প্রেমালিঙ্গণ পর্ব-০৭

0
329

#প্রেমালিঙ্গণ
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-৭

সকাল থেকে এখনো তন্দ্রা তার ঘর থেকে বের হয়নি। তুলিকে স্কুলের জন্য আজ তাহেরা মাহমুদই তৈরি করে খাইয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আজ থেকে তন্দ্রার সেমিস্টার শুরু হয়েছে। স্টাডি টেবিলে গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে সে। এখন আপাতত পড়া ছাড়া তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ অন্য কিছুই নেই। তন্দ্রা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একপলক সময় দেখে নিলো। ঘড়িতে এখন দশটা বেজে পনেরো মিনিট। স্বাক্ষর তিনদিনের ক্যাম্প শেষে আজ সকাল সাতটার দিকে বাসায় ফিরেছে। জার্নি করে আসার ফলে টায়ার্ড সে। কোনো রকমে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় সটানভাবে শুয়ে পড়েছে। তন্দ্রা ঘর থেকে বের না হওয়ায় স্বাক্ষরের সাথে তার দেখা হয়নি। স্বাক্ষর আসার খবরটা তুলিই তাকে দিয়েছে।

ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা বাজতে চললো। তাহেরা মাহমুদ তন্দ্রাকে তৈরি হয়ে নিতে বলেন। ইলিয়াস মাহমুদ এবং ইউসুফ মাহমুদ অনেক আগেই নাস্তা করে অফিসে চলে গেছেন। সাথে করে তুলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছেন। তন্দ্রা বই পড়া বন্ধ করে আলমারি থেকে মেরুন রঙের গাউনটা বের করে। কদিন আগেই জামাটা সে উপহার পেয়েছে তবে কে দিয়েছে তার জানা নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জামাটাকে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে দেখছে, কেমন লাগবে পড়লে! এরপর সেটা নিয়েই ওয়াশরুমে চলে যায়। তন্দ্রা গোসল করেই বের হয় ওয়াশরুম থেকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো মুছছে আর নিজেকে দেখছে। মেরুন রঙটা তার গায়ে ভালোই মানিয়েছে। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে লম্বা চুলগুলো তাড়াতাড়ি করে শুকিয়ে নেয় তন্দ্রা। এরপর ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়। সে ঘর থেকে বের হয়ে দেখে তাহেরা মাহমুদ তার জন্য প্লেটে খাবার বাড়ছেন। তন্দ্রা গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ে। তন্দ্রা বসতেই স্বাক্ষর আসে। ধূসর রঙা শার্ট পড়নে, চুলগুলো বাতাসে নড়েচড়ে উঠছে। ফর্সা গায়ে ধূসর রঙা শার্টটা যেন ফুটে উঠছে। গোসল করার ফলে দেখতে খুব স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। তন্দ্রা গভীর ভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে স্বাক্ষরের কতবার পলক পড়েছে তাও গুনে ফেলেছে তন্দ্রা।

–এই জামা কবে কিনলি?

মায়ের প্রশ্নে অবাক হয়ে যায় তন্দ্রা৷ সে তো ভেবেছিল তার বাবা মা হয়তো কিনে এনেছে।

–আমার ঘরের বিছানার উপর ছিল। আমি ভেবেছি তোমরা দিয়েছো।

স্বাক্ষর খাওয়া বাদ দিয়ে সাহেরা মাহমুদ এর দিকে তাকায়। সাহেরা মাহমুদ পানির গ্লাসটা তন্দ্রার দিকে এগিয়ে দিয়ে তাহেরা মাহমুদকে বলেন…

–আমি এনেছিলাম তন্দ্রার জন্য। জামাটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল তাই।
–ওহ তাই বল।

এতোক্ষণে স্বাক্ষর যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। তন্দ্রার কেন জানি না সাহেরা মাহমুদ এর কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না। চোখ ছোট ছোট করে একবার স্বাক্ষরের দিকে তাকালো সে। স্বাক্ষর দিব্যি নিজের মতো করে খেয়ে যাচ্ছে। তন্দ্রা আর কথা বাড়ায় না।

নাস্তা করেই স্বাক্ষর বাসা থেকে আগেই বের হয়ে আসে। গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে ফোন ঘাটছে আর তন্দ্রার বের হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। তন্দ্রা তার মা এবং বড় মা’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ির কাছে আসে। স্বাক্ষর তন্দ্রাকে দেখা মাত্র অপর পাশে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তন্দ্রা বসতেই স্বাক্ষর ড্রাইভিং সিটে বসে।

