প্রেমনদীর মাঝি পর্ব-০৯

0
309

#প্রেমনদীর_মাঝি
#পর্ব_৯
#মুসফিরাত_জান্নাত

রাত প্রায় আটটা ত্রিশ বাজে৷আমি এক হাত গালে দিয়ে টেবিলে ভর করে চেয়ারে বসে আছি৷ সামনে বই আর কতগুলো শিটের ছড়াছড়ি।এদের মাঝেই চলছে কলমের খোচাখুচি খেলা।বিছানার উপর নিভৃত ভাই বসে বসে ফোনে কি যেন করছেন। আমি একবার আড়চোখে ওনাকে দেখছি আর কত কি ভাবছি।তার মাঝে কোচিং থেকে ফেরার পথে বৃষ্টির সময়টা স্থান পাচ্ছে।উনি হুট করে কোথায় থেকে উদয় হয়ে এসে আমাকে সঙ্গ দিলেন আমাকে ভেজা থেকে রক্ষা করতে।কিন্তু আদৌ কি তিনি সফল হয়েছিলেন?বৃষ্টি ফোঁটার আমার শরীর ভিজিয়ে দেওয়া থেকে হয়তো রক্ষা করেছিলেন ঠিকই।কিন্তু তখন আমার মন যেভাবে ভিজে গিয়েছিলো, তা কি আদৌ রক্ষা করতে পেরেছেন?পারেন নি।বরং আমার কাটখোট্টা প্রেমের পরশ বিহীন শুকনো হৃদয়কে ভিজিয়ে দিয়েছিলেন।কাল রাতের বেলায় রহিম চাচা ও চাচির প্রেম দেখে মনের কোনে যে আফসোস জমেছিলো তা আর ফিরতি পথে হুট করেই সেই অদৃশ্য পানিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন।উনি বলেছিলেন বৃষ্টির মাঝে ছাউনি হতে এসেছেন।এই কথাটাই যেনো সব দ্বিধার দেয়াল ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলো।আমি বুঝে গিয়েছিলাম উনি শুধু বৃষ্টির দিনেই নয় খাঁ খাঁ রোদ্দুরেও আমার ছাউনি হবেন।আমার বিপদ আপদ সকল সময়ে ঢাল হয়ে থাকবেন।ওনার গম্ভীর ব্যক্তিত্বের আড়ালের গভীর চোখ দু’টো যেনো সেই আভাসই দিচ্ছিলো আমাকে।আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম তখন।এখনও দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।কিন্তু উনি তো ফোনে দৃষ্টি রেখেছেন।ওই দৃষ্টি দেখবো কিভাবে?
তবে কি আমার ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে যাবে?নেভার।এটা আমি কখনো হতে দিবো না।তাহলে কি করা যায়?অনেক ভেবেচিন্তে ওনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বললাম,

“আচ্ছা একটা কথা যদি জিজ্ঞেস করি সত্যি উত্তর দিবেন?”

আমি ভেবেছিলাম আমার প্রশ্নে দৃষ্টি সড়াবেন উনি।কিন্তু নাহ ওভাবেই ফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললেন,

“প্রশ্নটা না করলে বুঝবো কি করে সত্যি উত্তর দিবো নাকি মিথ্যা উত্তর দিবো!”

ওনার ত্যাড়াবাকা কথায় কিঞ্চিৎ রাগ হলো আমার।ওনাকে তাকানোর জন্য প্রশ্ন করেছি উনি তো তাকাচ্ছেনই না, তা বাদ দিয়ে ত্যাড়ামো করছেন।কেনো রে ব্যাটা! আমি কি নর্দমার কীট নাকি? যে আমার দিকে তাকানো যায় না।খাটাশ কোথাকার!হুহ।মনে মনে শ খানেক গালি দিলাম আমি।তারপর মনের ভিতর ঘুর ঘুর করা প্রশ্নটা করলাম,

“আচ্ছা, আপনি কি সত্যি খালামনির ইচ্ছায় আমাকে বিয়ে করেছেন নাকি পেছনে অন্য কাহিনি ছিলো?”

আমার এহেন প্রশ্নে দৃষ্টি তুলে তাকালেন আমার দিকে।তারপর কণ্ঠ গম্ভীর করে বললেন,

“পড়ার সময়ই কি যত উদ্ভট প্রশ্ন ঘুরঘুর করে তোমার মাথায়?”

ওনার উত্তর শুনে আমার কেনো যেনো মনে হলো উনি কিছু লুকাতে চাইছেন।আমি সুক্ষ্ম চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে লুকানো অভিব্যক্তিটা বোঝার চেষ্টা করলাম।ওনাকে বেঝার এই প্রসেস ফুলফিল হওয়ার আগেই নিভৃত ভাই প্রসেসে ফুল স্টোপ লাগিয়ে দিয়ে বলেন,

“পড়াটা কি আমার মুখে লেখা আছে নাকি?”

