প্রেমমানিশা পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
279

#প্রেমমানিশা(৩০)

‘ স্যার ‘

অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল প্রণয়। ইতিমধ্যে সকলেই বেরিয়ে পড়েছে যার যার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আজকে প্রণয়ের ক্লাসটা সবার শেষে ছিল। প্রণয় নিজের মতো ওর বই আর মার্কার নিয়ে বের হচ্ছিল এমন সময় কেউ একজন পিছন থেকে ‘ স্যার ‘ বলে ডেকে উঠলো। প্রণয় কণ্ঠস্বরের মালিক কে চিনে তাই পিছনে ফিরল না। সটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

অতসী প্রণয়কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে প্রণয়ের সামনে এসে দাড়ালো। ইনিয়ে বিনিয়ে বললো ‘ না মানে স্যার..… ‘

‘ কিছু বলার থাকলে দ্রুত বলুন মিস অতসী। আমার সময়ের মূল্য আছে। আমার সময় ফেলনা নয় ‘

প্রণয়ের কাটকাট গলায় বলা কথা শুনে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো অতসী। প্রণয়ের কাছ থেকে কখনও এরকম শক্ত গলায় কথা শুনেনি। হতবাক অতসী নিজেকে সামলে বললো ‘ আসলে স্যার আমার মনে হলো আপনি কোনো কারণে আমার উপর রেগে আছেন। আমি কি কোনো ভুল করেছি ? ‘

‘ আপনার সঙ্গে রাগারাগি করার মতো সম্পর্ক কি আমার আপনার সঙ্গে আছে ? নিজেকে এত ইম্পর্ট্যান্ট কেন মনে করেন আপনি ? কে হন আপনি আমার ? কেউ না আপনি আমার…… ‘ প্রণয় কাটকাট গলায় উত্তর দিলো।

এবার যেন অতসী আরও অবাক হলো। এ ও কাকে দেখছে ? এটা কি সেই মানুষটা যে ওর সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য এত কাকুতি মিনতি করেছে। অতসী খানিকটা ভেজা গলায় কোনোমতে ‘ ঠিক বলেছেন..… কেউ হইনা আমি আপনার। কেউ না..… ‘ বলে দৌড়ে চলে গেলো।

অতসীকে এভাবে দৌড়ে যেতে দেখে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলো প্রণয়। ওর মনের কোণে জমে থাকা সন্দেহের জট এখন ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে। প্রণয় এখন বুঝতে পারছে এতদিনের অতসীর অনুপস্থিতির কারণ।

তবে প্রণয় বরাবর প্রমাণে বিশ্বাসী তাই উপস্থিত প্রমাণ না দেখে কোনো আগাম পদক্ষেপ নিবে না। ওর ধারণা যদি ঠিক হয় তাহলে খুব শীঘ্রই ও ওর মিস ইন্ডিয়াকে ফিরে পাবে। এখন শুধু দেখার পালা মিস ইন্ডিয়া নিজে থেকে প্রণয়ের কাছে ধরা দেয় নাকি প্রণয়কে তাকে হাতেনাতে ধরতে হয়।

—-

সবেমাত্র সানার ক্লাস শেষ হয়েছে। সময়টা এখন প্রায় দুপুর। আজ আবার দুটো ক্লাস ছিল তাই তাড়াতাড়ি ছাড়া পাওয়া। তবে তাড়াতাড়ি ছাড়া পেয়েও শেষ শান্তি হলো না। সূর্য এখন মাথার উপর খাড়া হয়ে দাড়িয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে বসন্তকাল এসে গেছে।

সানাহ্ ক্লাস ছেড়ে বের হলো। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করলো। ফারহানকে ফোন দিয়ে শপিংয়ের জন্য ডেকে আনা যাক। সানাহ্ কন্টাক্ট লিস্টে ফারহানের নাম্বার খুঁজতে খুঁজতে এগোচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো কেউ ওকে ‘ সানাহ্ ‘ বলে ডাকছে।

সানাহ্ ফোনের উপর থেকে চোখ সরিয়ে আশেপাশে চোখ বুলালো। এরপরই নজর পড়ে গেলো অদূরে সামনে দাড়িয়ে থাকা ফারহানের উপর। মুহূর্তের মাঝেই সানার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ভেসে উঠলো কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী রইলো না যখন সানাহ্ দেখলো ফারহানের পাশে রিয়াশা দাড়িয়ে আছে।

ফারহান দূর থেকে সানাহ্কে হাত উঠিয়ে ডাকছে কিন্তু ফারহানের পাশে রিয়াশাকে দেখে সানার আর ফারহানের কাছে যেতে ইচ্ছা করছে না। তবুও নিজের ভিতরে থাকা কষ্টগুলো পাথর চাপা দিয়ে ঠোটের কোণে মেকি হাসি ঝুলিয়ে ফারহানের দিকে এগিয়ে গেলো সানাহ্। সানাহ্ এগিয়ে গিয়ে ফারহানের কাছে দাড়াতেই ফারহান রিয়াশার কাছ থেকে সরে এসে সানার কাছে দাড়িয়ে সানার কাধে হাত রেখে বলল ‘ হেই রিয়া মিট মাই ফিয়ন্সে …. সাইয়ারা কায়নাত সানাহ্। এ স্টুডেন্ট অফ ইংলিশ লিটারেচার ডিপার্টমেন্ট। তিনদিন পরই আমাদের বিয়ে। ‘

‘ আরে মামা তিনদিন পর তোর বিয়ে আর তুই আমাকে এখন বলতেছিস ? আমি তোর বিয়ের কথা না বললে তো তুই বলতিই না। শেষে দেখা যেত বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করে সারলে আমি জানতাম আমার বন্ধুর বিয়ে হয়েছে। এইডা তুই কি করলি ? আমারে একবার বললিও না ? বিয়ে করছিস তো করছিস তাও আবার তোর অপনেন্ট কে…. বাংলা আর ইংলিশ তো এক ঘাটে জল খায় না। ‘ রিয়াশা হাসতে হাসতে ফারহানের কাধে চাপর মেরে বললো।

রিয়াশার এরকম হম্বিতম্বি ভাব সানাহ্ তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে। মেয়েটাকে ওর একদমই ভালো লাগে না। সবসময় কেমন ফারহানের গাঁয়ে পড়া ভাব করে। এসব গাঁয়ে পড়া মেয়েদের সানাহ্ দুই চোখ কেন এক চোখেই সহ্য করতে পারেনা। এরা ওর চোখের বিষ। যদি পারতো তাহলে দুটো লাথি মেরে বিদায় করতো।

‘ আসলে একটু তাড়াহুড়োতেই আছি। বিয়ের পরপরই সানার অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা। এখন সেই কারণেই মূলত বিয়েটা আরও এক সপ্তাহ আগানো হয়েছে। যার কারণে সব দ্রুত করতে হচ্ছে। বিয়ে আমরা ঘরোয়া ভাবে করবো কিন্তু বিয়ের পর বৌভাতের অনুষ্ঠান করার প্ল্যান আছে। এখন যে যার ভাগ্যে আছে তার সঙ্গেই তো বিয়ে হবে। সানাহ্ আমার ভাগ্যে তাই তার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। বাই দা ওয়ে তুই বৌভাতে আসবি তো ? ‘ ফারহান বোকার মত মাথা চুলকিয়ে হাসতে হাসতে বললো।

‘ আরে যাবো মানে ? আমাকে তো যেতেই হবে। আখের মেরে ইয়ার কি শাদি হ্যা..… হাম না যায়ে তো ক্যাসে হোগা। হাম জারুর জায়েঙ্গে…. ‘ রিয়াশা হাসতে হাসতে বললো।

তারপর ফারহান রিয়াশার সঙ্গে আরও দুয়েক জরুরি কথা বলে রিয়াশাকে বিদায় জানিয়ে সানাহ্কে নিয়ে হাঁটা ধরলো। সানাহ্ যেন এতক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এতক্ষণ দুই বন্ধুর মধ্যে নিজেকে এলিয়েন মনে হচ্ছিল। এরা নিজেরা নিজেরা কথা বলছিল অথচ ওর দিকে খেয়ালই নেই।

‘ তো সানাহ্ আজকে কি কি শপিং করবে ? কসমেটিকস,শাড়ি,গয়না, স্টিলেটো, ব্যাগ আর…. আর কি ? চুড়ি ? ‘ ফারহান জিজ্ঞেস করলো।

