প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা পর্ব-০৭

0
586

#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|সপ্তম পর্ব |

ঝড় থেমে গিয়েছে অনেক অগেই। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির সাথে শিলা পড়ছে গগনে। টিনের চালের উপর শিলা প্রতিফলিত হওয়ার সাথে সাথে বিকট আওয়াজ হচ্ছে। প্রেম নীড়ে নিশ্চুপ পরিবেশ। বাহিরের শিলা বৃষ্টির আওয়াজ খুব ভালো ভাবে’ই কর্ণধারে আসছে সকলের। চৈত্র মাসের শেষে শিলা বৃষ্টির আগমন মোটেও ভালো না। আম গাছের ছোট আম ঝড়ে যাবে শিলা বৃষ্টিতে। নবান্ন উৎসবে মাঠে উঠানো আমন ধান নুয়ে যাবে সর্বক্ষণে। কৃষকদের আজ মন খারাপ শিলা বৃষ্টির অগমনে।

আজাদ সাহেব সোফায় মনমরা হয়ে বসে আছেন। আয়েশা আজাদ হতাশ দৃষ্টিতে প্রিয় স্বামীর মনমরা মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। আয়েশা আজাদের সেই চঞ্চল, দুরন্তপনা স্বামীকে’ই পছন্দ। মনমরা হয়ে বসে থাকা আজাদ সাহেবকে দেখে অন্তরে পীড়া দিচ্ছে।

” কি বলেছে মেয়েটা? থাকবে তো? আমার কিন্তু বেশ লেগেছে রুপকে।”

আয়েশা আজাদ স্বামীর পাশে বসে নরম স্বরে কথাগুলো বললেন। আজাদ সাহেব লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ কর স্ত্রীর কথার প্রত্যুওরে বললেন,

” মেয়েটা কোন কারণে ভয় পেয়েছে। আজ এই বৃষ্টি বাদলের দিন থেকে আগামীকাল চলে যাবে বলেছে।”

” তুমি না করোনি?”
“করেছি। লাভ হয়নি।”

সন্ধ্যার নাস্তা করতে নাদিফ নিচে নেমে আসে। মা-বাবার দুঃখিভরা মুখখানা দেখে এগিয়ে যায় সেখানে। মা-বাবার মাঝে বসে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। এদিকে আচমকা আদরের ছেলের আগমনে আয়েশা আজাদ চমকে উঠে। ছেলে যে মা-বাবার আদর পেতে চাচ্ছে তা বুঝতে পারে আয়েশা বেগম।

” আমার আব্বাটার কি হয়েছে হঠাৎ? কিছু কি লাগবে?”

আয়েশা আজাদ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন। নাদিফ বাবার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আঁকিবুঁকি করছে।

” নাদিফ! এভাবে আর কতদিন শুয়ে বসে কাটাবি? নাবিলের সাথে অফিসে জয়েন করে নে এবার? পড়াশোনা শেষ করেছিস দুই বছর তো হলো।”

নাদিফ নিশ্চুপ। মায়ের কোলে মাথা রেখে যেন অনেক শান্তি পাচ্ছে। আজাদ সাহেবের আদরের পুত্র নাদিফ। নাদিফের জন্মের সময় বাঁচা মরা নিয়ে সংশয় ছিলো সকলের মাঝে। আজাদ সাহেব তো ফুটফুটে ছেলেকে দেখে খুবই আনন্দিত ছিলেন কিন্তু পর মুহূর্তে ডাক্তার যখন বলল যে আজাদ সাহেবের ফুটফুটে ছেলে সন্তানের গাঢ় জন্ডিস হয়েছে যা শরীরের নব্বই পার্সেন্ট ছড়িয়ে গিয়েছে। নাদিফের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিলো মাত্র দশ পার্সেন্ট। আজাদ সাহেব পাগর প্রায় বাচ্চার অসুস্থের কথা শুনে। এই মসজিদ সেই মসজিদে দান, দোয়া করতে থাকেন অনবরত। দীর্ঘ দুইমাস আই সি ইউ তে থাকতে হয় নাদিফকে। অবশেষে আল্লাহর অসীম রহমতে নাদিফ সুস্থ হয়ে আসে। সেই সময় থেকে আজাদ সাহেবের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে নাদিফ। ছোট থেকে বড়ো হওয়া পর্যন্ত নাদিফের উপর ভুল ক্রমেও হাত তুলেনি আজাদ সাহেব। এই যে! এখন নাদিফ কোন কাজ কর্ম করে না, ঘোরাফেরা করে এতেও আজাদ সাহেবের কোন সমস্যা নেই। কিন্তু বাবা হয়ে যতটুকু বলার তা বলেছেন আজাদ সাহেব।

” মন খারাপ কেন তোমাদের?”

