প্রেমালিঙ্গণ পর্ব-০৩

0
417

#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-৩

তিনদিন গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে আজ তন্দ্রা তার পরিবারের সাথে বাড়ি ফিরেছে। যতই ঘুরতে বা বেড়াতে যাক নিজের বাড়ির মতো শান্তি অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। তন্দ্রা বাসায় এসেই সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় সটানভাবে শুয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নেয়।

–হোম সুইট হোম।

তাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তুলি বলে….

–বাইরে থেকে এসে ফ্রেশ না হয়েই শুয়ে পড়েছ আপু!

অন্যদিকে স্বাক্ষর তার বেস্টফ্রেন্ড আকাশের কাছে অ্যালভিনকে রেখে গিয়েছিল। অ্যালভিনকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই সে ওদের বাসার এসেছে। স্বাক্ষরের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ঢুলতে ঢুলতে অ্যালভিন তার গা ঘেঁষে সোফায় বসে পড়ে। অ্যালভিনকে দেখা মাত্রই স্বাক্ষর আদর করে কোলে তুলে নেয়।

–অ্যালভিন আই মিস ইউ!

বিড়ালটা কি বুঝলো কে জানে! সঙ্গে সঙ্গে সেও “মিয়াও” বলে উঠলো।

গোধুলি বিকেল। সূর্যের তাপ অনেক আগেই কমতে শুরু করেছে। তন্দ্রা কাধে ব্যাগ জড়িয়ে প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়তে যাচ্ছে। পাশেই বকবকানি ইলোরা তো আছেই। তার বকবকানির মূখ্য ভূমিকাই হচ্ছে মুহিত। গত তিনদিনে কি কি হয়েছে সেই নিয়েই কথা বলছে ইলোরা। তবে তন্দ্রা অন্যমনস্ক হয়ে আছে কিছু একটা ভেবে। কি ভাবছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটার কারণে ইটের কণার সাথে পা লেগে পড়েই যেতে নিচ্ছিলো তন্দ্রা। ইলোরা তার কথা বন্ধ করে তাকে ধরে ফেলে। একটু হলেই পড়ে গিয়ে বেশ ভালোই ব্যথা পেতে হতো তাকে। সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।

–কি হয়েছে তোর? কি এতো ভাবছিস?
–কিছু না। চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তন্দ্রার বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে আসে। স্বাক্ষরেরও তখন বাড়ি ফেরার সময় হয়ে যায়। রিকশা দাঁড়ায় ইলোরা’দের বাসার গলির সামনে। তখনই সেখান দিয়ে স্বাক্ষর তার বাইক নিয়ে ফিরছিলো। তার চোখ মুখে ক্লান্তি ছাপ স্পষ্ট বিদ্যমান। সে বাইক থেকে নেমে রিকশার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওয়ালেট বের করে রিকশা ভাড়া পরিশোধ করে দেয়।

–রিকশায় যেতে হবে না। চল আমার সাথে।

তন্দ্রা বিনাবাক্যে রিকশা থেকে নেমে আসে। সে কিছু বললেও স্বাক্ষর তার কোনো কথাই শুনবে না। এমনটা আরও দুদিন হয়েছে তাই এই মুহুর্তে সে আর দ্বিমত করেনি।

বাসায় এসে কলিং বেল চাপতেই তুলি এসে গেইট খুলে দেয়। তার সাথে করে অ্যালভিনও লাফাতে লাফাতে ড্রইংরুম অব্দি চলেই এসেছে৷ তন্দ্রাকে দেখা মাত্রই অ্যালভিন দৌঁড়ে কাছে ছুটে আসে।

–ওরে মা রে!

