প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
209

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৪

ঐশ্বর্য এখনো অবধি সেই আয়নার দিকে তাকিয়ে। হাত লাগিয়ে বার বার আয়না ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল। আসলেই কি সবটা সত্যি ছিল নাকি তার ভ্রম? তবে কিছুতেই কিছু পাচ্ছেনা। সবশেষে সে নিজ থেকেই ভেবে নিল, এতো কিছু হবার পর তার ক্লান্ত মস্তিষ্ক তাকে এসব ভাবাচ্ছে। এভাবে আয়নার সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল তবুও। প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে রইল গভীর মনোযোগের সহিত। সেই মূহুর্তে ওয়াশরুম থেকে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে প্রেম। সবার আগে চোখ রাখে ঐশ্বর্যের দিকে। মেয়েটা আনমনে আয়নার দিকে চেয়ে রয়েছে।
“ঐশ্বর্য? কি দেখছো আয়নায়? গো ফাস্ট। অনেক রাত হয়েছে। তোমার ঘুম দরকার।”

ঐশ্বর্য কিছুটা হকচকিয়ে তাকায়। তারপর মাথা দুলিয়ে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হলো।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই প্রেমকে দেখতে পেলো না প্রেম। হয়ত খাবার নিতে গেছে। ভেজা মাথার চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে পেঁচিয়ে এসে জানালার পাশে দাঁড়ালো সে। জানালার পাশে রয়েছে সেই রিসোর্ট। যেখানে ঐশ্বর্য এরিকের প্রা’ণ নিয়েছিল। সেখানকার সুইমিংপুলটা জ্বলজ্বল করছে। যদিও সব পানি ট্রান্সফার করা হয়েছে। সুইমিংপুল খালি। ঐশ্বর্য কৌতুহলী হয়ে নিজের দূরদৃষ্টি দিয়ে তাকায়। পুলিশদের ইনভেস্টিগেশনের শেষ নেই। এখনো অবধি তারা ইনভেস্টিগেশন করেই চলেছে। অনেক লাইটে ঝলমল করছে জায়গায়টা। এতোক্ষণে হয়ত সকলে হোটেল ছেড়েছে। ঐশ্বর্য হাসে।
“যতই করো না কেন ইনভেস্টিগেশন। কিছুই পাবে না। ওকে কে মে’রেছে এ জন্মে তোমরা জানতে পারবে না। সিসিটিভি ক্যামেরা সব তো নষ্ট করা। কিছুই নেই তোমাদের প্রমাণ দেওয়ার মতো। তবেও চালিয়ে যাও। কিপ ইট আপ।”

দরজা খোলার শব্দে পিছু ফিরে তাকায় ঐশ্বর্য। প্রেমের হাতে খাবার। দরজা লাগিয়ে বেডে এসে বসে প্রেম। ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
“সকলে ভয়ে তটস্থ ঐশ্বর্য। এরিকের মৃ’ত্যুর খবর আশেপাশে ছড়িয়ে গেছে। পুলিশ তো এখনো এখানে রয়েছে। ওরা যদি বুঝে যায় ওকে তুমি মে’রেছো তখন কি হবে ভেবে দেখেছো?”

ঐশ্বর্য চুপ থাকে। প্রেমের অস্থিরতা দেখছে সে নিরবে। ঐশ্বর্যের নিরবতা দেখে খাবার রেখে তাকায় সে। বিচলিত হয়ে বলে,
“আই থিংক ওকে মে’রে দেওয়া তোমার উচিত হয়নি। আর মানুষের জগত আলাদা ঐশ্বর্য। সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে কেউ অপ’রাধ করলে বিচার করে কোর্ট, হাইকোর্ট, পুলিশ। আর সেক্ষেত্রে মা’র্ডার কেসে ফেঁসে যেতে পারো তুমি। আমার মনে হয় আজই তোমায় নিয়ে এই দেশ ছাড়লে ভালো হতো। যদি একবার জেনে যায় আর…!”

