প্রীতিলতা পর্ব-০৩

0
394

#প্রীতিলতা❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#৩য়_পর্ব🍂

পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে আমার। গলাটা শুকিয়ে ধুদু মরুভূমি হয়ে গেছে যেন। তাই পানির সন্ধানে অনেক কষ্টে ভারী চোখের পাতা টা মেলে তাকালাম। শরীরের উপর দুই পার্টের কম্বল দেওয়া। শরীর টা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে।

দেখতে পেলাম মাথার ওপরে সিলিং ফ্যানটা ভন ভন শব্দ করে ঘুরছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম জানালার পর্দা ফিনফিন করে উঠছে। বাহিরে তাকিয়ে সঠিক সময় অনুধাবন করতে পারলাম না এখন রাত নাকি ভোর।

শারীরিক ক্লান্তিতে আবার চোখ বুজে এলো আমার।শরীরে কোন জোর পাচ্ছি না আমি যে উঠে বসবো। শরীরটা এমন লাগছে কেন আমার?

হঠাৎ মস্তিষ্কের নিউরন গুলো সতর্ক করল আমাকে। গত রাতের ঘটনা গুলো এক এক করে মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। আমি তো ছাদে ছিলাম এখানে এলাম কিভাবে। আর একটু কিছু মনে করার জন্য ব্রেনের উপরে প্রেসার দিতেই মাথাটা কেমন যন্ত্রণায় শির শির করে উঠলো।

ব্যথাটা সহ্য করতে না পেরে মুখ দিয়ে ব্যাথাতুর আওয়াজ বের হয়ে আসল। তৎক্ষণাৎ মাথার পেছনে কারোর হাতে স্পর্শ অনুভব করলাম কিঞ্চিত উঁচু করে ধরে আমার মুখের খুব নিকটে শীতল কন্ঠে একটা প্রশ্ন শুনলাম,

— আপনার কি আবার শরীর খারাপ লাগছে? কি অসুবিধা লাগছে আমাকে বলুন?

কণ্ঠস্বরটায় কিছু একটা ছিল। যা আমার সারা শরীর জুড়ে শীতল একটা শিহরণ প্রবাহিত হল। হালকা কেঁপে উঠলাম আমি। চোখ মেলতে কষ্ট হলেও মনের মধ্যে আগুত্মক কে দেখার বাসনা প্রবাল ধারণ করল।

অল্প অল্প পলক ফেলে চোখ মেলে তাকালাম আমি। বেশি দূরে খুঁজতে হয়নি তাকে। নিজের মুখের উপরেই কিঞ্চিৎ দূরে একটা পুরুষয়ালী লম্বাটে অবয়ব ভেসে উঠলো।যার হালকা লালচে বর্ণ চোখ এবং ঠোঁট জোড়া শুষ্ক।

সম্পর্কের সে আমার স্বামী হলেও জীবনে প্রথমবার নিজেরা এত কাছে কোন পুরুষের উপস্থিতি আমাকে বড্ড অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। তারপরও বেহায়া চোখ জোড়া তার অবয়বে আটকে পড়েছিল। ঘনঘন কয়েকটা ঢোক দিলাম।

উনি হয়তো কোন কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাই মাথাটা আরেকটু উঁচু করে ধরে , সোজা করে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলেন আমাকে। হাত বাড়িয়ে খাটের পাশের ল্যামশেড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা তুলে আমার মুখের সামনে ধরে বললেন,

— খাইয়ে দিতে হবে নাকি আপনি নিজে পারবেন?

এতক্ষণ আহাম্মকের মত তাকিয়ে থেকে তার কর্মকাণ্ডগুলো দেখছিলাম। আমার দুটো জিনিস মনে হচ্ছে। এক আমি স্বপ্ন দেখছি, নতুবা আপন মনে কল্পনা করছি। আসলে ব্যাপারটা কি?

— কী হলো পারবেন?

আবার সেই কণ্ঠস্বর …! নিজের লোপ পাওয়া বোধশক্তি ফেরত এসেছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোন আওয়াজে বের করতে পারলাম না শুধু কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা ধরলাম। খেতে গিয়ে বেশ খানিকটা পানি নিজের গায়ে এবং কম্বলের উপর ফেললাম। চ্যাহ…!কী করলাম এটা।

অপরাধীর দৃষ্টিতে সাফওয়ানের দিকে তাকালাম। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর পানি গ্লাসটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ধীরে ধীরে খাইয়ে দিলেন আমাকে।

একটা মানুষের এমন আকস্মিক পরিবর্তন এবং তার লালচে চোখ জোড়া দেখে ভয় আমার পেটের ভেতরের কেমন যেন গরগর করতে লাগলো। ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন।

পানির গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে আমার দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল,

— কি হয়েছে?

