প্রেমময় বিষ পর্ব-০৫

0
296

#প্রেমময়_বিষ
#মাহিমা_রেহমান
#পর্ব_৫

____

কোনোদিকে খেয়াল না করে আমি প্রাণ’পণ ছুটে চলছি। এদিক দিয়ে পা কেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।কিন্তু এখন আমার এসবের দিকে খেয়াল দিলে চলবে না। দৌড়াতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে কিন্তু আমাকে যে থামলে চলবে না তাই এই ক্ষত পা নিয়েই ছুটে চল’ছি।যে করেই হোক আমাকে এই শয়তানের হাত থেকে বাঁচতেই হবে। ছুটতে ছুটতে আমি এতটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছি যে আমার আশেপাশে কি হচ্ছে কিছু’ই আমার মাথায় ঢুকছে না।হঠাৎ করেই একটা গাড়ি আমার সামনে এসে পড়ে,,এমতাবস্থায় আমার কি করা উচিত তা ঠিক মাথায় আসছে না।তাই ভয় পেয়ে মুখের সামনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।কিন্তু এতক্ষণ অব্দি কিছু না হওয়ায় চোখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি গাড়িটা থেমে গেছে আর তার থেকে একজন পুরুষ নেমে আসছে।আমার পা থেকে এতটাই ব্লিডিং হচ্ছে যে,,,আমি চোখে ঝাপসা দেখছি।তাছাড়া পায়ের ক্ষত’টা এতো দৌড়াদৌড়ির ফলে এতটাই বাজে অবস্থা হয়ে গেছে যে দাঁড়িয়ে থাকতে ও বড্ড কষ্ট হচ্ছে এখন।কিন্তু অনেক হার মানলে চলবে না।তাই সামনেই দিকে এগিয়ে গেলাম যদি লোকটার কাছ থেকে কোন সাহায্য পাই।

একটু সাম’নে এগোতেই মানুষটাকে দেখে আমি চমকে যাই।একি!এটাতো রায়ায ভাইয়া।তাই আর দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি,,,

আমার এমন কান্ড দেখে ভাইয়া একটু হকচকিয়ে যায়।আর সাথে সাথে নিজের থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিতে চায়।কিন্তু আমি ছাড়ছি না জোর করে ভাইয়ার সাথে সেঁটে আছি।

বেলকে এভাবে কাঁদতে দেখে রায়ায একটু নরম হয়।তাই অস্তে অস্তে বেলকে নিজের থেকে ছড়িয়ে নিয়ে সামনে এনে দাঁড় করায়,, কিন্তু বেলা ঠিক মত দাঁড়াতে পারছে না দেখে,, একবার বেলাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকে,

–কি হয়েছে বেলা? তোর এই অবস্থা কেন? আর তুই বা এমন পাগলের মত কোথা থেকে ছুটে আসছিল?আর তোকে দেখে তো বেশ ইঞ্জুরি মনে হচ্ছে। কি হয়েছে বল আমাকে?

°আমি এক এক করে ভাইয়াকে সবটা বলতে লাগলাম°

“আজকে হঠাৎ করে আমাদের ইংলিশ ম্যাম ক্লাসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ায় তাকে ধরাধরি করে সকলে হসপিটালে নিয়ে যায়।আর তাই স্যার-ম্যামরা সকলে তাকে দেখতে যাবে বলে স্কুল আজকে একটু তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেয়।কিন্তু আমার কাছে কোনো মোবাইল না থাকায় বাড়িতে ফোন করে এই খবরটা জানাতে পারি না।আর ড্রাইভার তো নিজের ফিক্সড করা টাইমেই আসবে তাই আর কোনো উপায় না পেয়ে আমার এক বান্ধবীর সাথে ফুচকা খেতে চলে যাই।দুই বান্ধবী মিলে যখন ফুচকা খেতে মশগুল তখন একটা ছোট ছেলে এসে আমাকে বলতে লাগে,

— আপু আপনাকে একটা ভাইয়া ঐযে ঐখানটায় ডাকছে (হাত দিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে) বলেছে আপনাকে তাড়াতাড়ি যেতে।আপনাকে নাকি নিতে এসেছে।

বাচ্চাটার কথা শুনে আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম।আমার এই সময় স্কুল ছুটি হয়েছে, বাড়িতে তো কেউ জানে না।তাহলে আমাকে আবার কে নিতে আসবে?হয়তো বা আদিব ভাইয়া এসেছে,, এসব ভেবে আশাকে বিদায় দিয়ে বাচ্চাটার দেখানো জায়গাটায় চলে আসি।

কিন্তু জায়গাটা অনেক নির্জন। আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভাবি হয়তো কেউ মজা করেছে। তাই ফিরে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেই।যেই ফিরে যাওয়ার জন্য সামনের দিকে পা বাড়াই,, তখনই একটা কণ্ঠ শুনতে পাই,