–তন্দ্রাবতী ইউ লুকিং বিউটিফুল।

কথাটা বলেই স্বাক্ষর গাড়ি স্টার্ট দেয়। এক্সামের জন্য কিছুটা টেনশন হতে থাকে তন্দ্রার। সে বসে থেকেই বাইরের দিকে তাকিয়ে দু’হাত কচলাতে থাকে। স্বাক্ষর তন্দ্রার অবস্থা বুঝতে পেরে গান ছেড়ে দেয়।

এই মন কিছুই চায় না শুধু তুই হলেই চলে
নাম লিখিয়েছি বুঝি আমি তোর ঐ কপালে
ধরে মন শুধু বায়না তোকে দেখবে যে বলে
মন আর কিছুই চায় না শুধু তুই হলেই চলে
দুজনে ডুবে আছি…
দুজনে ডুবে আছি দুজনেরই মন গভীরে
যে বাধন বেধেছি তা কখনো যাবে না ছিড়ে

এদিকে তন্দ্রার এক্সামের জন্য কিছুটা টেনশন হচ্ছে তার উপর গম্ভীর মহারাজ মনের সুখে গান শুনছেন। তন্দ্রা চোখ ছোট ছোট করে বার কয়েক আড়চোখে স্বাক্ষরের দিকে তাকায়। এতে করে তার কোনো হেলদোল নেই বললেই চলে। সে নিজের মতো করেই ড্রাইভ করছে। তন্দ্রা ভেবে পায় না হঠাৎ করে স্বাক্ষরের রোমান্টিক গান শোনার মানে টা কি! রোমান্টিকতা যে তার বৈশিষ্ট্যের সাথে বড্ড বেমানান লাগছে। তন্দ্রার ঠিক হজম হচ্ছে না ব্যাপারটা। বিরক্ত হয়ে নিজের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে গানটাকে অনুভব করতে থাকে। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে। মুহুর্তটা ভালোই লাগছে তন্দ্রার, সাথে গানটাও।

তোকে ছুঁয়ে আমি বলে দিয়ে গেলাম
আমার আমি’টাকে তোকে লিখে দিলাম
আজ থেকে আমি যতটা না নিজের
তারও বেশি হলাম তোর ঐ হৃদয়ের
তোকে খুব ভালোবাসি…
তোকে খুব ভালোবাসি, ছুটে তাই কাছে আসি
দুজনের রবো দুজন, এভাবেই বারোমাসই
দুজনে ডুবে আছি, দুজনেরই মন গভীরে
যে বাধন বেধেছি তা কখনো যাবে না ছিড়ে

গান শোনার এক পর্যায়ে তন্দ্রা ঘুমিয়েই পরেছে। স্বাক্ষর নিজের কাধ থেকে তন্দ্রার মাথা সন্তপর্ণে সরিয়ে দিয়ে তাকে ডাক দেয়। ঘুমের মাঝেই তন্দ্রা বার বার জানালার সাথে ধাক্কা লাগছিল তাই স্বাক্ষর নিজের কাধে তার মাথা রাখে। ভার্সিটি সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে পাঁচ মিনিট হতে চললো। স্বাক্ষর একবার হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে তন্দ্রাকে ডাকতে শুরু করে।

–তন্দ্রাবতী! আমরা এসে পড়েছি। উঠ!

চোখ পিটপিট করে তন্দ্রা তাকিয়ে দেখে স্বাক্ষর তারই দিকে তাকিয়ে আছে। সে সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে ব্যাগ হাতে নিয়ে স্বাক্ষরকে বলে…

–আসছি।
–হুম! অল দ্য বেস্ট।

তন্দ্রা মুচকি হেসে গাড়ি থেকে নেমে যায়। স্বাক্ষর তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। তন্দ্রা ভার্সিটির ভেতর প্রবেশ করার বেশ কিছু সময় পর স্বাক্ষর গাড়ি নিয়ে চলে যায়। অফিস রুমের সামনে ইলোরা আর মুহিত তন্দ্রার জন্য অপেক্ষা করছিল৷ তিনজনের সিট এক সিরিয়ালেই পরেছে।