প্রেম উত্তেজিত হয়ে উঠছিল না দেখে ঐশ্বর্য এগিয়ে এসে তার বাহু দুটো ধরে শান্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“ওহ হো! এতো হাইপার হচ্ছেন কেন? আপনাদের জগত সম্পর্কে আমার যথেষ্ট ধারণা আছে মি. আনস্মাইলিং। আর ওরা আমি না চাইলে কখনোই জানতে পারবে না সে এরিকের মৃ’ত্যুর পেছনে কে আছে! আর ওই হোটেলের কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা কাজই করবে না। প্রমাণ পাবে কি করে? আর ভ্যাম্পায়ার ঐশ্বর্য আর মানুষ ঐশ্বর্যের মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য। আমার রূপ দেখেও ফেলে তবে তারা তো ভয়েই মুখ খুলবে না।”

প্রেমের ভয় যেন তবুও কমে না। ঐশ্বর্যকে হারাবার ভয়টা যেন কাটছেই না তার। বুকটা কাঁপছে অনবরত। ঐশ্বর্যকে নিজের কাছে বসিয়ে দিয়ে তার মাথার চুল থেকে টাওয়াল খুলে সুন্দর করে মুছে দিতে দিতে বলে,
“আর ইউ সিউর? আমি তোমাকে দ্বিতীয়বার হারাতে চাই মাই এ্যাংরি বার্ড। পারলে নিজের মধ্যে লুকিয়ে ফেলতাম তোমায়। সেই সিন্দুকে লুকিয়ে রাখতাম যেখানে আমি ছাড়া অন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ।”

ঐশ্বর্য ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। প্রেমের হাত দুটো মেলে দিয়ে বুকে মাথা রাখে। চোখ বুঁজে নেয়। প্রেমের কাছে থেকে স্বস্তি অনুভব করে ঐশ্বর্য। প্রেমের ঘ্রাণ তার মন মাতিয়ে তোলে। ঐশ্বর্য নরম সুরে বলে,
“আর আমার মনে আপনি ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ।”

“একটা কথা বলো! যদি জীবনে এমন কোনো দিন আসে যেদিন তুমি আমাকে সম্পূর্ণ ভুলে যাবে। সেদিনও কি এই একই কথা বলবে?”

ঐশ্বর্য মাথা উঠিয়ে প্রেমের দিকে তাকায়। প্রেমের স্থির দৃষ্টিতে ঐশ্বর্যের জবাবের অপেক্ষায়। ঐশ্বর্য উল্টো প্রশ্ন করে বলল,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“উত্তর চাই প্রিন্সেস!”

“যদি এমন কোনো পরিস্থিতি আসেও। যদি আপনাকে ভুলেও যাই তবুও এই মনে অন্য কারো প্রবেশ ঘটবে না। আমি সজ্ঞানে, অন্য কোনো ঘোরে থাকলেও শুধু আপনারই।”

প্রেম স্বস্তিমাখা হাসি হাসে। তারপর দ্রুত খাবারের প্লেট নিয়ে ঐশ্বর্যের সামনে ধরে বলে,
“নাও তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। ঘুমাতে হবে তো। দেখেছো কয়টা বাজে?”

দুজন মিলে ডিনার সেড়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে নানানরকম গল্প করতে থাকে। যেন দুজনের আজ ঘুমানোর পরিকল্পনা নেই। প্রেম ঐশ্বর্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে আর ঐশ্বর্যের মাথার চুলে বিলি কেটে দিয়ে চলেছে। ঐশ্বর্য তাকে তার রাজ্য, তাদের চলন, প্রকৃতি সম্পর্কে বলে চলেছে। এরই মাঝে প্রেম তাকে প্রশ্ন করে উঠল,
“তোমরা ভ্যাম্পায়ার তো মানুষের মতোই দেখতে। তবে রোদে গেলে তোমাদের স্কিন পু’ড়ে যায় কেন?”