কথাটা শুনে আমি নিভৃত ভাইয়ের দিকে কটমট করে তাকাই।আমার প্রসেসটা ভেস্তে দিলো কেনো?দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

“আমি বলেছি আপনার চেহারায় পড়া লেখা আছে?”

উনি আমার দিকে তাকিয়ে জবাবে বললেন,

“তাহলে এইভাবে উল্লুকের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?বইয়ে মনোযোগ দেও। পড়া শুরু করো।”

শেষের কথাটা তিনি আদেশের সুরেই বলেন। আমি ওনার কথা শুনে ব্যঙ্গ করে বলি,

“পাইছেনই তো ওই একটা কথা।পড়া শুরু করো।আমাকে বিরক্ত করো না।ব্লা ব্লা ব্লা… আরেহ ভাই আমার একটা কথার উত্তর দিলে কি আপনার জিভ ক্ষয়ে যাবে নাকি?”

তিনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলেন,

“আমি তোমার ভাই লাগি?”

আমি একটু ভেবে বলি,

“হ্যাঁ লাগেন এই তো।খালাতো ভাই!”

কথাটা শুনে ওনার ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে আসে৷ তিনি একটু গম্ভীর গলায় বলেন,

“তিন কবুলে বিয়ে করেছো।এখনো খালাতো ভাই?”

আমি আমতা আমতা করে বলি,

“হ্যাঁ খালাতো ভাই।সবাই পুরাতনকে অবজ্ঞা করে নতুনের উন্মাদনায়।তাই বলে পুরাতন সম্পর্ক কি মুছে যায় নাকি?আমি পুরাতনকে ভালোবাসতে পছন্দ করি।”

“কিন্তু একপাক্ষিক কোনো পুরাতন সম্পর্কও টেকে না।আমি তোমাকে বোন মানি না।আর কখনো ভাই বলবে না আমাকে।”

থমথমে কণ্ঠে আদেশ দিলেন উনি।আমিও সুযোগ লুফে নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

“তাহলে কি মানেন আমাকে?বউ?”

আমার কথার কোনো জবাব দিলেন না উনি।বরং ফোনে দিকে মনোযোগ আরও বৃদ্ধি করলেন।আমার এবার রাগ হলো ওনার উপর।সারাদিন বই, ফোন আর ল্যাপটপ ছাড়া অন্য কিছু বোঝেন না।আমার তো মাঝে মাঝে এই তিনটাকে সতীন মনে হয়।বই এর ব তে বড় সতীন,মোবাইলের ম তে ছোট সতীন, আর ল্যাপটপের এল ফোর লিটল সতীন মানে ছোট সতীন।এই তিন সতীনের সাথে সংসার করে জীবন শেষ আমার।উনি যেনো পাত্তাই দেন না আমাকে।কিন্তু আমিও বা কম কিসে?আমাকে পাত্তা না দিলে তাকে শান্তি দিবো নাকি?ওই সতীনপর ঘাড় যদি আজ না ম’টকেছি তো আমিও পুষ্প নয়।হন্তদন্ত করে ওনার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।তারপর এক ঝটকায় ওনার ফোন কেড়ে নিয়ে বললাম।

“আমার কথার জবাব কই?কেনো বিয়ে করেছেন আমাকে?আর এতো কেয়ারই বা করেন কেনো?”

আমার এই এহেন কান্ডে তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। তিনি আমার দিকে গোলগোল চোখে তাকান। অতঃপর এক ঝাটকায় আমার হাত টান দিয়ে আমায় একদম তার কাছে নিয়ে যান। অতঃপর শীতল কন্ঠে বলেন,

“তোমার সাহস কিভাবে হয় আমার ফোন কেড়ে নেয়ার?আর আমি তোমাকে কেয়ার করি এটা ভাবলে কি করে?”

প্রথমে তার এত কাছে চলে আসায় আমি ভড়কে যাই। তার থেকে সরে আসার চেষ্টা করি কিন্তু পরক্ষণেই তার কথা শুনে আমি সরু চোখে তাকাই।সন্দিহান কণ্ঠে বলি,

“তাহলে তখন আমাকে বৃষ্টি ভেজা থেকে রক্ষার্থে ছাতা নিয়ে এগিয়ে গেলেন কেনো?আমাকে এভাবে জোর করে পড়াচ্ছেনই বা কেনো?এসবকে কেয়ার করা বলে না!”

আমার কথা শুনে ওনার ঠোঁটের এক কোণে সুরু এক হাসির রেখা ফুটে উঠে৷ তিনি আমার মুখের দিকে একটু ঝুঁকে বলেন,

“এসবকে কেয়ার করা বলে নাকি?”