গোধুলি বিকেল। আকাশটা বেশ পরিস্কার। নীলাভ আকাশে পাখিরা নিজের খেয়াল খুশি উড়ে বেড়াচ্ছে। তন্দ্রা, ইলোরা আর মুহিত মাত্রই এক্সাম দিয়ে বের হয়েছে। গেইটের বাইরেই ফুচকা ভেলপুরি দোকান বসেছে। সাথে ঝালমুড়ি তো আছেই। তন্দ্রা দু প্লেট ফুচকা অর্ডার দেয়। মুহিত খাবে না, আগেই বলে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝে দোকানদার মামা দু প্লেট ফুচকা দিয়ে যান। দেখতেও বেশ ঝাল ঝাল। মুহিত ফোন ঘাটতে ঘাটতে প্রশ্ন করে।

–এতো ঝাল তোরা খাস কি করে?
–এভাবে!

বলেই একটা ফুচকা মুখে পুরে নেয় তন্দ্রা। ইলোরা তো আগেই খেতে শুরু করে দিয়েছে। অনেকদিন পরেই আজ দুজন একসাথে ফুচকা খাচ্ছে। ইলোরা ফুচকা চিবোতে চিবোতে বলল….

–আমরা কিভাবে খাই তা তুমি খেলেই বুঝতে পারবে।
–কেন?
–এটা বলে বুঝানো যায় না রে পাগলা। খেয়েই দেখো।

ইলোরা জোর করে একটা ঝাল দেওয়া ফুচকা মুহিতের মুখে পুরে দেয়৷ মুহিতও তা খেয়ে নেয়।

–পানিইইইইইই।

মুহিতের চেচামেচিতে তন্দ্রা আর ইলোরা নিজেদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। তন্দ্রা উঠে গিয়ে পনেরো টাকা দিয়ে এক বোতল পানি কিনে নিয়ে আসে। মুহিত এক মুহুর্তেই পুরো পানি সাবাড় করে ফেলে। তন্দ্রা আর ইলোরার ফুচকা খাওয়া শেষ হতেই মুহিত বিল মিটেয়ে দেয়। এরপর দুজনে রিকশায় চড়ে বসে।

রাতে তন্দ্রা সবে মাত্র খাবার খেয়ে তার ঘরে এসেছে। তুলি তার হেয়ার ব্যান্ড আর চিরুনি নিয়ে আসে চুলে বেনী গাঁথার জন্য। তন্দ্রা তুলিকে দুই বেনী গেঁথে দেয়৷ তুলি ওয়াশরুম থেকে ব্রাশ করে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। এতোক্ষণে তন্দ্রাও তার চুলে বেনী করে ফেলেছে। এতোক্ষণে তুলি ঘুমিয়েও পড়েছে। পরবর্তী এক্সাম আবার তিনদিন পর। তন্দ্রা ফ্রেশ হয়ে শুতে নিবে এমন সময় কেউ দরজায় নক করে। অনুমতি পেয়ে স্বাক্ষর ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।

–কিছু কি দরকার ভাইয়া?
–তোকে একটা জিনিস দেওয়ার আছে।

একটা জিনিস দেওয়ার কথা শুনেই তন্দ্রা ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে। চারদিন আগের ঘটনা মনে পড়ে যায়। সেদিন তো স্বাক্ষর একটা অসম্ভব কাজ করে ফেলেছিল। আজ না জানি কি দেবে। ভাবতেই কেমন একটা হচ্ছে তন্দ্রার। স্বাক্ষর তন্দ্রাকে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড় করায়। অজানা কারণেই তন্দ্রার হৃদস্পন্দন বাড়ছে। স্বাক্ষর তার অনেকটা কাছাকাছিই। আয়নায় তন্দ্রা স্বাক্ষরের মুখটা দেখতে পারছে। মুখে অমলিন হাসি লেগে আছে তার। তন্দ্রা কিছুটা লজ্জা পায় তার হাসিতে। পকেট থেকে একটা তাজা বেলীফুলের মালা বের করে তন্দ্রা বেনীতে লাগিয়ে দেয়। এরপর নিজের দিকে ফেরায়। স্বাক্ষরের শরীর থেকে এক তীব্র ঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকছে।

–ডিয়ার বেনীওয়ালি তন্দ্রাবতী। তোমার লম্বা চুলে বেলীফুল ছাড়া বড্ড বেমানান লাগে।

কথাটা বলে এক মুহুর্ত স্বাক্ষর সেখানে থাকে না। দ্রুত তন্দ্রার ঘর থেকে প্রস্থান করে।

চলবে?…….