প্রেমময় বিষ পর্ব-০৪

0
271

প্রেমময়_বিষ
#মাহিমা_রেহমান
#পর্ব_৪

____

এখন প্রায় গভীর রাত।কিন্তু আমি না ঘুমিয়ে কেঁদেই চলছি সেই কখন থেকে।

“তখন আদিব ভাইয়া আমাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রুমে পাঠিয়ে দেয় ঘুমানোর জন্য।বাকিরাও যে যার রুমে চলে যায়”

কিন্তু আমি আর ঘুমাচ্ছি কই? সেই তখন থেকে কেঁদেই চলছি।সেদিন কলেজে আমাকে এতগুলো মানুষের সামনে ভাইয়া আমাকে মারলো,,তাতে সমস্যা ছিল না অতটা।কারণ তারা কেউ তো আর আমাকে চিনত না।কিন্তু এভাবে আদিব ভাইয়া আর কিয়ারা আপুর সামনে আমাকে অপমান করা মোটেই ঠিক হয়নি ওনার।আমি ওনাকে ভালোবাসি বলে উনি যাই খুশি তাই করবে নাকি আমার সাথে?কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম।

____

দেরি করে রাতে ঘুমানোর জন্য বাড়ির ছোটরা একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠল।এদিকে নাস্তর সময় হয়ে এসেছে কিন্তু বেলার কোনো দেখা নেই।তাই রুমি বেগম গেলেন মেয়েকে ডাকতে।

বেলার রুমে ঢুকে উনি মেয়ের মলিন মুখ দেখে থমকে গেলেন, আর অস্তে অস্তে করে মেয়েকে ডাকতে লাগলেন,

— বেলা এই বেলা, তাড়াতাড়ি ওঠ।সেই কখন সকাল হয়েছে।এখন যে বেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে।নাস্তার সময় ও হয়ে এসেছে।তাড়াতাড়ি ওঠ।

বেলা হালকা করে চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকাল,
তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে শুয়ে বলতে লাগল,

— মা একটু ঘুমাতে দাও।আমি নাস্তা পরে করে নিব।এখন তুমি যাও।

— মার খাবি কিন্তু বলে দিলাম।তাড়াতাড়ি উঠে পড় ওঠ বলছি,,

অগ্যতা মায়ের জোরাজুরিতে উঠতেই হলো।

রুমি বেগম যেতে যেতে বলতে লাগলেন,
— তাড়াতাড়ি আয়,আজকে নাস্তায় নানা রকমের হালুয়ার সাথে পরোটা আছে কিন্তু।

মায়ের কথা শুনে আমার জিভে জল চলে আসল।তাই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে গেলাম নাস্তা করতে।

নিচে গিয়ে দেখি সবাই উপস্থিত।শুধু আদিব ভাইয়া আর রায়ায ভাইয়া ছাড়া।

হঠাৎ করে আমার সিড়ির দিকে চোখ গেল আর দেখতে পেলাম রায়ায ভাইয়া নিচে নামছে।তার ঠিক পিছনে আদিব ভাইয়া,,সাথে সাথে আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।রায়ায ভাইয়াকে এখন বড্ড অসহ্য লাগছে।খুব রাগ উঠছে ওনার ওপর।তাই আর ভুলেও উনার দিকে ফিরে তাকালাম না।তারই মাঝে আদিব ভাইয়া আমার পাশে এসে বসে পড়লেন। ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে আবার নিজের মত বসে রইলাম।তখনই আদিব ভাইয়ার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,

— এখন কি অবস্থা তোমার বেলা? রাতে ঠিক মত ঘুম হয়েছিল তো?

ভাইয়ার কথা শুনে আমি ‘হ্যা’ বোধক মাথা নাড়ালাম। ভাইয়াও মুচকি হেসে আর কিছু বললেন না।

~ এরই মাঝে মা, বড়মা, চাচী আর ফুপি খাবার এনে টেবিলে রাখলেন।আর যুথি রান্নাঘর থেকে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে।পরোটা আর হালুয়া দেখে আমি আর লোভ সামলাতে পারলাম না। সবার আগেই নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম।এক এক করে সকলে খেয়ে-দেয়ে ওঠে যার যার কাজে চলে গেল।আর মা, বড়মা, চাচী আর, ফুপি খেতে বসল এখন।আমি সোজা নিজের রুমে চলে এলাম।কারণ এখনই আমাকে রেডি হতে হবে স্কুলে যাওয়ার জন্য।