তিনি আমার এত কাছে চলে আসায় আমি ভড়কে যাই। মুহূর্তেই আমার বুক ধকধক শুরু করে।দম বন্ধ হয়ে আসে যেন।চোখ দুইটি চঞ্চল হয়ে এদিক ওদিক ঘুরপাক খায়। ঠোঁট ও গলা শুকিয়ে আসে খানিকটা। আমি কোন মতে জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁট যুগল ভিজিয়ে নিয়ে আমতা আমতা করে বলি,

“হুম বলে।”

কথাটা বলেই আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। চোখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম তার নয়ন দু’টিতে গভীর মাধুর্যতা লেপ্টে আছে।ঠিক এই চোখই তো দেখতে চেয়েছিলাম আমি।ওই দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। কিছু তো একটা আছে এই দৃষ্টির মাঝে। যা আমাকে গভীর ভাবে এক ঘোরের মাঝে নিয়ে যাচ্ছে।আমার তার প্রতি এমন চাহনি দেখে উনার ভ্রু কুটি কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে আসে। উনি আমার নাক টেনে দিতেই আমি ঘোর থেকে বেরিয়ে আসি আর আমি তার থেকে ছিটকে দূরে এসে পড়ি।উনি নিজের ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজব কাজের দিকে মন দিয়ে বলেন,

“এসব কিছু আমি দ্বায়িত্বের খাতিরে করছি।আফটার অল ইউ আর মাই রেসপন্সিবিলিটি।এর বাইরে কিছু না।”

কথাটা শুনে রাগ হলেও আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ টেবিলে গিয়ে চেয়ারে বসে একটা বই নিয়ে পড়া শুরু করলাম।

_____________________

পরদিন সকালে আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছি এমন সময় উনি তাড়া দিয়ে বলেন,

“তুমি কোচিং করতে যাচ্ছো নাকি কোনো বিয়ের পার্টিতে যাচ্ছো বলো?”

আমি আয়নার মধ্য দিয়েই ওনার দিকে তাকিয়ে বলি,

“মানে?”

“কতক্ষন হলো রেডি হচ্ছো সে খেয়াল আছে?এতক্ষনে তো আমার ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে আসাও হয়ে যাবে।একটু পর যে ক্লাস শুরু হবে তা মাথায় আছে?”

আমি মুখ ফুলিয়ে বলি,

“মেয়েদের একটু সময় লাগেই।”

কথাটা বলে মিনিট কয়েকের মাঝেই বই পত্র গুছিয়ে একবারে পরিপাটি হয়ে যাই।উনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে বের হয়ে যান। আমিও তার পিছু পিছু বেরিয়ে আসি।খালামনিকে বলে রওনা দিয়ে দেই।

পার্কিং এরিয়াতে এসে দাঁড়াতেই দেখি উনি একটি কালো রঙা মার্সিডিজ নিয়ে আমার সামনে হাজির হন৷গাড়ি দেখে আমি তার দিকে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাই। অস্ফুটস্বরে বলে উঠি,

“এইটা কোথা থেকে আমদানি হলো?”

উনি গাড়ির এপাশের দরজা খুলতে খুলতে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বলেন,

“ঢাকা মেডিকেল থেকে রেজিস্টার্ড ডাক্তার হিসেবে সবার মধ্যে টপ করায় আব্বু গিফট করেছিলো।তখনই আমদানি হয়েছে।”

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,

“তাহলে এতোদিন দেখলাম না যে!”

“একটু ঝামেলা হয়েছিলো তাই সার্ভিসিং করতে দিয়েছিলাম।”

কথাটা বলে উনি নিজের সিটে গিয়ে বসলেন।আমিও ওনার পাশে নিজের জায়গা দখল করলাম।উনি গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়েই কি মনে করে থেমে গেলেন।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“গাড়ির সিটবেল্ট বাঁধো নি কেনো?হটাৎ ব্রেক কষলে যে চোট পাবে সে খেয়াল আছে?”

ওনার কথা শুনে নিজের দিকে দৃষ্টি দিলাম আমি।গাড়িতে চড়তে অভ্যস্ত নই তাই এমনিতেই অস্বস্তি হচ্ছিল।তারউপর ওনার এমন কথায় লজ্জিত বোধ করলাম।আমি যে সিট বেল্ট বাঁধতে জানি না। উনি আমার দিকে কিছু সময় সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।আমিও ওভাবেই বসে রইলাম।একটু পর উনি ঝুঁকে আসলাম আমার দিকে।আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।উনি আমার সিটবেল্ট বেঁধে দিয়ে বললেন,

“নিজের সমস্যার কথা মুখ ফুটে বলতে হয়।আমার মাঝে কোনো সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার নেই যে তোমার মুখ দেখেই সব বুঝে যাবো।”

কথাটা বলে গাড়ি স্টার্ট দিলপন উনি।আর আমি ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।কে বলে ওনার মাঝে সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার নেই?এই যে এখনো তো মুখ ফুটে বলিনি তবে বুঝলেন কি করে?

চলবে