প্রেমময়ী তুমি পর্ব-১২+১৩

0
476

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_১২
#নিশাত_জাহান_নিশি

রোজ উপরে উপরে কথাগুলো বললেও ভেতরে ভেতরে সে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল! নূরকে চূড়ান্ত আঘাত করা ছাড়া তার হাতে আর কোনো উপায় ছিল না! মাত্র এক বছরের ভালোবাসার জন্য সে ২৪ বছরের ভালোবাসাকে অস্বীকার করতে পারবে না! শীঘ্রই জায়গা পরিত্যাগ করল রোজ! একটিবারের জন্যও পিছু ফিরে নূরের দিকে তাকালো না। নূর এখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারছে না। একই জায়গায় থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদ এবং সাদমান ব্যাকুল হয়ে নূরের দিকে এগিয়ে আসতেই নূর সেন্সলেস হয়ে সাদমানের কাঁধে লুটিয়ে পড়ল!

সাদমান হতবাক দৃষ্টিতে নূরের অবচেতন মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নূরের অকেজো শরীরটাকে আগলে ধরার মতো সামান্যতম জ্ঞানটুকুও নেই তার! অপরদিকে চাঁদ নিবার্ক ভঙ্গি কাটিয়ে বর্তমানে ফিরে এলো। শীঘ্রই উল্টো দিকে ঘুরে এসে নূরকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরল! চাপা আর্তনাদ করে সাদমানকে বলল,,

“মানুষটা অজ্ঞান হয়ে গেছে সাদমান ভাইয়া। প্লিজ উনাকে ধরুন। আমি তো একা পারছি না উনাকে সামলাতে।”

সাদমানের ধ্যান ভাঙল। উদ্বিগ্ন হয়ে নূরকে আষ্টেপৃষ্টে ধরল। চাঁদকে উদ্দেশ্য করে তৎপর গলায় বলল,,

“চাঁদ শক্ত করে ধরো নূরকে। আমাদের এক্ষণি এখান থেকে বের হতে হবে।”

নূরের মাথাটা চাঁদ তার কাঁধের উপর সযত্নে রাখল। উত্তেজিত গলায় সাদমানকে বলল,,

“আমরা কি এখন হসপিটালে যাব সাদমান ভাইয়া?”

“না চাঁদ। আমরা এখন বাড়ি ফিরব। সামান্য অজ্ঞান হয়েছে নূর। প্রাথমিক চিকিৎসাতেই ঠিক হয়ে যাবে।”

দুজনই নূরকে নিয়ে খুব সাবধানে পা ফেলে পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো। চাঁদ এবং নূরকে রিকশায় বসিয়ে সাদমান হন্ন হয়ে পাশের দোকান থেকে একটি পানির বোতল কিনল। অনেকক্ষণ যাবত নূরের চোখে-মুখে পানি ছিটানোর পরেও নূরের জ্ঞান ফিরছিল না! চাঁদ সাংঘাতিক ঘাবড়ে গেল। শঙ্কিত গলায় সাদমানকে বলল,,

“ভাইয়া আমার না খুব ভয় করছে। নূর ভাইয়া ঠিক আছে তো? আহামরি কোনো ক্ষতি হয়ে গেল না তো?”

সাদমান রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল। স্বাভাবিক গলায় বলল,,

“ভয় পাওয়ার কিছু নেই চাঁদ। সব ঠিক আছে। তুমি এক কাজ করো নূরকে নিয়ে এই রিকশাটা করে বাড়ি ফিরে যাও। আমি পেছনে নূরের বাইক নিয়ে আসছি। বাড়িতে পৌঁছেই তুমি ওকে বিছানায় শুইয়ে দিবে। রুমে কোনো চিৎকার চ্যাঁচামেচি বা হৈ-হট্টগোল করা চলবে না। আঙ্কেল এবং আন্টিকে বুঝাবে। আর আমি এদিকে বাড়ি ফেরার পথে নূরদের ফ্যামিলি ডক্টর হায়াত আঙ্কেলকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরছি ওকে?”

চাঁদ শুকনো গলায় মাথা ঝাঁকালো। নূরকে তার কাঁধের সাথে অতি যত্নে এবং সাবধানে চেপে ধরল। রিকশাওয়ালাকে বলে সাদমান তাদের দুইজনকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। অন্যদিকে সাদমান নূরের বাইকে করে প্রথমে ডক্টরের চেম্বারে গেল। ওখান থেকে ডক্টরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ডক্টরসহ নূরদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

প্রায় দুঘন্টা পর। নূরের মাত্র জ্ঞান ফিরল। চারিদিকে পরিবারের সবাই ভীড় জমিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাবরিনা আবরার মুখ চেপে কাঁদতে ব্যস্ত। হাবিব আবরার মাথা নুইয়ে শোক ঢাকতে ব্যস্ত! চাঁদ এবং সোহানী রুমের দরজায় উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের চোখে এখনও আতঙ্কিত ভাব উদীয়মান। সাদমান অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে নূরের হাতের স্যালাইনের নলটি খুলে দিলো! পিটপিট চাহনিতে নূর বিস্তীর্ণ রুমটিতে চোখ বুলালো। পরক্ষণে আবার চোখ জোড়া বুজে অব্যক্ত যন্ত্রণায় চোখের জল ছেড়ে দিলো! সাবরিনা আবরার এবার ভীষণ চটে বসলেন। চোখ জোড়া লাল করে উনি নূরের পাশে বসলেন। বিনাশব্দ প্রয়োগে ঠাস করে নূরের গালে এক চড় বসিয়ে দিলেন! পরিবেশ তাৎক্ষণিক গরম হয়ে উঠল। হাবিব আবরার, চাঁদ, সোহানী এবং সাদমান উদগ্রীব ভঙ্গিতে সাবরিনা আবরারের দিকে এগিয়ে এলো। নূর টলমল দৃষ্টিতে সাবরিনা আবরারের দিকে তাকাতেই সাবরিনা আবরার নূরের গালে পুনরায় আরও একটি চড় মেরে বসলেন! শক্ত গলায় বললেন,,