— কোথায় যাচ্ছো বেলা সুন্দরী? আমিতো এখানে।

রবিনের কণ্ঠ শুনে আমি অনেকটা চমকে যাই আর পিছন ফিরে তাকাই।রবিনের সাথে ওর আরো কয়েকজন বন্ধুকে দেখতে পাই।এদের সবাইকে একসাথে দেখে আমি অনেকটা ভয় পেয়ে যাই।

রবিন ধীরে ধীরে আমার কাছে এগোতে থাকে।এতে আমি আরও ভয় পেয়ে যাই আর বলতে লাগি,

— কি সমস্যা আপনার? এতো অপমানিত হয়েও আপনার লজ্জা হয়নি? আপনি আবার আমার পিছু নিচ্ছেন। এখনতো আপনি নিজের লিমিটই ক্রস করে ফেলেছেন। কি করে পারলেন আমাকে এমন একটা নির্জন জায়গায় ডেকে আনতে?

— আহঃ! সুন্দরী রাগছো কেনো? আমি কি তোমাকে এখানে মার’তে ডেকেছি নাকি বক’তে? আমিতো তোমায় আদর করতে এখানে ডেকেছি। তুমি তখন আমায় সকলের সামনে এভাবে থাপ্পর দিলে না? তাই আমিও সেই থাপ্পড়ের বিনিময়ে আদর দিতে এসেছি।

— কি যাতা বলছেন? আর একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না বলে দিচ্ছি( কথাগুলো বলতে বলতে আমি আমার ব্যাগের থেকে একটা ব্লেট আর মরিচ গুঁড়া যা সবসময় সেফটির জন্য নিজের কাছে রেখে দেই সেগুলো বের করে হাতের মুঠোয় লুকিয়ে নিলাম)

— কাছে না আসলে তোমাকে আদর করব কি করে সুন্দরী? – কথাটা বলে রবিন একদম আমার সামনে এসে খুব জোরেই আমার হাত চেপে ধরলেন। আর সাথে সাথে আমি ওর হাতে ব্লেট দিয়ে দিলাম এক টান।

সাথে সাথে রবিন চিৎকার করে আমার হাত ছেড়ে দিল। এই সুযোগে আমি দিলাম এক দৌড়। আমাকে দৌড়াতে দেখে ও ওর বন্ধুদের বলতে লাগলেন,

— সুন্দরীকে ধর।আজকে ওর একদিন কি আমার একদিন – কথাগুলো বলে ওরা সবাই আমার পিছনে ছুটতে লাগল।

আর আমি এদিক সেদিক না দেখেই শুধু ছুটে চলছি হঠাৎ করেই আমার পা কিসের সাথে লেগে যেন কেটে যায়,, যার ফলে অনেকটা ব্যথাও পাই আর সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে উঠি।কিন্তু পক্ষান্তরে ওদেরকে আবার আমার পিছনে আসতে দেখে ব্যথার কথা ভুলে গিয়ে পূনরা’য় দৌড় লাগাই।আর দৌড়াতে দৌড়াতে মেইন রোডে দিকে চলে আসি আর তখনই আমার সামনে একটা গাড়ি এসে পরে আর আমি ভয়ে চোখের উপর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি”

___

আমার কথাগুলো শুনে রায়ায ভাই আমার মাথাটা নিজের বু*কে চেপে ধরেন।আমি ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে শান্তিতে কাঁদতে থাকি।কিছু সময় অতিক্রম হওয়ার পর ভাইয়া আমার মাথাটা নিজের বুক থেকে তুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে ওঠে,

— গাড়িতে উঠে বস, আয়।

উনি আমাকে ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজে আমার পাশে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।সারা রাস্তা আমরা কেউ আর কোনো রকম টু শব্দটি ও করি নি।কিন্তু আমার পক্ষে আর চুপ থাকা সম্ভব হচ্ছে না।তাই আর না পেরে যেই কিছু বলতে যাবো এমনি ভাইয়া বলতে লাগলেন,

— চুপচাপ মুখ বন্ধ করে বসে থাক।আমি তোর প্রতি কনসার্ন দেখে! মনে করিস না আমি আবার তোকে ভালোবাসি।তুই আমার পরিবারের একজন সদস্য তার সাথে একজন মেয়ে! তাই তোকে প্রোটেক্ট করা আমার দায়িত্ব।তাই দায়িত্বকে ভালোবাসা ভেবে নিস না।

ভাইয়ার কথা গুলো শুনে মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। উনি শুধুই ওনার দ্বায়িত্ব পালন করছে? হাহ! দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম।

___

বাড়ির গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে ভাইয়া আমার পাশের দরজা খুলে দিলেন আর বলতে লাগলেন,

— হাঁটতে পারবি? এইটুকু জায়গা হেঁটে যেতে পারবি তো নাকি?

