প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা পর্ব-০৬

0
581

#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|ষষ্ঠ পর্ব |

গ্রীষ্মকালীন সময়ে রোদের পর বৃষ্টির আগমন যেন অমাবস্যার চাঁদ। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যাওয়া মানুষদের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। বৈকালীন শেষ সময়ে সূর্য্যিমামা যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে ঠিক সেই সময়ে প্রকৃতির মান হয়েছে। পুরো আকাশ জুড়ে শুধু মেঘের ভেলারা খেলা করছে।
রুপ দুঃখি মনে কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুপের হাতে একশত টাকা রয়েছে অবশিষ্ট। রুপ ভেবেছিলো সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু প্রকৃতির যা অবস্থা! দেখে মনে হচ্ছে এখন বের হলে মাঝপথে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে হবে।

” ম্যাম বাসায় যাবেন না?”

গভীর ভাবনায় বিভোর ছিলো রুপ। কারোর ডাকে পিছনে ফিরে তাকাতে’ই দেখে রুপের ছাত্র ফয়সাল হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে আর তাঁর পাশেই মিষ্টি মেয়ে ফাল্গুনী।

” হ্যাঁ যাবো। তোমরা আগাও। আমার কিছু কাজ আছে।”

ফয়সাল আরো কিছু বলবে তাঁর আগেই ফাল্গুনী ফয়সালকে এক প্রকার টেনে সাম্মুখে নিয়ে যাচ্ছে। চার পাঁচ কদম আগানোর পর ফয়সাল ফাল্গুনীর হাত ঝেড়ে আবারও রুপে সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে কিছুটা লাজুক হাসি এনে বলে,

” আপনি কি আপনার বয়ফ্রেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছেন?”

রুপ অবাক, বিমূঢ়। চঞ্চল দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। এমন লজ্জাকর পরিস্থিতিতে যে ছাত্রের সামনে পড়তে হবে তা ভবঘুরে বুঝতে পারেনি রুপ।
এদিকে ফাল্গুনীর মাথায় হাত। ফয়সাল যে এতোটা ঠোঁট কাঁ’টা স্বভাবের হবে তা আগে বুঝার উচিত ছিলো ফাল্গুনীর।

” বাসায় যাও তোমরা।”

ফয়সালকে ফাল্গুনী এক প্রকার জোর করে রুপের সামনে থেকে নিয়ে যায়।
এদিকে রুপ কোচিং সেন্টার থেকে বের হয়ে আসে। বলা তো যায় না! কখন যেন আবার কোন ছাত্র এসে বলবে,

” ম্যাম আপনার জামাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন?”

রুপ আর ঝুঁকি নিতে চায় না। এমনিতেও আসার সময় রাগী লোকটা নিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি। এ নিয়ে চিন্তার শেষ নেই রুপের।

বন্ধু মহলে আড্ডায় মেতে আছে সকলে। একসাথে তিনটে মোটরবাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মজা মাস্তি করছে। সকলের হাতে চায়ের কাপ। হালকা করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে আর কথা বলছে। প্রায় পাঁচজন বন্ধুর মধ্যে আড্ডার আসর জমলেও শুধু একজন গভীর ভাবনায় ব্যস্ত। নাদিফ পরপর নিকোটিনের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে যাচ্ছে আর কি যেন চিন্তা করছে। বন্ধুমহলের মধ্যে একজনের নাম আকাশ। খুবই দুষ্টু প্রকৃতির। নাদিফের উদ্দেশ্যে বলে,

” কি মামা! প্রেমে পড়েছো নাকি? ভাবসাব ভালো ঠেকছে না।”

সিগারেটে শেষ ফুক দিয়ে আকাশের পিঠে চাপড়ে নাদিফ উওর দিল,

” ভালোবাসা আমার দ্বারা সম্ভব না। এসব ভালোবাসা করার সময় আমার নেই। মেয়ে মানুষ মানে ঝামেলার বস্তু।”

” তাহলে স্মোক করছিস কেন?

নাদিফ এবার কিছুই নড়েচড়ে উঠলো। ললাটে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে বলল,

” আজকাল মনে হচ্ছে আমার অগোচরে কিছু একটা হচ্ছে। কেউ একজনের দিকে মন ঘুরে যাচ্ছে। যা আমি চাই না, তাই হতে যাচ্ছে।”

আকাশ হতভম্ব। বন্ধুমহলের সবসময় সবচেয়ে নিরামিষ খেতাব পেয়ে এসেছে নাদিফ। আর সেই নাদিফের মনে কিছু একটা ঘটছে। ভেবেই আনন্দ লাগছে। আকাশ মনে মনে দোয়া করছে যেন কোন মেয়ে আসে নিরামিষের জীবনে। আকাশ কিছু বলবে তাঁর আগেই নাদিফ অদূরে কাউকে দেখে বলে উঠে,

” আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। তোরা থাক আমার কাজ আছে।”

নাদিফ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। বাইকে চড়ে আড্ডামহল থেকে আড়ালে চলে গেলো।

ব্লক সি এখনও অনেকটা পথ দূরে। প্রবল বাতাস বইছে চারপাশে। হয়তো কোথাও ঝড় হচ্ছে! রুপ ওড়না দিয়ে শরীরে ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিলো। বলা তো যায় না যদি ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টিধারা নেমে আসে!
রুপের এখন প্রকৃতির উপর বেশ অভিমান হচ্ছে। কেন এই অসময়ে মন খারাপ করতে হবে প্রকৃতির! মাঝে মাঝে তো রুপের মত অসহায়দের কথাও ভাবতে পারে তাই না!

” এই ঝড়ের মধ্যে কোথায় যাচ্ছো মেয়ে? ঐ পাড়া তে কি তোমার প্রেমিক থাকে?”

একদিকে বাতাস আরেকদিকে ধুলো ময়লা। চোখ খুলে রাখা দায়। রাগী লোকটার কথা কানে আসায় রুপ দাঁড়িয়ে যায়। এদিক সেদিক নজর ঘুরিয়ে সময় নিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। বাতাসের কারণে রাগী লোকটাও ঠিক মতো তাকাতে পারছে না।

” বাসায় যাচ্ছি।”
” তা কার বাসায় যাচ্ছো। প্রেমিকের বাসায় বুঝি?”

রুপের এখন ইচ্ছে করছে রাগী লোকটার গাল ফাটিয়ে দিতে। কথায় কথায় অপমান রুপের আর সহ্য হচ্ছে না। রুপ ভাবছে, “এই লোকটা কি মেয়েদের সহ্য করতে পারে না! পরমুহূর্তে মনে পড়লো এক ঘন্টা আগের ফোনকলের কথা। হয়তো প্রেমিকাকে ফোন করতে গিয়ে আমাকে ফোন করেছে। এই রাগী লোকটা আমাকেই সহ্য করতে পারে না। রাগী লোকটা ভাবে আজাদ আঙ্কেলের সহিত আমার,,, ছিহ ছিহ কথা’ই বলবো না লোকটার সাথে।”

রুপ পাল্টা উওর না দিয়ে প্রবল বাতাসে আবারো হাঁটা শুরু করে দিলো। এদিকে মেয়েটা নাদিফকে আবারও ইগনোর করায় নাদিফ ভীষণ রেগে যায়। নাদিফ এসেছিল পড়শি ভেবে সাহায্য করতে কিন্তু এই মেয়ে করলো কি।

” কথা না শুনলে কিন্তু প্রেম নীড়ে জায়গা হবে না। আর প্রেম নীড় যাওয়ার সঠিক রাস্তাও বলে দিবো না।”

রুপ বুঝতে পারছে লোকটা মিথ্যা বলছে। রুপকে অপমান করার নতুন বুদ্ধি আটছে। রুপ থামলো না। নিজের মতো আগাতে লাগলো। এদিকে রুপের ত্যাড়াবাঁকা কাজে নাদিফ অবাক। রুপ যে ভুল রাস্তায় আগাচ্ছে শুনেও কোন পতিক্রিয়া করলো না। কিন্তু নাদিফ তো আর এটা হতে দিবে না। যতই হোক পড়শি তো! নাদিফ মোটরবাইক চালু করে শা শা করে রুপের সামনে এসে দাঁড়ালো। আচমকা মোটরবাইক থামায় রুপ ভয় পেয়ে যায়। রাগান্বিত কন্ঠস্বরে কিছু বলবে তার আগেই নাদিফের রাগান্বিত চেহারা দেখে ভয় পেয়ে যায়। নাদিফের নজর পুরোপুরি রুনের দিকে নিবদ্ধ।

” একটা কথা বারবার বলতে পছন্দ করি না অপরুপ! তুমি আমাদের বাসায় আমাদের দায়িত্বে আছো। মাঝপথে এভাবে ফেলে চলে যেতে পারি না। উঠে এসো।”

রুপ যেন আকাশ থেকে টপকে পড়লো। কন্ঠনালী থেকে আপনা আপনি স্বর বের হয়ে আসলো ‘অপরুপ!’ নাদিফের দিকে তাকিয়ে দেখলো নাদিফ নির্বিকার যেন মাত্র কিছুই বলেনি। কোন উপায়ান্তর না পেয়ে রুপ আবারও রাগী লোকটার পিছনে মোটরবাইকে চড়ে বসলো।