“ঐ বাইরের মেয়েটা এখন তোর লাইফে এতটাই ইম্পর্টেন্ট হয়ে গেল নূর? যে ঐ একটা মেয়ের জন্য আজ তোর শরীরের এই দশা? নিজেকে এভাবে শেষ করে দিচ্ছিস তুই হ্যাঁ? আমি তো বলব ঐ মেয়েটা একদম ঠিক কাজ করেছে! তোকে ছেড়ে গেছে। পরিবার থেকে সে ভালো শিক্ষা পেয়েছে বলেই সে মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। আফসোস, তোকে আমরা সেই সুশিক্ষা দিয়ে মানুষ করতে পারি নি! আর এই কারণেই তুই আগে পরিবারের কথা না ভেবে একটা বাইরের মেয়ের কথা ভাবছিস! এই যে তোর বাপ, ভাই এবং আমি মিলে সেই ছোটোবেলা থেকে তোকে এত যত্নে, এত ভালোবেসে বুকে আগলে রেখে বড়ো করেছি সেই ভালোবাসার কি কোনো মূল্য নেই? এতটাই মূল্যহীন আমাদের ভালোবাসা? ভেবে দেখেছিস কখনো? তোর বাপ যে এখন চাকরি বাকরি ছেড়ে ঘরে বসে আছে এই গোটা সংসারটা এখন চলবে কীভাবে? কখনো মনে হয় না বাইরের মানুষদের কথা না ভেবে ভালোভাবে পড়াশোনা করে একটা ভালো পজিশনে যাই? বড় ভাইয়ের মতো নিজেও ঢাল হয়ে বাবার পাশে দাঁড়াই? একটু পরিবারের কথা ভাবী?”

নূর চোখ বুজে চোখের জল ছাড়ছে। হ্যাঁ বা না কিছুই বলছে না। হাবিব আবরার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাবরিনা আবরারের কাঁধে হাত রেখে বললেন,,

“বাদ দাও না এসব সাবরিনা। ছেলে বড়ো হয়েছে এখন, নিজের ভালো নিজে বুঝে। এখন তাদের গাইডলাইন দেওয়ার মতো বয়স আমাদের নেই! সময় ফুরিয়ে আসছে আমাদের। তবে আমার এই ছেলের থেকে আমি অনেক কিছু আশা রাখি! জানি না আদৌ সেই আশা পূর্ণ হবে কি-না! তার আরেক ভাই মাহিনের মতো এই ছেলেটাও কিছু একটা করে দেখাতে পারবে কি-না।”

হাবিব আবরার বিষন্ন মনে নূরের রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। সাবরিনা আবরার ফুঁপিয়ে কেঁদে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন। উনি ও হাবিব আবরারের পিছু পিছু রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। তবে উনি আবারও ফিরে এলেন! চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তটস্থ গলায় বললেন,,

“খবরদার বলছি। নূরকে আর কোনোভাবে উস্কাবি না! তার কোনো অন্যায় আবদারকেও প্রশ্রয় দিবি না তুই! সাবধান করলাম তোকে। মনে থাকে যেন!”

চাঁদ কেঁপে উঠল! তাৎক্ষণিক মাথা নুইয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। সাবরিনা আবরার প্রস্থান নিলেন। ইতোমধ্যেই সোহানী চাঁদকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। রাগে গজগজ করে চাঁদের হাত শক্তভাবে চেপে ধরল! চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“খালামনি কি বলে গেছে মাথায় আছে তো? নেক্সট টাইম যেন না দেখি নূরকে কোনোভাবে উস্কাতে। দয়া করে নিজের কুবুদ্ধিগুলোকে নিজের কাছেই রাখ। বাইরে প্রকাশ করিস না।”

চাঁদ কিছু বলল না। পিছু ঘুরে সোজা নিজের রুমে চলে গেল! এক ছুটে বিছানার উপর ধপ করে শুয়ে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ল। অন্যদিকে সোহানী নূরের রুমে প্রবেশ করে সাদমানকে বলে আজকের রাতটা সাদমানকে নূরের কাছেই থাকতে বলল। সাদমানও এক কথায় রাজি হয়ে গেল। কিচেন থেকে খাবার দাবার সাজিয়ে এনে সোহানী নূরের রুমে রেখে গেল। সাদমান দায়িত্ব নিয়ে নূরকে জোর করে দু, এক লোকমা খাবার খাইয়ে দিলো। এরপর নূরকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো!