আমার পায়ে বর্তমানে অনেক ব্যাথা।কিন্তু ব্যথার চিন্তা করলে তো চলবে না।তাই ভাইয়াকে বললাম,

— সমস্যা নেই, আমি হাঁটতে পারবো।

কথাটা বলেই নামতে নিলে হুট করে ভাইয়া আমাকে কোলে তুলে নিলেন।ওনার এমন কাজে আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই।উনি শক্ত মুখে সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলছে আর আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আছি।

__

বাড়ির ড্রইংরুমে এসে আমায় সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল রায়ায ভাইয়া। আমি ওনার যাওয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম।বাড়ির সকলে আমার এই অবস্খা দেখে দৌড়ে আমার কাছে এলো আর জিজ্ঞেস করতে লাগল কি হয়েছে আমার? এদের এতো প্রশ্ন শুনে আমার মাথা ঝিম ধরে গেছে।তখনই কথা থেকে যেন আদিব ভাইয়া ছুটে এলেন।আবিদ ভাইয়া আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমার পা দেখতে লাগলেন আর কিয়ারা আপুকে বলতে লাগলেন,

— কিয়ারা তাড়াতাড়ি গিয়ে ফার্স্ট এইড নিয়ে আয়।

— যাচ্ছি ভাইয়া।

কথাটা বলেই কিয়ারা আপু ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলো।আর আদিব ভাইয়া খুব যত্ন সহকারে আমার পা ক্লিন করে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে।এই মানুষটাকে আমি যতই দেখি ততই অবাক হই।মানুষটা কত ভালো? কত কেয়ারিং।আর অপরদিকে রায়ায ভাইয়া! যে কিনা আমাকে দু চোখে সহ্য করতে পারে না।আজ প্রথম খুব আফসোস হচ্ছে কেন আদিব ভাইয়াকে ভালো না বেসে রায়ায নামক মানুষটার প্রেমে পড়তে গেলাম। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে একপলক উপরের দিকে তাকালাম আর তাকিয়ে দেখলাম রায়ায ভাইয়া আমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে।তাই সাথে সাথে আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।

হঠাৎ করে মনে হলো আমি হাওয়ায় ভাসছি।তাকিয়ে দেখি আদিব ভাইয়া আমাকে কোলে তুলে নিয়েছে।আমার দিকে তাকিয়ে ভাইয়া বলতে লাগলেন,

— চলো তোমাকে রুমে দিয়ে আসি, নিশ্চয়ই এই পা নিয়ে উপরে উঠতে পারবে না।

আমি আর কিছু বললাম না।শুধু মাথা নাড়ালাম।

ভাইয়া আমাকে রুমে এনে খাটে বসিয়ে দিলেন আর আমার মাথার পিছনে একটা বালিশ দিয়ে দিলেন। তখনই সবাই এসে হাজির হলেন আর দাদি এসে একপ্রকার আহাজারি শুরু করে দিলেন,

— হায়!হায়রে! এটা কি হইলো এডা? দুই মাইয়া দেহি এক লগে বিছানায় পইড়া গেল রে… কার নজর লাগলো আমার দুই নাতনির উপর।

তখনই কিয়ারা আপু দাদিকে শান্তনা দিয়ে বলতে লাগলো,

— আহঃ! নানু তুমি এভাবে আহাজারি করছো কেন বলতো। সব কিছুই খুব শীগ্রই ঠিক হয়ে যাবে তুমি দেখে নিও।

তখনই মা এসে আমায় জিজ্ঞেস করতে লাগলো,

— কি হয়েছে তোর? কি করে তোর পা কাটলো? বলবি তো কিছু ? না বললে আমরা বুঝবো কি করে?

এসব কথা কাউকে বলা যাবে না,, বললেই সবাই নিশ্চয়ই অনেক চিন্তা করবে তাই আমি কথা ঘুরিয়ে বলতে লাগলাম,

— ওটা তো! কিসের সাথে লেগে জানি আমার পা কেটে গেছে হেহেহে…

মা মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করলেন না তাই পূনরায় জিজ্ঞেস করলেন,

— সত্যি বলছিস!

— হ্যা মা আর কি হবে। এখন তোমরা সবাই যাও আমি একটু রেস্ট নিব।আর টায়রার পায়ের কি অবস্থা?

— ওর পা একটু মচকে গেছে।কিছুদিন রেস্ট করলে নাকি ঠিক হয়ে যাবে ডাক্তার বলে গেছে।আচ্ছা তুই এখন রেস্ট নে আমরা সবাই গেলাম।

কথাগুলো বলে সবাই বের হয়ে গেল রুম থেকে।যাওয়ার আগে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে গেল।যাক এবার একটা শান্তির ঘুম দিতে পারবো। তার ওপর স্কুল যাওয়া থেকে কিছুদিনের জন্য হলেও নিস্তার পাবো।

___

ঘুমের মধ্যে অনুভব করছি কেউ আমার কপালে নিজের ওষ্ঠ স্পর্শ করছে।তাই হঠাৎ করেই নিজের চোখ খুলে ফেললাম।কিন্তু একি! আমিতো রুমের মধ্যে কাউকে দেখতে পারছি না।হয়তো সপ্ন ছিল, এই ভেবে পূনরায় আবার ঘুমিয়ে গেলাম।

চলবে ইনশাল্লাহ,,