প্রেমমানিশা পর্ব-২৭+২৮+২৯

0
209

#প্রেমমানিশা(২৭)

রান্নাঘরের কাজ সেরে মিসেস কায়নাত বসার ঘরের সোফায় গিয়ে বসলেন। হাতটা বাড়িয়ে এসির রিমোটটা হাতে নিয়ে এসির টেম্পারেচার আরও কমিয়ে দিলেন। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে তার মনে হয় এতক্ষণে এক কেজি ঘাম শরীর থেকে পড়েছে। আগত বসন্তের হালকা এই উত্তাপেই এই অবস্থা, যখন গ্রীষ্মকাল চলে আসবে তখন কি হবে আল্লাহ মালুম।

মিসেস কায়নাত যখন নিজের মতো নিজে জিরিয়ে নিতে ব্যস্ত তখনই বাড়ির সদর দরজার কলিং বেল বেজে উঠলো। মিসেস কায়নাত উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। দরজা খুলে দেখলেন লয়ার মিস্টার বড়ুয়া এসেছেন। মিসেস কায়নাত আলতো হেসে মিস্টার বড়ুয়াকে সোফায় বসতে বললেন।মিস্টার বড়ুয়াকে বসিয়ে রেখে মিসেস কায়নাত কিছু নাস্তা পানি আনতে গেলেন।

‘ কেমন আছো মামণি ? ‘

সানাহ্ আপনমনে ব্রেড চিবচ্ছিল। লয়ার মিস্টার বড়ুয়া যে বাড়িতে এসেছেন সেটা ওর নজরেই পড়েনি তাই হঠাৎ মিস্টার বড়ুয়ার কথায় চমকে উঠলো। অবাক হয়ে মিস্টার বড়ুয়ার দিকে তাকালো। তারপর মানুষটা কে বুঝতে পেরে স্মিত হেসে বললো ‘ আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো উকিল আঙ্কেল ? ‘

‘ আমিও ভালো আছি মা। শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে ? আগে তো বিয়েই করতে চাইতে না আর এখন একেবারে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেললে। এই জন্যই তো ভাবী আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ‘ মিস্টার বড়ুয়া তার পান খাওয়া দাত দেখিয়ে মুচকি হেসে বললেন।

‘ হ্যাঁ সে বিয়ে.. ‘ সানাহ্ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ওদের কথার মাঝেই মিসেস কায়নাত স্নাকসের ট্রে এনে বসার ঘরের টি টেবিলের উপর রেখে বললেন ‘ এসব কথা নাহয় পড়ে হবে ভাই। আগে যেই কাজের জন্য আপনি এসেছেন সেটা মিটিয়েনী ? প্রপার্টির কাগজ এনেছেন আপনি ? ‘

‘ হ্যাঁ আপনি যেভাবে যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই এনেছি। আপনি বলেছিলেন আপনাদের বান্দরবনের গেস্ট হাউজ বাদে যেসব স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি আছে সেসবের অর্ধেক সানাহ্ আর অর্ধেক অতসী পাবে। বাকি যে ফার্ম হাউজ ওটা একটা অনাথ আশ্রমকে দিয়ে দিবেন তাইতো ? আমি সেই মতোই কাগজ করে এনেছি। আপনি চাইলে দেখে নিতে পারেন ‘ বলে মিস্টার বড়ুয়া মিসেস কায়নাতের দিকে সম্পত্তির কাগজগুলো এগিয়ে দিলেন।

সানার কোনোকালেই এসব সম্পত্তির প্রতি আগ্রহী ছিল না তাই সে এসবে বোর হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যে পারলে সে এখনই এখান থেকে উঠে যায় কিন্তু খিদের বশে সে যে পাঁচ ছয়টা ব্রেড টোস্ট করেছে সেগুলো কে শেষ করবে ? আগে তো মনে হয়েছে খিদার জ্বালায় সে অনায়াসে আট দশটা খেয়ে ফেলতে পারবে কিন্তু ওর ধারণা যে সম্পূর্ণ ভুল সেটা ও এখন বুঝতে পারছে।

তবে যে করেই হোক সানাহ্ খাবারগুলো শেষ করবে কারণ খাবার নষ্ট করা তার পছন্দ নয়। এমন কত মানুষ আছে যারা খেতেই পায় না আর ও খেতে পেয়েও সেগুলো নষ্ট করবে ? এটা একেবারেই অসম্ভব।

সানাহ্ যখন শরীর হেলিয়ে দুলিয়ে কোনোমতে খাবার গিলছে তখনই ওর ট্রাউজারের পকেটে থাকা ফোন তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো। এই সাত সকালে কে ফোন করেছে দেখার জন্য ফোন বের করতেই সানার ঠোঁটের কোলে হাসি খেলে গেলো। ফোনের ডিসপ্লেতে গোটা গোটা অক্ষরে ‘ আশা আন্টি ‘ লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। সানাহ্ বেশ খুশিই হলো যে এই বোরিং টাইমে কেউ অন্তত তাকে সময় দিতে ফোন করলো।
সানাহ্ ফোন রিসিভ করতেই ঐপাশ থেকে মিসেস আশা বললেন ‘ কেমন আছো সানাহ্ ? ‘

জবাবে সানাহ্ মিষ্টি হেসে বললো ‘ আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো আন্টি ? কি করছো ? তোমাদের কি ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গেছে ? ‘

‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা। হ্যাঁ আমাদের ব্রেকফাস্ট করা শেষ। এই যে এখন অফিসে যাবো। রোজই অফিসে যেতে হয়। ‘ মিসেস আশা ক্লান্তি মিশানো গলায় বললেন।

‘ এখন তো এগুলো ছেড়ে দিলেই পারো আন্টি। এই সময় আর কত স্ট্রেস নিবে তুমি ? এত আর্ন করে কি লাভ ? ফারহান তো আছেনই। এতদিন তুমি করলে। এখন থেকে নাহয় উনি করবেন। ‘ সানাহ্ চিন্তিত হয়ে বললো।

‘ এসব কি আর সাধে করি মা ? চাকরি করাটা একসময় আমার বাধ্য বাধকতা হলেও এটা এখন আমার প্যাশন। আসলে কর্মমুখী মানুষ জীবনের শেষ সময়েও কোনো কাজ না করে থাকতে পারে না। সব যদি ছেড়েই দিতে পারতাম তাহলে এতদিনে ব্যবসাকে এতটা দাড় করাতে পারতাম না। তবে সমস্যা নেই। রুদ্রটা পড়াশুনা শেষ করেই অফিস জয়েন করবে। তখন এমনিতেই আমার উপর আর প্রেসার থাকবে না। ‘ মিসেস আশা স্নিগ্ধ হেসে বললেন।

‘ হ্যাঁ তাতো ঠিক। তোমার মতো মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি আন্টি। এতটা ডেডিকেটেড আর এফিশিয়েন্ট নিজের কাজে যে আমার মনে হয় আমিও তোমার মতই হবো। এ ওয়ার্কাহলিক পারসন। ‘

