজ মেহেরাব। একদম ওনার মতো দেখতে। টুইনস ওরা।”
বেলা আড়চোখে আরও একবার ভিডিওটির দিকে তাকালো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
—“জানি। উনারা আমাদের এলাকাতেই থাকেন।”

কথাটা রুপার কানে প্রবল ঝংকার তুললেও তা বিশেষ আমলে নিতে পারলো না সে। বিশ্বাস করলো না। মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো, “ধুর! মিথ্যা বলছিস কেন?”

মনে মনে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললো বেলা। মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছিল সে। ভাগ্যিস রুপা বিশ্বাস করেনি। নয়তো এ খবর পুরো ভার্সিটিতে রটিয়ে ছাড়তো সে।

ভার্সিটির পেছনের পিচঢালা রাস্তায় কালো গাড়িটি দাঁড় করানো। নির্জন জায়গা। ড্রাইভার আর আকিবকে ছাড়া কাউকে দেখতে পাচ্ছে না বেলা। আকিব বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে গাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল সে। বেলাকে দেখতে পেয়ে অল্প মুচকি হাসলো। নম্র স্বরে বললো,
—“কেমন আছেন ভাবী?”

প্রতিউত্তরে বেলাও লাজুক হেসে বললো, “ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”
—“আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনার জন্যই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাই ভেতরে অপেক্ষা করছেন।”

বলে গাড়ির পেছনের সীটের দরজা খুলে দিলো আকিব। বেলা নিঃশব্দে ভেতরর গিয়ে বসতেই একদফা চমকালো। বড় মাপের ব্যস্ত নেতা তার সঙ্গে দেখা করতে এসে আরাম করে সীটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার নিশ্বাসের থেকে থেকে চলাচল বেলা তীব্র ভাবে শুনতে পারছে। এসির পাওয়ার অতিরিক্ত করে রাখা। কালো রঙের জানালার কাঁচগুলো উঠানো। বাহিরের কেউ ভেতরটা দেখার জো নেই। একহাত কপালে রেখে ঘুমাচ্ছে লোকটা। গায়ে ভিডিওর সেই সাদা পাঞ্চাবী। বুকের প্রথম তিনটে বোতাম খোলা। লোমশ বক্ষস্থল ক্ষীণ দৃশ্যমান। ঘাড় বেয়ে ঘামের সূক্ষ্ণ রেখা স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে।
বেলা হাঁসফাঁস করলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। লোকটা কি উঠবে না? বাহিরে তাকিয়ে সবাইকে একবার পরখ করে নিলো সে। আকিব আর ড্রাইভার দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বেলা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ইতস্তত হাতে আদ্রর চওড়া কাঁধে আলতো ধাক্কা দিলো। মৃদু স্বরে ডাকলো,
—“আদ্র। শুনছেন? আদ্র?”

আদ্র অল্প নড়েচড়ে উঠলো। তন্দ্রা কেটে গেল নিমিষেই। কপাল থেকে হাত সরালো। চোখ মেলল ধীরস্থির ভাবে। প্রচন্ড বাঁকানো ভ্রুযুগল নিয়ে কিছুক্ষণ গাঢ় নেত্রে চেয়ে রইলো অবুজ প্রেয়সীর দিকে। মুখশ্রী জুড়ে একরাশ ঘুমু ঘুমু ভাব তার। ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে সে খুব গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,
—“কখন এসেছো?”

বেলা আড়চোখে সুদর্শন পুরুষটির দিকে একপলক তাকালো। জবাবে ছোট্ট করে বললো, “কিছুক্ষণ আগে।”

দু’হাতে চোখ কচলে ঠিক হয়ে বসলো আদ্র। বাহিরে দৃষ্টি ফেলে কি যেন দেখল। অনুমতি ছাড়াই বেলার ওড়নার একাংশ টেনে ঘর্মাক্ত ঘাড় মুছলো। গলা উঁচিয়ে হাঁক ছাড়লো,
—“ইমরান! এদিকে আসো।”