আজ রাতে বাড়ির অন্য সদস্যরা মুখে কিছু তুলল না। অভুক্ত অবস্থাতেই সবাই মন খারাপ করে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘড়ির কাটা রাত প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই। নীড় আজ বেশ রাত করে বাড়ি ফিরেছে! অফিসে কাজের খুব চাপ ছিল তাই। সোহানী সজাগ ছিল বিধায় সদর দরজাটা আজ সোহানীই খুলে দিলো! সঙ্গে সঙ্গেই নীড়ের ক্লান্ত-শ্রান্ত এবং ঘর্মাক্ত মুখমন্ডল দেখে সোহানী বেশ ভাবুক হয়ে উঠল! নীড়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আজ ফিরতে এত দেরি হলো যে? কাজের চাপ কি খুব বেশি ছিল?”

নীড় মলিন হাসল। অফিসের ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,,

“বাড়ির সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”

সোহানী মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। নীড় তব্ধ শ্বাস ছেড়ে বলল,,

“নূর? নূরের কী অবস্থা?”

সোহানী মাথা নুয়ালো! ভার গলায় বলল,,

“এখন ভালো। তবে সন্ধ্যার দিকে সেন্সলেস হয়ে পড়েছিল!”

“মানে? কী বলছ কী তুমি?”

নীড় মরিয়া হয়ে উঠল! এক ছুটে সোহানীকে পাশ কাটিয়ে নূরের বেডরুমের দরজায় কড়া নাড়ল। উত্তেজিত হয়ে নূরের নাম ধরে বারংবার ডাকতে আরম্ভ করল। নীড় যেন এই মুহূর্তে বড্ড অধৈর্য্যে হয়ে পড়েছে! দুঃশ্চিন্তায় সে ভেঙে পড়েছে। ভাতৃত্বের টান অনুভব করছে খুব গাঢ়ভাবে! নীড়ের অবাধ্য হাঁকডাকে সাদমান উৎন্ঠিত হয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে দৌঁড়ে দরজা খুলে দিলো। সাদমানকে দেখামাত্রই নীড় স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। অস্থিরমনা হয়ে সাদমান কিছু বলার পূর্বেই নীড় সাদমানকে পাশ কাটিয়ে ঘুমন্ত নূরের পাশে বসল। কয়েক দফা বিশৃঙ্খল শ্বাস ছেড়ে নীড় নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। নিস্তেজ হয়ে থাকা নূরের বিবর্ণ মুখমন্ডলে তাকিয়ে নীড় আরও ব্যথীত হয়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে! চোখে জল নিয়ে সাদমানকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“একটু খেয়াল রাখিস ওর। খাবার দাবার খেয়েছে তো?”

সাদমান নীড়ের দিকে এগিয়ে এলো৷ নীড়ের হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে তাকে অভয় দিয়ে বলল,,

“খেয়েছে ভাইয়া। ঘুমের ঔষধও খাইয়ে দিয়েছি। আই থিংক সকালে উঠে একটু বেটার ফিল করবে। আপনি একদম নিশ্চিন্তে থাকুন ভাইয়া। আমি ওর খেয়াল রাখব।”

নীড় আশ্বস্ত হলো। সাদমানের দিকে ভরসার দৃষ্টিতে তাকালো। আবারও চোখ ঘুরিয়ে নূরের নেতিয়ে যাওয়া মুখমণ্ডলে তাকালো। বুকটা আবারও কেঁপে উঠল তার। তাৎক্ষণিক রুম থেকে প্রস্থান নিলো সে! পুনরায় সে সোহানীর সম্মুখীন হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় সোহানী থমকালো। নীড়ের অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো। শুকনো গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কাঁদছেন আপনি?’

নীড় তাড়াহুড়ো করে চোখের জল মুছে নিলো। ধীর গলায় প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,,

“বাড়ির সবাই রাতের খাবার খেয়েছে?”

সোহানী মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। নীড় হতাশ হলো৷ বিষন্ন শ্বাস ছাড়ল৷ জায়গা পরিত্যাগ করতে করতে বলল,,

“অনেক রাত হয়েছে সোহানী। এবার ঘুমিয়ে পড়ো।”

সোহানী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল! নীড়ের যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। অতঃপর নীড়ের কথামতো তার বেডরুমে প্রবেশ করল। ঘুমন্ত চাঁদের পাশে সেও চুপটি করে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চাঁদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে অঢেল আদর নিয়ে চাঁদকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল!

,
,

পরেরদিন সকাল প্রায় নয়টা ছুঁইছুঁই। ঘুমের মধ্যেই চাঁদ হঠাৎ তার গাঁয়ে ঠাণ্ডা কিছুর অনুভূতি পেল! ফটাফট চোখ জোড়া খুলে সে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল! শঙ্কিত চোখে অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সে উদোম শরীরে দাঁড়িয়ে থাকা নূরকে দেখতে পেল! টলমল শরীরে নূর চাঁদের গাঁয়ে হাত দিয়ে পানি ছিটাচ্ছে! চাঁদ অবাক হলো! ভ্রু যুগল সরু করে নূরের দিকে তাকালো। দৃষ্টি তার বিস্ফোরিত। নূর অর্ধখোলা চোখে পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে এখনও চাঁদের চোখে-মুখে ছিটাচ্ছে! চাঁদ এবার ক্ষিপ্র হয়ে উঠল। মুখে লেগে থাকা পানির ছিঁটা গুলো দুহাত দিয়ে মুছে সে তেজী দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী হচ্ছেটা কী এসব? কী করছেন কী আপনি?”

