প্রিয় ভালোবাসা পর্ব-০২

0
3418

#প্রিয়_ভালোবাসা

#নিশাত_তাসনিম

#পর্ব:২

উনি দাড়িয়ে গেলেন, ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে বারান্দার কার্নিসে হাত রেখে দাড়ালেন।
চোখগুলো বন্ধ করে বলতে লাগলেন,,,

—ওর সম্পর্কে যত বলবো ততই কম হবে।জানো আমি আজও ওকে ভালোবাসি,ওর জন্য কখনও মনে ঘৃনা আসেই না।ওর সাথে যখন আমার প্রথম দেখা হয়েছিলো তখন আমার বয়স ছিলো ২২।এই ২২ বছর পর্যন্ত আমি কখনও কোনো রিলেশনে যাই নি,হ্যা তবে কয়েকজনের সাথে ফ্লার্ট করেছিলাম।কখনও সিরিয়াস হই নি।সবাই বলে না যে লাভ এট ফার্স্ট সাইড ঠিক সেটাই হয়েছিলো আমার যখন ওকে প্রথম দেখেছিলাম।

সেদিনটা ভুলার মতো নয়,সেদিন যখন আমি রেডী হয়ে ভার্সিটিতে যাচ্ছিলাম, ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢুকার সময় একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা খেলাম, আমি নিজেকে সামলে নিতে পারলেও মেয়েটি পারেনি ও পড়ে যায়।আমি ওর দিকে তাকিয়ে উঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই আমার মুখটা হা হয়ে যায়।কি সুন্দর দেখতে চোখ,কী মায়াবী চেহারা, ডাগর ডাগরআঁখি,কি লম্বা চুল,পরনে ছিলো সাদা কামিজ,সাদা জামাতে যে কাউকে এতো সুন্দর লাগতে পারে আমি কল্পনাও করতে পারি নি।মোটকথা ওকে দেখেই আমার হার্টবিট জোরে জোরে বিট করতে লাগলো।আমি কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,,’সরি,সরি আমি দেখি নি।’মেয়েটি কিছু না বলে চুপচাপ উঠে চলে গেলো।আমি অবাক হয়ে গেলাম।ওর পিছন পিছন আমিও গেলাম ভাবলাম আমার ভুল হয়েছে সরি বলা উচিত।

আমি এবার বললাম সরি,আমি ইচ্ছে করে করি নি।

ও আমার দিকে না তাকিয়ে বললো,জানি আপনারা কেউই ইচ্ছে করে করেন না আমরা নিজে নিজে পড়ে যাই।

আমি এবার উনার সামনে যেয়ে বললাম,আমি সত্যি ইচ্ছে করে করি নি।

ও আমাকে পাশ কাটিয়ে বললো,আচ্ছা ঠিক আছে।পথ থেকে সরুন।

আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম,আপনার নাম টা কী জানতে পারি?

ও এবার আমার দিকে তাকালো,তাকিয়ে বললো,আরে আপনি রুদ্র ভাইয়া না?

আমি অবাক হয়ে গেলাম ও আমাকে চিনে,কিন্তুু কীভাবে?আমি বললাম,,হুম।কিন্তুু তুমি আমাকে কীভাবে চিনো?

ও এবার হেসে হেসে বললো,,আরে আপনাকে তো সবাই চিনে।আপনি ভার্সিটির টপারদের মধ্যে একজন আবার ভার্সিটির রকস্টার বলে কথা আর তাছাড়া আমি আপনাকে অন্যভাবেও চিনি?

আমি ভ্রু কুচকে তাকাতেই বললো,,আরে কালকে যে পিংক কালারের জামা পরা একটা মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করেছিলেন না ওর ফ্রেন্ড আমি।আমি তখন পিছনে ছিলাম আপনি আমাকে হয়তো খেয়াল করেন নি আমি আপনাকে খেয়াল করেছিলাম।

এবার আমারর কাশি উঠে গেলো ।মেয়েটা আমাকে সরাসরি ইনসাল্ট করলো,কোথায় ভাবলাম ওর সাথে ফ্লার্ট করবো? আমি বললাম,,ওহ্।তা তোমার নাম কী?