হঠাৎ করে অ্যালভিনকে দেখে তন্দ্রা ভয়ে ঘাবড়ে গিয়ে কি করবে ভেবে পায় না৷ তাড়াতাড়ি করে স্বাক্ষর পেছনটায় লুকিয়ে পড়ে। তন্দ্রার এরূপ ব্যবহারে চরম বিরক্ত স্বাক্ষর। মেয়েরা নাকি বিড়াল পছন্দ করে, এই মেয়ে হচ্ছে তার উল্টো। এত্তো কিউট বিড়ালকে কেন ভয় পেতে হবে। অ্যালভিন কি তাকে খেয়ে ফেলবে! এই সমস্ত কথাই ভাবতে থাকে স্বাক্ষর। তন্দ্রা তার ঘামে জড়ানো শার্টটাকে আঁকড়ে ধরে ভীতু গলায় বলল…

–ভাইয়া প্লিজ ওকে দূরে সরাও।
–আমি পারবো না।
–তুমি যা বলবে তাই শুনবো। প্লিজ!
–সত্যি তো?
–তিন সত্যি।

তন্দ্রার কথায় স্বাক্ষর তার সামনে থেকে সরে এসে অ্যালভিনকে কোলে তুলে নেয়। অ্যালভিন যেন আরও আহ্লাদী হয়ে তার শরীরের সাথে মিশে থাকে। সুযোগ পেয়ে তন্দ্রা তার ঘরে দৌঁড়ে আসে। যেন এতোক্ষণে সে শান্তির নিশ্বাস ফেলতে পেরেছে। স্বাক্ষর তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আনমনেই হেসে দেয়। একহাতে অ্যালভিনকে ধরে অন্য হাতে দরজা আটকে নিজের ঘরে চলে আসে।

তন্দ্রা ফ্রেশ হয়ে নিজের ঘরেই বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে সাহেরা মাহমুদ তাকে ডেকে গেছে হালকা কিছু নাস্তা করে নেওয়ার জন্য। তবে সে এখন খেতে পারবে না বলে দিয়েছে৷ হালকা ক্ষিধে তো তার পেটে আছেই। সাত পাঁচ না ভেবেই সে খাবার টেবিলে চলে যায়। সাহেরা মাহমুদ তন্দ্রার জন্য ঝাল ঝাল নুডলস পরিবেশন করে।রেখেছেন। আজই দুপুর বেলা সে তার বড় মায়ের হাতে নুডলস খাবে বলে বায়না ধরেছিলো। তুলি তার দুই ঝুটি নাচাতে নাচাতে টেবিলে এসে বসে। তন্দ্রা সবে মাত্র এক চামচ মুখে দিয়েছে এমন সময় তন্দ্রা জোরে ডেকে বসে।

–মালাই আইসক্রিম!

তুলির ডাক শোন মাত্রই অ্যালভিন যেখানেই ছিল সেখান থেকে দৌঁড়ে এসে তন্দ্রার পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। হয়তো মনে করেছে তন্দ্রা তাকে ডেকেছে। অ্যালভিনকে দেখা মাত্রই তন্দ্রা চেয়ারে উপর পা তুলে বসে। আর তার সেই একই ডায়লগ…

–ও মা গো।

তখন তাহেরা মাহমুদ ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেয়ের এমন কাজে হতবাক তিনি। সামান্য একটা বিড়ালকে কেউ এতো ভয় পায়। আল্লাহ মালুম এই মেয়ে কোন গ্রহের এলিয়েন। তিনি তন্দ্রার দিকে চোখ পাকিয়ে বলেন….

–এক থা’প্প’ড় মে’রে ঠিক করে দেবো বে’য়া’দব মেয়ে। সামান্য একটা বিড়ালকে সবসময় কেন ভয় পেতে হবে? ও কি বাঘ না ভাল্লুক!
–আহা তাহেরা মেয়েটাকে এভাবে বকছিস কেন?
–এই তোদের আশকারায় মেয়েটা দিনকে দিন বাদর হচ্ছে আপা। বলি ও কি এখনো ছোট আছে?

তন্দ্রা চুপ করে নুডলস খেয়ে নেয়। আর একটা টু টা শব্দ হলেই তার মা আবার রেগে যাবেন। অ্যালভিন এখনো ড্যাবড্যাব করে তার দিকেই তাকিয়ে। স্বাক্ষর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর সাদা রঙের টিশার্ট পড়েছে। হয়তো গোসল সেরেই এখানে এসেছে। টিশার্টের বুকের পাশে হালকা হালকা ভেজাও রয়েছে চুল গুলোও হালকা হালকা ভেজা। টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় সে।

–ছোট মা এক মগ কফি করে দিতে পারবে?
–তুই একটু অপেক্ষা কর আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি বাবা।
–হুম।

