প্রীতিলতা পর্ব-০২

0
446

#প্রীতিলতা❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#২য়_পর্ব🍂

দেখেছ কতটা কে*টে গেছে তোমার হাত , ইশ্ র*ক্ত ও পড়ছে তোমার হাত থেকে। তুমি নিজের একটুও খেয়াল রাখো না প্রীতিলতা।

গাল ফুলিয়ে অভিমানী ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে পুতুল তুলো দিয়ে আমার হাতের কেটে যাওয়ার অংশটুকু মুছে দিতে লাগলো।

আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আমার অশ্রু সিক্ত নয়নজোড়া অন্যদিকে ঘুরিয়ে বাঁ হাতের তালুতে চোখ মুছে তাকে বললাম,

— তুমি আছো তো আমার খেয়াল রাখার জন্য। তাহলে মিছে সময় নষ্ট কেন করব।

ও তুলো দিয়ে হাত মুছতে মুছতে আমার দিকে আর চোখে তাকিয়ে “চ” এর মত উচ্চারণ করে বলল,

— উফ ও প্রীতিলতা। আমি না থাকলে যে তোমার কি হত?

বলার ধরন দেখে আমার ভারি হাসি পেল। কিঞ্চিত হেসে উত্তর দিলাম,

— কী আর হতো বলো, তুমি যদি এই বাড়িতে না থাকলে এতদিনে হয়তো ম’রে’ই যেতাম।

পুতুল নিজের কাজ বন্ধ করে কোমরে দুই হাত বাধিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে এক আঙুল উঁচিয়ে বলে উঠলো,

— এই তুমি পঁচা পঁচা কথা কেন বলছ প্রীতিলতা? তুমি ম*রে যাবে না। আমি সব সময় তোমার সাথে সাথে থাকবো তাহলে তো তুমি আর মরে যাবে না তাই না?

ওর হাত ধরে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে মুখে উত্তর দিলাম,

— উহু তাহলে আর ম’রে যাব না।

*তোমার হাতে খুব ব্যথা করছে তাই না প্রীতিলতা? তখন আমায় অত জোরে কেন জড়িয়ে ধরতে গেলে তুমি?তাহলে কাঁচের চুড়ি গুলো আর ভেঙ্গে তোমার হাতের মধ্যে ঢুকে যেত না।

আমিতো শুধু সিক্রেট কথা বলছিলাম। ভুতের গল্প তো বলছিলাম না যে ওমনি ভাবে জড়িয়ে ধরতে হবে। আমার দম নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো।বাবাহ্

তুমি হাতের যন্ত্রণার কথা বলছো পুতুল সোনা! কই সেখানের য*ন্ত্র*ণা তো আমি অনুভব করতে পারছি না। নাকি হাতের য’ন্ত্র’ণার তুলনায় বক্ষপিঞ্জরের য’ন্ত্র’ণা বেশি হয়ে গেল। তাই হয়তো অনুভব করতে পারছি না।

তুমি তো বোঝো না পুতুলসোনা মনের য/ন্ত্র/না কতটা ভ/য়/ঙ্ক/র। যে য/ন্ত্র/না কাউকে না দেখানো যায়, না কাউকে বলে বোঝানো যায়। এ তো শুধু একান্ত ভাবে নিজেকে অনুভব করতে হয়।যা প্রতিনিয়ত তার অদৃশ্য লেলিহান শিখা দিয়ে দ*গ্ধ করতে থাকে অন্তঃস্থকে।

আচ্ছা। তুমি একটু বসো আমি আসছি। একদম কোথাও যাবে না কিন্তু আমি এক্ষুনি আসছি প্রীতিলতা।

— আবার কোথায় যাচ্ছ তুমি। হাতের ব্যথা এমনিতেই সেরে যাবে তুমি আমার এখানে এসে বসো যেও ন…