মেয়েটা মুচকি হেসে বললো,,আমার নাম ইশিকা রহমান।

আমি বললাম,,বাহ, তোমার নাম টা তো ভারী মিষ্টি।

ইশিকা মুচকি হেসে বললো,লাভ নেই ভাইয়া।

আমি এবার থতমত খেয়ে গেলাম।মেয়েটা যে পটবে না ভালোই বুঝলাম।এরপর প্রতিদিন ওর পিছনে ঘুরতে থাকি, নানাভাবে ওর সাথে ফ্লার্টিং করতে থাকি।ও সব কিছু হাসিমুখে উড়িয়ে দিতো।আমি ওর প্রতি ধীরে ধীরে উইক হতে থাকি,প্রতিদিন ওর সাথে একবার কথা বলা, দেখা করা আমার অভ্যাস হয়ে যায়। আমি ওর প্রতি এতো উইক হয়ে পড়ি যে ওর সাথে কথা বলতে না পারলে আমার ঘুম হতো না। আমি বুঝলাম আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।এরপর আমি ওকে প্রপোজ করি,কিন্তুু ও না করে দেয়।ওর না করে দেওয়াটাই আমার কাছে আরো ভালো লেগেছিলো।কারন আমি কখনও কারো সাথে প্রেম করি নি,ফ্লার্ট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলাম।অনেকেই আমাকে প্রপোজ করতো আমি রিজেক্ট করে দিতাম।অনেক কষ্টে ওকে আমার ভালোবাসা বুঝাতে পেরেছিলাম।পরে ও রাজি হয়ে যায়।৬টা মাস ওর সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো।আমাদের রিলেশনের তিন মাস পর আমি বুঝলাম ইশিকাও আমাকে ভালোবাসে। ওকে আমি এত ভালোবাসতাম যে ওর অন্য কোনো দোষ আমার কাছে দোষ মনেই হতো না।ও আমাকে সত্যিকারে ভালোবাসতো কী না জানি না,তবে আমি ওকে প্রচুর ভালোবাসতাম।”

এতটুকু বলেই উনি থামলেন।আমি কখন যে উনার পাশে দাড়ালাম বুঝতেই পারি নি,উনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি প্রচুর গামছেন।গায়ের টি-শার্ট টিও ভিজে গেছে।উনি থরথর করে কাঁপতেছেন।আমি উনার গায়ে হাত দিতেই দেখলাম উনার শরীর গরম হয়ে আছে।বুঝলাম উনি এ সময়ে নেশা করেন,এখন উনার নেশা করা খুব প্রয়োজন।কিন্তুু কেউ যদি এ সময়টুকু নিজেকে কাবু করতে পারে তাহলে তার নেশা টা কেটে যায়।এর জন্য উনার মাইন্ড ডিসট্রেক্ট (distract)করাটা খুব জরুরী।উনি অন্য কোনো কিছুতে কনসেন্ট্রেট করলেই নেশার টান কমে যাবে।আমি উনাকে কিছু বলতে যাবো তখনই দেখলাম উনি রুমের দিকে যাচ্ছেন।

আমি ফট করে বলে দিলাম,,”আপনি ইশিকা আপুকে ভালোইবাসেন নি।”

আমার কথাটা শুনে উনি দাড়িয়ে গেলেন।
আমি বললাম,যদি উনাকে ভালোইবেসে থাকতেন তাহলে উনার বিষয়টা আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ থাকতো।কিন্তুু আপনার কাছে আপনার ছাই-পাশ বেশী গুরুত্বপূর্ণ, তাইতো উনার কথাগুলো না বলে ছাইপাশ গিলতে যাচ্ছেন।উনি কিছু না বলে ফিরে এসে বারান্দার রকিং চেয়ারটায় বসলেন।আবার কিছু সময় চুপ করে রইলেন।ধীরে ধীরে চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,,,

–“ওকে আমি ভালোবাসি কি না সেটা আমার তোমার থেকে জানতে হবে?তুমি বলো তুমি কি কাউকে কখনও ভালোবেসেছিলে?

