#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-৬
সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙে স্বাক্ষরের। কাল সারারাত মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। এদিকে তার চোখ বিন্দু পরিমান ঘুম ধরা দেয়নি। সে আড়মোড়া ভেঙে এখনো বিছানাতেই শুয়ে আছে। এই মুহুর্তে যেন কাল রাতের কথা তার ভাবনায় নেই। সে তো আরামসে কোলবালিশটাকে জাপ্টে ধরে আছে। রাতে মেঘ হওয়ার দরূন আবহাওয়া শীতল-ই আছে। সকালের মিষ্টি রোদ সাদা পর্দা ভেদ করে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করছে। বালিশের পাশ থেকে ফোনটা বের করে টাইম দেখে নেয় স্বাক্ষর। হসপিটাল থেকে তিনদিনের জন্য একটা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে৷ উঠেই একটা টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় সে।
তুলি সেই কখন থেকে তন্দ্রাকে ডেকে যাচ্ছে৷ তাকে যে কেউ ডাকছে সেদিকে তার কোনো হেলদোল নেই। কিছু সময় পর পর একটু আধটু “হুম” বলে আবার ঘুমিয়ে যাচ্ছে৷ অন্যদিনের তুলনায় কাল রাতে দেরি করেই নিদ্রারা চোখে হানা দিয়েছিল, যার দরূন এখনো তন্দ্রা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এদিকে তুলির স্কুলে যাবারও সময় হয়ে আসছে। তার আজ ক্লাস টেস্ট আছে। দেরি হয়ে গেলে ক্লাস টিচারের কাছে বকা শুনতে হবে। তন্দ্রা ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে “কোনো এক নির্জন প্রহরে স্বাক্ষরের কাধে মাথা রেখে জোছনা বিলাস করছে সে। স্বাক্ষরের পুরুষালি হাতের মাঝে তার কোমল হাতটা আবদ্ধ হয়ে আছে। দুজনে পাশাপাশি বসে রোমাঞ্চকর মুহুর্ত অতিবাহিত করছে” চোখ পিটপিট করে তন্দ্রা যখন আশপাশটা তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করে, তখন দেখে তার মা কোমড়ে হাত রেখে রাগী দৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। আর তুলি স্কুল ড্রেস পড়ে বিছানায় বসে। মায়ের গম্ভীর মুখটা দেখে ঝটপট শোয়া থেকে উঠে বসে।
–তাড়াতাড়ি তুলিকে নিয়ে তৈরি হয়ে খেতে আয়।
–আচ্ছা মা।
তন্দ্রা বিছানা ছেড়ে নেমে আলমারি থেকে নিজের জন্য একটা কালো রঙের লং জামা বের করে। এরপর তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে এসে তৈরি হয়ে নেয় সাথে তুলিকেও তৈরি করে দেয়। ডাইনিং টেবিলে সবাই ওদের জন্যই অপেক্ষা করছে। তুলি গিয়ে স্বাক্ষরের পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ে। তন্দ্রা স্বাক্ষরের মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসে। এরই মাঝে একটি বারও স্বাক্ষর তার দিকে তাকায়নি। সে নিজের মতোই খাওয়ায় ব্যস্ত। স্বাক্ষরকে দেখা মাত্রই তন্দ্রার কাল রাতের কথা মনে পড়ে যায়৷ মুহুর্তেই লজ্জায় ফর্সা গালে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে। “আচ্ছা, স্বাক্ষর কি তাকে পছন্দ করে বা কোনো ভাবে ভালো টালো বাসে নাকি” এই সমস্ত ভাবনার মাঝেই মায়ের ডাকে তন্দ্রার ঘোর কা’টে।
–আজ কি খাওয়ার ইচ্ছে নেই নাকি? কি এতো ভাবছিস?
তাহেরার কথা সবাই নাস্তা খাওয়া ছেড়ে তন্দ্রার দিকে তাকায়। স্বাক্ষরও এবার তার দিকে তাকিয়েছে। ভ্রুযুগল কুচকে তাকিয়ে আছে তন্দ্রার দিকে। চোখ দিয়েই যেন জিজ্ঞেস করছে “কি হয়েছে?” সবার এভাবে একসাথে তাকানোতে তন্দ্রা মেকি হেসে তার মা’কে বলল….