‘ এতকিছু কিনার কি আছে ? আমি কি এত জিনিস বিয়েতে পড়ব ? বিয়ে তো ঘরে হবে। তাহলে এসবের দরকার কি ? আর যদি অনুষ্ঠানের জন্য কিনি তাহলে এতকিছুর কি দরকার ? আপনার কি আমাকে এক গাদা আটা ময়দা মেখে বসে থাকা সুন্দরী মনে হয় ? ‘ সানাহ্ তির্যক চোখে প্রশ্ন করলো।

‘ ওহ্ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি আবার আর পাঁচজন মেয়েদের মতো এত সাজগোজ করতে পছন্দ করো না। সিম্প্লিসিটি ইজ ইউর রুল…. ‘ ফারহান চোখ দুটো বড় বড় করে হেসে বলল।

‘ সাজলে বুঝি আপনার জন্য ভালো হতো ? আপনার ওই বান্ধবীর মত আটা ময়দা মেখে সুন্দরী হলে কি আমায় সারাদিন দেখতেন ? ‘ সানাহ্ দাতে দাত চেপে কথাগুলো বলে ধুপধাপ পায়ে ফারহানকে ফেলেই এগিয়ে গেলো।

ফারহান কিছুক্ষণ আহাম্মকের মত দাড়িয়ে রইলো। সানার কথার অর্থ তার বোধগম্য হয়নি। সানাহ্ কি কথাগুলো নরমালি বললো নাকি রেগে গিয়ে বলল সেটাই তো বুঝার অবকাশ হলো না। তার আগেই তো ধুপধাপ করে চলে গেলো। কি হলো জিনিসটা ?

সানাহ্ দাত কিরবির করতে করতে এগোচ্ছে। রাগে ওর পুরো গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। রাগে গজরাতে গজরাতে বলছে ‘ এই লোকটা এমন কেন ? ওই মেয়েকে দেখলেই আমার কথা ভুলে যায়। মেয়ে দেখলেই পুরুষ মানুষ খালি ছুকছুক করে। ঘরে বউ রেখে বাইরে মুখ দেওয়া ছেলেদের স্বভাব । এরা জীবনেও বদলাবে না।। আমিই পাগল…. উনার বদলানোর আশা করছি ‘ ইত্যাদি আরও নানান কথা বলতে বলতে সানাহ্ এগোচ্ছে।

‘ সানসাইন ‘

হঠাৎ সানার মনে হলো জাপানের গলা পেলো। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ? ওর জাপান ভাই তো ব্যবসায়ের কাজে দেশের বাইরে এখন । সে যদি ঢাকা আসতো তাহলে তো অবশ্যই জানাতো। অগত্যা ব্যাপারটা কে নিজের মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিল।

কিন্তু কিছুক্ষন পরই আবারও ডাকটা কানে ভেসে এলো সানার। এবার আর সানাহ্ চুপ থেকে পারলো না। ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাল। নজরে পড়লো ভার্সিটির বাইরে কালো মার্সিডিজ এর গাঁয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে থাকা জাপানের দিকে। দুপুরের সোনালী রোদ জাপানের চোখে মুখে আছড়ে পরে জাপানকে দিচ্ছে অপার সৌন্দর্য।

বহুদিন পর জাপানকে দেখে সানাহ্ যেন খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। এক দৌড়ে ছুটে গেলো জাপানের কাছে। অনেকটা জায়গা দৌড়ে যাওয়ায় জাপানের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে হাপিয়ে গেলো। জাপানের সামনে দাড়িয়ে দু মিনিট দাড়িয়ে জিরিয়ে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বলতে শুরু করলো ‘ জাপান ভাই তুমি সত্যিই এসেছ ? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। আরও আগে এলে না কেন ? আসার আগে আমাকে জানাওনি কেন ? আমাকে বুঝি সারপ্রাইজ দিতে এসেছ ? ‘ সানাহ্ কথাগুলো বলে আনন্দে জাপানের বাম হাত ধরে টানতে লাগলো। এই একটা মানুষকে সানার খুব পছন্দ,তার জাপান ভাই। জাপান সানার মনের কথা সানার মুখ দিয়ে বের করার আগেই বুঝে যায় বলেই সানার তাকে এত পছন্দ।

প্রত্যেক নারীর জীবনে বিশেষ একজন মানুষ থাকে যাকে সেই নারী জীবনের যেকোনো মুহূর্তে বিশ্বাস করতে পারে,ভরসা করতে পারে। তবে সানার ক্ষেত্রে সেটা ব্যতিক্রম। সানার জীবনে বিশেষ ভরসার মানুষ হলো চারজন যাদের সে জীবনের কোনো মুহূর্তে কোনো ক্রমেই অবিশ্বাস করতে পারে না। প্রথম জন ওর বাবাই মিস্টার আফজাল করিম যে তার জন্মদাতা, যে তাকে তার জীবনের দশটা বছর আগলে রেখেছে। দ্বিতীয়জন ওর ছোটো মামা শায়খ, যার সঙ্গে সে তার শৈশবের মূল্যবান সময় পার করেছে।

তৃতীয়জন ওর ফুপাতো ভাই জাপান, যে ওকে সবসময় নিজের বোনের মতো আগলে রেখেছে। জাপান কখনোই সানাহ্কে এটা বুঝতে দেয়নি যে সানার কোনো ভাই নেই। সে সানার বড় ভাইয়ের অভাব পূরণ করেছে। আর সবিশেষে চতুর্থ জন বা শেষ জন হলো সানার হবু বর ফারহান। যে তার নারী মন বুঝতে অপারগ কিন্তু নিজের সবটা দিয়ে সানাহ্কে আগলে রাখতে সক্ষম।

সানাহ্ এই চারজন মানুষকে কখনোই অবিশ্বাস করতে পারে না। হ্যাঁ হয়তো নারীর স্বভাব সুলভ রুপে সে একটু আগে ফারহানকে নিয়ে কিছু অবাস্তব কথা বলছিলো কিন্তু সে জানে ফারহান তাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকাবে না।

কিন্তু নারী মস্তিষ্ক বরাবরই প্রিয়জনদের নিয়ে ঈর্ষাপরায়ণ। প্রিয় মানুষকে তারা কখনোই অন্যের সংস্পর্শে সহ্য করতে পারে না তাইতো অকারণে রেগে যায়। রাগারাগি করে,মান অভিমান করে আর মূর্খ প্রেমিক পুরুষ তার মানে অন্য কিছু বের করে। এই কারণেই হয়তো মানুষ যত লম্বা হয় তার বুদ্ধি ততটাই হাঁটুর নিচে থাকে।

‘ আরে ব্রো রিলাক্স। একসঙ্গে এত প্রশ্ন করলে উত্তর দিবো কি করে ? আমি তোর মত এত দ্রুত উত্তর দিতে পারবো না। আমি একটা একটা করেই দিচ্ছি। তুই সময় নিয়ে শুন। সত্যিই এসেছি বলেই আমাকে নিজের সামনে দেখতে পারছিস। তোকে সারপ্রাইজ দিবো বলেই না জানিয়ে হুট করে এসেছি। এই এক সপ্তাহ ব্যবসায়ের কাজে দেশের বাইরে ছিলাম। এই কালই ফিরলাম আর দেশে ফিরেই তোর বিয়েতে চলে এলাম। এখন এতদিন না আসার খেসারত একেবারে দিবো…. একেবারে তোর বিয়ের অনুষ্ঠান অ্যাটেন্ড করে তবে যাবো। তোর দস্যু বোনের জন্য তো আসতে পারি না। এখন বাড়ি ফিরে আমাকে পেলেই ঝগড়া জুড়ে দিবে। ‘

‘ তুমি একলা এলে ? ফারাইরা এলো না যে ? ওর কি শরীর খারাপ ? ‘ সানাহ্ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো। সে আশা করেছিল ফারাইরা আসবে। কিন্তু সে আসে নি।

‘ আর বলিস না…… ওর সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হয়েছে। পরীক্ষা বলে আসতে পারছিল না বলে মন খারাপ করছিলো। পরে আমি বললাম তোর বিয়ের পর তোর শশুর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ওকে তোর সঙ্গে দেখা করিয়ে আনবো। কথাটা শুনে তার খুশি আর দেখে কে। ও তোকে অনেক পছন্দ করে। ‘ জাপান এক গাল হেসে বললো।

সানাহ্কে রেগে যেতে দেখে ওর পিছু পিছু আসছিল ফারহান। আচমকা ওকে দৌড় দিতে দেখে সে ঘাবড়ে গিয়েছিল তাই সে নিজেও দৌড়ে ছুটে এলো। কিন্তু এসেই সানাহ্কে অচেনা এক পুরুষের সঙ্গে হাসাহাসি করতে দেখে তার মনটাই বিষিয়ে গেলো। কৌতূহল হলো ছেলেটা কে জানার। নিশ্চই বিশেষ কেউ নাহলে সানাহ্ যার তার সঙ্গে হাসাহাসি করে না।