সানার কথা শুনে তীব্র স্বরে হেসে উঠেন মিসেস আশা। সানার এসব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা উনাকে বড্ড হাসায়। আসলেই মেয়েটা এতটাই সরল যে সবকিছুকেই সোজা মনে করে। কিন্তু এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কোনোকিছুই সোজা নয়।। একবেলা পেটের খাবার জুটানোর জন্যও মানুষকে এখানে যুদ্ধ করতে হয়। তবে উনি এখনই স্বপ্নের দুনিয়ায় বাস করা সানার ভুল ভাঙাবেন না। মেয়েটা যতটা পারুক স্বপ্ন দেখুক। এরপর তো বাস্তবতার নিষ্ঠুর ধাক্কায় একসময় আপনিতেই সব বুঝে নিবে। তখন নাহয় আবার জীবনটাকে নতুন করে সাজাবে।

মিসেস কায়নাত সম্পত্তির কাগজপত্র দেখছেন। সবকিছু একবার ভালো করে পরখ করে নিয়ে মিস্টার বড়ুয়াকে বললেন ‘ ঠিকাছে তাহলে আমি এখানে কবির আর আমার সাইন নিয়ে নিলে আপনি এগুলো কাজ করতে দিয়ে দিবেন। আমি চাইছি আগামী দুই এক মাসের মধ্যেই প্রপার্টি সানাহ্ আর অতসীর নামে করে দিতে। ‘

‘ কিন্তু ভাবী একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এখন সমস্যাটা সলভ না হলে আমি কাজে এগোতে পারছি না। সমস্যাটা একটু অন্যরকম। ‘ মিস্টার বড়ুয়া আমতা আমতা করে বললেন।

‘ সমস্যা ? কি সমস্যা ? ‘ মিসেস কায়নাত ভ্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে মিস্টার বড়ুয়ার দিকে দৃষ্টি দিলেন। মিস্টার বড়ুয়ার এহেন আমতা আমতা ভাব উনার পছন্দ হচ্ছে না। এই ধরনের মানুষদের উনার একেবারেই পছন্দ না যারা সিরিয়ালের মতো সিরিয়াস সিচুয়েশনে এমন তোতলাতে তোতলাতে কথা বলে।

‘ কোম্পানি থেকে বেশ কয়েকদিন আগে অনেক মোটা অঙ্কের টাকা উইথড্র করা হয়েছে কিন্তু কেন উইথড্র করা হয়েছে তার কোনো ক্ল্যারিফিকেশন পাওয়া যায়নি। এই কথাগুলো আমি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কাছ থেকে জানতে পেরেছি যখন কোম্পানির সব অ্যাকাউন্টস চেক করিয়েছিলাম আপনার কথায়। ‘

মিস্টার বড়ুয়ার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন মিসেস কায়নাত । উনি বুঝতে পারলেন না মোটা অঙ্কের টাকা কে উইথড্র করেছে ‘ Flora ‘ থেকে। ‘ Flora ‘ হলো বাংলাদেশের প্রথম সারিতে থাকা ফ্যাশন ডিজাইনিং হাউসের মধ্যে অন্যতম ফ্যাশন হাউজ। ‘ Flora ‘ তে বিভিন্ন ধরনের ক্লাসিক্যাল জুয়েলারি ডিজাইন করা থেকে শুরু করে নয়নাভিরাম সব আউটফিটও ডিজাইন করা হয়।।’ Flora ‘ তে বাংলাদেশের সবথেকে বড় ডিজাইনারদের আবাস।

‘ হিউজ এমাউন্ট মানে ? কে মোটা অঙ্কের ক্যাশ তুলেছে ? ক্যাশ নিশ্চই কোম্পানি শেয়ার হোল্ডারদের বাইরে কেউ তুলতে পারবে না ? ‘ মিসেস কায়নাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

‘ হুম হিউজ এমাউন্ট…. এরাউন্ড ওয়ান মিলিয়ন। কোম্পানির ফিফটি পার্সেন্ট শেয়ার মিস হোল্ডার সাইয়ারা কায়নাত সানাহ্ তুলেছেন। ‘ এক প্রকার ভয়ে ভয়েই কথাগুলো বললেন মিস্টার বড়ুয়া।

উনি এখন ভালো করেই বুঝতে পারছেন যে এরপর এই মা মেয়ের মধ্যে কত বড় ধরণের যুদ্ধ লাগতে চলেছে। যদিও সানাহ্ আর মিসেস কায়নাতকে উনি মাত্র একবারই সম্মুখে দাঙ্গা বাঁধাতে দেখেছেন কিন্তু এই দুই মা মেয়ের সাপে নেউলে সম্পর্কের ব্যাপারে কোম্পানির অনেকেই বেশ খানিকটা জানেন। এর পিছনেও কারণ আছে।

একবার সানাহ্, মিস্টার কবির আর মিসেস কায়নাত একটা বড় ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। সানাহ্ তখন সবে উনিশে পা দিয়েছে মনে হয়। সেখানে মিস্টার বড়ুয়াও ‘ Flora ‘ র পার্সোনাল লয়ার হিসেবে গিয়েছিলেন। সেখানেই মা মেয়ের মত বিরোধ হওয়ায় দুজনে রীতিমত ঝগড়া করে মিটিং ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর থেকেই সকলে মা মেয়ের সম্পর্কের ব্যাপারে অল্প বিস্তর অনেক কিছুই জানে।

মিসেস আশার মেজাজ গরম হয়ে গেলেও নিজেকে ঠান্ডা রাখতে চেষ্টা করলেন। উনি অবশ্যই চাননা বাইরের মানুষের সামনে উনার আর উনার মেয়ের মধ্যে ঝামেলা করে মেয়ের সম্মান নষ্ট করতে। এর আগে একবার এই ভুল করেছেন তাই দ্বিতীয়বার আর এই ভুল করবেন না। উনি শান্ত গলায় বললেন ‘ তাহলে মিস্টার বড়ুয়া আপনি এখন আসতে পারেন। আমি কবিরের সঙ্গে কথা বলে পেপার্স এ সাইন নিয়ে আপনার কাছে পেপারগুলো পাঠিয়ে দিবো। নমস্কার… ‘

মিসেস কায়নাতের বলার পর মিস্টার বড়ুয়ার কাছে বলার মত আর কিছুই থাকে না। উনি মেকি হেসে নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মিস্টার বড়ুয়া বেরিয়ে যেতেই এবার মিসেস কায়নাত উঠে দাঁড়ালেন। ধীর পায়ে শান্ত মেজাজে এগিয়ে গেলেন সানার দিকে।
নিঃসন্দেহে বসার ঘর থেকে খাবার ঘরের দূরত্ব বেশি নয়। এই তিরিশ সেকেন্ডের দুরত্ব। দূরত্ব কম বলেই সানাহ্ এতক্ষণ মিস্টার বড়ুয়া আর মিসেস কায়নাতের প্রত্যেকটা কনভারসেশন শুনতে পেয়েছে। কিন্তু আজ সানার মোটেই নিজের কোনো কাজের এক্সপ্লেনেশন দেওয়ার ইচ্ছা নেই তাই ও উঠে দাঁড়ালো। মিসেস কায়নাতকে আসতে দেখেও না দেখার ভান করে সিড়ির দিকে পা বাড়ালো।

‘ আই ওয়ান্ট টু টক উইথ ইউ সানাহ্…… কাম হেয়ার ‘ মিসেস কায়নাত খাবার টেবিলের এক কোনায় চেয়ারে বসে শক্ত গলায় বললেন।