এই বলে স্বাক্ষর তুলির পাশের চেয়ার টেনে তন্দ্রার মুখোমুখি হয়ে বসে। তন্দ্রার খাওয়া শেষ হতেই সে ঘরে চলে যায়। তুলি স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে…

–ভাইয়া আমার চকলেট?
–আজ তো আমি ছোট পরীর চকলেট আনতে ভুলে গেছি।

চকলেট আনেনি শুনে তুলির মনটা বেজায় খারাপ হয়ে যায়। স্বাক্ষর তার মন খারাপ দেখে হেসে দেয় আর পকেট থেকে চকলেট বের করে এগিয়ে দেয় তুলির দিকে।

–ইয়ে। থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া।

রান্না ঘর থেকে তাহেরা চেচিয়ে বলে…

–একটার বেশি খাবি না তুলি। দাঁতে পোকা হবে। চকলেট খেয়েই ব্রাশ করে নিবি।
–আচ্ছা আম্মু।

চকলেট নিয়ে তুলি তন্দ্রার ঘরে চলে আসে। তাহেরা স্বাক্ষরকে এক মগ কফি এনে দেন। স্বাক্ষর এক গাল হেসে থ্যাঙ্কিউ বলে তার ঘরে চলে যায়। এই মুহুর্তে তার কফি খাওয়াটা খুবই দরকার ছিলো। কফি সে নিজেই বানিয়ে খেতে পারতো তবে ঘর থেকে বের হয়ে দেখে তাহেরা তন্দ্রার উপর রেগে আছেন। উনাকে শান্ত করতে স্বাক্ষর কফির আবদার করে বসে। তাহেরাও খুশি খুশি রান্না ঘরে চলে যান।

তন্দ্রা তার ঘরে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। গত তিনদিনের নোট গুলো ইলোরা তাকে দিয়েছে। নেক্সট সেমিস্টার প্রায় এগিয়েই এসেছে। পড়া ছাড়া এখন তার অন্য কোনো কিছুর প্রতি ধ্যান নেই। তুলি তার একটা বই নিয়ে তন্দ্রার কাছে আসে। কাল তার গনিত সাবজেক্ট নিয়ে ক্লাস টেস্ট আছে। তন্দ্রার কাছে আসা মূলত একটা অংক বুঝার জন্য। সে তুলিকে তার পাশের চেয়ারটায় বসায়। খাতায় অংক করে বুঝিয়ে দিতে থাকে। সে প্রথমে না বুঝলেও পরে মনোযোগ দিয়ে বুঝার চেষ্টা করে।

রাতে খাবার খেতে বসার আগেই হুট করে কারেন্ট চলে যায়। সবে মাত্র খাবার খেতে বসেছিল সবাই। ইলিয়াস, ইউসুফ আর স্বাক্ষর নিজেদের জায়গাতেই বসে আছে। স্বাক্ষর তার ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে রাখে। আইপিএস চলছে না আজ। ইতিমধ্যেই ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা তন্দ্রার। কপাল আর ঘাড়ের সাথে লেপ্টে থাকা চুল গুলো দিয়ে ঘাম বেয়ে পড়ছে। সে টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে দুটো হাত পাখা নিয়ে আসে৷ একটা দিয়ে নিজেই বাতাস করতে থাকে। তাহেরা ওদের খাবার বেড়ে দিতে শুরু করেন। এই গরম আজ সারাদিনে বেশ অনেকবার লোডশেডিং হয়েছে। গরমে ম’রিম’রি অবস্থা দেখে তন্দ্রার বাবা ইউসুফ মাহমুদ বললেন…

–তন্দ্রা মা। তুমি হাত পাখা দিয়ে বাতাস করো আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।
–আব্বু তুমি কি শুধু আপুকেই খাইয়ে দেবে, আমাকে দেবে না?

তুলি তার বোকাসোকা চাহুনিতে বাবার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল। ইউসুফ মাহমুদ আপ্লূত হয়ে নিজের প্লেটেই খাবার বেড়ে নেন মেয়ে দুটোকে খাইয়ে দেবেন বলে।

–আজ আমি আমার দুই মেয়েকেই খাইয়ে দেবো।

চলবে?…….