সঙ্গে সঙ্গে আকিব আর ড্রাইভার এগিয়ে এলো। আদ্রর দিকে উৎসুক চোখে চাইতেই সে বললো,
—“বাসায় যাবো। গাড়ি ছাড়ো।”
ড্রাইভার মাথা ঝাঁকালো। গাড়িতে বসে পরলো বিনা বাক্য ব্যয়ে। আকিব তখন জানালায় ক্ষীণ উঁকি মেরে বললো,
—“আমি তবে চলে যাচ্ছি ভাই? দরকার হলে ফোন করবেন। আমি আবার আসবো।”
আদ্র মুখে কিছু বললো না। হালকা মাথা কাত করলো মাত্র।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। নিরবতার প্রখরতা খুব। আদ্র চুপচাপ, শব্দহীন ভাবে বেলার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি স্থির, অনড়। তীক্ষ্ণতায়, দৃঢ়তায় ভরপুর। বেলার গাল ভারী হয়ে আসছে। লজ্জায়, অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে আছে সে। এভাবে তাকানোর কি আছে? লোকটা কি বুঝতে পারছে না, তার যে খুব লজ্জা লাগছে। প্রেমিকের দৃষ্টির পিঠে সিক্ত বেলা আড়ষ্ট হচ্ছে বারবার।
জোড়ালো গলায় বেলা বললো,
—“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার অস্বস্তি হচ্ছে। অন্যদিকে তাকান।”
আদ্র নিমগ্ন স্বরে উত্তর দিলো, “তুমি মিথ্যে বলছো বেলা। তোমার অস্বস্থি হচ্ছে না। একদমই হচ্ছে না।”
—“আপনার ধারণা ভুল। অন্যদিকে তাকান।”

আদ্র শুনলো না। দূর্বোধ্য হাসলো। বেলার লজ্জা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে শুধালো,
—“তোমাকে আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছে বেলা।”

লজ্জায় সে আর কথাই বলতে পারলো না। তাকালোও না। আদ্র আবারও সীটে হেলান দিয়ে শুয়ে পরলো। চোখ বুজলো। হতাশ কণ্ঠে বললো,
—“তোমাকে শাড়ি পরিয়ে আমার রুমে বসিয়ে রাখার ইচ্ছেটা মাথা চড়া দিয়ে উঠছে বেলা। তোমাকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা বাজেভাবে আহত করছে। তুমি একটু বাজে হতে পারলে না? এত সুন্দর হতে কে বলেছিল তোমায়?”

প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেলো বেলা। পরক্ষণেই ড্রাইভারের কথা মস্তিষ্কে হানা দিতেই রেগে তাকালো সে। ঝাঁঝালো কণ্ঠের রেশ ধরে বিশাল নেত্রে পলক ঝাপটালো। বললো,
—“সমস্যা কি আপনার? ড্রাইভার সামনে না?”
আদ্র ঠাট্টার সুরে ড্রাইভারকে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলো,
—“আমার কথা কি তুমি কিছু শুনেছো ইমরান?”
সে মিটিমিটি হেসে মাথা দুলালো, “না ভাই।”
আদ্র জয়ের হাসি এঁটে বেলাকে বললো, “দেখেছো? শুনেনি।”

সময় গড়ালো। গাড়ি থামলো এলাকা থেকে বেশ অনেকটা দূরে। গাছের আড়াল করে। বেলা ধীর পায়ে নেমে পরলো। আদ্রর দিকে একবার চেয়ে চলে যেতে নিলেই তার হাত শক্ত করে ধরে ফেললো আদ্র। কোত্থেকে গোলাপের একটা তোড়া বের করে ধরিয়ে দিলো তার হাতে। বেলা অবাক চোখে তাকালো। কিছু বলার পূর্বেই আদ্র কেমন অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠলো,
—“কথা দিচ্ছি বেলা, গোলাপগুলোর পাঁপড়ি পরে যাওয়ার আগেই তোমাকে আমার ঘরে তুলবো।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

প্রিয় বেলা

২৫.
বাতাসে কেমন পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। আদ্র একদমই সহ্য করতে পারে না এই গন্ধ। হাঁচি হয়, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। রুমাল নাকে চেপে ড্রাইভারকে গাড়ি গ্যারাজে রেখে আসতে বললো সে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আশপাশটা একবার দেখে নিলো। না! কাউকে তো কিছু পোড়াতে দেখা যাচ্ছে না। তবে ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারিদিক। বিরক্ত হয়ে আদ্র দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠলো,
—“রাহেলা আন্টি। কোথায় আপনারা? পোড়া গন্ধ কোথা থেকে আসছে? স্প্রে করেননি কেন এখনো?”