জাপানের সঙ্গে কথা বলাতে ব্যস্ত থাকলেও সানার হঠাৎ খেয়াল হলো ফারহান কোথায়। সে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ফারহানকে খুঁজলো। ফারহানকে নিজের কাছেই দাড়িয়ে থাকতে দেখে মিষ্টি হেসে জাপানকে দেখিয়ে বললো ‘ ফারহান ও আমার জাপান ভাইয়া। বলেছিলাম না ওর কথা আপনাকে। দেখলেন হুট করে আমাকে চমকে দিতে না বলেই চলে এসেছে । ব্যাপারটা সারপ্রাইজিং না ? ‘

ছেলেটা জাপান জানার পর ফারহানের মন ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যাওয়ার আর যতটুকুও বাকি ছিল তারও আশা শেষ। ফারহানের মন চাইছে সানার মতো যদি হুটহাট বেরিয়ে যেতে পারতো সব ছেড়েছুঁড়ে তাহলে তার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হতো না। তবুও নিজের বুকে ওঠা ঝড় সামলে মেকি হেসে বললো ‘ হুম অনেক সারপ্রাইজিং। তুমি,অতসী, আন্টি আর তোমার জাপান ভাই সকলেই চমকে দিতে খুব পছন্দ করো। চমকে দেওয়া তোমাদের রক্তে বইছে। ‘

ফারহানের দাতে দাত চেপে মেকি হেসে কথাগুলো বলার ধরন জাপানকে বেশ অবাক করলো। সেই সঙ্গে অসস্তিতেও ফেললো। কেবলই মনে হচ্ছে ফারহান তাকে পছন্দ করে না। তাই সে সানাহ্কে বললো ‘ মনে হয় ভাইয়া আমার হুট করে আসাটা পছন্দ করেননি। ‘

‘ নাহ্ কই ? ফারহান সেরকম ধরনের মানুষই না। উনি অনেক আন্তরিক। আমার ভাই বোনদের নিজের ভাইবোন মনে করেন। তাইনা ফারহান ? ‘ সানাহ্ এক গাল হেসে বলল।

ফারহানের মনে হলো চোখে মুখে কেউ এক বাটি চুন মেখে দিয়েছে। সানার কথা শুনে থমথমে গলায় বলল ‘ অবশ্যই তাই। আফটার অল তুমি আমার হবু বউ। তোমার ভাই বোন মানেই আমার ভাই বোন। তোমার যা তাইতো আমার। ‘

সানাহ্ ফারহানের কথায় থাকা গম্ভীর ভাব ধরতে পারলো না। বরং ফারহানের কথা শুনে মস্ত হেসে জাপানকে বললো ‘ দেখেছো বলেছিলাম না ফারহান ওরকম মানুষই নন। যাই হোক এসব কথা এখন ছাড়ো। আমরা আজকে আমাদের বিয়ের শপিং করতে যাচ্ছি আর সেখানে তুমিও যাবে আমাদের সাথে। তুমি তো জানো এত জামা কাপড়ের মধ্যে আমি নিজের জন্য কিছু পছন্দ করতে হিমশিম খাবো তাই তুমি হেল্প করলে আমার লাভ হবে। তোমার চয়েস ভালো আর আমার পছন্দের সঙ্গেও মিলে তাই কোনো প্রবলেম হবে না। ‘

‘ বলছিস ? তুই যখন বলেছিস তখন তো আর না করতে পারি না। ঠিক আছে কি আর করবো…. চল দেখি ‘ বলে জাপান নিজের গাড়ির দিকে এগোতে লাগলো।

জাপানকে ওর গাড়ির দিকে এগোতে দেখে সানাহ্ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো ‘ তুমি কি এখন আলাদা গাড়িতে যাবে ? ওহ প্লিজ তুমি এখন বলো না তাহলে কিসে যাবো। আজব তো তিনজন যখন একই জায়গায় যাচ্ছি তাহলে একসঙ্গে গেলেই হয়। আলাদা যাওয়ার কি কোনো দরকার আছে ? তুমি ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দাও। আমি শিওর আমরা সবাই একসঙ্গে গেলে ফারহান খুশি হবেন। তাইনা ? ‘

ফারহান আর কি বলবে। শুধু নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিল। জাপান সানার কথামত ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। ফারহান এবার গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সানাহ্ আর জাপানকে ওদের জায়গায় বসতে বললো।

ফারহান ভেবেছিল সানাহ্ এবার অন্তত ওর চিন জাপান ভাইয়ের সঙ্গে চিপকে থাকবে না কিন্তু ওকে নিরাশ করে সানাহ্ এবারও একই কাজ করলো। জাপানের সঙ্গে পিছনের সিটে বসার আগে একবার বললোও না যে সে পিছনে বসছে। একবারের জন্য ফারহানকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না। নিজের জাপান ভাইকে পেয়ে ফারহানকেই ভুলতে বসেছে। এটা কেমন ভালোবাসা যেখানে অন্য কাউকে পেয়ে ভালোবাসাকে ভুলে থাকা যায় ? ফারহানের উত্তর জানা নেই তাই সে বিষাদ মনে গাড়ি নিয়ে এগোলো….

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#প্রেমমানিশা(৩১)

[পর্ব: কনফেশন]

‘ আমি তো বুঝতেই পারছি না কোনটাতে আমাকে ভালো লাগে। এই যে মিস্টার কবি আর জাপান ভাই তোমরা যদি আমাকে চুস করতে হেলপ করতেই না পারো তাহলে এসেছ কেন ? আন্টি আর মাকে পাঠিয়ে দিলেই পারতে। এই বলো না কোনটাতে ভালো লাগে। ‘ সানাহ্ অধৈর্য্য হয়ে বললো।

অসীম ধৈর্য্য নিয়ে ঘন্টা দুয়েক ঘাটাঘাটি করার পর অবশেষে যখন সানার শাড়ি পছন্দ হলো তখনও সে দ্বিধায় পড়লো। এতগুলো শাড়ির মধ্যে তার দুটো পছন্দ হয়েছে আর দুটোই সেরা। কিন্তু কোনটা নিবে সেটাই বুঝতে পারছে না কারণ দুই শাড়িরই কালার কম্বিনেশন আর ডিজাইন মারাত্মক নজর কাড়া। কোনটা রেখে কোনটা নিবে সেটাই বোঝার উপায় নেই।

এমনিতেই বিয়েতে যাওয়া নিয়ে অনেক গড়িমসি করেছে। এখন যদি কোনো শাড়ি নিয়ে যেতে না পারে তাহলে ওর মায়ের ওকে মাঝ রাতে বাড়ি থেকে বের করে দিতে দুই মুহূর্ত সময় লাগবে না। কিন্তু তাই বলে তো আর বিয়ে বাড়িতে দুটো শাড়ি পড়ে যাওয়া যায় না।
সানার কথায় ফারহানের ভাবনার ছন্দপতন ঘটল। সে মুখ তুলে দেখলো সানাহ্ চিন্তিত ভঙ্গিতে দুটো শাড়ি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সানার কথায় জাপানও তার স্পেশাল কল রেখে দিল। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে এখন সানাহ্কে হেল্প না করে ফোনে কথা বললে সানাহ্ আর তার সঙ্গে কথাই বলবে না তাই সে ফোন রেখে সানার কথায় মন দিল।

– ‘ বাঙ্গি কালারেরটা তোমাকে ভালো মানাবে ‘

– ‘ হোয়াইটের মধ্যে ম্যাজেন্ডা পাড়ের শাড়িতে তোকে জোস লাগবে ‘

কথাগুলো বলেই যেন চমকে উঠলো ফারহান আর জাপান। দুজনেই একসঙ্গে ভিন্ন ধর্মী রং বলে সানাহ্কে বিপদে ফেলে দিয়েছে। ফারহানের বাঙ্গি কালারের পাকিস্তানি শিফন জর্জেট শাড়ি পছন্দ আর জাপানের হোয়াইটের মধ্যে ম্যাজেন্ডা পাড়ের ইন্ডিয়ান রাজগুরু পছন্দ। সানাহ্ পড়বে তো পড়বে কোনটা ? এক অনুষ্ঠানে দুটো শাড়ি পড়া তো সম্ভব না।