নূর এবার পূর্ণ চোখ মেলে চাঁদের দিকে তাকালো। সম্বিত ফিরে পেতেই মাথা ঝাঁকালো। শক্ত গলায় বলল,,

“জায়গা দাও আমি ঘুমাব!”

চাঁদ তাজ্জব দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। গভীর এক ঘোরে তলিয়ে গেল সে। মুখে হাত দিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,,

“আশ্চর্য! হলোটা কী এই লোকের? রাতারাতি এত পরিবর্তন? অতি শোকে লোকটা পাগল হয়ে গেল না তো?”

নূর রাগী দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“কী হলো? এখনও বসে আছো কেন? বললাম তো আমি ঘুমাব। কানে শুনছ না?”

চাঁদ এবার প্রচণ্ড ক্ষেপে গেল। চোখ লাল করে নূরের দিকে তাকালো। রূঢ় গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আশ্চর্য তো! আপনি আমার বিছানায় ঘুমাবেন কেন? বিছানাটা কি আপনার?”

চাঁদের কথায় কোনোরূপ ভাবান্তর হলো না নূরের! বিনাশব্দ প্রয়োগে চাঁদকে টেনে হেছড়ে বিছানা থেকে নামিয়ে দিলো! চাঁদের দিকে আঙুল তাক করে বলল,,

“কোনো রকম ডিস্টার্ব করার চেষ্টাও করবে না আমাকে। বুঝতে পেরেছ?”

চাঁদ তিরিক্ষিপূর্ণ মেজাজে কিছু বলার পূর্বেই নূর সটান হয়ে বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল! চোখ বুজে বোধ হয় গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল! দেখে যেন মনে হচ্ছে কত রাত ঘুমায় না সে। চাঁদ ঘোর থেকে বের হয়ে এলো! চোয়াল উঁচু করে কোমড়ে হাত গুজে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ একই ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা নূরের দিকে তাকিয়ে সে তেড়ে এলো নূরের দিকে। ভাবুক গলায় বলল,,

“আমার রুমে এসে আমার সাথেই ফাফর? এ তো দেখছি চোরের মায়ের বড় গলা!”

চাঁদ আর এক মুহূর্ত ব্যয় করল না। নূরের করা সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করে সেও ডেক্সের উপর থেকে আরও একটি পানির বোতল নিয়ে নূরের গাঁয়ে পানি ছিটাতে শুরু করল! নূর এবার নড়েচড়ে উঠল। পিটপিটে চোখে এদিক ওদিক তাকালো। অতঃপর মুখ উঁচিয়ে রক্তিম বর্ণের চোখ জোড়ায় পিছু ঘুরে চাঁদের দিকে তাকাল। তিক্ত গলায় বলল,,

“আবার শুরু করেছ না? আবার আমাকে জ্বালানো শুরু করেছ? বারণ করেছিলাম না আমাকে ডিস্টার্ব না করতে? তবুও কেন ডিস্টার্ব করলে?”

চাঁদ গর্জে উঠল। ক্ষীণ গলায় বলল,,

“কে কাকে জ্বালানো শুরু করেছে হ্যাঁ? আমি না আপনি? কে আগে কার রুমে এসেছে বলুন? কে আগে কাকে পানি ছিটিয়েছে? কে আগে কাকে নিয়ে টানা হেছড়া করেছে বলুন?”

নূর হুট করে শোয়া থেকে উঠে বসল। পা ভাজ করে বিছানার উপর বসল। কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সেট করল। শরীরের আড়মোড়া ভেঙে নাক টেনে তিক্ত গলায় বলল,,

“তোমার সব ভাই-বোনরা এসে আমার রুম দখল করে রেখেছে! আমি কোথায় ঘুমাব বলো? আমার তো চোখের ঘুম এখনও ফুরায় নি। খুব জ্বলছে চোখগুলো। মাথাটাও ব্যথায় টনটন করছে। শরীরে একরত্তি শক্তিও পাচ্ছি না।”

চাঁদ খুশিতে মৃদু হাসল। নূরের দিকে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী বললেন আপনি? কে এসেছে?”

নূর ঘুমে বুদ হয়ে বাঁ দিকে মাথাটা বাঁকিয়ে ধীর গলায় বলল,,

“আয়মন ভাইয়া এসেছে। সাব্বির ভাইয়া এসেছে। নাদিয়া, সাদিয়া, রুহি, জায়মা সবাই এসেছে। ওরা এসেই আমার রুমে অ্যাটাক করেছে! আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ওরা নিজেই আমার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে।”

চাঁদ আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না! খুশিতে আত্নহারা হয়ে দৌঁড়ে রুম থেকে প্রস্থান নিতেই নূর পেছন থেকে চাঁদকে মিনমিনে গলায় ডেকে বলল,,

“চাঁদ? আমার মাথাটা একটু টিপে দিবে? প্রচণ্ড ব্যথা করছে মাথাটা। আম্মু রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত। তাই আম্মুকে এখন ডাকতে ইচ্ছে করছে না।”

#চলবে…?

