প্রেমালিঙ্গণ পর্ব-০২

0
505

#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-২

বিশাল উঠোনে আড্ডা চলছে। আকাশ জুড়ে পূর্ণিমার চাঁদ বিদ্যমান। বড় জাম গাছটার আড়াল থেকে চাঁদের আলো এসে পড়ছে পুরো উঠোন জুড়ে। কিছু কিছু জায়গায় আবছা আবছা। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে তন্দ্রা এবং তার কাজিনরা বসে আড্ডা দিচ্ছে। ভাই বোনদের খুনসুটি মাখা আড্ডা গুলো খুবই মিস করে তন্দ্রা। হসপিটাল থেকে স্বাক্ষরকে মাত্র তিনদিনের ছুটি দেওয়া হয়েছে। তাই ওরা গায়ের হলুদের দিন এসেছে। আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল। এতোদিন পর বাবার বাড়িতে এসে খুবই খুশি সাহেরা এবং তাহেরা। গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে এগারোটার দিকে। রুবি সেই কখন তার ঘরে ঘুমোতে চলে গেছে। এখানে শুধু বসে আছে শুভ, হেনা, তুলি, তন্দ্রা, শিরিন, সাইফ, আর হাসনা। স্বাক্ষরও এখানে আছে তবে ওদের থেকে দূরে একটা চেয়ারে বসে ফোনে ক্যারম খেলছে। ওর এইসব আড্ডা একদমই পছন্দ নয়। ওদের আড্ডার মাঝেই শুভর ফোনে তার গার্লফ্রেন্ডের কল আসে। সে কল রিসিভ করে কথা বলতে থাকে। দুজনের কথার একপর্যায় শুভ কলটা কে’টে দিয়ে ফোনটাকে হাতে নিয়ে চেচিয়ে বলে ওঠে।

–বন্ধু তুমি একা হলে আমায় দিও ডাক, তোমার সাথে গল্প করবো আমি সারারাত।

শুভর কথা শুনে সবাই একত্রে এসে দেয়। হেনা তার পিঠে চাপড় মা’রে।

–ধরা পড়লে তোর উপর গণধোলাই পড়বে এটা নিশ্চিত।
–তারপর টিভির হেডলাইন হবে, গার্লফ্রেন্ডের সাথে সারারাত গল্প করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল যুবক শুভ। আর সেই গণধোলাইয়ে প্রাণ হারিয়েছে নিস্পাপ ছেলেটি।

হাসনার কথায় শুভ মুখটাকে কাঁদোকাঁদো করে রাখে। তন্দ্রার কোলে মাথা রেখে তুলি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ আগেই। সাইফ কন্ঠস্বর খাদে রেখে বলে…

–তোরা তো আজ আমার কাছে গান শুনতে চাইলি না৷ আগে তো এমন ছিলি না তোরা?
–এখন আমরা চালাক হয়ে গেছি।
–তুই চুপ থাক হেনা। তন্দ্রা তুই শুনবি আমার গান?
–ভাইয়া ক্ষমা কর। গত বছর তোর গান শুনে আমার অজ্ঞান হওয়াটাই বাকি ছিল।
–শরম দিলি ভাই রে?
–তোর কি লজ্জা শরম আছে নাকি? তন্দ্রা তো ঠিকই বলেছে। তোর যা গলা, শেষে দেখবি কুকুর পানিতে নেমে আ’ত্ম’হ’ত্যা করতে চাইবে।
–আর তোর গলা কি? ফাটা বাঁশ একটা।

শিরিন বেজায় রাগ দেখায় সাইফকে। ওদের সব কথাই স্বাক্ষর বসে বসে শুনছে আর বিরক্ত হচ্ছে৷ রাত বারোটায় এদের থেকেই এমন উদ্ভট কথাবার্তা আশা করা যায়। সে কিছুটা গম্ভীর স্বরে তন্দ্রাকে বলে….