মিসেস কায়নাতের কথা শুনে সানার চলন্ত পা জোড়া থেমে গেলো। মিসেস কায়নাতের দিকে চোখ না ফিরিয়েই আগ্রাসী গলায় বললো ‘ বাট আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু টক উইথ ইউ মা.. আই অ্যাম গোইং টু মাই রুম সো ডোন্ট ডিস্টার্ব মী। ‘

‘ বাট আই হ্যাভ টু ডিস্টার্ব ইউ ডিয়ার…… ইউ হ্যাভ টু লিসেন মি অ্যান্ড এনসার মি। আমি কি জানতে পারি কেন তুমি কোম্পানির একাউন্ট থেকে এরাউন্ড ওয়ান মিলিয়নের মতো ক্যাশ উইথড্র করেছো ? ‘ মিসেস কায়নাতের গলায় তীব্র ঝাঁঝ শোনা গেলো।

সানাহ্ও ওর মায়ের গলার তেজ বাড়তে দেখে থেমে রইলো না। পূর্বের থেকেও বেশি তেজী গলায় বললই ‘ অবভিয়াসলি ইউ হ্যাভ দা রাইট টু নো বাট আই অ্যাম নট ফোর্সড টু ইনফরম ইউ। ‘

‘ অফকোর্স ইউ আর…… এন্ড ইউ আর মাই ডটার সো ইউ আর ফোর্সড টু ইনফরম মি। ‘ মিসেস কায়নাত এবার তেতে উঠে বললেন।

‘ নো আই অ্যাম নট……আই অ্যাম নট ইউর ডটার অ্যান্ড ইউ আর নট মাই মাদার। আসলে লোকে ঠিকই বলে মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি। তুমি আমার সো কল্ড মাসী ছাড়া কিছুই না। ইউ আর অনলি মাই আন্টি অ্যান্ড ইউ আর নট মাই মাদার। মাই মাদার ইজ মিসেস আয়াত আমরিন। আর ‘ Flora ‘ তে আমার বাবারও শেয়ার আছে তাই আমি ক্যাশ উইথড্র করলে আমি তোমাকে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই। রীমেম্বার দেট ইউ আর অনলী মাই আন্টি, নট মাই মাদার।

আজ নেহাৎ আমার মামণি আর বাবাই একটা কার অ্যাকসিডেন্টে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে নাহলে আই ডোন্ট নিড ইউ। ইনফ্যাক্ট আমার এখনও তোমাকে দরকার নেই। আই এম এনাফ ফর মাইসেলফ। ইউ আর নাথিং টু মি। সো ডোন্ট ট্রাই টু বি স্মার্ট উইথ মি অ্যান্ড ডোন্ট ট্রাই টু অ্যাক্ট লাইক এ মাদার। ইউ আর অলওয়েজ মাই আন্টি ফর মি…. ‘ বলেই রাগে গজগজ করতে করতে সানাহ্ ধুপধাপ পায়ে কাঠের সিড়ি বেয়ে উঠে গেলো।

সানাহ্ যখন রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এতগুলো কথা শুনাচ্ছিল তখনও মিসেস কায়নাত ভাবতে পারেননি সানার কাছে সে আজও মা হতে উঠতে পারেনি। আজও সে সানার সো কল্ড মাসীই রয়ে গেলো। যদি শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় তাহলে নিজে জন্ম না দেওয়া সানাহ্কে যখন নিজ হাতে বড় করলেন তখন উনি কি ? উনি কি শুধুই ওর আন্টি ? কেন আজও উনি সানার কাছে তার মাসীই রয়ে গেলেন ? উত্তর জানা নেই মিসেস কায়নাতের..…

সানাহ্ উঠে যেতেই মিসেস কায়নাত দিশা হারিয়ে দাড়ানো থেকে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। সানার কথা শুনে উনার মাথা ঘুরাচ্ছে। এসব কি বলে গেলো মেয়েটা ? মেয়েটার কাছে কি তবে সে ব্যর্থ মা ? আর কি করলে সে তার মেয়ের কাছে একজন ভালো মা হতে পারবে সেটা মিসেস কায়নাতের জানা নেই। তবে এবার আর মেয়ের মন পাওয়ার জন্য কিছু করার শক্তিও নেই মিসেস কায়নাতের। তবে কি উনার মন অবহেলা পেয়ে পেয়ে মরে গেছে ?

মিসেস কায়নাত যখন চেয়ারে বসেই আপনমনে নিজের ব্যর্থতার গণনা করছিলেন তখনই ধুপধাপ আওয়াজ করে সিড়ি দিয়ে নেমে এলো সানাহ্। দেখে মনে হচ্ছে কোথাও যাচ্ছে কারণ ইতিমধ্যেই তার বেশভূষা বদলে গেছে। পরনে একটা কফি কালারের কুর্তি উইথ কফি অ্যান্ড ব্ল্যাক কম্বিনেশন কোটি আর ব্ল্যাকিশ ব্লু রংয়ের জেগিনস। পায়ে নেভি ব্লু স্নিকার্স আর গলায় অফ হোয়াইট স্কার্ফ। সব মিলিয়ে যেন সানাহ্কে কোনো অপ্সরীর থেকে কম মনে হচ্ছে না। মন মেজাজ খারাপ হওয়ায় সানাহ্ একবারের জন্যও মিসেস কায়নাতকে কোথায় যাচ্ছে সেটা বলে যাওয়ারও প্রয়োজন মনে করলো না।।সোজা হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো।

রিকশায় করে বসুন্ধরা সিটি মলের সামনে এসে দাঁড়ালো সানাহ্। রিকশা থেকে নেমে রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে মুক্ত করলো। রিকশাওয়ালা ধুলা উড়িয়ে চলে যেতেই মুক্ত বাতাসে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মলে ঢুকলো সানাহ্। এলিভেটর দিয়ে আট তলায় উঠলো। আট তলায় পৌঁছেই আইস স্কেটিং সেক্টর খুজে বের করলো। তারপর নির্ধারিত জায়গায় নিজের ব্যাগ রেখে এক ঘণ্টার জন্য পে করে আইস স্কেটিং করতে নিজেকে প্রস্তুত করলো।

এটাই হয়ে এসেছে সবসময়। সানার যখনই তীব্র রাগ উঠে কিংবা নিজেকে অসহায় মনে হয় তখনই সে প্রচন্ড মরিচ দিয়ে ঝাল ফুচকা খায় কিংবা বসুন্ধরায় স্কেটিং করতে চলে এসেছে। স্কেটিং শিখেছে সেই ছোটবেলায় তার মামনির তত্ত্বাবধানে। তখন এসব ভালো লাগতো না কিন্তু ওর মামণি জোর করেই এসব করাত। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এই স্কেটিংই তার নিজেকে ঠিক রাখার রসদ।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#প্রেমমানিশা(২৮)