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_১৩
#নিশাত_জাহান_নিশি

“চাঁদ? আমার মাথাটা একটু টিপে দিবে? প্রচণ্ড ব্যথা করছে মাথাটা। আম্মু রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত। তাই আম্মুকে এখন ডাকতে ইচ্ছে করছে না।”

চাঁদ থমকালো! চক্ষুজোড়া অঢেল বিস্ময় নিয়ে পেছন ফিরে নূরের দিকে তাকাল। এই মুহূর্তে চাঁদের আকাশ থেকে টুপ করে মাটিতে পড়ার মতো অনুভূতি হচ্ছে! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে নূর আদৌতে চাঁদকে এই কথা বলেছে। নূরের কোথাও কোনো ভাবান্তর হলো না। ঘুম জড়িত চোখে সে শান্ত চাহনিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখে মনে হচ্ছে যেন তার মতো শান্ত-শিষ্ট মানুষ পৃথিবীতে আর দুটো নেই! হুট করেই মায়া জন্মালো চাঁদের! আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নূরের দিকে নির্বাক গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আপনি আমাকে বললেন, আপনার মাথা টিপে দিতে?”

নূর বড় করে একটি হাই তুলল। নড়েচড়ে স্থির হয়ে বসল। সন্দিহান গলায় বলল,,

“হ্যাঁ তোমাকেই বললাম। কেন? কোনো আপত্তি আছে?”

ঘটনার আকস্মিকতায় চাঁদ দ্রুত গতিতে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো! নূর যন্ত্রণায় কপাল ঘঁষতে লাগল। ধৈর্য্যহীন গলায় বলল,,

“আচ্ছা? গতকাল রাতে কি আমি ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলাম? তুমি জানো কিছু এই বিষয়ে?”

ধীর পায়ে হেঁটে চাঁদ নূরের দিকে এগিয়ে এলো। কপাল কুঁচকে প্রত্যত্তুরে বলল,,

“উঁহু। আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না। কারণ আমি আপনার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তবে সাদমান ভাইয়া বা আপু হয়তো এই বিষয়ে কিছু জানেন। আপনি চাইলে তাদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন।”

কপালটা খড়তড়ভাবে কুঁচকালো নূর। আন্দাজে বলল,,

“আমার কী মনে হচ্ছে জানো? গতকাল রাতে আমাকে ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছিল। আর এ কারণেই আমার মাথাটা প্রচণ্ড রকম ব্যথা করছে। চোখগুলো জ্বালা-পোড়া করছে। নিজেকে স্থির করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কী করছি না করছি কিছুই বুঝতে পারছি না। দুনিয়াটা চরকির মতো ঘুরছে!”

চাঁদ এবার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল! নূরের দিকে আরও একটু এগিয়ে এলো। উত্তেজিত গলায় বলল,,

“শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে আপনার? খালামনিকে ডাকব?”

ধপাস করে নূর বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। মনটা হঠাৎ তার খুব বিষন্ন হয়ে উঠল! রোজের কথা মনে পড়তেই দুনিয়াটা ঝাপসা হয়ে এলো! বুকটা অপ্রকাশ্য যন্ত্রণায় ভারী হয়ে উঠল। শারীরিক যন্ত্রণা যতই গাঢ় হোক না কেন মানসিক যন্ত্রণার কাছে তা কিছুই না। তার স্থায়ীত্বও খুব কম। তবে যদি একবার কেউ এই মানসিক যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে তবে মৃত্যুর আগ অবধি এই যন্ত্রণার স্থায়ীত্ব থেকে যায়! তা গোড়া থেকে নির্মুল করা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এসব ভাবতে ভাবতেই নূর চাপা শ্বাস ছাড়ল! দ্বিমত পোষণ করে বলল,,

“কাউকে ডাকা লাগবে না। আমি ভালো আছি। প্লিজ তুমিও আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও! আর বাকিদেরও বলবে এই রুমে যেন ভুলেও প্রবেশ না করে। আমাকে প্লিজ একটু একা থাকতে দাও! নিজের মতো করে থাকতে দাও।”

মাথার উপর বালিশ চেপে ধরে নূর শারীরিক এবং মানসিক উভয় যন্ত্রণায় গোঙাতে লাগল! চাঁদ অস্থির হয়ে উঠল! কী করবে না করবে তা ভেবে উতলা হয়ে উঠল। অনেক ভেবে-চিন্তে চাঁদ মনোস্থির করল নূরের মাথা টিপে দেওয়ার! বুকে অদম্য সাহস জুগিয়ে চাঁদ নূরের মাথার ঠিক উল্টোপিঠে হাত ছোঁয়ানোর পূর্বেই রুমের দরজা ঠেলে বাড়ির সব অতিথিরা এসে হানা দিলো! নাদিয়া, সাদিয়া, রুহি, জায়মা, আয়মন, সাব্বির সবাই হৈ-হুল্লোড় করে চাঁদের রুমে প্রবেশ করল। চাঁদ আকস্মিক দৃষ্টিতে তাদের প্রত্যেকের দিকে তাকাতেই খিলখিলিয়ে হেসে তারা চাঁদের দিকে ছুটে এলো। চাঁদের সব খালাতো বোনরা এসে চতুর্পাশ থেকে চাঁদকে ঘিরে ধরল। শুধু আয়মন এবং সাব্বির বাদে। তারা দুজনই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। এই মুহূর্তে চাঁদ অনুভূতিশূণ্য! খুশিতে হাসবে নাকি নূরের জন্য ভাববে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। অন্যদিকে চাঁদের সব বোনরা খুশিতে উত্তেজিত হয়ে চাঁদকে জড়িয়ে ধরে লাফাচ্ছে। জায়মা প্রফুল্ল গলায় বলছে,,

“কতদিন পর তোর সাথে দেখা হলো বল? কীভাবে ছিলি এতদিন আমাদের ছাড়া?”