–তন্দ্রাবতী অনেক রাত হয়েছে ঘরে যা। তুলিরও এখানে ঘুমোতে সমস্যা হচ্ছে।

তালুকদার বাড়ি আজ যেন আলোয় আলোয় ঝলমল করে উঠছে। মণিকুড়া গ্রামের এই একটা বাড়িই সবচেয়ে বড়। বাড়িটা যেন নিজের আভিজাত্যকে আঁকড়ে ধরে আছে। আজ এ বাড়ির বড় নাতনি রুবির বিয়ে। বিশাল বাড়িটা আজ মেহমানে গিজগিজ করছে। পুরো গ্রামবাসীকেই দাওয়াত করেছেন মিজান তালুকদার। নাতনির বিয়েতে খুশির সীমা নেই উনার। আছরের নামাজের পরপরই বরযাত্রীরা চলে আসবে তাই উনার যত অতিথি আছে সবাইকে দুপুরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। মিজান তালুকদারের তিনটে ছেলে দুটো যমজ মেয়ে। বড় ছেলের এক ছেলে এবং দুই মেয়ে শুভ, রুবি আর শিরিন। মেঝো ছেলের তিন ছেলে মেয়ে সাইফ, হেনা আর হাসনা। উনার ছোট ছেলের তো কোনো কথাই নেই। বয়স তার আটত্রিশ এর কাছাকাছি। বিয়ের নাম গন্ধও নেই। সারাদিন সন্যাসীদের মতো ভবঘুরে হয়ে থাকে।

লাল বেনারসি শাড়ি পড়ে বউ সাজে সুন্দরী রমণীর থেকে কম লাগছে না রুবিকে। তন্দ্রা, হেনা, হাসনা, শিরিন আর তুলি এই ঘরে বসে আছে। নিজেরাই সাজিয়ে দিয়েছে রুবিকে৷ হেনা, হাসনা আর শিরিন শাড়ি পড়েছে৷ তন্দ্রা শাড়ি সামলাতে পারে না তাই সে আর তুলি একই রকমের লং গাউন পড়েছে। পুরোটা গাউন লাল রঙের আর ছোট ছোট সাদা স্টোনের কারুকাজ করা। হালকা সাজ আর সুন্দর করে হিজাব করেছে তন্দ্রা। নিজে তৈরি হয়ে তুলিকেও সাজিয়ে দেয়। বাইরে থেকে মানুষের শোরগোল শোনা যাচ্ছে। হয়তো বরযাত্রীরা চলে এসেছে। রুবিকে বিছানার উপর বসিয়ে রেখে ওরা পাঁচজন বাইরে চলে আসে। বরকে বরণ করে হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। শিরিন আর হাসনা গিয়ে গেইট আটকায়। তন্দ্রা হেনা আর তুলি ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। স্বাক্ষর সকালেই জানিয়ে দিয়েছে, গেইটে যখন বরযাত্রীদের আটকানো হবে তখন যেন তাকে সামনে দেখা না যায়। যেচে পড়ে যেন কোনো ছেলের সাথে কথা না বলে। উল্টো পাল্টা কিছু দেখলেই ভার্সিটি বাঙ্ক দিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথাটা স্বাক্ষর তার মা’কে জানিয়ে দিবে৷ তাহেরা জানতে পারলে ভীষণ বকবে সেই ভয়ে তন্দ্রা মুখ বুজে স্বাক্ষরের কথা মেনে নেয়। গেইট ধরে হাসনা বিশ হাজার টাকা দাবি করলে বর পক্ষের একটা ছেলে বলে ওঠে…

–এ তো মেয়ে না সাক্ষাৎ ডা’কা’ত রানী।
–যেহেতু ডা’কা’ত রানী বলেছেন, ডা’কা’তি তো করতেই হয়।
–তালুকদার বাড়ির মেয়ে তো এমনি এমনি নিয়ে যেতে পারবেন না দুলাভাই। শালিক পাখিদের দাবি মানুন আর বউকে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যান।

তন্দ্রার কথা প্রতুত্তরে বরের ভাই বুকে হাত গুজে।

–আর যদি দাবি না মেনে ভাবীকে তুলে নিয়ে চলে যাই?
–বউ খুঁজে বের করা কি এতোই সোজা?

রুবির হবু বর রবিন তার ভাইয়ের কানাকানি কিছু একটা বলে। এরপর ওরা আপস করে নেয়। রবিন নিজের হাতে দশ হাজার টাকার বান্ডিলটা শিরিনের হাতে দিয়ে দেয়। এরপর বরযাত্রী স্বসম্মানে স্টেজে নিয়ে যাওয়া হয়। তন্দ্রা তুলিকে নিয়ে রুবির কাছে আসে। তুলির খুব ক্ষিধে পেয়েছে তাই তন্দ্রা তার জন্য প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসে। স্টেজে বরপক্ষের ছেলেরা বসে আসে। বরপক্ষের বড়রা কনেপক্ষের বড়দের সাথে কথা বলছেন। এদিকে রবিনের একটু ওয়াশরুমের যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। স্টেজের পাশে জুতা খুঁজে না পাওয়ায় তার ভাই রনি বলে…

–সুন্দরী বিয়াইনরা জুতা চুরি করতে পারে আগে জানতাম না তো। তবে আমরাও কিন্তু কম যাই না। একজোড়া হারাবে আরেক জোড়া রেডি।

হেনা ঠোঁট উঁচু করে চু চু শব্দ করে। এরপর হায় হুতাশ করে ছেলেটাকে বলে….