‘ যাহ বাবা দুজনে তো দুই শাড়ি বললে… এখন কি করা যায় ? এক কাজ করি…. দুটো শাড়িই নিয়ে ফেলি। জাপান ভাইয়েরটা মায়ের বান্ধবীর বিয়েতে পড়বো আর ফারহানেরটা আমাদের এনগেজমেন্টে পড়বো। এটাই ভালো হবে। ভাইয়া আপনি এগুলো প্যাকেট করেন আর সঙ্গে কিছু ডার্ক কালারের সুতির শাড়ি দেখান। ‘ বলে সানাহ্ শাড়িগুলো সেলসম্যানের দিকে এগিয়ে দিল।

সানার কথা শুনে ফারহানের রাগ হলো। সানাহ্ কেন তার জাপান ভাইয়ের পছন্দ করা শাড়ি বিয়েতে পড়বে ? ফারহানের পছন্দ করা শাড়ি পড়লে কি সমস্যা ? ফারহানের মনে হচ্ছে জেনেশুনে এখানে এসে তার কপাল পুড়িয়েছে সে। সে যদি জানত এখানে এসে এসব দেখতে হবে তাহলে কখনোই এখানে আসতে রাজি হতো না।

সানাহ্ তার মায়ের কথা মতোই বিয়েতে আর তাদের এনগেজমেন্টে পড়ার জন্য শাড়ির সঙ্গে সঙ্গে কিছু ডার্ক কালারের সুতির শাড়ি নিলো যাতে বিয়ের পর সেগুলো পড়তে পারে। এখন হয়তো যুগ বদলেছে। অনেক মেয়েরাই বিয়ের পর সেলোয়ার কামিজ পড়ে কিন্তু সানাহ্ শাড়িতেই বিবাহিত হওয়ার আনন্দ খুঁজে পায়।

সব শাড়ি কেনাকাটা শেষে এবার ওরা তিনজনে ওয়েডিং কালেকশন সাইটে ছুটলো। আনুষঙ্গিক সব তো কেনাকাটা শেষ। এখন শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য লেহেঙ্গা আর গয়না কেনা বাকি। এই দুটো জিনিস কেনা হয়ে গেলেই ওরা বাড়ি ফিরতে পারবে।

যথারীতি ওরা গিয়ে লেহেঙ্গা সিলেকশনে মন দিল। সেলসম্যান একের পর এক সব নজরকাড়া লেহেঙ্গা দেখাচ্ছে কিন্তু কোনোটাই সানার মনঃপুত হচ্ছে না। সবই ওর ভাষ্য মতে ক্যাটক্যাটে। অবশেষে জাপান এবার শ খানেক লেহেঙ্গা দেখার পর বিরক্তির চরম পর্যায়ে গিয়ে সানাহ্কে ধমক দিয়ে বললো ‘ তোর সমস্যা কি বলতো ? একটাও ভালো লাগছে না কেন ? এরকম করলে কি করে হবে ? এভাবে চললে তো বিয়ের লেহেঙ্গাই কিনা হবে না। ‘

‘ তাই বলে কি যেটা ইচ্ছা সেটা উঠিয়ে নিয়ে যাবো ? আমার দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র বিয়ে। এই বিয়েতে কি আমি নিজের পছন্দমত লেহেঙ্গা পড়তে পারবো না ? আজব কথা বলো তুমি ভাইয়া…. এই এই ওয়ান সেকেন্ড। এই যে ভাই ঐ মেরুন কালারের লেহেঙ্গা বের করুন। ওটা খুলে দেখান আমাকে ‘ জাপানের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ই সানার চোখে পড়লো একটা মেরুন কালারের লেহেঙ্গা।

লেহেঙ্গাটা সিম্পল আর গর্জিয়াসের মাঝামাঝি পর্যায়ে এবং বেশ নজরকাড়া। অনুষ্ঠানে সানার ক্যারি করতে বেশি প্রবলেম হবে না এর অল্প কারুকার্যের কারণে। ফুল লেহেঙ্গা মেরুন হলেও দুপাট্টা কিছুটা জবা ফুলের মত রঙিন। রঙের নামটা সানার ঠিক জানা নেই তবে এই লেহেঙ্গা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। ওর মামনির শখ ছিল মেয়েকে বিয়েতে মেরুন কালারের লেহেঙ্গা দিয়ে নিজ হাতে সাজাবেন কিন্তু আপসোস সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না।

অবশেষে বিয়ের লেহেঙ্গা, গয়নাগাটিসহ যাবতীয় যত ধরনের কেনাকাটি ছিল সব মিটিয়ে ওরা একটা ক্যাফেতে ঢুকলো। এর মাঝেই ফারহানের বৌভাতের সুটও কিনে ফেলা হয়েছে। সব কেনাকাটা করতে করতেই বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। পৃথিবী নিজেকে মুড়িয়েছে তমসার অন্ধকারাচ্ছন্ন চাদর গায়ে। চারপাশে নেমে এসেছে এক গভীর অন্ধকার।

‘ এই তোরা কে কোনটা খাবি বল আমি অর্ডার করছি ‘ জাপান ক্যাফের মেনু কার্ড দেখতে দেখতে বললো।

‘ আমার জন্য শুধু রাইস বোল হলেই চলবে। বাড়ি ফিরে রাতে না খেয়ে শুলে প্রবলেম আছে। ‘ সানাহ্ ওর ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে বলল।

‘ ভাইয়া আপনি কিছু নিবেন না ? ‘ সানাহ্ অর্ডার দিয়েছে কিন্তু ফারহান কিছুই বললো না দেখে জাপান ফারহানকে জিজ্ঞেস করলো।

‘ ওয়ান ক্যাপাচিনো… ‘ গম্ভির মুখে বললো ফারহান।
জাপান খানিকটা অপ্রস্তুত হলো ফারহানের ব্যবহারে। ফারহানের ব্যবহার সেই শুরু থেকেই তার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে। তবে সে কথা বাড়ালো না। ওয়েটারকে ডেকে সবার অর্ডার বলে দিলো। ওয়েটার যেতেই জাপানকে জরুরি কল অ্যাটেন্ড করতে হবে বলে সে ফোন নিয়ে ক্যাফের বাইরে চলে গেলো।

‘ আপনার কি মন খারাপ কবি সাহেব ? ‘

সানাহ্ সেই প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছে ফারহানকে আজ অন্য দিনের তুলনায় বেশি মনমরা আর গম্ভীর মনে হচ্ছে। কিন্তু সময়াভাবে আর জাপান সামনে থাকায় কিছু বলার সুযোগ পায়নি। ব্যাপারটা যতটা সম্ভব না দেখার ভান করেছে কিন্তু ফারহানের এরকম থমথমে মুখ দেখতে তার মোটেই ভালো লাগছে না। কি হয়েছে কি লোকটার ?

‘ কার ? আমার ? আমার আবার মন খারাপ হয় নাকি ? আমি কি মানুষ ? আমার মন খারাপ হওয়ার কথাই না ‘ ফারহান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো।

ফারহানের কথার ধরণেই সানার বুঝতে বাকি রইলো না ফারহান কোনো কারণে তার উপর রেগে আছে। তাই সে রাগান্বিত ফারহানকে শান্ত করার জন্য ফারহানের হাতে হাত রাখলো। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হলো। ফারহান তো শান্ত হলোই না উল্টো রাগে ঝটকা মেরে সানার কাছ থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে দাতে দাত চেপে বললো ‘ ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু টাচ মি। ইউ ডোন্ট হ্যাভ দা রাইট। ইউ হ্যাভ লস্ট ইট। একচুয়ালি তোমার আমাকে বিয়ে না করে তোমার জাপান ভাইকে বিয়ে করা উচিত। সেই তোমার জন্য পারফেক্ট। ইউ বোথ আর মেইড ফর ইচ আদার ‘

কথাগুলো বলে ফারহান এক মুহুর্ত আর সেখানে দাড়ালো না। এখন তার মাথা গরম তাই এখানে থাকলে আরও বেশি উল্টাপাল্টা কথা বলবে তাই এখান থেকে চলে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। যেই ভাবা সেই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো ফারহান।

সানাহ্ শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফারহানের যাওয়ার পথে। ফারহান আর সানার মাঝে হওয়া বাক বিতন্ডা অল্প বিস্তর অনেকের কানেই গেছে বলে তারা নিজেদের খাওয়া দাওয়া, আড্ডা ছেড়ে সানার দিকে তাকিয়ে আছে। সানাহ্ একবার ঝাপসা চোখে আশেপাশে তাকিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লো। চোখ দুটোর কার্নিশে জমা হওয়া অশ্রু মুছে চেয়ারের গাঁয়ে হেলান দিয়ে কপাল হাত ঠেকিয়ে বসে রইলো।