নিচে নেমে দেখতে পেলাম আদিব ভাইয়া আর রায়ায ভাইয়া ড্রইংরুমে বসে কি নিয়ে যেন আলাপ আলোচনা করছে।কিন্তু এদিকে আমি চিন্তায় শেষ! কারণ আজকে ও যদি রায়ায ভাই আমাকে না নিয়ে চলে যায় তাহলে মা আজকে আমার গলায় ছুরি ধরবে এটা সিওর আর কি কারণ তাও বের করে ছাড়বে।এইরে! মা যদি এসব জানতে পারে তাহলে আমাকে আস্ত চিবিয়ে খাবে।

আমি যখন আমার ভাবনায় মগ্ন ঠিক তখনই খুব জোড়ে টায়রার চিৎকার করার আওয়াজ শুনতে পেলাম।আর সাথে সাথে সবাই দৌড়ে ওর রুমে চলে এলাম।একটু পর বাড়িয়ে সকলে এসে হাজির হলেন।বড়মা টায়রাকে ডাকতে লাগলেন,

— কি হয়েছে তোর? তখন এভাবে চিৎকার করছিলি কেন?

টায়রা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,

— আমি ওয়াশরুমের ভিতর পড়ে গেছি মা,,,কিন্তু এখন আর উঠতে পারছি না।তার ওপর পা অনেক ব্যাথা করছে – টায়রা কথাটা বলেই জোরে জোরে কাঁদতে লাগল।

টায়রার কান্না শুনে রায়ায ভাই অনেকটা বিচলিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন,

— বোন আমার, একটু কষ্ট করে দরজাটা খোলার চেষ্টা কর।

— ভাইয়া আমার পক্ষে দরজা খোলা সম্ভব হচ্ছে না।অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু উঠতে পারছি না- কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলতে লাগল টায়রা।

— আচ্ছা দাঁড়া আমি তাহলে দরজা ভাঙার চেষ্টা করছি।

— না ভাইয়া দরজা ভাঙতে হবে না।আমি উঠার চেষ্টা করছি।

বেশ কিছুক্ষন পর টায়রা দরজা খুলে দিয়ে সেখানেই বসে পড়ল।তখনই রায়ায ভাই এসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে খাটে বসিয়ে দিলেন আর আদিব ভাইয়াকে বলতে লাগলেন,

— আদিব তাড়াতাড়ি আমার পকেট থেকে ফোনটা বের করে ডাক্তার আঙ্কেলকে ফোন দিয়ে বল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের বাড়িতে যেন চলে আসে – কথাটা বলে ভাইয়া টায়রার পা টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন।আর আদিব ভাইয়া ডাক্তারকে ফোন দিয়ে আসতে বলে ফোনটা আবার রায়ায ভাইয়াকে ফেরত দিয়ে দিলেন।

টায়রার জন্য খুব খারাপ লাগছে।ইশরে! মেয়েটা খুব ব্যথা পেয়েছে।তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে।কিন্তু একটা বিষয় ভেবে ভালো লাগছে,, যাক আজ আর আমাকে স্কুলে যেতে হবে না ভেবেই খুশি খুশি লাগছে।কিন্তু আমার খুশিতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে দাদি বলতে লাগলেন,

— কিরে ছ্যামড়ি স্কুলে না গিয়া এহানে কি করস? যা যা তাড়াতাড়ি স্কুলে যা।

দাদির কথা শুনে আমি বলতে লাগলাম,

— কিন্তু দাদি টায়রার এই অবস্থা।

মাঝখান দিয়ে মা বলতে লাগল,

— পা টায়রার গিয়েছে, তোর তো আর যায়নি।তাড়াতাড়ি স্কুলে যা।

কি আর করা মন খারাপ করে নিচে নামতে লাগলাম।একটু আগে আদিব ভাইয়া আর রায়ায ভাইয়াকে নিচে নামতে দেখেছি।কোথায় গেছে যে জানে?কিন্তু নিচে এসে দুজনকেই এখানে পেয়ে গেলাম।তাই আমি দৌড়ে গিয়ে আদিব ভাইয়াকে কিছু বলতে যাবো অমনি নিজের পায়ের সাথে পা লেগে পড়তে নিলাম,, ঠিক তখনই আদিব ভাইয়া আমাকে ধরে ফেললেন।কিন্তু ব্যালেন্স রাখতে না পারায় দুজনেই একদম গিয়ে পড়লাম সোজা নিচে।

ভাইয়ার ফেস দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব ব্যাথা পেয়েছে।তাই আমি তাড়াতাড়ি করে উঠতে নিলে একটা বলিষ্ঠ হাত আমাকে একটানে তুলে নিলেন।হাতের মালিক কে? তা দেখতে নিলেই রায়ায ভাইয়াকে দেখে আমি চমকে উঠলাম।

ভাইয়া আমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলতে লাগলেন,

— তোর কি বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই।না আছে বয়সের কোনো মান্য। ছেলে দেখলেই গায়ে পড়তে ইচ্ছা করে তোর তাই না।

— তুই এসব কি বলছিস রায়ায?তুই তো দেখলি ও কেমন পায়ে পা লেগে পড়ে যাচ্ছিল। ও কি ইচ্ছে করে পড়েছে নাকি?