তার মধ্যে এক ছুটে চোখের আড়াল হয়ে গেল পুতুল।

_________🌺🌺_________

রাতে খাওয়ার টেবিলে সবাই একসাথে দেখে অনেকটাই অবাক হলাম আমি । এই বাড়িতে নয়টার মধ্যে রাতের খাবার খাওয়া হয় কিন্তু বড় ভাইয়া এবং ভাবী দুজনে ডাক্তার হওয়ার কারণে তাদের চেম্বার থেকে আসতে দেরি হয় যার ফলে তারা নিজেদের রুমেই ডিনার সেরে নেন।

আর সাফওয়ান তো অনেক রাত করে বাড়ি আসেন। অনেক সময় বাহিরে থেকেও খেয়ে আসেন। আবার যখন না খেয়ে আসেন। নিচে ডাইনিং টেবিল থেকে খেয়ে আসেন। উঁকি দিয়ে দেখেছি শাশুড়ি মা বসে থেকে যত্ন করে তার ছেলেকে খাওয়ান। তাই আর খাওয়ার ব্যাপারে আমি আর তাদের মাঝে যাই না।

তবে আজ হয়তো বিশেষ কোনো কারণ আছে নাহলে এই অদ্ভুত গ্রহগুলোকে একই কক্ষপথে পাওয়া যেত না। আমার ভাবনার মাঝেই সাফওয়ান চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।

টেবিলের উপরে তার জন্য বরাদ্দকৃত প্লেটটা সোজা করতে করতে আমার দিকে এক ঝলক তাকালেন তাতেই আমাদের দৃষ্টি বিনিময় হল কারণ আমি তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। তিনি দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।

সবাইকে পরিবেশন করা হলো। আমি মাকে হাতে হাতে সাহায্য করছিলাম। ভাবী বাহিরে থেকে আসায় তাদের সাথে ক্ষেত্রে বসে পড়ল। খাওয়ার সময় কথা বলা বাবা পছন্দ করেন না। তাই সবাই চুপচাপ খাবারে মনোনিবেশ করল।

খাওয়া দাওয়া শেষে বাবা বললেন,

— আগামীকাল সকালের ট্রেনে আমি আর তোমাদের মা ঢাকায় যাচ্ছি। তিন দিন তোমাদের খালামণির বাসায় থাকবো। তারপর ওখান থেকেই আমরা ওমরা হজের জন্য ক্যাম্পের সাথে যোগ দেব।

সবাই একেবারে আকাশ থেকে পড়ল যেন। বড় ভাইয়া সাকলাইন বললেন,

— বাবা তুমি তো আমাদের আগে জানাওনি যে তোমরা হজে যাচ্ছ।

পুতুলকে জানিয়েছি। সে তো তার প্রীতিলতাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। তাকে সাথে করে ঢাকায় তোমাদের খালামনির বাসায় রেখে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে বলল সে তার প্রীতিলতার কাছেই ভালো থাকবে। বলে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।

তারপর আমার দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

— মামনি, পুতুলের খেয়াল রেখো তুমি। খুব শিগগিরই ফিরে আসার চেষ্টা করব।

— জ্বী বাবা।

তারপর বাবা আবার বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

—- তোমাদের সবাইকে তো আগে বলে রেখেছিলাম সাফওয়ানের বিয়ের পর আমি আর তোমাদের মা ওমরা হজের জন্য মক্কায় যাব। আমি যাওয়ার প্রসেসিং অনেক আগে থেকেই শুরু করেছিলাম গতকালকেই কনফার্ম হলাম।

তোমরা তো বাবা খুব ব্যস্ত মানুষ। এতসব ব্যাপার মাথায় রাখা সম্ভব না। আড় চোখে সাফওয়ান দিকে তাকিয়ে বললেন,

— আর কেউ কেউ তো কোনো কিছু না করেই খুব ব্যস্ত মানুষ।

সাফওয়ান কিছুক্ষণ বাবার দিকে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিজের ফোনে কি করতে লাগলেন যেন।

তোমাকে বলেছিলাম প্রীতি মামনি কে নিয়ে তার বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে যাওনি কেন?