‘ একি ফারহান ভাই কোথায় ? ‘

ইমার্জেন্সী কল অ্যাটেন্ড করে ফিরতেই জাপান লক্ষ্য করলো ফারহানের জায়গাটা শুন্য অথচ দশ মিনিট আগেও এখানে ফারহান ছিল। কিন্তু এই দশ মিনিটে যে কি ঘটেছে তার তো কিছুই জানা নেই জাপানের। জাপানের কথা শুনে সোজা হয়ে বসলো সানাহ্। স্বাভাবিক গলায় বললো ‘ উনার একটা ইমার্জেন্সী কাজ পড়ে গেছে। তাই আমাকে বলেই চলে গেলেন। তোমাকে জানিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমিই বলেছি আমি জানিয়ে দিবো তোমাকে। ‘

জাপান আর কথা বাড়ালো না। অতঃপর ওরা দুজনে খাওয়া দাওয়া করে বাড়ির পথে রওনা দিলো। জাপান এবার বেশ অবাক হলো সানার ব্যবহারে। আসতে সময় সানাহ্ তার সঙ্গে যত কথা বলেছিল তার একশো ভাগের এক ভাগও ফিরতে পথে বলেনি। কিছু কি হয়েছে ? জাপানের জানা নেই।

বাড়ি ফিরে শপিংয়ের ব্যাগগুলো মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সানাহ্ সোজা উপরে নিজের ঘরে চলে গেল। সকলে বেশ অবাক হলো সানার ব্যবহারে। সানাহ্কে দেখতে মিসেস আশা এসেছিলাম কিন্তু যার সঙ্গে দেখা করতে এলেন সেই তার দিকে ফিরে তাকালো না। হয়তো সারাদিন দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত হয়ে গেছে তাই কেউ আর ব্যাপারটাকে বিশেষ পাত্তা দিল না।

ঘরে ফিরেই কাধের ব্যাগটা তার জায়গামতো রেখে জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো সানাহ্। তার মাথা প্রচন্ড ধরেছে। মনে হচ্ছে এক মুহূর্তও সে দাড়াতে পারবে না। মাইগ্রেনের ইফেক্ট। সানাহ্ কোনোমতে গোসল সেরে বেরিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ঘুমের ওষুধ নিয়ে খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ওষুধের প্রভাবে সানার চোখ জুড়িয়ে আসছে। একবার মনে হলো দরজার লক লাগিয়েছে কিনা। কিন্তু ঘুমের ওষুধের প্রভাবে উঠে গিয়ে লক লাগানোর মতো শক্তি সানার নেই।

ঘুম ভেঙে নিজেকে অন্ধকার ঘরেই আবিষ্কার করলো। প্রথমে মিনিট দুয়েক কোথায় এসে বুঝতে সময় লাগলো। কিছুক্ষণ পরই টের পেলো ও ওর ঘরেই আছে আর ভোরের আলো এখনও ফুটেনি। কিন্তু কি অদ্ভুত… ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পরও সানার ঘুম এত তাড়াতাড়ি ভেঙে গেলো ? এটা কি আদৌ সম্ভব ? সানাহ্ জানেনা তবে কাল রাতে বেকায়দায় ঘুমানোর কারণে গা গতর সব ব্যথায় টনটন করছে। মাথাটাও বেশ ভার ভার লাগছে।

শরীরে শক্তি নেই তবুও কোনোমতে নিজেকে সামলে উঠে বসলো সানাহ্। পা দুটো টেনে নিয়ে করিডোরের সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। ড্রয়িং রুমে শূন্যতা বিরাজ করছে। এত সকালে কেউই থাকার কথা না। সানাহ্ ধীরে ধীরে রান্নাঘরে গেলো। এক কাপ স্ট্রং ব্ল্যাক কফি বানিয়ে বাড়ির বাইরে বাগানে এসে দাঁড়ালো।

কফির কাপে চুমুক দিতেই শরীরটা যেন চাঙ্গা হয়ে উঠলো।। সানার এখন এক মুহূর্তের জন্য কফি খেয়ে মনে হচ্ছে এই কফি ওর শরীর এবং মস্তিষ্ক দুটোই চাঙ্গা করেছে। মস্তিষ্কের সকল জট খুলে গেছে। কালকে রাতের লম্বা ঘুম আর আজকে সকালের স্ট্রং কফি দুইই তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছে ফারহানের সঙ্গে ঝামেলা মিটানোর। সে জানে তাকে কি করতে হবে। সানাহ্ বাঁকা হেসে কফির কাপে আরেক চুমুক বসালো। মেজাজটা তার এখন ফুরফুরে।

ব্যালকনিতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আদা কুচি দিয়ে চা খাচ্ছে ফারহান। কাল সারারাত ঘুম হয়নি তার। এই একরাত না ঘুমিয়েই তার এই অবস্থা আর সানাহ্ যে প্রায়ই ঘুমাতে পারেনা তখন তার কি অবস্থা হয় গড নোজ। সকাল সকাল চা খেতে তার বেশ ভালই লাগছে। মেজাজটা তো ফুরফুরে লাগছেই সেই সঙ্গে কালকে নিজের করা ভুলের প্রতি অনুতাপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কাল ওভাবে রিয়েক্ট না করলেই পারতো।

হঠাৎ মনে হলো ঘরে ফারহানের ফোন বাজছে। ফারহান হাতের কফি মগটা রেলিংয়ের কিনারে রেখে ঘরে দৌড় দিল। ঘরে পৌঁছতে পৌঁছতে ফোন একবার কেটে গেলেও আবার কলদাতা ফোন দিল। ফারহান ফোন হাতে নিয়ে দেখলো স্ক্রিনে সানার নাম জ্বলজ্বল করছে। স্ক্রিনে সানার এক হাস্যোজ্জ্বল ছবি যেটা তারা সিলেটে মাধবপুর লেকে তুলেছিল। ফারহান যেন এক মুহূর্তের জন্য তার হার্টবিট মিস করলো।

কিয়ৎকাল পরে নিজেকে সামলে ফোন রিসিভ করলো। ফোন কানে দিতে না দিতেই ওই পাশ থেকে গম্ভীর স্বরে সানাহ্ বলে উঠলো ‘ সময় তিরিশ মিনিট। সিলেটগামী ট্রেন সাড়ে আটটায় ছাড়বে আর এখন বাজে আটটা। চাইলে শেষবারের মতো দেখা করতে পারেন। আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো। ‘

কথাটা বলে এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলো না সানাহ্। ফোন হুট করে কেটে দিল আর ফারহানকে কিছুই বলার সুযোগ দিলো না। ফারহান মিনিট কয়েক থম মেরে রইলো। পরিস্থিতি তার অর্থ বোঝাতেই ফারহান ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল ঘরের বাইরে ।

ফারহানের গাড়িটা দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে স্টেশনের দিকে। স্টেশন বাড়ি থেকে প্রায় তিরিশ মিনিটের দূরত্বে কিন্তু এই তিরিশ মিনিটও ফারহানের কাছে পাহাড় সমান দূরত্ব মনে হচ্ছে। তিরিশ মিনিটের আগে পৌঁছতে না পারলে ফারহান তার সানাহ্কে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে কিন্তু সে যে চেয়েছিল সানাহ্কে সবসময়ের জন্য নিজের করতে। তার সেই ইচ্ছার কি হবে ?

ফারহান ড্রাইভ করছে আর বারবার ঘড়ি দেখছে। ঘড়িতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি কিন্তু তার মন বারবার বলছে সানাহ্ কিছুতেই তাকে ছেড়ে যেতে পারে না। তবে কি সানাহ্ তার সঙ্গে মজা করছে ? মজা করে থাকলে এটা খুব খারাপ ধরনের মজা। সবকিছু নিয়ে মজা করা যায় না। অন্তত ফারহানের মন নিয়ে তো একেবারেই নয়।

স্টেশনে পৌঁছতেই গাড়ি ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল ফারহান। দৌড়ে ঢুকলো জনলোক পূর্ণ স্টেশনে। সকাল সাড়ে আটটার সময়টা অন্যদের জন্য অনেক সকাল হলেও স্টেশনের জন্য এই সময়টা দুপুরের মতোই ব্যস্ততা পূর্ণ সময়। লোকজন আসছে যাচ্ছে আর কেউ কেউ ট্রেনের অপেক্ষা বসে আছে। ফারহান দৌড়ে টিকেট কাউন্টারের সামনে গেলো। টিকেট কাউন্টারে বসে থাকা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো ‘ সিলেটের ট্রেন কি বেরিয়ে গেছে ? ‘