আমি কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বললাম,,

–হুম,অনেক ভালোবেসেছি।আর ও আমাকে অনেক ভালোবাসে।

আমার কথা শুনে উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন তারপর হুট করেই জোরে হেসে দিলেন।আমি উনাকে হাসতে দেখে ভড়কে গেলাম,আমি হাসির কী এমন বলেছি?

—তোমার কী মনে হয়, আমি বিখ্যাত বিজন্যাসম্যান, অনুভব খান চৌধুরী, কারো সম্পর্কে না জেনে বিয়ে করবো?তোমার লাইফের এ টু জেড জানি আমি।সব কিছুই আমার জানা।

উনার কথা শুনে এবার আমি গামতে লাগলাম।আমার সম্পর্কে সব জানে মানে?কী জানে উনি?কীভাবে জানে?উনি কি এটাও জানেন যে আমি একজন ধর্ষিতা?কিন্তুু বিষয়টা শুধু আমি আর মুমু জানি।আমি কেঁপে কেঁপে বললাম,,মানে কী কী কী জানেন আপনি?

উনি রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললেন,,,

–মিস সাবরিনা আফরিন সেঁজুতি উপসস সরি মিসেস সাবরিনা সেঁজুতি আমার জানা মতে আপনার লাইফে আপনি এমন কিছু করেন নি যে আপনাকে তোতলিয়ে কথা বলতে হবে।নাকি আমার রিপোর্টার আমাকে এমন কিছু জানায় নি।আচ্ছা সেসব বাদ দিন, আমার মাথায় এটা ডুকছে না যে, আপনি সিঙ্গেল থাকা সত্ত্বেও আমাকে কেনো বলেছেন আপনি রিলেশন করেছিলেন?আমার মতে এখন যে কোনো মেয়ে হলে বলতো আমি প্রেম করি নি, রিলেশন করি নি,আরো কত কী।আমার কাছে ভালো হতে চাইতো।কিন্তুু আপনি এমন কিছুই করেন নি।ইভেন আমাকে এসব কিছু ছাড়তেও বলেন, যেখানে অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই আমাকে এত্তগুলো জ্ঞান দিয়ে দিতো।কিন্তুু আপনি সেটাও করেন নি কেনো?মা আমাকে বলেছিলো আপনি সবার থেকে অনেক আলাদা, আজ তা প্রমানও পেলাম।আমি কি আমার প্রশ্নের উত্তর টা পেতে পারি?

আমি চুপচাপ রইলাম।কি বলবো,ভেবেই পাচ্ছি না?আমি উনার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বললাম,,আগে আপনি বলুন আপনি আমার সম্পর্কে কী জানেন?আর কীভাবে জানেন?

উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু ভাব নিয়ে বললো,

–ও কাম অন,তুমি কেনো তোমার পুরো পরিবারের মানুষের খবর জানা আমার জন্য চুটকির ব্যাপার।বিকস এই দুনিয়াতে টাকাই সব। টাকা দিয়ে সব করা যায়।আর তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানি।

–ওকে, একটু সংক্ষেপেই বলি,তোমার নাম সাবরিনা আফরিন সেঁজুতি।তুমি সবাইকে বলো সাবরিনা সেঁজুতি।তোমার মায়ের নাম সানজিদা আফরিন। সবাই উনাকে আফরিন বলে।আর তুমি এই কারনেই তোমার নাম আফরুন বলো না।তোমার বাবার নাম সিয়াম আরাফাত।তোমার বাবা-মায়ের ডিবোর্স হয়ে যায় যখন তোমার বয়স ৫। তোমার মায়ের দ্বীতীয় স্বামী ছিল তার কারন। উনারা একে অপরকে ভালোবাসতেন তাই তোমার বাবাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যান।ওখানে তোমার মায়ের তিন সন্তান আছে।তোমার মা চলে যাবার পরেই তোমার দাদী তোমার বাবাকে আবার বিয়ে দেয়। তোমার দাদী তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো এমনকি মারতো।তাই তোমার মামা আর মামী তোমাকে উনাদের কাছে নিয়ে যায় এবং উনাদের কাছেই তুমি বড় হও।উনারা তোমাকে ভালোবাসে,তোমার মামা তোমার জন্য সব করতে পারে এবং তুমিও তোমার মামার জন্য সব করতে পারো।তাই তুমি তোমার মামার পা অপারেশনের টাকা জোগাড় করার জন্য একজন নেশ আই মিন আমাকে বিয়ে করেছো টাকার জন্য।এন্ড তোমার একটা বেষ্ট ফ্রেন্ড আছে ওর নাম কী যেন মম না মুমু।এম আই রাইট?