*সাফওয়ান নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন।

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাবার বাড়ির কথা শুনে ভিতরের কষ্টগুলো কেমন যেন মাথা চারা দিয়ে উঠলো।

বাবা এবার একটু ধমকের স্বরে বলে উঠলেন,

— আমি তোমার সাথে কথা বলছি সাফওয়ান।

এবার তিনি নম্র দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে শিতল কন্ঠে বললেন,

— আমি তো সেই শুরু থেকে আপনার কথাই শুনে আসছি বাবা। আপনি বলুন আমি শুনছি বাবা।

ছেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশার শ্বাস ফেলে বাবা আবার বললেন,

— তোমাকে বলেছিলাম প্রীতি মামনি কে নিয়ে তোমার শশুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে। তুমি গেলে না কেন? লজ্জায় রমজান ভাইয়ের ফোন রিসিভ করতে পারছি না আমি।

সাফওয়ান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— প্রীতি যদি যেতে চান, যেতে পারেন। কিন্তু আমি যাব না। আমার কাজ আছে।

উচ্চস্বরে ধমকে উঠলেন সাখাওয়াত সাহেব বললেন ,

— কী রাজকার্য কর তুমি? সারাদিন থাকো তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা নিয়ে নয়তো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে কোথাও হারিয়ে যাও। এইভাবে জীবন চলে নাকি?

সাকলাইন ভাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সাফওয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,

— এখন বিয়ে করেছো তুমি। বিয়ের আগে যা করেছ করেছ। এবার চাকরি বাকরি খোজ এবং সংসারী হও। তোমার একটা ভবিষ্যৎ আছে। এখন থেকে চিন্তাভাবনা শুরু করো।

সাফওয়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,

— হ্যাঁ বাবার আদর্শ ছেলে তুমি। তার সমস্বরে ই তো কথা বলবে।

কখনো কি জানতে চেয়েছ আমি কি চাই। তোমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছাটাকে সেই ছোটবেলা থেকেই আমার উপরে চাপিয়ে এসেছে তোমরা। আমার জীবনের প্রতিটা স্তরে তোমাদের কথাই শেষ কথা। এমন কেন করো তোমরা আমার সাথে।

যা বলেছ তাই শুনেছি। হঠাৎ করে বিয়ে করতে বলেছ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও বিয়ে করেছি আমি। আর কি চাও তোমরা আমার কাছে। এবার তো আমাকে একটু মুক্তি দাও।( হাত জোড় করে)

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না সাফওয়ান। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে চলে গেলেন। ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সাখাওয়াত সাহেব। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন ,

— ছোট ছেলেটাকে একদম মানুষ করতে পারলাম না।

কথাগুলো বলে আমার দিকে হতাশার দৃষ্টিতে এক ঝলক তাকিয়ে বাবা নিজের ঘরে চলে গেলেন। মাও তার পেছন পেছন ছুটলেন তাকে সামলানোর জন্য। সবাই যে যার রুমের দিকে চলে গেল।

বাকি রয়ে গেলাম শুধু আমি। পুরো ডাইনিং রুম জুড়ে পিন পতন নীরবতা। তবুও কানে বজ্র ধ্বনির মত বেজে চলেছে

*বিয়ে করতে বলেছ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও বিয়ে করেছি আমি। আর কি চাও তোমরা আমার কাছে। এবার তো মুক্তি দাও আমায়।

________🌺🌺_______

রাতের আকাশে ধূসর মেঘের ঘনঘটা। সারা আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তারা। দেখে মনে হচ্ছে যেন সূর্য সারা দিন পৃথিবীটাকে যে উনুনে গনগনে আঁচে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেছে, অস্ত যাওয়ার পূর্বে সেই উনুনের আগুন চাপা ছাইটা সারা আকাশে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে পৃথিবীটাকে নতুনভাবে সতেজ করে তোলার জন্য। শো শো করে বাতাস বইছে। ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ।