‘ মামা ইচ্ছে মত কাচা মরিচ,শুকনা মরিচ দিয়ে ঝাল ঝাল করে ফুচকা দিন তো। ‘

সানাহ্ ফুচকাওয়ালাকে তার ফুচকার অর্ডার দিয়ে এসে একটা খালি চেয়ার টেবিলে বসলো। সময়টা এখন শেষ বিকেল। গৌধুলি লগ্নের শেষ সোনালী আবরণ সানার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। সানাহ্কে দিচ্ছে অপার আনন্দ। সানাহ্ শুধু চোখ দুটো বন্ধ করে অনুভব করছে চোখ মুখের উপর আছড়ে পড়া সোনালী উষ্ণ রোদ। হঠাৎ সানার মনে হলো ক্যামেরা নিয়ে আসলে ভালো হতো। যখন ক্যামেরার সবথেকে বেশি প্রয়োজন থাকে তখনই সানার মনে থাকে না আনার কথা।

মিনিট দশেক পর ফুচকাওয়ালা সানার দেওয়া স্পেশাল ফুচকার অর্ডার দিতে এসে টেবিলে প্লেট রেখেই সানাহ্কে দেখে চমকে গেলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘ আফা আপনি আইজও এখানে আইসেন ? ‘

‘ কেন আমার কি এখানে আসা মানা ? ‘ সানাহ্ তীব্র ঝাল দেওয়া ফুচকা একটা মুখে তুলে বললো। ইতিমধ্যে অত্যাধিক ঝালে সানার চোখ মুখ লাল হয়ে আসছে তবে সানাহ্ নির্বিকার। সানার রাগ কমানো আর মন খারাপ মিটানোর দুইমাত্র উপায় তো এটাই। কাজেই ঝাল লাগলেও সানাহ্কে খেতে হবে।

‘ না মানে..… হ্যাঁ আফা আপনি আর আইয়েন না এখানে। আপনি দয়া কইরা আমার কাছে আর খাইবার আইয়েন না। ‘ ফুচকাওয়ালা মামা বিনীত সুরে বললেন।

‘ কেন ? আমি কি দোষ করলাম ? দুনিয়া শুদ্ধ মানুষ আপনার কাছে খেতে আসতে পারবে আর আমিই পারবো না। আমার মত একলা নারীর সঙ্গে এই অন্যায় কেন ? ‘ খোশ মেজাজে বললো সানাহ্। তার নাক, চোখ, মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি তার মন খারাপ আস্তে আস্তে মিটিয়ে দিচ্ছে।

‘ আপনি প্রত্যেকবার আইয়েন আর আমার এখান থেইকা ইচ্ছামত ঝাল দিয়া ফুচকা খাইয়া যান। ঝালে আপনার নাক,চোখ মুখ দিয়ে পানি পরে তবুও আপনি খান। আপনার লাল মুখখানা দেখলে আমার ডর করে। আপনি আর আমার এখান থেইকা খাইয়েন না। আপনার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি নিজেরে মুখ দেখামু কেমনে ? ‘ ফুচকাওয়ালা ভীত গলায় বললেন।

‘ হ্যাঁ আমি তো ঝাল দিয়ে খাওয়ার জন্যই আপনার এখানে আসি। ঝাল দিয়ে আপনার বানানো ফুচকা খেতে আমার দারুন লাগে। আর ভয় পাওয়ার কি আছে ? আমি আপনাকে টাকা দেই আর আপনি আমাকে ফুচকা বানিয়ে দেন। এখন সেই ঝাল ফুচকা খেয়ে যদি আমার কিছু হয় তাহলে তার সম্পূর্ণ দায়ভার আমার। ‘

ফুচকাওয়ালা বুঝলেন সানার সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এই মেয়ে তার অনুরোধ রাখবে না । বরং এখন এখান থেকে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কথায় কথা বাড়ে। দরকার কি কথা বাড়ানোর ? ফুচকাওয়ালা সানার কাছ থেকে ফুচকার দাম নিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন।

আঁধার ঘনিয়ে এসেছে কিছুক্ষণ আগেই। সানাহ্ রিক্সায় উঠে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। তার মেজাজ এখন ফুরফুরে। ঝাল ঝাল ফুচকা তার ভিতরের সব রাগ জেদকে টেনে হিচড়ে বের করে এনেছে। মনে হচ্ছে বাড়ি গিয়ে ওর মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

ইতিমধ্যে চোখ মুখ লাল টমেটোর মতো হয়ে গেছে তবে বিকেলে প্যারাসিটামল খাওয়ায় জ্বর নেমে গেছে। সানার আবার জ্বর নেমে গেলেই মাথায় চেপে থাকা ভুতও নেমে যায়। তাইতো সে এখন অনুতপ্ত নিজের কাজে। সকালে মুখে যা এসেছে তাই শুনিয়ে দিয়েছে মাকে। অথচ একবারও ভাবেনি এই মাই তাকে কত ভালোবেসে, আদর দিয়ে বড় করেছে। আসলে সে সন্তান নামের কলঙ্ক। তার মতো সন্তান থাকলে সব মায়েরাই কষ্টে থাকবে।

‘ সানাহ্ তুই কি তোর মায়ের সঙ্গে আবার কোনো দাঙ্গা বাঁধিয়েছিস ? ‘

বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই প্রশ্নের মুখে সানাহ্। হঠাৎ আচমকা ওর বাবাকে এই ভোর সন্ধ্যায় বাড়িতে দেখে চমকে গেলো। ওর বাবা সচরাচর এই সময় বাড়িতে থাকে না। সে ব্যস্ত থাকে তার ব্যবসায়ের কাজে ‘ Flora ‘ তে । মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে মাও অফিসে যায় কিন্তু সেটা হঠাৎ হঠাৎ। মা বেশিরভাগ সময় মেয়েদের সময় দিবে বলে বাড়ি থেকেই কাজ করে।

‘ কেন বাবা ? ‘ নিজেকে সামলে দ্রুত বাবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিল সানাহ্।

মেয়ের এহেন বোকামিতে মিস্টার কবির বিরক্ত হলেন। ভ্রু কুচকে বললেন ‘ তোমাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু তুমি উত্তর না দিয়ে উল্টো আমাকেই প্রশ্ন করছো। তুমি কি জানো তোমার মা বিকাল বেলা কাউকে না বলে হুট করে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে গেছে ? যাওয়ার সময় বলে গেছে সে আর ফিরবে না।

বাড়িতে অতসী ছিল। ও আমাকে ফোন করে জানানোর পর আমি আশাকে ফোন করলাম। আশা বললো কায়নাত ওর বাড়িতেই আছে আর কান্নাকাটি করছে। উল্টাপাল্টা কি বিলাপ বকছে সেটা আশা নিজেই বুঝতে পারছে না। তুমি আবার কি ঝামেলা করেছো যে কায়নাত এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে ? ও কিন্তু বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মানুষ না। ‘

এবার সানার মুখটা দেখার মত ছিল। মিস্টার কবিরের কথা শুনা মাত্র ওর মুখটা চুপসে গেলো। অপরাধী সুরে বললো ‘ সকালে মায়ের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল আর আমি অনেক বাজে..… ‘

সানাহ্কে বাকি কথাটুকু আর বলতে দিলেন না মিস্টার কবির। তার আগেই সানাহ্কে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বললেন ‘ আমি আর কিছু শুনতে চাচ্ছি না। আমি জানিনা তোমাদের মা মেয়ের মধ্যে কি ঝামেলা হয়েছে আর আমি জানতে চাইছিও না। আই থিঙ্ক তুমি জানো তোমার এখন কি করা উচিত । ‘