উনার এমন বর্ণনা শুনে তো আমার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।আমি চোখ বড় বড় করে মাথা নাড়ালাম যার অর্থ হুম ঠিক।তবে একটা বিষয়ে কনফিউসড উনি কী জানেন আমি একজন ধর্ষিতা?আমি এ বিষয়ে কথা না বাড়ালাম না।
হঠাৎ একটা কথা মাথায় আসতেই বললাম,,,

–আপনার নাম টা কী???

উনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন মনে হলো আমি যেন এলিয়েন।আমি আমতা আমতা করে বললাম,,,

—আসলে আপনি তখন বলেছিলেন আপনার নাম অনুভব খান চৌধুরী।আবার বলেছিলেন ইশিকা আপু আপনাকে রুদ্র বলেছিলো।তো আপনার নাম মানে আর কি, বুঝেছেনই তো আমি কি বলতে চাইতেছি?

উনি চোখ গুলো লাল করে বললেন,,,

—রুদ্র আমার অন্য একটা নাম।আর আমার এই নামে আমাকে ডাকা নিষেদ।আমাকে শুধু অনুভব ডাকবে।বলেই গটগট করে রুমে চলে গেলেন।আমিও উনার পিছু পিছু গেলাম।আমি রুমে ডুকতেই দেখলাম উনি ওয়াইনের বোতলগুলো পা দিয়ে লাথি দিলেন সাথে সাথে বোতলগুলো দেয়ালের সাথে লেগে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।আমি তাড়াতাড়ি উনার দিকে যেতেই পায়ে কাচ আটকে গেলো সাথে সাথে রক্ত বের হতে লাগলো। আমার চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি পড়তে লাগলো তাও আমি কোনো শব্দ করলাম না,হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললাম।
উনি বিছানায় বসে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা রেগে বললেন,,
—-কী এমন স্ট্যাচুর মতো দাড়িয়ে রইলেন কেনো?

আমি নিচের দিকে তাকিয়ে করুন কন্ঠে বললাম,,
—প্লিজ একটু লাইট টা নিভিয়ে দেন তো, আসলে আমি জানি না তো সুইচ কোথায়।

উনি আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালেন, তারপর উঠে গিয়ে লাইট বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে উল্টে শুয়ে পড়লেন।
আমি আস্তে আস্তে পায়ের থেকে কাচ টা বের করে কাচগুলো একএ করতে লাগলাম।গায়ের সাদা ওড়না টা দিয়ে ফ্লোর টা মুছে ফেললাম,ওড়নার একপাশ ছিঁড়ে পায়ে বাঁধলাম তারপর কাচগুলো নিয়ে রুমের এক কোনে রাখলাম।এরমধ্যে কাঁচ একএ করতে গিয়ে আমার হাতে দুই জায়গায় কাচ দিয়ে কাটা যায়।আমি তাও কোনো শব্দ করলাম না,চুপচাপ দাতমুখ খিঁচে সহ্য করতে লাগলাম।লাইট অফ থাকলেও বাহিরের চাঁদের আলোয় আমি সব স্পষ্ট দেখলাম।উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি এখনো আগের মতো শুয়ে আছেন।আমি ওয়াসরুমে গিয়ে কল ছেড়ে দিলাম এবার মুখ চেপে কান্না করতে লাগলাম।কাঁটা জায়গাতে ওয়াইন লাগার কারনে বেশি জ্বলছিলো।অনেকক্ষণ কান্না করার পর টেপ বন্ধ করে রুমে গিয়ে,,,,

চলবে,,,

(সবার পছন্দ এক নয়,ভালো না লাগলে এড়িয়ে চলুন।)