রাহেলা দিলদার দৌঁড়ে এলেন। মোটা শরীর নিয়ে দৌঁড়ঝাপ করা একটু বেশিই কষ্টকর। এসে ক্ষীণ সময় হাঁপিয়েই কুল পেলেন না। তাড়াতাড়ি মুখ চালিয়ে বললেন,
—“আপা পুরান জিনিস পুরাইছিলো ইকটু আগে। ওইটারই পুড়া গন্দ আইতেছে।”

তিক্ত মেজাজটা চড়া দিয়ে উঠলেও আদ্র কথা বাড়ালো না। কণ্ঠে কঠিনতা এনে বললো,
—“একটু আগে হলে এখনো রুমস্প্রে করেন নি কেন? এসিও বন্ধ। আমি যে পোড়া গন্ধ সহ্য করতে পারি না, তা জানেন না আপনি?”
রাহেলা মাথা নুয়ালো। মলিন কণ্ঠে বললো,
—“ছোরি, ছোরি। ভুইলা গেছিলাম। এহনই দিতাছি।”

রাহেলা আবারও ছুটলো। আদ্র সেদিকে একবার চেয়ে সোজা ঘরে চলে গেল। এসির তাপমাত্রা কমিয়ে শীতলতা বাড়িয়ে দিলো। ফ্রেশ হয়ে এসেই ল্যাপটপ নিয়ে বসলো সে। ই-মেল চেক করতে লাগলো একে একে।
রেখা ছেলের দরজার সামনে জড়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অনেক্ষণ যাবত। ছেলে তার অনেকদিন হলো প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। হুটহাট পাশে বসে বলে না, “আজকের দিনটা অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে মা। হাত ধুঁয়ে-টুয়ে ভাত খেতে পারবো না এখন। খাইয়ে দাও তো।”
কোলটা কেমন খালি খালি লাগছে। রেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেড়ানো দরজায় আলতো ধাক্কা দিলেন। নিমিষেই খুলে গেল তা। ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। আদ্র মাত্র একবার তাকালো। দৃষ্টি ফেরাতে ফেরাতে বললো,
—“কোনো প্রয়োজন মা?”

রেখা আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিঃশব্দে ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন। হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
—“আর কত আদ্র? আর কত শাস্তি দিবি?”

কি-বোর্ডে অনবরত টাইপ করতে থাকা আঙুলগুলো ক্ষণিকের জন্য থমকালো। পলক পরলো দু’বার। ফের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে নিষ্প্রাণ স্বরে বললো,
—“শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো মা। আমি না।”
—“আমি কি শাস্তি দিচ্ছি তোকে? আমি শুধু মেয়েটার ভালো চাচ্ছি আদ্র। আমি চাই না আমার মতো কষ্ট কেউ করুক। তোর বাবা যখন মারা গেল তোরা তখন মাত্র পনেরো বছরের ছিলি। তোর দাদার ব্যবসা না থাকলে পথে নামতে হতো আমাদের। আব্বা কতবার তোদের রেখে দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চেয়েছিল আমাকে, জানিস? কতটা মানসিক যন্ত্রণা আমি সহ্য করেছি তার অনুমান কখনো করেছিস? কখনো বুঝতে চেয়েছিস আমার কষ্ট?”