–আপনার জুতা কোথায় বিয়াই সাব?

রনি সাইডে তাকিয়ে দেখে তার জুতা উধাও হয়ে গেছে। রনিকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে হেনা হেসে দেয়। এইদিকে বাড়ির ছেলেরা বরযাত্রীদের খাওয়াতে ব্যস্ত। খাওয়ার পালা শেষ হলেই বিয়ে পড়ানো শুরু হবে। ঘন্টা খানেক পর কাজী সাহেব চলে আসেন। আর বিয়ে পড়ানো শুরু করেন। কাজী সাহেব কবুল বলতে বলার সাথে সাথেই রবিন কবুল বলে দিয়েছে। এরপর কাজী সাহেব রুবির কাছে যান। তাকে কবুল বলতে বললে সে কিছুক্ষণ থেমে কান্না করে দেয়। এখানে হেনা, হাসনা, শিরিন, তন্দ্রা আর তুলিও আছে। রুবির পাশে বসে তন্দ্রা তার হাতটা শক্ত করে ধরে। রুবি কবুল বলে দেয়। কিছুক্ষণ পর বর বউকে একসাথে বসানো হয়। আয়নার মুখ দেখার পর্ব শুরু হয়। রুবি এখনো ঘোমটা টেনে আছে। হেনা একটা আয়না নিয়ে আসে। শুভ রুবির পাশে গিয়ে বসে।

–আপা দুলাভাইকে তোকে গিফট করলাম। কিভাবে তরমুজ বানাবি তোর ব্যাপার।

তন্দ্রা, হেনা, হাসনা আর শিরিন ফ্যালফ্যাল করে শুভ দিকে তাকায়। তরমুজ বানাবে? লাইক সিরিয়াসলি! তন্দ্রা শুভর কথার প্রত্যুত্তরে বলল…

–কিসের মধ্যে কি? ওটা তরমুজ না তেজপাতা হবে।
–ওই একই হলো।

বর বউ দুজনকে একসঙ্গে খাবার টেবিলে নিয়ে যাওয়া হয়। শুভ আর সাইফ বেড়ে বেড়ে দিচ্ছে। তন্দ্রাও কিছুক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। তন্দ্রা এবার চোখ যায় স্বাক্ষরের দিকে। সাদা পাঞ্জাবী পড়েছে সে। তাদের জামার বিপরীত স্বাক্ষরের পাঞ্জাবি। সাদা পাঞ্জাবীতে লাল স্টোনের কারুকাজ করা হয়েছে। স্বাক্ষর তার নানাভাইয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলার ফাঁকে এক দু’বার নিজের কালো ফ্রেমের চশমাটা আঙ্গুল দিয়ে ঠিক করছে। এরই মধ্যে তন্দ্রা তা গুনেও ফেলেছে। সে তুলিকে বলে, মায়ের কাছ থেকে একটা মাথা ব্যথার টেবলেট যেন তার জন্য ঘরে নিয়ে যায়। এই বলে তন্দ্রা চলে যায়। ফ্যান অন করে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। তন্দ্রা মনে করে তুলি এসেছে তাই সে চোখ বন্ধ রেখেই তাকে ভেতরে আসতে বলে।

–ঔষধটা খেয়ে নে। বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

স্বাক্ষরের গলার আওয়াজ শুনে চোখ মেলে তাকায় তন্দ্রা। শোয়া থেকে উঠে বসে।

–তুমি এখানে?
–তুলির থেকে জানলাম তোর নাকি মাথা ব্যথা করছে! মা, ছোট মা সবাই ব্যস্ত তাই আমিই নিয়ে আসলাম। কিছু খেয়েছিস?
–হুম!
–তাহলে ঔষধটা খেয়ে নেয়।

তন্দ্রা স্বাক্ষরের হাত থেকে ঔষধ আর পানির গ্লাসটা নেয়। খাওয়া হলে স্বাক্ষর তাকে বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিতে বলে।

–আপুকে যখন বিদায় দিবে আমাকে তখন ডেকে দিও ভাইয়া?
–আচ্ছা। ঘুমা তুই।

স্বাক্ষর ঘরের দরজা চাপিয়ে চলে যায়। সেই সুযোগে তন্দ্রা কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়। কাল রাতে ঘুম না হওয়ার জন্য এতোক্ষণ মাথা ব্যথা করছিলো।

চলবে?…….