আজাদ সাহেব যেমন নাদিফকে ভালোবাসে তাঁর চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ নাদিফ বাবা-মাকে ভালোবাসে। বাবা-মায়ের মুখের হাসি যেন নাদিফের জন্য সব। এক নিমেষেই বাবা-মায়ের মন খারাপ বুঝে গিয়েছে।

” রুপ চলে যাবে বলছে। তাই মন খারাপ।”

আয়েশা আজাদের কথা শুনে নাদিফ মায়ের কোল থেকে উঠে বসলো। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ বিদ্যমান। নাদিফ ভাবছে, নাদিফের গতকালকের ব্যবহারের জন্য কি রুপ চলে যাবে! পরক্ষণে আবার ভাবছে, চলে গেলে যাক তাতে কার কি!
নাদিফ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আবারও মায়ের কোলে শুয়ে পড়লো। আজাদ সাহেব প্রথমে খব খুশি হয়েছিলো ছেলের প্রতিক্রিয়া দেখে কিন্তু পরমুহূর্তে নাদিফের শুয়ে পড়া দেখে হতাশ হলেন।

” চলে যেতে চাইছে চলে যাক। তাতে তোমাদের মন খারাপ কেন? আসলো’ই তো গতকাল। আজ চলে যাবে বললেই কি যেতে পারবে?”

” মেয়েটা কোন কারণে ভয় পেয়েছে।”

নাদিফ নিশ্চুপ। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছে। মা-বাবার মন খারাপ সহ্য হয় না নাদিফের।
আচমকা শোয়া থেকে উঠে বলে,

” মেয়েটা কোথায়?”
” নিজের ঘরে হয়তো।”

আজাদ সাহেব যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। আজাদ সাহেবের ছেলে রুপের সাথে কথা বলবে ভেবেই আনন্দ পাচ্ছেন।
নাদিফ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। উপরে চলে গেলো। এদিকে নাদিফ চলে যেতেই আজাদ সাহেব স্ত্রীকে দাঁড় করিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচা শুরু করলেন। আয়েশা আজাদ স্বামীর পাগলামিতে লাজুক হাসেন। আজাদ সাহেব গান গাইছেন আর নেচে যাচ্ছেন সহধর্মিণীর সাথে।

” আমি যে তোমার, শুধু যে তোমার!
আমি যে তোমার।”

—————-

প্রকৃতির নিয়ম কি অদ্ভুত। মন খারাপের সঙ্গ দিতে চলে এসেছে নিমেষেই। নিজ কামরায় মন টিকছে না রুপের তাইতো ছাদে চলে এসেছে এই রাতে বৃষ্টি বিলাস করতে। ছাদের কর্নিশে একটা চিলেকোঠার ঘর রেয়েছে। যেখানে বসার জন্য ছোট বড়ো চারটে চেয়ার পাতা আছে। রুপ ছাতা মাথায় দিয়ে এই ঘরে চলে আসে। রাইসা এই ঝড়েও কাজে চলে গিয়েছে। রাইসা যেই শপে কাজ করে সেটার মালিক একজন মহিলা। তাই রাতে ওভারটাইম করাতেও কোন চিন্তা নাই। রাইসা চলে যেতেই রুপ যেন আজ ভীষণ একা হয়ে গিয়েছে। তাইতো ছাদে চলে আসা। একা একা বৃষ্টি বিলাস করবে।
ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি ঝড়ছে। বাতাস বইছে প্রবলভাবে। চিলেকোঠার ঘরের পূর্বপাশে জানালা বিদ্যমান। সেখান দিয়ে বৃষ্টির পানি ঝিরঝির করে ঘরে প্রবেশ করছে। রুপ চোখ বন্ধ করে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো।
ঝিরঝির বৃষ্টির ফোঁটা রুপের মুখশ্রীতে। ভিজে যাচ্ছে রুপের সারা মুখশ্রী। চোখ বন্ধ করা অবস্থায় বৃষ্টির ছোঁয়া উপভোগ করে যাচ্ছে রুপ। এ যেন আলাদা প্রশান্তি। রুপ যেন ছেলে বলায় চলে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজে এতিমখানার বড়ো আম গাছ থেকে লুকিয়ে আম কুড়িয়ে ওড়না ভরতি নিয়ে আসতো রুমে। চুপি চুপি কেউ যেন না দেখে তাঁর আগেই চার পাঁচজন মিলে সেই আম কেঁ’টে লবন মরিচ মিশিয়ে খেতো। কখনো তো গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুমঝুম বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে ময়ূর পঙ্খীর মতো নেচে বেড়াতো রুপ।
রুপ হাসছে। মন খুলে হাসছে। কতদিন পর হাসছে জানা নেই। বৃষ্টিতে রুপের গলায় পেঁচানো ওড়না অনেকটাই ভিজে গিয়েছে। রুপের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আপনমনে ভিজতে ব্যস্ত রুপ।

হাতে কারোর স্পর্শ পেয়ে রুপের স্তম্ভিত ফিরে আসে। অন্যমনস্ক রুপ আচমকা হাত টান লাগায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে কারোর সুঠাম বক্ষঃস্থলে। শরীর কাঁপছে শীতে, অন্তর কাঁপছে ভয়ে। পিনপতন নীরবতায় শুধুমাত্র বাহিরের ঝুমঝুম বৃষ্টির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

” সারা রাত এভাবে পর পুরুষের সাথে ল্যাপ্টে থাকবে কি? তোমার প্রেমিক কিছু মনে করবে না!”