লোকটা ফারহানের কথা শুনে নিজের হাতে থাকা ঘড়িতে চোখ বুলালো। এরপর ফারহানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে সামনের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললো ‘ ওই তো যাচ্ছে তো ‘। ফারহান লোকটার ইশারা অনুসরণ করে সামনের দিকে নজর দিল। ওহ মাই গুডনেস…. একি ট্রেন তো বেরিয়ে যাচ্ছে। ফারহান দৌড়তে লাগলো ট্রেনের পিছু পিছু কিন্তু ধীর গতির ট্রেন যেন আজ তার অদৃশ্য গতি পেয়েছে, ছুটছে বুলেটের মত।

ফারহানকে দৌড়তে দেখে আশেপাশে থাকা সকলেই নিজেদের কাজ থামিয়ে ওর দিকে নজর দিল। ট্রেনে যারা ছিল তারাও একে একে মাথা বের করে ফারহানকে দেখতে লাগলো। মেয়েরা তো ফারহানকে দেখেই উত্তেজনায় বেহুঁশ হওয়ার জোগাড়।

ফারহান যার জন্য এত রাস্তা ছুটে এলো সেই অপেক্ষা করলো না তার জন্য অথচ সে বলেছিল অপেক্ষা করবে। আপসোস ট্রেন বেরিয়ে গেছে। ফারহান যেন হাঁটার শক্তি হারিয়েছে। সে ধপ করে পাশে থাকা বেঞ্চে বসে পড়লো। ওর পুরো শরীর অসার হয়ে আসছে। হাত পা কাপছে মৃদুমন্দ।

‘ আমি তো ভেবেছিলাম আপনার বুঝি আমার উপর থেকে মন উঠে গেছে তাই আপনি আসবেন না। কিন্তু আপনি আমাকে ভুল প্রমাণ করলেন। আপনি এখনও আগের মতই আছে। চঞ্চল আর অস্থির ধরনের মানুষ। ‘

হঠাৎ মনে হলো ফারহানের শরীর তীব্র ঝাকুনি দিয়ে উঠলো। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আগের বলা কথাগুলোর মালিককে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর তাকে পেয়েও গেলো। অবিশ্বাস্য হলেও সানাহ্ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার তৃপ্তির হাসি যেন কতদিন পর হাসছে। ফারহানের মনে হলো সে আবার সানার হাসির প্রেমে পরে গেছে। কেমন এক দম্বন্ধকর অনুভূতি হচ্ছে। তবে কি এটাই তার প্রেমে পড়ার লক্ষণ ? প্রেমে পড়ে তার পতন হচ্ছে বলেই একে প্রেমে পড়া বলে। তবে সে এই দমবন্ধকর অনুভূতিকে আপন করতে চায় সানার প্রেমে পড়ে।

সানাহ্ হাসছে তার ঠোঁট বাঁকিয়ে। কি অকৃত্রিম সেই হাসি অথচ ফারহানের গা জ্বালা করছে, দম বন্ধ লাগছে। ইচ্ছা করছে দৌড়ে গিয়ে বদমাশ মেয়েটাকে দুটো কষিয়ে মারতে। এতক্ষণ ওকে পাগলের মতো ছুটিয়ে এখন হাসা হচ্ছে ? তবে ফারহান অতি কষ্টে নিজেকে সামলে রাখলো। এতজন মানুষের সামনে ভুলভাল কিছু করে ভালোবাসার মানুষটার অসম্মান সে করবে না। এমনিতেই কাল কম কিছু হয়নি।

উপায়ান্তর না পেয়ে ফারহান তার রাগ প্রশমিত করতে সানাহ্কে ফেলেই হাঁটা শুরু করলো। ফারহানকে চলে যেতে দেখে সানাহ্ দ্রুত ফারহানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করলো। ফারহানকে বললো ‘ এই এই আপনি আমাকে ফেলে যাচ্ছেন কেন ? আমাকে নিতে এলেন অথচ আমাকে ফেলেই চলে যাচ্ছেন ? আমার দোষটা তো বলে যান… ‘

‘ আমি বুঝিনা তোমার এত সবাইকে চমকে দিতে হবে কেন ? এক আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহ কি তোমাকেই সবাইকে চমকে দেওয়ার কাজ দিয়েছে ? তুমি ছাড়া আর কেউ কি চমকে দিতে পারে না ? তোমারই কেন সবসময় চমকে দিতে হবে ? হোয়াই ? হোয়াই ? ‘ ফারহান সানার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো।

‘ আরে ধুর এবার আমি আপনাকে চমকে দিলাম কোথায় ? উল্টো আপনি আমাকে কাল চমকে দিলেন। রেগে চলে গেলেন শুধু কারণে। গেলেন তো গেলেন এটা বলে গেলেন যেন আমি জাপান ভাইকে বিয়ে করে নেই। না মানে এটার কোনো মানে হলো ? আমি কোন দুঃখে ভাইয়াকে বিয়ে করবো ? আর কিভাবেই বা বিয়ে করবো ? একে তো আমি কখনও ওকে বড় ভাই ছাড়া অন্য কোনো চোখে দেখিনি। দ্বিতীয়ত ও তো অলরেডি এনগেজড। ওর এনগেজমেন্ট আমাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার আগেই হয়ে গেছে। ওর ফিয়ন্সে কে আমি চিনি। ভীষণ মিষ্টি মেয়ে তবে আমার চাইতেও ছোট এই যা। ‘ সানাহ্ ঠোঁট উল্টিয়ে ফারহানের পিছু পিছু হাটতে হাটতে বললো।

এবার যেন সানার কথা শুনে ফারহান বড়সর এক ৪৪০ ভোল্টের শক খেলো। যেই ছেলের সঙ্গে সানাহ্কে দেখে সে রেগে ফায়ার সেই ছেলে এনগেজড!! এত বড় একটা ভুল ফারহান কি করে করলো। মানুষ চিনতে ভুল করলো ? সানাহ্ আর জাপানের মধ্যে থাকা সম্পর্ক চিনতে ভুল করলো ? ভাগ্যিস রাগের মাথায় সানাহ্কে উল্টাপাল্টা আর কিছু বলেনি নাহলে আজ আর তার মুখ দেখতে হতো না। মেয়েটা ওর রাগ ভাঙাতে না এসে উল্টো ওকেই সাড়াশি নিয়ে তাড়া করতো।

ফারহানকে চুপ করে যেতে দেখে পা চালিয়ে এগিয়ে এলো সানাহ্। ফারহানের ডান হাতের ভাজে নিজের বাম হাত পুড়ে দিয়ে বললো ‘ এই যে আজ এই হাতটা ধরলাম…. এই হাত জীবনের কোনো মুহূর্তে ছাড়বো না কারণ আমি জানি আপনি আমার। আমাদের মধ্যে রাগ হবে, ঝগড়া হবে, মারামারিও হবে কিন্তু বিচ্ছেদ হবে না। ‘

ফারহান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সানার দিকে। আজ সানাহ্কে তার অদ্ভুত ঠেকছে। এই সানাহ্কে সে চিনে না। যেই সানাহ্ তার দিকে ফিরে একটা শব্দ খরচ করতো না আজ সেই সানাহ্ই তাকে এতকিছু বলছে। ফারহানের বিশ্বাস হচ্ছে না। ফারহান নিজেকে সামলে সানার দিকে ঝুঁকে এলো। সানাহ্ শুধু চুপচাপ ওর কার্যকলাপ দেখছে।

ফারহান খানিকটা ঝুঁকে সানার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো ‘ এই জীবনে মনে হয় ভালোবাসার মতো অঘটন ঘটিয়েই ফেলেছি সানাহ্। অজান্তেই তোমাকে ভালোবেসেছি, তোমার বিরহে পুড়েছি এবং তোমাকে দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়েছি। কজ আই অ্যাম ইন অ্যাকসিডেন্টলি লাভ উইথ ইউ। আমি তোমার কথার প্রেমে পড়েছি… তোমাতেই আমার সর্বনাশ দেখেছি। আজ এই আমি, ফারহান ইমতিয়াজ মরে গেলেও জানবে এই ফারহান তার সবটা দিয়ে এক নারীকেই ভালোবেসেছে। সে এক নারীতেই আসক্ত। আই অ্যাম এ ওয়ান ওমেন ম্যান ডিয়ার। ‘

সানাহ্ এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। ফারহানের বলা প্রত্যেকটা কথার মর্ম বুঝতে তার কষ্ট হচ্ছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না ফারহান তাকে এই কথাগুলো বলেছে। সানাহ্ যেন বরফের মতো জমে গেছে। ওর পা দুটো তাদের জায়গাতেই আটকে গেছে। শরীরে মৃদু মন্দ বাতাস বইছে আর কেমন শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে। কিসের এই অনুভূতি ? প্রিয়জনের কাছ থেকে প্রিয় কথা শোনার অনুভূতি ?