–এই তো আমি খাচ্ছি। কিছু হয়নি তো।
কোনো রকমে খাবারটা শেষ করে তন্দ্রা। স্বাক্ষর আগেই নাস্তা করে গাড়ি বের করেছে। এখন বাইরে অপেক্ষা করছে তন্দ্রা এবং তুলির জন্য। দু কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, দুই বেনীওয়ালি তুলি গিয়ে উঠে বসে গাড়ির পেছন সিটে। হরহামেশাই তন্দ্রাকে বসতে হয় স্বাক্ষরের পাশে। তন্দ্রা নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য ফোনের মেসেঞ্জার ঘাটাঘাটি করছে। গ্রুপে ফ্রেন্ডদের কি আপডেট আসলো তা জানার জন্য। স্বাক্ষর নিজের মতো করে ড্রাইভ করছে। তবে আড়ালে বার কয়েক আড়চোখে তন্দ্রাকেও দেখছে সে। মোবাইলে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্বাক্ষর খুবই বিরক্ত হচ্ছে। তবে তা প্রকাশ করছে না। তুলিকে তার স্কুলে পৌঁছে দিয়ে স্বাক্ষর আবারও ড্রাইভ করতে শুরু করে। সে তার দৃষ্টি সামনে রেখেই বলে..
–আমার হসপিটাল থেকে তিনদিনের জন্য ক্যাম্পে যাওয়া হচ্ছে৷ আমি কিন্তু তোর খোঁজ রাখবো। বন্ধুবান্ধব নিয়ে যেন বেশি হৈহল্লা না করা হয়। ভার্সিটি আর কোচিং ছেড়ে অন্য কোথাও যাবি না। আমি কল করলে তৎক্ষনাৎ রিসিভ করবি। মিসড কল যেন না হয়। শুনেছি জায়গাটা নাকি খুবই সুন্দর। তোর জন্য কিছু আনবো?
এতোক্ষণ মনোযোগ সহকারে তন্দ্রা স্বাক্ষরের কথা শুনছিল। সে তার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়।
–আমার কিছু লাগবে না।
মুখে এই কথাটা বললেও, মনে মনে সে বলে “মুখে কেন বলতে হবে, তুমি কি জানো না আমার গিফট পেতে কতটা ভালো লাগে!” তন্দ্রা স্বাক্ষরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সকালের ব্যস্ত শহরটাকে দেখতে থাকে। বাইরে থাকে ঠান্ডা বাতাস আসছে। তন্দ্রা চোখ বন্ধ করে তা অনুভব করে। এরই মাঝে ভার্সিটির সামনে চলে আসে ওরা। তন্দ্রা চোখ মেলে তাকায়। একবার স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে, ব্যাগ নিয়ে বের হয়। গেইটের সামনে ইলোরা আর মুহিত তারই জন্য অপেক্ষা করছে। গাড়ি থেকে নেমে তন্দ্রা কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই ইটের কণার সাথে লেগে পড়ে যেতে নিয়েও পড়ে না। মুখ থেকে অস্ফুটে শব্দে ভেসে এলো।
–আহ!
স্বাক্ষর তন্দ্রার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছিল এতোক্ষণ। সে গাড়ি থেকে নেমে তন্দ্রার দিকেই এগিয়ে যায়। ব্যস্ত ভঙ্গিতে তন্দ্রার হাত ধরে বলে….
–দেখে হাঁটবি তো। ব্যথা পেয়েছিস? দেখি কোথায় লেগেছে!
বলেই হাঁটু গেড়ে তন্দ্রার সামনে বসে স্বাক্ষর। পা দেখতে চাইলে তন্দ্রা তার পা সরিয়ে নেয়৷
–আমার কোথাও লাগেনি ভাইয়া৷
–ঠিক তো?
–হুম।
–আচ্ছা তাহলে তুই যা।
স্বাক্ষর বুঝতে চাইছে তন্দ্রার পায়ে কোথাও ব্যথা লেগেছে কি-না। তন্দ্রা স্বাভাবিক ভাবেই হাটার চেষ্টা করে। ডান পায়ে কিছুটা ব্যথা অবশ্য পেয়েছে সে। তবে স্বাক্ষরকে সে তা জানাতে চায় না৷ কষ্ট করে ইলোরার কাছে গিয়ে তার হাতটা ধরে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে একবার স্বাক্ষরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বুঝানোর চেষ্টা করে যে, সে ঠিক আছে। স্বাক্ষর গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
–ভাইয়া কিন্তু তোর প্রতি ভীষণ পসেসিভ।
–আমার তোকে একটা কথা বলার আছে।
তন্দ্রা ইলোরাকে স্বাক্ষরের কথা গুলো বলে। এতোক্ষণ ইলোরা মনোযোগ সহকারে তন্দ্রার কথা শুনছিল।
–আমার কি মনে হয় জানিস?
