প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা পর্ব-০৮

0
578

#প্রেমনগরে প্রশান্তির ভেলা
#আফসানা_মিমি
|অষ্টম পর্ব |

গভীর রজনী। ব্যাস্তময় শহর যেন নিশ্চুপ। অদূরে গলির কুকুরের ঘেউঘেউ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রুপ শীতে কাঁপছে। অন্তরের গহীনে তীব্র অনুভূতি জন্মাচ্ছে রাগী লোকটাকে নিয়ে। রুপ তো এমন চাচ্ছে না। রুপ রাগী লোকটার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকবে। রাগী লোকটা তো বলেছে’ই রুপকে নিজের মতো চলতে। তাহলে সমস্যা কোথায়! রুপের কামরার সকল আসবাবপত্র আজাদ সাহেবদের। রুপ তো শুধু কাপড় বোঝাই ব্যাগ বহন করে নিয়ে এসেছে মাত্র।
আলমারি থেকে মোটা কম্বল বের করে শুয়ে পড়লো আরামদায়ক বিছানায়।
রুপ ভাবছে রাগী লোকটার কথা। কি সাঙ্ঘাতিক লোকটা। রুপের তো কোন দোষ ছিলো না! সে তো আপনমনে বৃষ্টি বিলাস করছিলো তাহলে কেন লোকটার এতো জ্বলে? রুপ একটা কথা ভেবে খুব খুশি। লোকটা আর সামনে আসবে না। এই রাগী লোকটা সামনে আসলে’ই উল্টা পাল্টা কাণ্ড ঘটে যায়। রুপের সারারাত পাড় হয়ে যায় রাগী লোকটার কথা ভেবে।

এদিকে নাদিফ বারান্দায় বসে পর পর নিকোটিনের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে যাচ্ছে। কিছু চিন্তা, কিছু ভয়, কিছু আবেগ, কিছু সংশয় নিয়ে সময় পাড় করছে।
নাদিফের অন্তরে যে অপরুপ গেঁথে গিয়েছে খুব গভীরভাবে তা বুঝছে পারছে নাদিফ। কিন্তু নাদিফ যে তাঁর অপরুপকে নিষেধ করে এসেছে নাদিফের সামনে না আসতে। নাদিফ কি পারবে! অপরুপ কে না দেখে থাকতে! নাদিফ মনে মনে ভাবছে,” অপরুপকে না দেখে থাকতেই হবে। নয়তো মেয়েটা যে চলে যাবে প্রেম নীড় ছেড়ে।”
আলগোছে নাদিফ বিছানায় শুয়ে পড়ে। অন্তরে খুব পীড়া হচ্ছে। জীবনের প্রথম নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়ে সব এলোমেলো লাগছে নাদিফের।
———

আজ সূর্য্যিমামা যেন খুব জলদিই পৃথিবীতে নিজের আলোর কিরণ দিচ্ছে। রুপের ঘুম ভাঙে সকাল সাতটায়। অভ্যাস মোতাবেক রুপ ঘুম ঘুম চোখে পাশে রাইসাকে ডেকে তুলতে উদ্যোগ নিলো কিন্তু পর মুহূর্তে মনে হলো রাইসা তো শপে, ফিরবে নয়টায়। ফ্রেস হয়ে একদম তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসলো। আট টায় পড়াতে যেতে হবে।

ফাহিমা আজ বেজায় খুশি। শ্বশুর সকল সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। মনের মধ্যে আর কোন সংশয় নেই। ফাহিমা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে ছোট ভাই সমেত দেবরের জন্য রুপের মত লক্ষি মেয়েকে পছন্দ করেছে তাঁর শ্বশুর। ফাহিমা আজ আলুর পরোটা বানাচ্ছে। নাদিফ, নাবিলের খুব পছন্দ আলুর পরোটা। আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেব বাগানে ব্যায়াম করতে ব্যস্ত। রুপকে তৈরি হয়ে নিচে নামতে দেখে ফাহিমা খুব খুশি হয়।

” এতো সকালে তৈরি হয়ে কোথায় যাচ্ছো রুপ?”