ফারহান মুচকি এসে সানার হাত ছেড়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে এলো। মিনিট কয়েক যাওয়ার পর মুচকি এসে সানাহ্ও পা চালিয়ে এসে আবার ফারহানের ডান হাতের ভাজে নিজের বাম হাত পুরে দিল। এই যে আজ থেকে শুরু এই পথ চলা। এই পথ চলতে থাকবে তাদের মৃত্যুর আগ অব্দি।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#প্রেমমানিশা(৩২)

গোল্ডফিল্ড এভিনিউ,

জন মূর্তিতে ভরে উঠেছে হল। চারদিকে শুধু হাস্যময় রমণীদের কলকলে হাসির শব্দ। ভেসে আসছে মৃদু শব্দে গানের সুর। আবার কোথাও ভাসছে ফুলের ঘ্রাণ। চারদিক মুখরিত হয়েছে ফুলেল সুবাসে। হলের এক পাশে ফুলে সজ্জিত স্টেজে বসে আছে নব দম্পতি।
মিসেস জামান মেহমান এবং আত্মীয় স্বজনদের অ্যাটেন্ড করার মাঝে ফাঁকফোকরে মেয়ে আর মেয়ে জামাইয়ের দিকে নজর দিচ্ছেন। মেয়ে টগরকে সুখী করতে চেয়েছিলেন। মেয়ের মুখের হাসি বলে দিচ্ছে উনি উনার উদ্দেশ্যে সফল হয়েছেন।

মিস্টার কবির আর ফারহান মিস্টার জামানের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। পুরনো সম্পর্ক আবারও ঝালাই করে নিচ্ছে তারা। পুরনো বান্ধবী হিসেবে মিসেস জামান,মিসেস আশা আর মিসেস কায়নাতের মধ্যে ভালই সখ্যতা আছে। আবার তাদের ছেলে মেয়েদের মধ্যেও মোটামুটি যোগাযোগ আছে। টগর সানার সমবয়সী। NSU এর সিএসসি তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়ালেখার দিক দিয়ে সানার জুনিয়র কারণ মাঝে টাইফয়েডের ভুক্তভোগী হয়ে ক্লাস সেভেনে দুইবার পড়তে হয়েছে।

মিস্টার কবির আর অতসী আগেই চলে এসেছেন। মিসেস কায়নাত,জাপান আর সানাহ্ গেছে বিয়ের উপহার কিনতে। মিসেস কায়নাত মেয়ের বিয়ের কাজের মধ্যে পরে বান্ধবীর মেয়ের বিয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। সেদিন মিসেস জামান ফোন করে মনে করিয়েছিলেন বলেই উপহার কেনার কথা মনে পড়লো।

ফারহান কথার মাঝে বারবার হলের এন্ট্রান্স গেটের দিকে নজর দিচ্ছে। মনটা আনচান করছে এক পলক সানাহ্কে দেখার জন্য। এই প্রথম ফারহান সানাহ্কে একদম ভিন্নভাবে আবিষ্কার করতে চলেছে। একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছে তারা তাই স্বাভাবিক ভাবেই সানাহ্ অত্যন্ত সেজেগুজে আসবে। আর এই সাজই ফারহান দেখতে চেয়েছিল।

‘ হবু বউকে খুঁজছেন মিস্টার দুলাভাই ? ‘

ফারহান আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সানাহ্কে খুঁজছিল কিন্তু আচমকা ওর পিছন দিয়ে হুট করে এসে অতসী ওর কানের কাছে কথা বলায় চমকে উঠলো। বুকে হাত রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ে শূন্যে যেন থু থু ফেললো। অতসী দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওর কান্ড কারখানা দেখছে। ব্যাপারটা ওর হাস্যকর লাগছে। ওর হবু দুলাভাই যে এতটা ভীতু হবে সেটা ওর জানা ছিলনা।

‘ এত অদ্ভুত অদ্ভুত নাম কোথা থেকে খুজে পাও তোমরা ? তুমি ডাকছো মিস্টার দুলাভাই। তোমার বোন ডাকে কবি সাহেব, মিস্টার কবি ব্লা ব্লা ব্লা। এরকম অদ্ভুত নাম আমি বাপের জন্মে শুনিনি কাউকে ডাকতে। ‘ নিজেকে খানিকটা সামলে ভরাট গলায় বললো ফারহান।

‘ বাপের জন্মে শুনেন নি ? তাহলে বউয়ের জন্মে শুনে নিন। অভ্যাস করে নিন। এখন থেকে এসবই শুনতে হবে। আফটার অল উই আর সাইয়ারা সিস্টার্স… ‘ কথাগুলো বলেই ফারহানের দিকে এক গা জ্বালানো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই গুনগুন করতে করতে চলে গেলো অতসী।

অতসী যেতেই ফারহান কিছু একটা বিড়বিড় করে মাথায় হাত রেখে চোখ দুটো খানিকটা বড় করে আবার স্বাভাবিক করলো। বুঝাই যাচ্ছে এদের দুই বোনের কাজে সে হতবাক প্রায়। যাহ বাবা আধা ঘন্টা তো হয়েই গেলো কিন্তু সানাহ্ যে এখনও এলো না। এতক্ষন লাগছে গিফট কিনতে ?

তবে ফারহানকে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সানাহ্ এসে হাজির তার জাপান ভাই আর মাকে সঙ্গে করে। আসার সময় ওয়েডিং গিফটকে তার জায়গামতো দিয়ে এসেছে। ফারহানের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে অপরূপ সুন্দরী সানাহ্কে দেখে। সানাহ্ তার ইচ্ছার মান রেখেছে। তার দেওয়া শাড়িটাই পড়েছে।

বাঙ্গি কালারের পাকিস্তানি শিফন জর্জেট বারিশ শাড়ির সঙ্গে পিঠের উপর ছেড়ে দেওয়া লালচে ঘন লম্বা চুল যেন এক অন্যরকমভাবে মানিয়েছে। হাতে সিলভার রোলেক্স ওয়াচ আর কানে গলায় শোভা পাচ্ছে রেড স্টোন বসানো ডায়মন্ড লকেটের সেট। পরনে মিডিয়াম হিলের ব্ল্যাক শূ।

সানাহ্ কোনোকালেই তথাকথিত হাই হিলের স্টিলেটোতে ইন্টারেস্টেড ছিল না। প্রথমত তার হাইট মোটামুটি ভালোই বলে স্টিলেটো পড়লে তাকে অতিরিক্ত লম্বা মনে হবে। দ্বিতীয়ত স্টিলেটো পড়ে নিজের হাইটের চেয়ে লম্বা জাহির করা তার মোটেই পছন্দ না।

হলে এসেই মিসেস কায়নাত মিসেস আশা এবং মিসেস জামানের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বহুদিন পর তিন বান্ধবী এক হয়েছেন। কথা যেন শেষ হতেই চাইছে না। সানাহ্ ওর মাকে তার বান্ধবীদের সঙ্গে এত হেসে হেসে কথা বলতে দেখে খুশি হলো। ওর মামনি চলে যাওয়ার পর থেকে ওর মা যেন হাসতেই ভুলে গেছে। সারাদিন শুধু যন্ত্রের মতো কাজ করে যায়। তবে আজ সে অনেকদিন পর মন থেকে হাসছে। শেষবার হেসেছিল যখন ওরা কয়েকদিন আগে রাতেরবেলা ঢাকা শহর ঘুরতে বেরিয়েছিল।

জাপান দেখলো সানাহ্ ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে আর ফারহান সানার সঙ্গে কথা বলার জন্য হাসফাস করছে। জাপান মুচকি হেসে সানাহ্কে বললো ‘ তুই তোর মাকে দেখছিস আর ওইদিকে দেখ তোর হবু বর তোর সঙ্গে কথা বলার জন্য রীতিমত তড়পাচ্ছে। যা গিয়ে কথা বল ভাইয়ার সঙ্গে। ‘

জাপানের কথার জবাবে সানাহ্ মিষ্টি হেসে ফারহানের দিকে এগিয়ে গেলো। ফারহান ততক্ষনে রুদ্র কল করায় ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। সানাহ্ ফারহানের পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ফারহানের কথা শেষ হওয়ার। ফারহান যখন তার কথাবার্তা শেষ করে ফোন পকেটে গুজলো তখন সানাহ্ গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো। নিজেকে ইশারা করে দেখিয়ে চোখে চোখে জিজ্ঞেস করলো ‘ কেমন লাগছে আমাকে ? ‘