মিস্টার কবিরের কথা শুনে সানাহ্ এবার মুখ উঠিয়ে তার দিকে তাকালো। ধীর গলায় বললো ‘ আমি জানি আমার এখন কি করা উচিৎ বাবা। আমি যাচ্ছি মাকে আনতে। ‘

‘ বাবা আমি কি আপাইয়ের সঙ্গে যাবো ? ‘ সানাহ্ যখন তার কথা বলেই সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো তখন অতসী মিস্টার কবিরের উদ্দেশ্যে কথাটা বললো।

‘ নাহ্ যার সমস্যা তাকেই মিটাতে দাও। তোমার আমার মাঝখানে বেগড়া দেওয়ার দরকার নেই। ‘ বরফ শীতল কন্ঠে বললেন মিস্টার কবির। উনার কথার বিপরীতে কেউ আর কিছু বলার সাহস পেলো না। সানাহ্ নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো। মেইন রাস্তায় উঠে ফারহানের বাড়ির উদ্দেশ্যে রিকশা নিলো।

‘ আর কত কান্নাকাটি করবি কায়নাত ? আমাকে বল কি হয়েছে। সেই থেকে তো কান্নাকাটিই করে যাচ্ছিস। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে কান্না করিস। কেন হয়েছে জিজ্ঞেস করলে কান্না করিস। তোকে তো এভাবে কান্না করতে আগে কখনও দেখিনি। সানার সঙ্গে কি আবার ঝামেলা হয়েছে ? ‘ মিসেস কায়নাতের কান্নাকাটি দেখে এবার এক প্রকার বিরক্ত হয়েই কথাগুলো বললেন মিসেস আশা। প্রিয় বান্ধবীর মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না উনি। বান্ধবীকে আগে কখনো এভাবে কাদতে দেখেননি।

মিসেস আশার কথা শুনেও কিছুই বললেন না। বরং মুখে হাত চেপে নিজের কান্না সংবরণ করার চেষ্টা করলেন। মিসেস কায়নাতের ব্যর্থ চেষ্টা দেখে তপ্ত নিশ্বাস ফেললেন মিসেস আশা। প্রিয় বান্ধবীর চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেখলেও মিসেস আশার দম বন্ধকর অনুভূতি হয়। মনে হয় এই কান্না নিজ চোখে সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।

হঠাৎ মিসেস আশার চোখে পড়লো বাড়ির মেইন গেটের বাহিরে কেউ রিকশা থেকে তাকে হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছে। মানুষটা কে নিকষ কালো অন্ধকারেও চিনতে ভুল হলো না মিসেস আশার। উনি হাত উঠিয়ে মিসেস কায়নাতের নজর এড়িয়ে দাড়িয়ে থাকার ইশারা করে মিসেস কায়নাতকে বললেন ‘ তুই এখানেই বস… আমি নীচ থেকে আসছি। কেঁদেকেটে তো গলা শুকিয়ে ফেলেছিস। আমি তোর জন্য পানি নিয়ে আসি যাতে পানি খেয়ে আবারও কাদতে পারিস। ‘

মিসেস আশার কথার জবাবে কিছুই বললেন না মিসেস কায়নাত। শুধু এক দৃষ্টিতে বাড়ির মেইন গেটের বাহিরে দাড়িয়ে থাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছায়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। উনার বান্ধবী মনে করেছেন মানুষটাকে মিসেস কায়নাত খেয়াল করেননি। কিন্তু আসলে তো উনিই সবার আগে খেয়াল করেছেন। তবে নিজে থেকে কিছু বলার ইচ্ছা হলো না বলে নীরব রইলেন।

মিসেস কায়নাতকে নীরব দেখে মিসেস আশা আর কিছু বললেন না। ধীর পায়ে নিচে চলে এলেন। নিচে এসে আগে সদর দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঢুকলো সানাহ্। সানাহ্ মিসেস আশাকে দেখে বললেন ‘ মা কোথায় ? কি অবস্থা ? ‘

‘ ভালো হয়েছে তুমি এসেছ। এসে থেকে আমার ঘরের বারান্দায় বসে কান্নাকাটি করছে। জিজ্ঞেস করছি কান্না কেন করছে কিন্তু কিছুই বলছে না। তুমি জিজ্ঞেস করলে যদি কিছু বলে। ‘

‘ আচ্ছা আমি দেখছি ‘ বলে সানাহ্ আর মিসেস আশার উত্তরের অপেক্ষা করল না। দ্রুত পায়ে সিড়ি দিয়ে উঠে গেলো। মিসেস আশা সানার যাওয়ার পথে এক পলক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। দুই দিন পরপর এরা মা মেয়ে ঝগড়া করে আর মাঝে উনি ফেঁসে যান। এইদিকে দুই মা মেয়েকে সামলানো অন্যদিকে বান্ধবীর অভিমান। অনুভূতির যাঁতাকলে পড়ে উনার চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়।

তবে এই প্রথম এরকম হলো যে ঝগড়া করে কায়নাত তার বাড়ি ছেড়েই চলে এসেছে। এর আগে কখনো এমন হয়নি। কায়নাত বরাবর অন্তর্মুখী স্বভাবের। নিজেদের বাড়ির ঝামেলা বাহিরে যেতে দেয় না।

বারান্দায় বসে বসে সন্ধ্যা বিলাস করছেন মিসেস কায়নাত। মনে পড়ছে পুরনো স্মৃতি। যখন উনার দিদি বেচেঁ ছিলেন তখন এভাবেই দুই বোন সন্ধ্যা বিলাস করতেন। সঙ্গে দুই কাপ ধোঁয়া উঠা চা যেন সন্ধ্যার আড্ডা জমিয়ে দিত। এই আড্ডা চলতো রাত বারোটা পর্যন্ত। এর মাঝে মিস্টার আফজাল আর মিস্টার কবিরও এসে যোগ দিতেন। আনন্দের ছিল সেই দিনগুলি।

আচমকা মনে হলো নরম একটা বিড়ালছানা এসে মিসেস কায়নাতের কোলে গুটিসুটি মেরে তার হালকা মেদবহুল পেট জড়িয়ে ধরে জাপটে ধরে বসেছে। মিসেস কায়নাত নীরবে বিড়ালছানা রুপি সানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মায়ের স্পর্শে অভিমানী সানাহ্ ডুকরে কেঁদে উঠলো। হেচকি তুলে কাদতে কাদতে বললো ‘ আই অ্যাম সরি মা…আমাকে মাফ করে দাও। এরকম ভুল আর করবো না। ওই সর্বনাশা জ্বর বরাবরই আমার সর্বনাশ করেছে।। আজও করলো… তোমার সঙ্গে আমাকে খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য করলো।
কিন্তু বিশ্বাস করো মা আমি অতগুলো টাকা কোনো খারাপ কাজে ব্যবহার করেনি। এমন কিছু করিনি যেটা তোমার আর বাবার সম্মান ডুবাবে। আমি যদি কারণ বলতে পারতাম তাহলে অবশ্যই বলতাম। কিন্তু আই প্রমিজ মা, আর এরকম রাগারাগি করবো না। তোমাকে বাজে কথা বলবো না। আই সয়ের মা… ‘