আদ্র ল্যাপটপ পাশে রেখে দিলো। পূর্ণ দৃষ্টে শান্ত ভাবে তাকালো। গম্ভীর স্বরে বললো,
—“তুমি কি তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলে মা? দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম তোমাকে। তোমার কান্না দেখে আমরাও কাঁদতাম। তুমিও তো খেয়াল করো নি কখনো।”

রেখার ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না আসতে চাইলো। তবে কাঁদলেন না তিনি। ঝাপসা চোখে স্বামীর হাসোজ্জল মুখশ্রী মানস্পটে ভেসে উঠলো। দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ শোনা গেল কিছুক্ষণ। কঠোর হয়ে রেখা বললেন,
—“তুই রাজনীতি ছেড়ে দেয়। আমি বেলার সঙ্গেই তোর বিয়ে দেব।”
—“যা সম্ভব না, তা কেন বলছো?”
—“আমি চাই না তোর বাবার মতো তোরও সেই অবস্থা হোক। কথাটা বুঝতে চাচ্ছিস না কেন?”

আদ্র রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে উত্তর দিলো, “যদি বাবার মতো আমার অবস্থা না হয়? আমি যদি মারা না যাই? তখন তো আফসোস রয়ে যাবে মা। বেলাকে না পাওয়ার আফসোস।”
রেখা হাল ছাড়লেন না। আবারও বোঝাতে লাগলেন, “ভালোর দাম নেই আদ্র। দূর্নীতি ছাড়া রাজনীতিতে টেকা যায় না।”
—“জানি। দরকার পরলে আমিও দূর্নীতি করবো।”

রেখা চমকালেন খুব। অবাক চোখে ছেলের মুখপানে তাকালেন। থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলেন,
—“তুই দূর্নীতি করবি আদ্র?”
—“যারা দূর্নীতির ভাষা বুঝে তাদের সেই ভাষাতেই বোঝাতে হয় মা। আমি বাবার মতো নই। খুব সম্ভবত সেই পরিণতি চাই না বলে দূর্নীতি করতেও পিছপা হবো না। বাবা ভালো মানুষ ছিলেন। সেই দাম ওরা দেই নি। চোখের সামনে এখনো ভাসে মা। এই এলাকার ডাস্টবিনে আমার বাবার লাশ পরে ছিল। পুরো একটা বছর আমাদের কাছ থেকে আলাদা ছিলেন তিনি। অত্যাচার সহ্য করেছেন, মৃত্যুর জন্য ছটপট করেছেন। আমরা টের পাইনি। ঘুণাক্ষরেও তার ভেতরের অবস্থা জানতে পারিনি।”

আদ্র থামলো। কণ্ঠস্বর ভেঙ্গে এলো যেন। রোধ হলো। তবে কান্নার ছিঁটেফোঁটাও এলো না। চোখ রোষাক্ত হলো। ওভাবেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল সে। রেখা বসে রইলেন। নিশ্চুপ ভাবে। চোখ থেকে পাষান জলরাশিগুলো বইতে থাকলো একাধারে।

বিহানকে পড়তে বসিয়ে বেলাও পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। ভাইব্রেশনে আটক ফোনটা ঝিরঝির আওয়াজ করতেই হাতে নিলো তা। নেতা সাহেব থেকে কল এসেছে। সে ধরলো কলটা। ওপাশ থেকে আদ্রর থমথমে কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
—“তোমার কাছে পাঁচ মিনিট আছে বেলা। ছাদে আসো।”

পরক্ষণেই কল কেটে গেল। দাম্ভিক নেতার কথার পিঠে পালটা কিছু বলতে পারলো না বেলা। কান থেকে ফোন নামিয়ে একবার স্ক্রিনে তাকালো। ঝটপট ফোনটা টেবিলে রেখে দাঁড়িয়ে পরলো। বিহানকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে ধমকালো,
—“আমি একটু ছাদে যাচ্ছি। একদম পড়া বাদ দিয়ে অন্যকিছু করবি না। এসে পড়া ধরবো। না পারলে দেখিস, বাবাকে দিয়ে মার খাওয়াবো।”
বিহান বেজার মুখে বইয়ে মুখ গুঁজলো। তাকালোই না। যেন বইয়ের ভেতর আজ ঢুকেই উদ্ধার করবে সে।

আদ্রকে বেশি অপেক্ষা করালো না বেলা। সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে ছাদে প্রবেশ করতেই আদ্রকে দেখতে পেল সে। ছাদ টপকে তাদের ছাদের রেলিংয়ের ওপর বসে আছে সে। সিগারেট ফুঁকছে। বেলা এগিয়ে এসে কাছাকাছি হলো। নাক, মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
—“আপনার না পোড়া গন্ধে, ধোঁয়ায় এলার্জি? তবুও সিগারেট খাওয়া বাদ দেন না কেন? এতে সমস্যা হয় না?”