–কি?
–আমার মনে হয় উনি তোকে পছন্দ করে। তুই পড়ে যাচ্ছিলি আর ভাইয়া কেমন উতলা হয়েছিল তোর ব্যথা পাওয়ায়।
–আমার প্রতি ভাইয়ার পসেসিভনেস এর জন্যই তোর এমনটা মনে হচ্ছে।
–আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। উনার চোখে আমি অন্য কিছু দেখেছি।
তন্দ্রা যেন আবারও চিন্তায় ডুবে গেল। বিড়বিড় করে সেও বলল…
–উনার চোখে আমিও অন্য কিছু দেখেছি।
–কিছু বললি?
ইলোরার কথায় তন্দ্রার চিন্তার ঘোর কাটে। সে আমতা আমতা করে বলে…
–হুম না। কিছু বলিনি।
সারা বিকেল ধরে ঝড়ো বাতাস বইছে। এই বুঝি আকাশ জুড়ে মেঘ বর্ষিত হবে। ইদানীং আবহাওয়া হুটহাট করেই কেমন খারাপ হয়ে যায়। সকালেও বেশ রোদ ছিলো, গরমে টিকে থাকা যাচ্ছিল না আর এখন কেমন আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে। এখন ঘড়িতে চারটে বাজে কিন্তু মনে হচ্ছে এই বুঝি সন্ধ্যে নেমে এলো। বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা বাতাসটা অনুভব করতে ভালোই লাগছে তন্দ্রার। না জানি স্বাক্ষরের ওইখানে আবহাওয়া ঠিক কেমন। চোখ বন্ধ করে তন্দ্রা ভাবতে থাকে।
–সত্যিই কি ভাইয়া আমাকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবে? তাহলে কেন আমি তা আগে বুঝতে পারিনি? মাঝে মাঝে তার চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, ওই চোখ দুটো কিছু বলছে! তার আমার প্রতি কেয়ার, পসেসিভনেস এর মাঝে কিছুটা ভিন্নতা খুঁজে পাই।
সকল ভাবনাকে আলদা করে রেখে তন্দ্রা তার ঘর থেকে বের হয়। এই ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজে গরম গরম খিচুড়ি খাওয়ার মজাই আলাদা। ঘর থেকে বের হয়ে সাহেরা মাহমুদকে খুঁজতে থাকে তন্দ্রা। তার সকল আবদার এই একটা মানুষের কাছেই। সাহেরা মাহমুদ তখন উনার ঘরেই ছিলেন। তন্দ্রা গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরে।
–বড় মা!
তন্দ্রার মুখ দেখে এই যেন সাহেরা মাহমুদ সব বুঝে নিলেন। তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
–বুঝতে পেরেছি। আমার মেয়েটার খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে!
–তুমি কি করে বুঝলে?
–মায়ের সিক্রেট।
কথাটা বলে মুচকি হেসে দেন সাহেরা মাহমুদ।
–রান্না করাই আছে। চল তোদের দু’বোনকে খেতে দিই।
–লাভ ইউ বড় মা।
সাহেরা মাহমুদ তন্দ্রার বাচ্চামিতে হেসে দিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়। তন্দ্রা এই ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। ইলিয়াস মাহমুদ এবং ইউসুফ মাহমুদ এখনো বাড়িতে আসেননি। তন্দ্রা ধীর পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং টেবিলে যায়। পায়ে হাল্কা ব্যথা এখনো আছে। সাহেরা মাহমুদ তন্দ্রা এবং তুলির জন্য প্লেটে খিচুড়ি বাড়ছেন। চেয়ার টেনে সেখানটায় বসে। এক চামচ মুখে নিয়ে খেতে শুরু করে। তন্দ্রা আজ স্বাক্ষরকে একটু একটু মিস করছে।
চলবে?…….