‘ তোর জ্বর এসেছে আর আমাকে বললি না ? একবার বললে কি আজ এত বড় ঝামেলা হতো ? তোর আর আমার মধ্যে এত বড় দাঙ্গা হতই না। ‘ সানার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন মিসেস কায়নাত।

‘ তুমি সবসময়ই আমাকে নিয়ে টেনশনে থাকো। এখন আবার নতুন করে আমার বিয়ের টেনশন। কয়েকদিনের মধ্যেই মামা মামী ওরা আসবে। ওদের সবাইকে দেখাশুনা করার টেনশন। তাই আর নতুন করে জ্বরের কথা বলে তোমাকে টেনশনে ফেলতে চাইনি। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি মা… অনেক। ইউ ক্যান্ট ইভেন ইমাজিন হাউ মাচ আই লাভ ইউ। ‘ সানাহ্ মিসেস কায়নাতকে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে বললো।

‘ সবসময় জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না সানাহ্। মা এমন একজন মানুষ যে সন্তানকে জন্ম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বহু কষ্টে সন্তানকে বড়ও করে। দিদি তোর জন্মদাত্রী মা কিন্তু আমি তোর পালনকর্তা মা। দিদি তোকে জন্ম দিলেও আমি কিন্তু তোকে বড় করেছি। আবার আমি তোকে বড় করলেও দিদি তোকে জন্ম দিয়েছে। তাই তোর জীবনে আমাদের দুজনেরই মূল্য সমান হওয়া উচিত। দিদি তোর জন্মদাত্রী মা বলে আমাকে তোর মাসী বলে মা হওয়ার অধিকার থেকে অবহেলা করতে পারিস না।

দিদি তোর কাছে যেরকম মা হওয়ার দাবিদার তেমনই আমিও। আর মায়ের কাছেও সন্তানের থেকে বড় কেউ না।।আমার মাথায় যতই অন্য কিছু নিয়ে টেনশন থাকুক না কেন আমার ফার্স্ট প্রায়ওরিটি সবসময় তুই আর অতসী। তোরা দুজনেই আমার সন্তান। কিন্তু তুই আমার বড় সন্তান…আমার বড় মেয়ে। কাজেই তোর কাছে আমার এক্সপেক্টেশন বেশি। তোর প্রতি আমার ভালবাসার প্রকাশও বেশি। আমি কোনোদিনই চাইবো না আমার কোনো সন্তান তাদের ভুলে বিপদে পড়ুক। ‘ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে যেন নিজেকে ভারমুক্ত মনে করলেন মিসেস কায়নাত। অনেক দিনের বোঝা নেমে গেছে উনার বুক থেকে।

‘ আই নো মা। আই অ্যাম ভেরি ভেরি সরি ফর হার্টিং ইউ। প্লিজ ফর্গিভ মি ফর দিস টাইম,প্লিজ। আই উইল নট হার্ট ইউ নেক্সট টাইম। আই সয়ের মা। প্লিজ বাড়ি চলো মা…… বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, অতসী অপেক্ষা করছে আর……আর আমি অপেক্ষা করছি মা। ‘ শেষের কথাগুলো খানিকটা থেমেই বললো সানাহ্।

সানার কথা শুনে মুচকি হাসলেন মিসেস কায়নাত। মুখ নত করে সানার আলগোছে বেধে থাকা চুলে ঠোঁট বুলিয়ে দিলেন। তারপর আবার সানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।এবার উনি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরবেন..…নিজের বাড়িতে।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#প্রেমমানিশা(২৯)

‘ তুই না বলেছিলি বাড়ি ফিরবি না ? তাহলে এখন আবার বাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল হয়েছিস কেন ? এত তাড়াতাড়ি কান্নাকাটি বন্ধ ? আমি ভেবেছিলাম তুই আরও কিছুক্ষণ কাদবি… ‘ মিসেস আশা হতবাক হয়ে হাস্যরত মিসেস কায়নাতকে দেখে বললেন কথাগুলো।
মিসেস আশার কথা শুনে মিটমিটিয়ে হাসলেন মিসেস কায়নাত। ধীর গলায় বললেন ‘ মা মেয়ের সিক্রেট… তুই বুঝবি না ‘।

মিসেস কায়নাতের কথা শুনে মিসেস আশা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো এটা বলবিই… বিয়ের পর যখন আমার মেয়েকে আমি বাড়ি আনবো তখন আমাদেরও সিক্রেট কথা থাকবে। তখন তোকে ওই কথা বলবো না। ‘

মিসেস আশার কথা শুনে মিসেস কায়নাত বললেন ‘ বলিস না.. আমি তোদের সিক্রেট কথা শুনতে চাইবো না। ‘

ব্যাস ঘটে গেলো পিনপতন নীরবতা। দুই বান্ধবীর কেউই যেন কথা বলার শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে কথা বলার জন্য কোনো উপযুক্ত বিষয় খুজে না পেয়ে দুজনেই কুলুপ এঁটে দাড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর সানাহ্কে বাড়ির বড় লোহার গেট পেরিয়ে ভিতরে আসতে দেখা গেলো। সে বেরিয়েছিল বাড়ি ফেরার জন্য রিকশা ঠিক করতে।

মেয়ের অপেক্ষায় ঠাকুর বাড়ির সদর দরজর বাইরে উচুঁ জায়গায় দাড়িয়েছিলেন মিসেস কায়নাত। মেয়েকে আসতে দেখে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘ রিকশা পেয়েছিস ? ‘

‘ হ্যাঁ মা পেয়েছি..…তুমি গিয়ে উঠো। আমি আন্টির সঙ্গে কথা বলে আসছি। ‘

মিসেস কায়নাত আর মেয়ের কথায় দ্বিমত করলেন না। ধীর লয়ে এগিয়ে গেলেন। মিসেস কায়নাত প্রস্থান করতেই সানাহ্ মিসেস আশার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার সুরে বলল ‘ থ্যাংক ইউ আন্টি মাকে সামলানোর জন্য। তুমি ছিলে বলেই মা এত দ্রুত রাজি হয়ে গেল। সত্যি বলতে তুমি যা করলে তারপর তোমাকে ধন্যবাদ বললেও তোমাকে ছোটো করা হয়। তোমাকে ভাষায় ধন্যবাদ জানানোর ভাষা জ্ঞান আমার নেই। বাট আই অ্যাম রিয়েলি অউফুল টু ইউ ‘

সানার কথা শুনে আলতো হাসলেন মিসেস আশা। সানার নরম হাত জোড়া নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন ‘ সানাহ্ আমি জানি তুমি ইন্টেলিজেন্ট। সবকিছু মাথা খাটিয়ে বোঝাতে তুমি এক্সপার্ট। তাই তোমাকে বলছি। কথার তীর আর ধনুকের তীর একবার ছুঁড়ে দিলে সেটা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। তাই নিজের বিপরীতে থাকা মানুষটাকে কিছু বলার আগে হাজারবার ভেবেচিন্তে তারপর বলবে। কায়নাত তোমার মা, মাসী নয়। সে তোমার ভালো চায়… তার মতো ভালোবাসতে তোমাকে আর কেউ পারবে না। আমি কি আমার কথা তোমাকে বুঝাতে পেরেছি ? ‘