ভাঙ্গা গলায় অনেক কষ্টে উত্তর দিলাম,

— ওয়াশরুমে যাব।

— আসুন।

বলে হাত ধরেও আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝতে পারলাম শরীরটা অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। মাথার মন থেকেও কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো।

সাফওয়ানের হাত ধরেই ওয়াশরুম পর্যন্ত গেলাম। তিনি আমাকে ওয়াশরুমের দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে রুম থেকে একটা টুল এনে দিলেন। এবং সেখানে বসেই ফ্রেশ হতে বললেন আর কোন দরকার পড়লে তাকে ডাক দিতে বললেন। তিনি বাহিরে আছেন।

আমি মাথা নাড়িয়ে সায় জানালাম। কিন্তু তার কোন কথাই আমার বোধগম্য হলো না।

কথাগুলো বলে ওয়াশরুমের দরজা চাপিয়ে তিনি বাহিরে চলে গেলেন।

আমি বেশিন ধরে টুলের উপরে বসলাম। আমি বুঝতে পারছি না আমি কি জেগে আছি নাকি এখনো ঘুমিয়ে আছি। মনে তো হচ্ছে নির্ঘাত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি। কারণ এখন তো রাত দিবার স্বপ্ন দেখা তো সম্ভব নয়। কয়টা বাজে তাও বুঝতে পারছি না।ধ্যাত…!

বেশি করে মুখে পানি দে প্রীতি আর নিজের ঘুম ভাঙ্গা না হলে কয়দিন পরে পাগলা গারদেই তোর ঘুম ভাঙবে।

________🌺🌺________

আবোল তাবোল চিন্তা শেষে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। পরনে কলাপাতা রং এর থ্রি পিস।ফ্রেশ হতে গিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম। আমার পোশাক কে চেঞ্জ করল…!

বাহিরে বের হয়ে এসে দেখি সেন্টার টেবিলে খাবারের প্লেট রাখছেন সাফওয়ান। আমি বেরোতে আমার দিকে এক ঝলক তাকালেন। তারপর গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে বললেন,

—- দ্রুত খেয়ে নিন। খাওয়ার পরে আপনার একটা মেডিসিন আছে।

নাহ আমি তো ঘুমিয়ে নেই আর স্বপ্নও দেখছি না। নির্ঘাত এই ব্যাটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

আমাকে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে সাফওয়ান প্রশ্ন করলেন,

— কি ব্যাপার এখন তো আপনাকে দেখে সুস্থ মনে হচ্ছে, তারপরও এখন কি আবার ভাত মাখিয়ে আপনাকে খাইয়ে দিতে হবে?

মুখে বিড়বিড় করে বললাম,

— না থাক। এত সৌভাগ্য আমার হয়নি। এমনিতেই যা চমক দেখালেন তাতেই থমকে গেছি। আর দরকার নেই বাবা।

চুপচাপ গিয়ে সোফায় বসলাম। খাবারে হাত দিয়ে বুঝলাম খাবার গরম। ভেতরের কৌতূহল আর দমন করতে না পেরে প্রশ্ন করেই বসলাম,

— কয়টা বাজে?

স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন,

— ভোর চারটা।

আমি চমকে উঠলাম। তারপর বললাম,

—- খালা এখনো জেগে আছেন?

ভুল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— কেনো?

— মানে খাবারটা গরম দেখছি, তাই আর কী

আমার কথার বিপরীতে তিনি একটা হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

— না খালা এখন জেগে নেই। তিনি অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেন আমাকে কি আপনার চোখে পড়ছে না নাকি আমাকে মনুষত্বহীন বলে মনে হয় আপনার? কোনটা?

বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে চলে গেলাম।

— হ্যাঁ মানে। আপনি খাবার না মানে আপনি আমার জন্য খাবার গরম করে নিয়ে এসেছেন?