ফারহান যেন এই কথার অপেক্ষাতেই ছিল। মুগ্ধ চোখে সানার দিকে তাকিয়ে বললো ‘ বাংলা একাডেমি আপনার সৌন্দর্যের প্রশংসা করার মতো যথোপযুক্ত শব্দের আবিষ্কার এখনও করতে পারেনি উড বি মিসেস ফারহান। তবে আপনি আমার প্রেমমানিশা। হুম আমার প্রেমমানিশা, আমার অমানিশার মতো অন্ধকার জীবনে এক মুঠো প্রেম আপনি। এবার বুঝে নিন আপনাকে কেমন লাগছে। আমার চোখে তো আপনি সবসময়ই অনন্যা। ‘

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হয়েছে। সকলে গ্রুপে গ্রুপে যে যার যার পরিবারের সঙ্গে খেতে বসছে। ফারহানদের পরিবারও নিজেদের হবু বেয়াই পরিবার নিয়ে খেতে বসেছেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে আরেক জায়গায়। সবার জায়গা হলেও জায়গা হয়নি ফারহান আর সানার।

গোল টেবিলে জনপ্রতি পাঁচজন করে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই হিসেবে মিসেস আশা,মিসেস কায়নাত,মিস্টার কবির,অতসী আর জাপানের বসার জায়গা হলেও সানাহ্ আর ফারহানের হয়নি। সানাহ্ বেশ চিন্তিত এ নিয়ে। ফারহান উপায়ান্তর না পেয়ে বললো ‘ আন্টি আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি সানাহ্কে নিয়ে অন্য টেবিলে বসতে পারি। আর কোনো উপায় তো দেখছি না। সব ফুল হয়ে গেছে। ‘

‘ আরে না না কিছু মনে করার কি আছে। তুমি ওকে তোমার সঙ্গে নিয়েই আলাদা বসাও। বাবা তুমি একটু দেখতো ও ঠিকমত খায় কিনা। খাওয়া দাওয়া নিয়ে তো সে অনেক গড়িমসি করে। তুমি একটু দেখেশুনে খাইয়ে দিও। ‘ মিসেস কায়নাত ফারহানকে অভয় দিয়ে বললেন।

নিজের মায়ের কথায় বিরক্ত হলো সানাহ্। কি দরকার ছিল ফারহানের সামনে এভাবে বলার ? না জানি ফারহান ওকে নিয়ে কি কি ভাবছে। ওই দেখো ওর জল্লাদ মায়ের কথা শুনে ব্যাটা বজ্জাত হাসছে। সানাহ্ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দাত কিরমির করলো। ফারহান মিসেস কায়নাতের কথা শুনে সায় দিয়ে বললো ‘ না না আন্টি চিন্তা করবেন না। আমি ওকে দেখেশুনেই রাখবো। ‘

ফারহান আর সানাহ্ বসেছে হলের একান্ত নিরিবিলি জায়গায়। এইদিকে মানুষের আনাগোনা কম। খাবার দাবারের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। একজন লোক আছেন যিনি খাবারের দিকটা তদারকি করছেন। একটু পরপর হাকডাক করে সব খাবার হাজির করছেন লোক দিয়ে।

সানাহ্ গেছে বর বউয়ের ছবি তুলতে। এসব ব্যাপারে সে অনেক এক্সপার্ট। বিভিন্ন ওয়েডিং এর ফটোগ্রাফি করা তার হবি। সে বিয়ের ছবি জমাতে পছন্দ করে। তার ঘরের একটা অংশ জুড়ে আছে নানান লোকের নানান বিয়ের ছবি যাদের বিয়েতে হয় সে তার মা বাবার সূত্রে গেছে নয় বোনের সূত্রে গেছে। এই ব্যাপারটা ফারহান যখন লক্ষ্য করেছিল তখন অবাক ওয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ‘ এগুলো কাদের ছবি ? এত জোড়া কাপলের ছবি তোমার রুমে কেন ? ‘

সানাহ্ উত্তর দিয়েছিল ওয়েডিং ফাংশনের থিম ফটোগ্রাফি কালেক্ট করা আমার হবি। আই লাইক ইট। ফারহান সেদিন অবাক হয়েছিল কিন্তু সানার পছন্দকে সম্মান করেছি। এই অপার্থিব পৃথিবীতে অনেকেরই উদ্ভট পছন্দ থাকে। সানাহ্ও তাদের মধ্যে একজন।

সানাহ্ তার শখের ফটোগ্রাফি করে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। ফারহান তাকে বসিয়ে প্লেট উল্টে প্লেটটা হালকা লেবু পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নাপকিন দিয়ে মুছে তাতে পোলাও বাড়লো। সঙ্গে একটু কাবাব আর চিকেন রোস্ট দিলো। সবকিছু ঠিকঠাক করে সানাহ্কে খেতে বলার উদ্দেশ্যে ওর দিকে ফিরতেই দেখলো সানাহ্ অলরেডি খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে সারাদিনের ধকলে সে ক্ষুধার্থ। ফারহান মুচকি হেসে নিজের পাতে খাবার বেড়ে খেতে বসল।

খুদার প্রকোপে প্রথমে খাবারের দিকে তেমন নজর না দিলেও ক্রমেই এসব তেলতেলে খাবার খেয়ে সানার শরীর খারাপ করছে। পরের টাকায় কেনা রসদ পেয়ে বাবুর্চি মন প্রাণ দিয়ে সব রান্নায় ঢেলে দিয়েছে। যার ফলপ্রসূ খাবার এখন তেলতেলে অখাদ্য ছাড়া কিছুই না। অথচ এই খাবারই শত লোকে কত তৃপ্তি নিয়ে ভোগ করছে। সানার ভাবতে অবাক লাগছে চিন্তাধারা আর রুচি একজন মানুষকে কতটা আলাদা করে দেয়।

‘ খারাপ লাগছে সানাহ্ ? খেতে পারছো না ? ‘

খেতে ব্যস্ত ছিল ফারহান। কিন্তু হঠাৎ কি মনে হতে সানার দিকে ঘুরে বসলো। দেখলো সানাহ্ না খেয়ে আনমনা হয়ে বসে আছে। ফারহানের কথা শুনে সানাহ্ বললো ‘ খেতে পারছি না। বিবমিষা হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে এখনই পেটের নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসবে। সারাদিনের টায়ার্ডনেসের পর এসব অয়লি ফুডে মাথা চক্কর দিচ্ছে। এমনিতেই অয়লী ফুড আমার সহজে হজম হয় না। ‘

ফারহান এবার চিন্তায় পড়ে গেলো। সানার প্লেট দেখে মনে হচ্ছে বড়জোর কয়েক লোকমা খেয়েছে। এখন বাড়ি ফিরেই ঘুমোবে। সারারাত থাকবে খালি পেটে। না খেয়ে খালি পেটে থাকাটা ঠিক না। কিন্তু খাবে কি করে ? খাবারের যে অবস্থা। ফারহানের নিজেরও খেতে ইচ্ছা করছে না।

‘ আচ্ছা থাক জোর করে খেতে হবে না। আমারও ভালো লাগছে না খেতে। সেন্টারে অনেক গরম লাগছে। চলো দুজনে বাইরে গিয়ে আইস্ক্রিম খেয়ে আসি। বাড়িতে ভাত আর সবজি আছে। দুজনে মিলে বাড়ি ফিরে খেয়ে নিবো। ‘ ফারহান প্লেটটা ঠেলে এগিয়ে দিয়ে বললো।

‘ পাগল হয়ে গেলেন ? আমি আপনাদের বাড়ি কি করে যাবো ? কাল না আমাদের এনগেজমেন্ট ? মা যেতে দিবে নাকি ? ‘ সানাহ্ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো। ফারহানের কথায় অবাক সে। বিয়ের আর মাত্র দুই দিন বাকি। এখন কি করে ওই বাড়ি যাবে।

‘ আচ্ছা যেতে হবে না। এখন তুমি বাইরে চলো। নিচে একটা শপ আছে। ওখান থেকে কোণ আইস্ক্রিম কিনে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে খাবো। হালকা শীতের আমেজে বরফ গলা আইস্ক্রিম খাওয়ার এক আলাদা মজা আছে। ‘ ফারহান বললো।

এবার আর ফারহানের কথায় আপত্তি করলো না সানাহ্। এমনিতেও তার কমিউনিটি সেন্টারের পরিবেশে ভীষণ মাথা ধরা ঝিমঝিম ব্যাথা করছে। বোধ হয় সে এখন দম বন্ধ করে মারাই যাবে। ফারহান সার্ভ করা লোকটার হাতে বকশিশের টাকা ধরিয়ে দিয়ে সানাহ্কে নিয়ে সকলের অগোচরে বেরিয়ে পড়লো রাত্রিবিলাস করতে।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….