— ও ইচ্ছে করেই পরেছে।ওকে তো আর তুই চিনিস না।ছেলে দেখলেই গায়ে পড়তে মন চায় ওর।

কথাগুলো শুনে চোখ বন্ধ করে নিলাম আর নীরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলাম।তখনই আদিব ভাইয়া রায়ায ভাইয়াকে থাকিয়ে দিলেন,

— হয়েছে এবার থাম তুই।

কথাগুলো বলে আদিব ভাইয়া আমার কাছে এসে আমার চোখের পানি মুছে দিলেন, আর বলতে লাগলেন,

— কিছু বলতে এসেছো বেলা?

রায়ায ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি চোখ মুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।তাই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আদিব ভাইয়াকে বলতে লাগলাম,

— আসলে ভাইয়া টায়রা তো পা ভেঙে বসে আছে।কিন্তু তাই বলে আমি তো আর স্কুল যাওয়া থেকে নিস্তার পাবো না।তাই বলতে এসেছিলাম,, আপনার যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে আমাকে একটু স্কুলে দিয়ে আসবেন।

— সমস্যা নেই, চলো তোমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসি।

— আলবাদ সমস্যা আছে।আদিব কি তোর মত খায় আর ঘুমায় যে তোর জন্য ওর মূল্যবান সময় গুলো নষ্ট করবে।আর প্রতিদিন তো আমিই তোকে স্কুলে নিয়ে যাই।আজ ন্যাকামো করে আদিবকে কেন বলছিস?

— আহা! রায়ায তুই থাকবি? হয়তো তুই টায়রাকে নিয়ে ব্যস্ত বলে তোকে বলে নি। চলো বেলা আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসছি।

— কোথায় যাওয়ার দরকার নেই তোর।ডক্টর আসলে ওনাকে জাস্ট রিসিভ করিস।আর একে তো আমি দেখছি।

কথাটা বলেই রায়ায ভাইয়া আমাকে টানতে টানতে বাহিরে নিয়ে এলেন।কিন্তু ওনার সাথে যাওয়ার আমার মোটেও ইচ্ছে নেই।তাই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগলাম,

— আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না।

আমার কথাটা শেষ হতে না হতেই উনি আমাকে টেনে গাড়িতে তুলে খুব জোরে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। এমন বিকট শব্দে আমি কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলাম।তাই ভয়ে আর কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলাম।

____

স্কুলে এসে উনি আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।সারারাস্তা দুজন একটা টু শব্দ টুকুও করি নি।আমি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ভিতরে চলে গেলাম।কিন্তু গেটের সামনে যেতে না যেতেই রবিন আমার পথ আটকে ধরলেন।

” রবিন হচ্ছে আমার এক ক্লাস সিনিয়ন।বেশ কিছুদিন যাবত আমাকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে এই ছেলেটা। কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না।তার এক কথা – আমি তোমাকে ভালোবাসি বেলা।আমার ভালোবাসা গ্রহণ করে নাও।কিন্তু আমি এতদিন যাবত তাকে বুঝিয়েই যাচ্ছি যে আমার দ্বারা এসব হবে না কিন্তু কে শুনে কার কথা? প্রতিদিন এসে আমার পথ আটকাবেই আর আমার মাথা চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে”

আজকে আর সইতে না পেরে কিছু কথা শুনিয়ে দিলাম,

— সমস্যা কি আপনার? কথা কি কানে যায় না আপনার।নেক্সট আপনাকে আমার সামনে যেন আর না দেখি।নয়তো আপনার খবর করে ছাড়বো ‌আমি।

কথাটা বলে আমি জায়গা প্রস্থান করতে নিলাম তখনই এই ছেলে আমার ওড়না ধরে দিল একটান। রাগে আমার গা জ্বলে উঠল্ এবার তাই আর সইতে না পেরে দিলাম এক চড়।চড় খাওয়ায় সাথে সাথে গালে হাত দিয়ে ব্যাটা মাথা নিচু করে নিল।আর আমি বলতে লাগলাম,

— লজ্জা করল না ? এভাবে একটা মেয়ের ওড়না টেনে ধরতে।নেক্সট টাইম আর কখনোই আমার সামনে আসবেন না।

কথাগুলো বলেই আমি নিজের ক্লাস রুমে চলে আসলাম।

চলবে ইনশাল্লাহ,,