ফাহিমার কথায় রুপ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রুপ যে টাকা বাঁচাতে এত সকালে বের হয়েছে। রিক্সা দিয়ে দশ মিনিটের রাস্তায় হেঁটে যেতে যে এক ঘন্টার বেশি সময় লাগবে।

” প্রাইভেট পড়াতে যাচ্ছি।”
ফাহিমা অবাক। বিস্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুপের দিকে।

” তোমার প্রাইভেট তো আটটায়। এতো সকালে কি হেঁটে গিয়ে আটটা বাজাবে?”
রুপ কিছু বলছে না। কিছুক্ষণ মৌনতা পালন করে ফাহিমার উদ্দেশ্যে বলল,

” আঙ্কেল আন্টি কোথায়?
ফাহিমা চায়ের কাপে চা ঢালছিলো। রুপের কথার প্রত্যুওরে বলল,

” বাগানে আছে। তুমি একটা কাজ করো তো! মা-বাবাকে চা দিয়ে আসো।”

রুপ হাসি মুখে চায়ের ট্রে নিয়ে বাগানে চলে গেলো।
——-
” তুমি মোর জীবনের ভাবনা,
হৃদয়ের সুখের দোলা!
নিজেকে আমি ভুলতে পারি,
তোমাকে যাবে না ভোলা!”

প্রেম নীড়ে প্রেম হবে না তা তো হবে না। বাগানে আজাদ সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী এসেছিলেন ব্যায়াম করতে কিন্তু আবহাওয়া গরম দেখে বাগানে চেয়ার পেতে মনের সুখে গান গাইছেন আজাদ সাহেব।

” বুঝলে ললিতা! আমার ছোট ছেলেকে ট্রেনিং দেয়া উচিত প্রেম সম্পর্কে। দেখলে না! কেমন মেয়েদের সহ্য করতে পারে না। আমি যদি তোমার ছেলের জায়গায় থাকতাম তাহলে একশত টা প্রেম করে বেড়াতাম। অবশ্য এখন আমাকে দেখে যে কোন মেয়ে পাগল হয়ে যাবে।”

আয়েশা আজাদ রেগে একাকার। স্বামীর মুখে শুধু প্রেম প্রেম বার্তা। এখন তো সীমা অতিক্রম করে ছেড়েছে। এই বয়সে বলে কি না মেয়েরা পাগল হবে!
আয়েশা আজাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

” দুইদিন হয় পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা করি না। ভাবছি আজ রান্না করবো।”

আজাদ সাহেব নাক কুঁচকালেন। এই পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা আজাদ সাহেবের জন্মের শত্রু। তাই প্রিয়তমা স্ত্রী সুযোগে সৎ ব্যবহার করে সর্বদা।

স্বামী স্ত্রীর কথার মাঝে রুপে আগমন ঘটে। আয়েশা আজাদ পূর্বের ন্যায় কল্পনা করছেন যে,” রুপ শাড়ি পরিধান করে হাতে মোটা বালাজোড়া পরে আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেবকে চা নাস্তা দিচ্ছে। চা পান করে খুশি হয়ে আয়েশা আজাদ নিজের গলার মোটা চেইন খানা রুপকে উপহার স্বরূপ প্রদান করছে।”

আয়েশা আজাদের সপ্নের মধ্যে ব্যাঘাত ঘটে রুপের কথার আওয়াজে। চায়ের ট্রেতে তিনটে পেয়ালা। দুইটাতে চা আরেকটাতে কফি বিদ্যমান।

আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেব হাসিমুখে চা হাতে নিলেন। পর পর চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন,

” মাশাআল্লাহ বউমা! চা টা ভীষণ স্বাদের হয়েছে। এভাবে প্রতিদিন আমার ছেলের বউয়ের হাতের চা পেলে দিনটা’ই সুন্দর যাবে।”

রুপের চোখ আজও কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম। বউমা কাকে বলছে আজাদ সাহেব?