চাঁদ জোরপূর্বক হাসল! প্রাণহীন গলায় বলল,,

“কই আর ভালো ছিলাম তোদের ছাড়া বল? খুব খারাপ দিন কাটছিল আমার। তোরা এসে গেছিস, এখন আমার ভালো থাকার পালা!”

প্রত্যেকে মৃদু হাসল। চাঁদকে আরও জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরল। সমস্বরে বলল,,

“আজ থেকে আমাদেরও ভালো থাকার পালা। বিয়ে বাড়ি এখন থেকেই জমল বলে! বাড়িতে ঢুকে মনে হচ্ছিল যেন বিয়ে বাড়িতে নয়, মরা বাড়িতে এসেছি আমার! এত নীরব থাকে বুঝি বিয়ে বাড়ি?”

এরমধ্যেই সাবরিনা আবরার এবং সোহানী ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুমে প্রবেশ করল। চারজনের মুখের কথা টেনে নিয়ে শুকনো হেসে সাবরিনা আবরার বললেন,,

“হ্যাঁ এজন্যই তো বিয়ের দশদিন আগেই জোর করে তোদের এই বাড়িতে আনা! আমার মরা বাড়িটাকে বিয়ে বাড়িতে পরিণত করবি বলে! আমার চাঁদ মা তো একাই আস্ত একটা বিয়ে বাড়ি! এখন তোদের অভয় পেলে তো আর কথাই নেই।”

উপস্থিত সবাই খুশিতে হেসে উঠল। জায়মা চাঁদকে ছেড়ে এবার এগিয়ে গেল সাবরিনা আবরারের দিকে। প্রাণোচ্ছ্বল হেসে সাবরিনা আবরারকে জড়িয়ে ধরে বলল,,

“কত বছর পর তোমার সাথে দেখা হলো খালামনি। তোমাকে এতটা কাছ থেকে পেয়ে সত্যিই খুব ভালো লাগছে।”

সাবরিনা আবরারও জায়মাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন। তব্ধ শ্বাস ছেড়ে ক্ষীণ গলায় বললেন,,

“সত্যিই এতগুলো বছর ধরে তোদের খুব মিস করছিলাম রে! আজ তোদের কাছে পেয়ে ষোল কলা পূর্ণ হলো আমার। খুশিতে মনটা ভরে গেল। বাড়িটা যেন আবার আগের মতো প্রাণ ফিরে পেল।”

নাদিয়া, সাদিয়া এবং রুহিও আবেগে আপ্লুত হয়ে সাবরিনা আবরারকে জড়িয়ে ধরল। খুশিতে সবাই ভেসে যাচ্ছিল। চাঁদ এবং সোহানী তাদের ভালোবাসা দেখে মলিন হাসল। এরমধ্যেই চাঁদের হঠাৎ নূরের কথা মনে পড়ল! ছটফট দৃষ্টিতে সে পাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে থাকা নূরের দিকে তাকাল। নূর কাত হয়ে শুয়ে প্রায় গভীর ঘুমে মগ্ন। ছোটো বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে সে। কিছুক্ষণ পর পর হঠাৎ কেঁপে ও উঠছে। হয়তো কিছুটা ঠাণ্ডার অনুভূতি হচ্ছে। তবে এই একটু সময়ের মধ্যে যে নূর গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবে তা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো চাঁদের! স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল চাঁদ। নূরের উদোম শরীরটা ঢাকার জন্য কাঁথা টেনে দিলো নূরের গাঁয়ে! আরাম পেয়ে নূর কাঁথাটাকে ভালোভাবে শরীরে জড়িয়ে নিলো। গাঢ় গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল। আয়মন দরজার বাইরে থেকে বুকে হাত বেঁধে ট্যারা চোখে চাঁদ এবং নূরের সব কার্যকলাপ দেখছিল! নূরের প্রতি এত সচেতনতা দেখে আয়মনের পাশাপাশি সাব্বির ও বেশ অবাক হলো! আয়মনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিস্মিত গলায় বলল,,

“ভাই? তুই কি কিছু বুঝছিস? চাঁদের হঠাৎ নূরের প্রতি এত সহানুভূতি?”

আয়মন মাথা নাঁড়িয়ে না বুঝালো। অবুঝ গলায় বলল,,

“কিছুই তো বুঝলাম না রে। রাতারাতি এত পরিবর্তন? অনেকক্ষণ তো হলো আমি এলাম। একটিবারের জন্যও চাঁদ আমার কাছে এলো না! অদ্ভুত না?”

আয়মনের অভিব্যক্তি শেষ হতেই চাঁদ এবার আয়মনের দিকে মনঃসংযোগ করল! প্রাণোচ্ছ্বল হেসে আয়মনের দিকে এগিয়ে এলো। আয়মন যেন প্রাণ ফিরে পেলো! স্মিত হেসে চাঁদের দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে চাঁদকে তার বাহুডোরে ডাকল। চাঁদ ও আয়মনের ডাকে সাড়া দিলো! দ্রুত পায়ে হেঁটে আয়মনকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। আবেগি গলায় বলল,,

“কেমন আছো ভাইয়া?”