প্রেম নীড়ের গেইটের সামনে মোটরবাইক এসে থেমেছে। কুদ্দুস মোল্লা মোটরবাইকের আওয়াজ শুনে বুঝতে পেরেছে ছোট মালিকের আগমন ঘটেছে। মাথায় টুপি পরিধান করে হাথে ছোট লাঠি নিয়ে ছুটে আসে গেইট খুলে দেয়ার জন্য।
ছোট মালিকের পিছনে কোন রমণীর বসতে দেখে অবাক হয়ে যায় কুদ্দুস মোল্লা। ততক্ষণে ছোট মালিকের মোটরবাইক ভবনে প্রবেশ করেছে। কুদ্দুস মোল্লা উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখে ছোট মালিকের মোটরবাইকের পিছনে বসারত রমণী আর কেউ না, এ বাড়ির নতুন ভাড়াটিয়া। কুদ্দুস মোল্লার মুখ তিন ইঞ্চি পরিমান হা হয়ে যায়। পকেটে হাত দিয়ে রুপের কাছ থেকে নেয়া টাকায় হাত বুলিয়ে নেয়।

—————

” আরেকটু সস দিবো কি মা?”

” না আন্টি! এতটুকু’ই হবে।”

সদর দরজা দিয়ে রুপ নাদিফ একসাথে প্রবেশ করেছে মাত্র। রুপের মন ভীষণভাবে খারাপ। আসার সময় বাতাসের কারণে রাইসার জন্য কিছু খাবার আনতে পারেনি। ভবনে প্রবেশ করতেই রুপের কর্ণধারে আসে আয়েশা আজাদের কন্ঠস্বর। আড়চোখে নাদিফের চলে যাওয়া দেখে আয়েশা আজাদের দিকে তাকায়। আয়েশা আজাদ রাইসা দ্যা খাদকের ভাণ্ডারকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে। কারোর আগমনের আভাস পেয়ে আয়েশা আজাদ তাকায়। রুপ নাদিফকে একসাথে দেখে বলে উঠে,

” তোমরা দুজন একসাথে যে এলে?”

নাদিফ উপরে চলে যাচ্ছিলো। মায়ের কথা শুনে যেতে যেতে প্রত্যুওরে বলে উঠে,

” এক অভাগী পথ হারিয়ে অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। দয়া হলো তাই সঠিক পথে নিয়ে এসেছি। এ নিয়ে আবার কোন ড্রামা শুরু করিও না মা!”

আয়েশা আজাদ মনে মনে বেজায় খুশি। ছেলে যে নিরামিষ থেকে আমিষে পরিণত হচ্ছে এটাই বেশি।

রাইসা খাচ্ছে তাও আবার আয়েশা আজাদের হাতের খাবার। রুপ ভ্রু কুঁচকে নিলো রাইসার কাজে। বিনা পয়সায় শুয়ে বসে খাওয়া রুপের একদম অপছন্দনীয়। কিন্তু রাআস্ এই কাজ করে সর্বদা। যেখানে খাবার পায় সেখানে’ই হামলে পড়ে। রুপ রাইসার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। রুপকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে আয়েশা আজাদ বলে উঠলেন,

” আহা আমার বউমা টা কত কষ্ট করে এসেছে!”

‘বউমা!’ স্টার জলসা সিরিয়ালের মত রাইসা রুপ একসাথে বলে উঠে। যাকে বলে চিৎকার করে। আয়েশা আজাদ থতমত খেয়ে যান। আজাদ সাহেবের সাথে থাকতে থাকতে আয়েশা আজাদের মুখ যেখানে সেখানে ফসকে যায়। আয়েশা আজাদ ডিব্বায় কামড় কেঁটে বলেন,

” আরে কি বলে কি বলে ফেলি! বলতে চেয়েছিলাম রুপ মা কত কষ্ট করে এসেছো। ফ্রেস হয়ে আসো নাস্তা দেই।”

রুপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। এদিকে রাইসা তো আয়েশা আজাদের কথা শুনে বসা থেকে উঠে গিয়েছিল। এখন আরামে বসে অসমাপ্ত খাবার সমাপ্ত করবে। রুপের ইচ্ছে করছে না নাস্তা করতে। আবার আয়েশা আজাদের মুখের উপর কিছু বলবে তার উপায় ও নেই।
” আন্টি নাস্তা করবো না। আমি ঠিক আছি। আঙ্কেল কোথায়?”

রুপের অমত করায় আয়েশা আজাদ কিছুটা আহত হলেন। রুপ যে তাঁদের আপন ভাবতে পারছে না এটা ভেবে কষ্ট পেলেন।

” উপরে’ই আছে। বই পড়ছে। কেন কিছু বলবে?”

আয়েশা আজাদের সরাসরি জিজ্ঞেস করায় রুপের অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে। রুপ ভাবছে, মুখের উপর নাবলে দেয়া কেমন দেখাবে। মনে অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে আয়েশা আজাদের উদ্দেশ্যে বলে,

” আমি আজ’ই চলে যাবো প্রেম নীড় ছেড়ে।”

চলবে…….