” আমি রুপ আঙ্কেল! আপনার বউমা রান্না করছে।”

আয়েশা আজাদ স্বামীকে চিমটি কাঁটেন। রুপকে চা হাতে দেখে অনেকটা ইমোশনাল হয়ে পড়েন তিনি তাইতো মুখ ফসকে সবসময়ের মতো সত্য কথা বলে ফেলেছেন। আজাদ সাহেব জিহ্বা কাঁটেন। রুপের দিকে করুণ স্বরে তাকিয়ে বলেন,

” আজও চশমা আনতে ভুলে গিয়েছি মা! আমি ভেবেছি আমার ছেলের বউ এসেছে।”

রুপ এবার হেসে দিলো আজাদ সাহেবের কথা শুনে। আজাদ সাহেবের কাছে গিয়ে মাথায় সেট করে রাখা চশমা চোখে লাগিয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলল,

” চশমা আনতে আজ ভুলেন নি আঙ্কেল! বরঞ্চ সঠিক জায়গায় বসাতে ভুলে গিয়েছেন।”

রুপের কথা শুনে তিন জন একসাথে হেসে উঠলো। আয়েশা আজাদের নিকট মনে হচ্ছে রুপ’ই সঠিক পাত্রী নাদিফের জন্য এবং প্রেম নীড়ের জন্য।
রুপ হাসিমুখে আজাদ সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর পাশে বসে পড়লো। আজ প্রাইভেটে যাবে না রুপ। বাবা-মা সমেত আঙ্কেল আন্টির সাথে জমিয়ে আড্ডা দিবে।

” একটা প্রশ্ন ছিলো আঙ্কেল?”

আজাদ সাহেব রুপকে নিয়ে চিন্তা করছিলো। রুপের কথায় স্তম্ভিত ফিরে আসে। হাসিমুখে বলে,

” কি প্রশ্ন?”

“আপনাদের ছোট ছেলে কোথায়? তাকে দেখছি না যে?”

আজাদ সাহেব আর আয়েশা আজাদ একজন অপরজনের দিকে তাকাচ্ছেন। দু’জনের মনে’ই লাড্ডু ফুটেছে। ঐ যে ইন্ডিয়ান বিজ্ঞাপনে বলে না! ‘দিল ম্যা লাড্ডু ফুটা!’ ঠিক তেমন। রুপ যে ইচ্ছে করে নাদিফের কথা জিজ্ঞেস করছে! আজাদ সাহেব ভাবছে,’ রুপের হয়তো নাদিফকে মনে ধরেছে।’ অপরদিকে আয়েশা আজাদ ভাবছে,’ আমার ছেলের বউ হতে রাজি!’
কিন্তু দুজনের এক জনও জানে না যে রুপ কোন ছোট ছেলের কথা বলছে। দেখা যাক কি হয়!

আয়েশা আজাদ এবার হাসিমুখে ছেলের গুনগান শুরু করলেন,

” আর বলিও না মা! আমার ছোট ছেলেটা যা পরিশ্রমী! সারারাত ল্যাপটপে মোবাইলে কাজ করে সকাল পর্যন্ত ঘুমায়। এই যে দেখো এখনও ঘুমাচ্ছে।”

আয়েশা আজাদেরকথা শেষ হতে’ই আজাদ সাহেব এবার ছেলের গুনগান শুরু করেন,

” দুই বছর হয়েছে পড়াশোনা শেষ করেছে আমার ছেলেটা। সে তো চায় বড়ো ভাইয়ের সাথে অফিসে জয়েন হতে। কিন্তু আমি বলি কি! আগে বাসায় বসে কাজ শিখে নে তারপর জয়েন হবি।”