আয়মন শুকনো হাসল! গম্ভীর গলায় বলল,,

“এখন কি আর এই ভাইটার কথা মনে আছে তোর? এখন তো নিজের খালাতো ভাই-রা আছে! এই হতভাগা আয়মনকে কি আর মনে আছে?”

চাঁদ নাক ফুলালো! খানিক রেগে বলল,,

“সবার আগে আমার এই ভাইটা বুঝলে? তাকে ছাড়া আমার অন্য ভাইরা আমার কাছে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। তুমিই প্রথম, তুমিই সেরা বুঝলে? এর মাঝখানে আর কেউ নেই। আর কেউ আসবেও না। আমি তাদের আসতেই দিব না!”

আয়মন মৃদু হাসল। আদুরে গলায় বলল,,

“মানে কীভাবে আমাকে পটাতে হয় খুব ভালোভাবেই রপ্ত করে ফেলেছিস তাই না? এত পাঁকা কেন তুই হ্যাঁ?”

চাঁদ ফিক করে হেসে দিলো। আয়মনের বুকের পাঁজর থেকে মাথা তুলে বলল,,

“তোমার বোন যে তাই এত পাঁকা!”

পাশ থেকে সাব্বির তেড়ে এলো চাঁদের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে চাঁদের নাক টিপে বলল,,

“এই আমি কি ভেসে এসেছি হ্যাঁ? আমার কোনো গুরুত্বই নেই? সবার সাথে মিশছিস, কথা বলছিস অথচ আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিস না?”

চাঁদ বিরক্ত হলো। সাব্বিরের হাতটা তার নাক থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। অস্পষ্ট গলায় বলল,

“ভাইয়া নাকটা ছাড় বলছি। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। তোর এই বদঅভ্যেস গুলোর জন্যই তোর সাথে আমি কম মিশি বুঝেছিস?”

চাঁদের নাক ছেড়ে সাব্বির এবার চাঁদের মাথায় গাড্ডা মারল! চাঁদের মুখের সামনে জিভ কেটে বলল,,

“তোর মত বাঁচাল এবং ধূর্ত একটা মেয়ের সাথে মিশতে আমার বয়ে গেছে বুঝলি? তোকে পাত্তা দেওয়ার সময় আছে নাকি আমার?”

চাঁদ ফোঁস করে সাব্বিরের দিকে তাকাতেই সাব্বির বাঁকা হেসে পাশের রুমে ছুট দিলো! চাঁদ গম্ভীর মুখে আয়মনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“দেখেছ ভাইয়া? সাব্বির ভাইয়া আমার সাথে কতটা অবিবেচকের মত কাজ করে? তুমি কখনই তোমার ভাইকে কিছু বলো না। সবসময় তোমার ভাইকেই সাপোর্ট করো।”

আয়মন অট্ট হেসে কিছু বলার পূর্বেই সোহানী তাদের মাঝখানে চলে এলো। আহ্লাদ করে চাঁদের কান টেনে বলল,,

“সাব্বির আপন ছোটো ভাই আয়মন ভাইয়ার। তো আয়মন ভাইয়া উনার ছোটো ভাইকে সাপোর্ট করবে না তো কি তোকে করবে?”

চাঁদ কপাল কুঁচকালো। সোহানীর হাতটা কান থেকে ছাড়িয়ে দিলো। ভেংচি কেটে বলল,,

“তুমিও হয়েছ ঠিক ঐ সাব্বিরটার মতো! তোমার চেয়ে আমার আয়মন ভাইয়া ঢেড় ভালো বুঝতে পেরেছ?”

চাঁদ এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না! নাদিয়া, সাদিয়া, রুহি এবং জায়মাকে নিয়ে হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হয়ে গেল। বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডায় মশগুল হয়ে উঠল। বেহুদা বিষয় নিয়ে হাসতে হাসতে একেকজন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল! আয়মন, সাব্বির এবং হাবিব আবরার ডাইনিং টেবিলে বসে বিভিন্ন ধরনের আলাপ-আলোচনা করছিল। মাঝে মাঝে তাদের বোনদের কাহিনী দেখে মিটমিটিয়ে হাসছিল! নীড় অনেকক্ষণ আগেই অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছে! আগে থেকেই অফিসের কাজ গুছিয়ে রাখছে। নীড়ের সাথে সাদমানও তার বাড়ি ফিরে গেছে। বাড়িতে কিছু জরুরী কাজ আছে তাই। অন্যদিকে সাবরিনা আবরার এবং সোহানী মিলে সকালের নাশতা ডাইনিং টেবিলে সাজাতে ব্যস্ত। কারোর দিকে তাকানোর সময় নেই তাদের। নূর গভীর ঘুমে মগ্ন! দিন-দুনিয়ার খবর নেই তার। ঘুমের রেশ কখন কাটবে তারও নিশ্চয়তা নেই। যতক্ষণ অবধি নূর ঘুমিয়ে থাকবে, ততক্ষণ অবধি বাড়িটা নিবিড়ে থাকবে! বাড়ির সবাইও নিশ্চিন্তে থাকবে। নূর ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানেই পরিস্থিতি গরম হয়ে ওঠা! আবারও সবার মধ্যে দুঃশ্চিন্তা কাজ করা।

সাবরিনা আবরার এবং সোহানী ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে সবাইকে ডেকে দিলেন। চাঁদ ও তাদের সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার টেবিলে চলে এলো। চেয়ার টেনে খাবার টেবিলে বসতে যাবে অমনি সোহানী চাঁদের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,,

“এই? দাঁত ব্রাশ করছিস তুই? ঘুম থেকে উঠেই তো লাফাতে লাফাতে এখানে চলে এলি। দিন দিন তুই কিন্তু খাটাশ হয়ে উঠছিস চাঁদ!”