আজ আকাশটার ও বুঝি আমার মত মন খারাপ করেছে। তাইতো আমার বুকের মত তার বুকে ও ঝড় বইছে। শুধু একটাই পার্থক্য আকাশ তার নিজের বুকের যন্ত্রণাটা চিৎকার করে পুরো ধরণীকে জানাতে পারবে কিন্তু আমি তা পারছি না নিজের বুকের যন্ত্রণাগুলো নিজের মধ্যেই পৃষ্ঠ করে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিতে হচ্ছে আমাকে। ইশ্ আমিও যদি তার মত চিৎকার করে একটু কাঁদতে পারতাম কতই না ভালো হতো।

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালাম। দূরদূরান্ত পর্যন্ত কৃত্রিম আলোয় আলোকিত পুরো শহর। চাঁদের আলো এখন আর এই শহরের দরকার নেই।হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির আবির্ভাব হলো পুরো শহর জুড়ে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলতে শুরু করলাম,

আজ নিজের উপর নিজেরই প্রচন্ড করুণা হচ্ছে আমার। আজ সবাই আমাকে আমার নিজের অবস্থান আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কতটা বোঝা আমি তাদের জন্য। আচ্ছা এই বোঝাটা কি আমি ছোট থেকেই ছিলাম নাকি হঠাৎ করেই হয়ে গেলাম।

শ্লেষের হাসি হেসে নিজেকেই নিজে বলতে শুরু করলাম,

প্রথমে ছিলাম বাবার ঘাড়ের বোঝা। একটা সময় পর এসে তিনি আর বোঝা বইতে না পেরে। আরেকজনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন এই বোঝাকে। সেই আগুত্তক বোঝা বইতে না পেরে হুংকার দিচ্ছে মুক্তি পাওয়ার জন্য। আচ্ছা এই শহরের কোন এক কোণে কী এই বোঝার জায়গা হবে না। একটু কী জায়গা হবে না সবার দৃষ্টির অগোচরে চলে যাওয়ার জন্য। ‌

শরীর ক্রমশ উষ্ণ হতে শুরু করলো আমার। চোখ জ্বালাপোড়া করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে আমার। কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে কন্ঠনালী। তারপরে ও আজ নিজের ব্যর্থতা অপারগতাকে মুখে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করছে।

কষ্ট হলেও যতদূর চোখ গেল জোর করে তাকিয়ে খুজলাম নাহ..! এ শহরে এই বোঝা টার কোন জায়গা হবে না। আবার বিদ্রুপের হাসি খেলে গেলো আমার ঠোঁট জুড়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে আবার বলতে লাগলাম,

–সৃষ্টি যখন তুমি করেছ তোমার ছায়া তলেই না হয় আমায় একটু জায়গা দাও। এ শহরে প্রীতিলতার কোন জায়গা নেই। কোথাও ন….

আর বলতে পারলাম না কন্ঠনালী রুদ্ধ হয়ে গেল। নিজের ভারসাম্য ছেড়ে দিলাম । হঠাৎ খুব জোরে আছড়ে পড়লাম কোথাও। বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি। নিজের মধ্যেকার সর্বশক্তি দিয়ে জোর খাটিয়ে চোখ জোড়া মেললাম স্পষ্ট কিছুই দেখতে পেলাম না শুধু অস্পষ্ট একটা প্রতিবিম্ব। হাতড়ে ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না সত্যিই অস্পষ্ট।বিরবির করে বললাম,

প্রীতিলতা তুমি পদ্য
পাতা ঝিমঝিমানো গদ্য
তোমার আমার সন্ধি
না পাওয়া ছকে বন্দী।🍂

চলবে……❣️