আদ্র পাশ ফিরে তাকালো। গম্ভীর, প্রাণহীন চোখে। হাতের সিগারেটে আরও একবার টান দিয়ে ফেলে দিলো সূদুরে। কোথায় যে গিয়ে পরলো সেটা। দৃষ্টি গোচর হলো না। আদ্র বললো,
—“আমি যেটা খাই, সেটায় পোড়া গন্ধ নেই। আর এটুকু ধোঁয়ায় কিচ্ছু হয় না আমার। অভ্যাস আছে।”
বেলা শুনলো না। জোড় গলায় বললো,
—“তাও। আর খাবেন না।”
—“আচ্ছা।”

আদ্রর দৃষ্টি বিস্তর আকাশে অনড় হয়ে আছে। তারাগুলো টিপটিপ করছে। আদ্র আগে বিশ্বাস করতো, ওই তারাগুলোর একটি আদ্রর বাবা। সম্মানিত এমপি। যাকে আটক করে রাখা হয়েছি পুরো এক বছর। তিল তিল করে প্রতিটা দিন মৃত্যু যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল তিনি বুঝি আত্মগোপন করেছেন! কিংবা বেঁচে নেই আর। তারপর একদিন বড় ডাস্টবিনটার ওখানে, গন্ধ, পঁচা মায়লার স্তুপে বাবার লাশটা পরে থাকতে দেখেছিল সে। বুঝতে পারেনি ওটা তারই বাবা। চেহারা ঝলসানো ছিল তো! বাবার সেই একবছর পুরোনো ছেঁড়া শার্টটা না দেখলে সে তো বিশ্বাসই করতো না, এটা তার প্রাণপ্রিয় বাবা।
যন্ত্রণাদায়ক এক গাঢ় নিশ্বাস ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। খুব কষ্টে। বেলার হাত আলতো করে ধরলো সে। বললো,
—“বেলা, আমি কিন্তু রাজনীতি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য করছি না। আমি শুধু জানতে চাই কারা আমার বাবাকে মেরেছিল, কেন মেরেছিল। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই আমি। ওদের দেখাতে চাই, ওরা সবসময় আমাদের নিচে ছিল। নিচেই থাকবে।”

বেলা কিছুই বুঝলো না। অবাক নয়নে চেয়ে রইলো শুধু। ওই সুদর্শন মলিন মুখটার দিকে। তার প্রেমিক পুরুষের দিকে। আদ্র হঠাৎ নিচে বসে পরলো। বেলার হাত টেনে তাকেও বসিয়ে দিলো। সময় ব্যয় না করে মাথাটা বেলার কোলে রেখে শুয়ে পরলো সাবধানে। বেলা হকচকিয়ে উঠলো। ভড়কালো খুব। মৃদু চেঁচিয়ে বললো,
—“পাগল হয়েছেন নাকি? ময়লার মধ্যে শুয়েছেন কেন? দরজা খোলা তো। আদ্র? উঠুন।”

আদ্র উঠলো না। একটা অক্ষরও শুনলো না যেন। চুপ করে চোখ বুজে রইলো। আদ্রর ক্লান্ত, মায়াময় মুখ দেখে বেলাও আর কিছু বলতে পারলো না। নিয়ন্ত্রণহীন হাত আপনা-আপনি ঝাঁকড়া চুলগুলোর ভাঁজে ভাঁজে চলে গেল। আদ্র তখন ডাকলো, “বেলা।”
বেলা ঘোরলাগা কণ্ঠে মৃদু জবাব দিলো, “হু।”

আদ্র তখন ঘুমিয়ে যেতে যেতে প্রবল দৃঢ়তার সঙ্গে বললো,
—“আমি তোমাকে খুব জলদি বিয়ে করে ফেলবো বেলা।”

________________

চলবে~