মিসেস আশার কথায় সানাহ্ আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিল যেন সে মিসেস আশার কথার মানে বুঝতে পেরেছে। অতঃপর মিসেস আশার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মায়ের সঙ্গে রিকশায় করে বেরিয়ে পড়লো। হঠাৎ মিসেস কায়নাত বলে উঠলেন ‘ সানাহ্ উনাকে বল রিকশা ঘুরাতে ‘

মায়ের কথার মানে বুঝতে না পেরে সানাহ্ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘ কেন মা ? ‘

‘ আজ দুই মা মেয়ে রাতের ঢাকা শহর ঘুরে দেখবো। তুই ঘুরতে চাস না আমার সঙ্গে ? ‘

সানাহ্ ওর মায়ের কথায় মুচকি হাসলো। রিকশাওয়ালাকে ডেকে বললো রিকশা ঘুরিয়ে নিতে। তারপর সানাহ্ আদুরে বিড়ালের মতো মিসেস কায়নাতের বাম হাত জড়িয়ে তার কাধে মাথা রাখলো। অন্ধকারে মিসেস কায়নাত নিঃশব্দে হাসলেন।

—-

এত বড় ঘরের মাঝেও দ্রুত পা চালাতে গিয়ে বারবার হোচট খাচ্ছে সানাহ্। তবে তবুও তার শিক্ষা নেই। দ্রুত পায়ে যেন ঘরে ছুটছে না দৌড়চ্ছে। সানার এত তাড়াহুড়ো করার পিছনে কারণ আছে। আজ টানা পাঁচদিন ক্লাস স্কিপ করার পর আবারও ভার্সিটি যাচ্ছে। এতদিন তো জ্বরের প্রকোপেই যেতে পারলো না। এতদিন পর যখন যাচ্ছে তখন তো লেট হয়ে গেলে সমস্যা।

এমনিতেই বাড়িতে ঝামেলার শেষ নেই। কাল আবার সানার বড় মামা,মেঝ মামা, মেঝ মামী আর ছোটো মামা এসেছে। শায়খ আসার পর সানাহ্কে আর পায় কে। ফারহান হাজার ফোন দেওয়ার পরও দুদন্ড ফারহানের ফোন ধরার সময় পায়নি শুধুমাত্র তার প্রিয় মামার সঙ্গে কথা বলবে বলে। এ নিয়ে অবশ্য ফারহান এক চোট রাগারাগিও করেছে কিন্তু কাল শেষ রাতে সানাহ্ তাকে ফোন করে ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে রাগ ভাঙিয়ে নিয়েছে। আবার এটাও বুঝিয়ে দিয়েছে তার জীবনে তার মামার জায়গা কোথায়।

সানাহ্ তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো। সানাহ্কে বের হতে দেখে মিসেস কায়নাত বললেন ‘ সানাহ্ দুই মিনিট দাড়া..… ব্রেকফাস্ট করে যা। ‘

‘ না মা আজ সময় নেই। আমি ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিবো..… ক্লাসে যেতে লেট হলে আমার এথিক্স রুল ব্রেক করবে। ‘ সানাহ্ দ্রুত পায়ে সদর দরজার দিকে যেতে যেতে বলল।

‘ এই দাড়া..… রিকশায় খুঁজতে গেলে দেরী হবে। আমি তোকে গাড়ি করে দিয়ে আসছি ‘ বলে শায়খ তার হাতে থাকা ফোনটা জিন্সের পকেটে ঢুকিয়ে পা চালাল।

শায়খের কথা শুনে সানাহ্ একবার বাম হাতের কব্জিতে থাকা কালো ঘড়ির ডায়ালে চোখ বুলিয়ে নিলো। নাহ্ এখনও বেশি দেরী হয়নি তবে সানাহ্ কৌশলে বলল ‘ তাড়াতাড়ি করো মামা…. দেরী হলে সমস্যা হয়ে যাবে। ‘

‘ সানাহ্ বাড়ি ফিরতে সময় একেবারে ফারহানের সঙ্গে বিয়ের শপিংটা করে ফিরিস। তোদের বিয়ের আর মাত্র তিনদিন বাকি। আজ শপিং না করলে আর সময় হয়ে উঠবে না। কাল আবার টগরের মেয়ের(আশা আর কায়নাতের ছোটবেলার বান্ধবীর মেয়ে) বিয়েতে যেতে হবে। পরশু তোর আর ফারহানের এনগেজমেন্ট। হাতে একেবারেই সময় নেই। ‘ সানাহ্ আর শায়খকে বের হতে দেখে এগিয়ে এসে বললেন মিসেস কায়নাত।

সানাহ্ তার মায়ের কথায় দ্বিমত করলো না। নীরবে মাথা নেড়ে ওর ছোটো মামার সঙ্গে বেরিয়ে গেল। বর্তমানে ওরা গাড়িতে। গাড়ি যাচ্ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটির দিকে।

‘ বিয়ের পরই তো অনার্স ফাইনাল। অনার্সের পর কি করার ইচ্ছা আছে ? মাস্টার্স কি শেষ করবি ? ‘

সানাহ্ নীরবে জানালার পাশে সিটের গাঁয়ে হেলান দিয়ে জানালার বাহিরের দৃশ্য দেখছিল।সবকিছু যেন তাদের অদৃশ্য গতি পেয়েছে। নিজেদের মতো ছুটে চলেছে। স্থির জিনিসও গতিশীল হয়েছে।

সানাহ্ ছোটবেলায় গাড়ি করে বের হওয়ার সময় জানালার বাইরের দৃশ্য দেখে এটাই ভাবত যে সে গাড়িতে উঠলেই সবকিছু জাদুবলে তার অদৃশ্য গতি ফিরে পায়। আর ছোটবেলার সেই ধারণা এখনও সানার মনে রয়ে গেছে। এখনও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হওয়ার পরও মাঝে মাঝে এসব মনে পড়ে।

হঠাৎ শায়খের কথা শুনে তার দিকে ফিরে বসলো সানাহ্। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো ‘ অনার্স শেষ করার পর আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই মাস্টার্স করে নিবো। ‘

‘ তাহলে তোর ফরেইন ভিসার কি হবে ? তুই না ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে এপ্লাই করেছিস ? ‘ শায়খ ড্রাইভ করতে করতেই অবাক হয়ে বললো।

‘ ভিসা এপ্লাই করলেই যে ভিসা পেয়ে যাবো কে বললো ? সবাই কি ভিসার জন্য এপ্লাই করলেই ভিসা পায় ? কই মেঝ মামা যে এপ্লাই করলো সে তো পায়নি । তাহলে আমিও যে পাবো তার কোনো গ্যারান্টি নেই। ‘

‘ আরে তার ব্যাপার তো আলাদা। মেঝ দাদু (মিস্টার আমান) এপ্লাই করেছিল কিন্তু দাদু তখন ম্যারিড ছিল আর পাসপোর্ট ছিল যখন সে আনম্যারিড ছিল তখনকার। তাই হয়নি তাছাড়া মেঝ দাদুর তো প্রবল ইচ্ছাশক্তি ছিলনা। তোর তো আর এইসব প্রবলেম নেই। তোর পাসপোর্ট ঠিক করতে দেওয়া হয়েছে বিয়ের কারণে। তাছাড়া তোর তো ইচ্ছা ছিল ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে পড়ার তাইনা ? ‘