আয়েশা আজাদ এবং আজাদ সাহেবের কথা শুনে রুপ মাথায় হাত দিয়ে রেখেছে। এই দুই বাবা-মা এতো ড্রামাবাজ যা বলার মতো না।

” আমি আপনাদের দামড়া মেজো ছেলের কথা জিজ্ঞেস করছি না। জিজ্ঞেস করছি আপনাদের ছোট ছেলে প্রেমের কথা! যার নাম অনুসারে ‘প্রেম নীড়’নাম রেখেছেন। ঐ যে আঙ্কেল আমাকে প্রথম দিন বলেছিলেন।”

আজাদ সাহেব এবার শুকনো ঢুক গিললেন। আড়চোখে প্রিয়তমা স্ত্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। আয়েশা আজাদ খুবই বিরক্ত স্বামীর এই মিথ্যা বলাতে। এখন কি উওর দিবে মেয়েটাকে! আজাদ সাহেব এবার ফট করে বলে উঠলেন,

” প্রেম তো আমার নাদিফের নাম মা! গোপন নাম। এই নামে আমি আর তুমি ডাকবো, আচ্ছা!”

————–

মধ্যাহ্নের সময় ক্লান্তির সময়। এই অসময়ে ক্লান্তিরা দলে দলে দল পাকিয়ে আসে। এই অসময়ে ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য খুব’ই খারাপের। রুপ রাইসার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সম্মুখে দৃষ্টিপাত করলো। রুপের সামনে শক্ত কাঠের দরজা বিদ্যমান। রুপের দৃষ্টি বর্তমানে ভীত। কাঠের দরজার জন্য নয়। বরঞ্চ কাঠের দরজার ঐপাড়ের রাগী লোকটার জন্য। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন সকলে। রুপ বর্তমানে নাদিফের কামরার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে গরম ধোঁয়া উড়ানো কফি। আয়েশা আজাদ রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলো বিধায় জোর করে রুপকে দিয়ে কফি পাঠিয়েছে। আয়েশা আজাদের কথায় হু হা মিলিয়েছে রাইসা। এজন্যই রুপ রাইসার উপর ক্ষিপ্ত। রুপ মনে মনে রাইসাকে চরম অভিশাপ দিলো, ” দোয়া করে দিলাম যেন তোর জামাই বউ পাগলা হয়। দিনে রাতে চব্বিশ ঘন্টা যেন তোকে জ্বালিয়ে মা’রে বজ্জাত মাইয়া।”

রাইসা হয়তো রুপের মনের কথা বুঝে গিয়েছে তাই তো দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

পরপর দুই তিনবার দরজায় কড়াঘাত করায় অপর পাশ থেকে চোখ বন্ধ অবস্থায় নাদিফ দরজা খুলে দেয়। দরজার অপরপাশে দণ্ডায়মান ব্যক্তিকে না দেখে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়ে। এদিকে রুপ পড়েছে মহা বিপদে। রুপ ভেবেছিলো লোকটা দরজা খুললে কফি লোকটার হাতে দিয়ে চলে আসবে সে কিন্তু তা আর হলো কই। রুপ ভয়ে গুটি গুটি পা ফেলে কামরায় প্রবেশ করে। পুরো কামরায় চোখ বুলিয়ে রুপের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ চলে আসে। রুপ ভাবছে,’ এটা কি মানুষের ঘর! নাকি গোয়াল ঘর?’ উওরটা রুপের অজানা। কেননা আমাদের অগোছালো নাদিফের ঘর তাঁর মতোই অগোছালো।
কফির কাপ টেবিলের উপর থেকে চলে আসতেই নাদিফের আদুরে কন্ঠস্বর রুপের কর্ণধারে ভেসে আসে,

” মাথাটা খুব যন্ত্রণা করছে, একটু হাত বুলিয়ে দিবে?”

চলবে…….