ভয়ে, লজ্জায় রুপ কাঁপছে। কানে কারোর ফিসফিস কথা শুনে শরীর শীতল হয়ে এসেছে। লজ্জায় ইচ্ছে করছে ম’রে যেতে।
এদিকে নাদিফের অবস্থা করুণ। রপের কামরায় রুপকে না পেয়ে ছাদে চলে আসে নাদিফ। প্রবল বাতাসে একটি কালো ছাতা ছাদের একপাশে উড়ে চলে গিয়েছে। নাদিফ বুঝতে পারে ছাতাটা রুপের। আর রুপ বর্তমানে চিলেকোঠার ঘরে রয়েছে। নাদিফ সঙ্গে ছাতা আনে নি। বৃষ্টির মধ্যেই এক প্রকার দৌঁড়ে চিলেকোঠার ঘরে প্রবেশ করে। অন্যমনস্ক হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া কেশব ঝাড়তে ঝাড়তে চোখ যায় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টিকন্যার দিকে। নাদিফের পৃথিবী যেন সেখানেই থমকে যায়।
নাদিফ যেন ভুল করেনি সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টিকন্যার নাম অপরুপ রেখে। ঝিরঝির বৃষ্টির ফোঁটাতে মুখে বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে। লতার মত লম্বা মাথার কেশব ভিজে গলার সাথে ল্যাপ্টে আছে। গলায় প্যাঁচানো ওড়না ভিজে শরীরের সাথে মিশে আছে। নাদিফ অনুভব করছে নাদিফের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের সামনে অপরুপকে দেখে ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছে। নাদিফ এই প্রথম কোন মেয়েকে এত কাছ থেকে দেখছে। মনের মধ্যে কেমন অস্থিরতা কাজ করছে নাদিফের। নাদিফ ভাবছে, “এভাবে আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না। মেয়েটাকে থামাতে হবে যে! কালবৈশাখী ঝড়ের উদ্রব যে মেয়েটা। যার রুপে গায়েল হয়ে দূর্বল হয়ে যাবে নাদিফ।”

মুখশ্রীতে কাঠিন্যতা ভাব এনে রুপের হাত টেনে ধরে। নাদিফের এই কাজ না করা উচিত ছিলো। নাহলে এখন আবারও অনর্থক কিছু ঘটতে পারতো না।

রুপ সুঠাম দেহের অধিকারী পুরুষের বক্ষঃস্থল থেকে সরে আসে। নিজেকে ঠিকঠাক করে অপর দিকে ফিরে তাকায়। ভেজা অবস্থায় কোন পুরুষের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব যে। নাদিফ নিজেকে স্বাভাবিক করে রুপের উদ্দেশ্যে বলে,

” কেন চলে যাবে?”

রুপ এতক্ষণ যেন অন্য জগতে ছিলো। নাদিফের কথায় মনে পড়ে যায় নাদিফের করা বিকেলের ব্যবহারের কথা।

” আপনার জন্য।”

রুপের উওরে নাদিফের ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে। নাদিফের জানা মতে নাদিফ এই মেয়ের সাথে স্ব-জ্ঞানে খারাপ কিছু করেনি। বিকেলে এই মেয়েকে সাহায্য করেছে মাত্র। নাদিফের এবার রাগ হলো, চরম রাগ। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখতে ঘন্টা খানেক।

” আমি কি তোমাকে ছুঁয়ে দিয়েছি? নাকি বাজে ভাবে তাকিয়েছি?”

” বাজে বকেছেন আমাকে।”

নাদিফের রাগ যেন পানি হয়ে আসলো রুপের কথা শুনে। শত চেষ্টাকরেও মনে করতে পারছে না যে কখন বকেছে।

” কখন বকেছি?”

” বলবো না।”

নাদিফের এখন হাসি পাচ্ছে রুপের কথায়। রুপের কন্ঠস্বরে বেজায় অভিমানের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এই অভিমান কিসের তা অজানা নাদিফের।

” যেয়ো না তুমি। বাবা মা কষ্ট পাচ্ছে। আমি আর তোমার সম্মুখে আসবো না। তুমি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই চলাফেরা করতে পারবে।”

কিছু সময় পিনপতন নীরবতা। রুপ ভেবেছে রাগী লোকটা চলে গিয়েছে। কিন্তু রুপের ধারণা ভুল। রাগী লোকটা যে বৃষ্টি বিলাশ করছে রুপের মত জানালার ধারে ঘেঁসে। চোখ বন্ধ অবস্থায় লোকটার সৌন্দর্য দ্বিগুন লাগছে। রুপ একাকী মনে অসায়, নিচে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নেয়। তখনই নাদিফের কন্ঠস্বর ভেসে আসে রুপের কর্ণধারে,

” ভুলেও আমার সামনে এসো না অপরুপ! ফের সামনে আসলে, প্রেমের জেলে বন্দি করে রাখবো।”

চলবে………