‘ মানুষ পরিস্থিতির শিকার। পরিস্থিতির যাঁতাকলে পড়ে মানুষ নিজের আপনজনদের প্রতি মায়া বিসর্জন দিতে পারে আর আমি তো শুধু স্বপ্ন বিসর্জন দিবো। আমি ফারহানকে আর আন্টিকে ছেড়ে যেতে চাই না। ‘ সানাহ্ শান্ত গলায় বললো।

‘ আমি জানিনা তুই এসব কি বলছিস কিন্তু আমি তোর অমতে কিছুই বলবো না। এটা তোর লাইফ তাই তোর রুলস। তোর ক্যারিয়ার তাই তুই যেটা চাইবি তাই হবে। আর কয়েকদিন পর তোদের বিয়ে তাই এসব নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। ‘ শায়খ মৃদু হেসে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বললো।

—-

‘ এই অতস!!! কি হয়েছে ? আজকাল এত অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড কেন থাকিস ? তোর সমস্যা কি ? ‘ জানালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অতসীর গাঁয়ে জোরে ঠেলা দিয়ে বললো আসাদ।

‘ ঠিক বলেছিস তুই। আজকাল প্রায়ই ওকে ক্লাসে ঘুমোতে দেখি। এই অতস তোর কি হয়েছে বল তো ? ‘ অবনি বললো।

আসাদের ধাক্কায় অতসী তার ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এলো। আড়মোড়া ভেঙে খানিকটা নড়েচড়ে বসলো। আসাদ আর অবনির কথা শুনে ওদের দেখিয়ে হাত ঝাড়ি দিয়ে বললো ‘ কি হবে ? কিছুই হয়নি….বাড়িতে আপাইয়ের বিয়ের ধুম লেগেছে। দিনরাত মা ছুটাছুটি করছে। একমাত্র বোনের বিয়ে তাই আমারও কাজ করতে হচ্ছে। আবার মামা মামী ওরাও এসেছে। মূলত আড্ডা,কাজ এসবের কারণেই ঘুম হচ্ছে না। ও সিরিয়াস কিছু না…. ‘

‘ তোর আপাইয়ের বিয়ের আর কয়দিন বাকি রে ? আমরা যেতে পারবো তো নাকি ? আমাদের দেখলে সানাহ্ আপু যেভাবে লাফিয়ে উঠে। দেখলেই তো আমার মনটা লাফালাফি করে। ইস তোর আপুটা তোর বড় না হয়ে ছোটো হলে কত ভালো হতো বলতো। আমার এই তেইশ বছরের জীবনে ওয়ান অ্যান্ড অনলি ক্রাশ অথচ ওরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ‘ আসাদ আফসোসের সুরে বলল।

‘ হুম তোর ক্রাশের কাথায় আগুন। ও তোর ছোটো হলেও তোর সঙ্গে ওর মিল হতো না। ফারহান ভাই আর আপাই একে অপরের ভূমিতব্য। ওরা একে অপরের ভাগ্যে ছিল তাই ওরা এক হচ্ছে। এখানে তোর,আমার কিছু করার নেই। ‘ অতসী আসাদকে ভেংচি কেটে বললো।

‘ হয়েছে হয়েছে বুঝেছি। তুই আসলে বন্ধু রুপি শত্রু তাই বন্ধুর সুখ তোর সহ্য হয়না। এই তোর নজর লেগেই সানাহ্ আপু আমার হলো না। ‘ আসাদও অতসীকে মুখ ভেংচি বললো।

‘ এ্যাহ যেই না চেহারা, নাম রাখছে পেয়ারা। একদিকে আপু ডাকছে আরেক দিকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছে। আহ্ শখ কত সিনিয়র আপুকে বিয়ে করবে!! ইহ সর সর। আমার আপাই কি তোর মত পিচ্ছি পোলারে বিয়ে করবো ? ইমপসিবল…… ‘ অতসী শূন্যে মুখ ভেংচিয়ে বললো।

‘ হয়েছে আর বলা লাগবে না। কি জিজ্ঞেস করেছিলাম আর কি বলছে । তা মহারানী আমার ক্রাশ থুড়ি বাঁশের বিয়ে আর কয়দিন পরে জানতে পারি কি ? আসলে আমি আমার ক্রাশ থুড়ি বাঁশকে বিয়েতে বউ সাজে দেখতে চাইছি। সেই কোন আমলে তোর ওরিয়েন্টেশনে দেখেছিলাম একটু শাড়ি পড়ে। মহিলা শাড়ি পড়ে আমার মন চুরি করে পালিয়েছে। ‘

‘ আর তিনদিন বাকি আছে। পরশু আপাই আর ফারহান ভাইয়ের এনগেজমেন্ট আর এর একদিন পরেই বিয়ে তারপর এক সপ্তাহের মধ্যেই অনুষ্ঠান। তোরা আসিস আপাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে। আপাই খুশি হবে। আপাই তো অবর সঙ্গে দেখা করতে আসতে চেয়েছিল কিন্তু ওই জ্বরের কারণে এতটা উইক হয়েছে যে বলার বাইরে। এই তো দুই দিন আগেও আবার জ্বর এসেছিল। আপাইয়ের এই জ্বর আমাদের নাকে দম করে রেখেছে। এখন দুলাভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। আল্লাহ জানে ভাইয়ার কি অবস্থা হবে..… ‘

‘ ওরে অতস রে অতস এইডা তুই কি শুনাইলি ? তোর আপাই আমরা গেলে খুশি হবে ? এটা শোনার পর তো এই পৃথিবীকেও স্বর্গ মনে হচ্ছে। আমি তো অবশ্যই যাবো সানাহ্ আপুর বিয়ের… ‘

অবনি তার কথা আর শেষ করতে পারলো না কারণ ততক্ষনে ক্লাসে প্রণয় ঢুকে গেছে । প্রণয় ক্লাসে ঢুকতেই প্রথমে অতসীর দিকে নজর দিল। প্রণয়কে দেখে অতসী দৌড়ে এসে নিজের নির্ধারিত সিটে বসলো। আজ অতসীর পরনে গ্রে কুর্তি অ্যান্ড ব্ল্যাক জিন্স। সঙ্গে গাঁয়ে জড়ানো সেই ডেনিম জ্যাকেট যেটা প্রণয় তার মিস ইন্ডিয়ার গাঁয়ে প্রথমবার দেখেছিল। আর গলায় গ্রেইশ ব্লু রঙের স্কার্ফ।

এক মুহূর্তের জন্য যেন প্রণয়ের চোখ সেখানেই আটকে গেলো । প্রণয় তার কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। স্থানুর মত জায়গাতেই দাড়িয়ে আছে। প্রণয়কে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে একজন স্টুডেন্ট দাড়িয়ে প্রণয়কে ডাক দিল। প্রণয় এবার চোয়াল শক্ত করে নিজের ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অতসীর দিকে শীতল দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলো। অতসী প্রণয়ের দৃষ্টির মানে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তবে প্রণয় ওর সেই দৃষ্টিকে পাত্তা দিল না। রাগী মেজাজে ক্লাসে মন দিলো।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….