উপস্থিত সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল! চাঁদ ভীষণ লজ্জা পেল। দৌঁড়ে জায়গা পরিত্যাগ করল। নিজের রুমে ফিরে এলো। নূরকে এখনো একই অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখল। নূরের বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসল! নূরের দিকে খানিক এগিয়ে এলো। কিছুক্ষণ নূরের দিকে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে আনমনেই নূরের কপালে হাত বুলিয়ে দিলো! মিনমিনে গলায় বলল,,

“খুব তাড়াতাড়ি আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন ভাইয়া। সব ধরনের শোক কাটিয়ে উঠুন। আপনাকে এভাবে প্রাণশূণ্য দেখতে আমার একদমই ভালো লাগছে না ভাইয়া। কিছু একটা মিসিং মিসিং লাগছে।”

নূরের কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো চাঁদ। দ্রুত পায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। দাঁত ব্রাশ করে এবং ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। সবার সাথে খাবার টেবিলে যোগ দিলো।

,
,

চারদিকে সন্ধ্যা নেমে আসতেই চাঁদ, সোহানী, নাদিয়া, সাদিয়া, রুহি এবং জায়মা মিলে কিছু স্ন্যাক্সস নিয়ে ছাদে চলে এলো আড্ডা দিতে! আয়মন এবং সাব্বির গেল বাড়ির পাশের দোকানে। বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠছিল তারা। তাই একটু রিফ্রেশমেন্টের জন্য বের হওয়া। অন্যদিকে নূরের মাত্র ঘুম ভাঙল! ঘুম থেকে উঠেই সে অস্থির হয়ে উঠল! পাগলের মতো রুমে ছুটোছুটি আরম্ভ করল। চুল টেনে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করতে লাগল! সাবরিনা আবরার উদ্বিগ্ন হয়ে ড্রয়িংরুম থেকে দৌঁড়ে এলেন নূরের রুমে। নূরকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে উনি কেঁদে উঠলেন। উত্তেজিত গলায় নূরের রক্তিম চক্ষুজোড়ায় তাকিয়ে বললেন,,

“কী হয়েছে বাবা? এমন করছিস কেন তুই?”

নূর চোয়াল উঁচু করে সাবরিনা আবরারের দিকে তাকালো! ঘাড়ের রগ টান টান করে বলল,,

“তুমি বুঝতে পারছ না আমি কেন এমন করছি হ্যাঁ? বুঝতে পারছ না? তুমি জানো না আজ রোজের গাঁয়ে হলুদ?”

নূরের এই ভয়ংকর রূপ দেখে সাবরিনা আবরার শুকনো ঢোক গিললেন! কম্পিত গলায় বললেন,,

“তুই আমার সাথে এভাবে চোখ লাল করে কথা বলছিস কেন নূর? কী হয়েছে তোর?”

সাবরিনা আবরারের করা প্রশ্নে নূরের কোনো রূপ ভাবান্তর হলো না। বদ্ধ উন্মাদের মতো সে রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে গেল। বালিশের তলা থেকে তার সেলফোনটি বের করল। কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো টেনে ধরল। রোজের নাম্বারে বেহায়ার মতো ডায়াল করতে লাগল। ঐ পাশ থেকে রোজ কল রিসিভ করছিল না! হলুদের সাজে সাজতে ব্যস্ত সে! নূরের কল তার ফোনে যতোবার বেজে উঠছিল ততোবারই সে ডুকরে কেঁদে উঠছিল! তবে এই অবস্থায় সে নিরুপায়। হৃদয় কেঁদে উঠলেও কিছু করার নেই তার! নূর আরও অস্থির হয়ে উঠল। হাতে থাকা ফোনটি ফ্লোরে ছুড়ে মারল। হ্যাংগার থেকে কালো রঙের টি-শার্টটি গাঁয়ে জড়িয়ে রুম থেকে বের হতেই সাবরিনা আবরারের মুখোমুখি পড়ে গেল। উদ্বিগ্ন হয়ে সাবরিনা আবরার নূরের পথ আগলে দাঁড়াতেই নূর চোয়াল শক্ত করে আবারও সাবরিনা আবরারের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“চাঁদ কোথায় মা? চাঁদ কোথায়?”

সাবরিনা আবরার ঘাবড়ে ওঠা গলায় বললেন,,

“আগে বল কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

নূর অধৈর্য্য গলায় বলল,,

“মা প্লিজ বলো চাঁদ কোথায়?”

সাবরিনা আবরার রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন,,

“চাঁদ ছাদে।”

নূর আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না! দ্রুত পায়ে হেঁটে ছাদে উঠে গেল। আড্ডার আসর থেকে চাঁদকে টেনে হেছড়ে এক সাইডে নিয়ে এলো। উত্তেজিত হয়ে সামনের চুলগুলো টেনে বলল,,

“তোমার ফোন কোথায়?”

চাঁদ হতবিহ্বল দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। কাঠ কাঠ গলায় বলল,,

“কেন?”

“রোজকে ফোন দাও। জাস্ট একবার ওর সাথে কথা বলিয়ে দাও।”

#চলবে…?