— খাবারটা ঠান্ডা হওয়ার আগে খেয়ে নিন।

আমিও আর কথা বাড়ালাম না চুপচাপ খাবার মনোযোগ দিলাম। খাওয়া শেষে ওষুধের পাতা থেকে তিনটে ট্যাবলেট আমার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। আমি ওষুধের সাইজ দেখে ওনাকে প্রশ্ন করলাম । এর থেকে ছোট ওষুধ আর নাই বাজারে।

তিনি আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে টিটকারী করে বললেন,

— কি আর করা যাবে বলুন। না আমার আর না আপনার কারোর বাপেরই দুর্ভাগ্যবশত ঔষধ তৈরির কারখানা নেই যে তারা আপনার জন্য আপনার পছন্দসই আকার আকৃতি দিয়ে ওষুধ তৈরি করবে।

— নাহ। ঠিক আছে।

— কী?

— কিছু না।

এরপর আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ওষুধ খেয়ে নিলাম। মুখ থেকে পানির গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে সাফওয়ানকে প্রশ্ন করলাম,

— আচ্ছা আপনি আমাকে এত ওষুধ খাওয়ালেন কেন? কি হয়েছিল আমার?

স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন,

— ভুতে ধরেছিল।

— কীহ..!

— সঠিকভাবে বলতে পারছি না, জিন ও হতে পারে। না হলে রাত বারোটার সময় কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এমনভাবে ছাঁদে দাড়িয়ে তো আর বৃষ্টিতে ভিজতে পারেনা তাই না…!

* তা আপনার এই জিন ভূতের সমস্যা কী ছোটবেলা থেকে নাকি হঠাৎ করেই উদয় হল।তার উপর আবার জ্বরের ঘোরে উদ্ভট বকবক করারও রোগ আছে আপনার।

আমার মনে পড়ল আমি তখন ছাদে থাকলেও একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কি করেছি আর কি বলেছি তার কিছুই আমার মনে নেই।

তার উপর ছোটবেলা থেকেই বৃষ্টিতে ভিজলেই আমার জ্বর আসবে কনফার্ম আর জ্বরের ঘোরে উদ্ভট কথা বলি এটাও সত্যি।

তাই আমি মুখটা কাচুমাচু করে অতি বিনয়ের সাথে নিজের ভুল স্বীকার করে বললাম,

— সরি। আসলে ত…

আমাকে থামিয়ে দিয়ে কটমট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সাফওয়ান বললেন,

— আপনার সরি, আপনার কাছেই রাখুন। ওই সরি আমার কোন কাজে আসবে না। জানেন আপনার এই উদ্ভট কাজের জন্য আমার বাবা আমাকে কি…

কথা বলতে বলতে থেমে গেলেন সাফোয়ান।

— কি হলো বলুন বাবা আপনাকে কি?

— না । কিছু না।

চুপচাপ শুয়ে পড়ুন আর আমাকেও একটু ঘুমাতে দিন। সারারাত কত সুন্দর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন পুরো বিছানা জুড়ে আর আমাকে আপনার চৌকিদারির দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে সারা রাত। এবার দয়া করে আমাকে একটু ঘুমাতে দিন।

যতসব উদ্ভট ঝামেলায় এসে জোটে আমার কপালে।

লাস্টের কথাটা বির বির করে বলে বালিশ নিয়ে খাটের ওপর পাশে শুয়ে পড়লেন। আমিও গায়ে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লাম।

হঠাৎ গত রাতের কথাগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই মুখ ফুটে তাকে প্রশ্ন করেই ফেললাম,

আচ্ছা আপনি কি কাউকে পছন্দ করেন?

বালিশে মুখ গুজে শুয়ে ছিলেন তিনি। আমার প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন তিনি।

আমি শুকনো কয়টা ঢোক গিলে বললাম প্লিজ আমি যে প্রশ্নটা করেছি তার সঠিক উত্তর দেবেন। আপনাকে আর বিরক্ত করবো না।প্রমিস।

সাফওয়ান গম্ভীর গলায় বললেন,

— না আমি কাউকে পছন্দ করি না।

বুকের উপর থেকে যেন বড় একটা পাথর নেমে গেল আমার।সেই খুশি হলাম আমি। আহা কি শান্তি..! যাক বাবা তাহলে কোন শাকচুন্নীর ঝামেলা নাই।

কিন্তু তারপরেই মাথার মধ্যে একটা প্রশ্ন উদয় হল। না চাইতেই কৌতূহলবশত মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে গেলো

— তাহলে আমাকে অপছন্দ করার কারণ কি?

আমার প্রশ্ন তার কানে যাওয়ার কিয়ৎক্ষণ পরে পাশ ফিরে হঠাৎ আমার উপর চড়াও হলেন তিনি। আমাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিসিয়ে বললেন,

— কারণ তুমি আমার বাবার পছন্দ….!

চলবে….❣️