“কারণ আমাদের শরীরের স্কিন অনেক পাতলা। ভ্যাম্পায়ার! শব্দটা যে শুনবে তার মনে কাটা দিয়ে উঠবেই। কারণ এজগতে ভ্যাম্পায়ার শব্দটি আ’তঙ্ক ছড়ায়। ভ্যাম্পায়ার মানে জীবিত আর মৃ’তের মাঝামাঝি অবস্থা। অর্থাৎ আমি সম্পূর্ণ জী’বিত নই। তবুও আপনি আমাকে ভালোবাসবেন?”

কথাটুকু বলে মাথা তুলে প্রেমের দিকে উৎসুক নয়নে তাকায় ঐশ্বর্য। প্রেম আগের মতোই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
“ঐশ্বর্য, তুমি কি তাতে কিছুই যায় আসেনা। মৃ’ত মানুষকেও ভালোবাসা যায়। যদি ভালোবাসতে পারো তবে তার পরিচয়, অস্তিত্ব কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। তুমি আমার সামনে আছো। আপনার কাছে আছো। এটাই কয়জন পায়?”

ঐশ্বর্য জাপ্টে ধরে প্রেমকে। প্রেমের বুকে মাথা গুঁজে দেয়। গমগমে সুরে বলে,
“আপনি আসলেই একটা প্রেমময় মানুষ। এমনি এমনি প্রেমে পড়িনি আপনার। আপনি মানুষটা আপাদমস্তক প্রেম দিয়ে পরিপূর্ণ! আর এই সম্পূর্ণ মানুষটাই আমার!”
দুজনে সারারাত গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্ত হয়ে। তখন প্রায় রাত তিনটা। চারিদিকে আধার আর অন্ধকারের ছায়া। চাঁদের মতো গ্রাস করেছে ঐশ্বর্যেরও শক্তি!

নতুন এক সকাল! সূর্যের কিরণে ঝলমলিয়ে উঠেছে চারিদিক। বাতাসও হচ্ছে হালকা। আকাশের সুন্দর রঙ। এ যেন মেঘের খেলা! সমুদ্রের সেই চেনা প্রতিধ্বনি! তা যেন পরিবেশ মাতিয়ে রেখেছে। জানালা খোলা। বাতাসগুলো সমস্ত প্রবেশ করছে ঘরে। প্রেম গায়ের চাদর আরেকটু জড়িয়ে নিলো। পাশ ফিরলো। হাত রাখলো ঐশ্বর্যের ওপর। কিন্তু হাতটা গিয়ে পড়ল বেডেই। চোখ বন্ধ করেই হাতাতে শুরু করল প্রেম। ঐশ্বর্য নেই। চোখমুখ কুঁচকে ফেলল সে। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো। বেডে ঐশ্বর্যের চিহ্নমাত্র নেই। তাহলে কি ওয়াশরুমে? আধশোয়া হয়ে দেখার চেষ্টা করল ওয়াশরুম। ওয়াশরুমের দরজা তো খোলা! ঘুমটা যেন তৎক্ষনাৎ উড়ে গেল। চোখ ডলে উঠে বসে পড়ল। আশপাশটা দেখে নিল। মেয়েটা আসলেই কোথাও নেই। সে তো না বলে কোথাও যায় না? তবে? একা একা সূর্যদ্বয় দেখতে চলে যায় নি তো? তার তো একদমই ঠিকঠিকানা নেই।

প্রেম দেরি করে না উঠে যায়। ফ্রেশ না হয়ে কোনোরকমে চোখেমুখে পানির ঝাপ্টা দিয়ে গায়ে শার্ট জড়িয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে যায়। নিচতলায় রিসেপশন অবধি আসে সে। বাহিরে যেতে নিলে মনে হয় একবার সেখানে জিজ্ঞেস করে নিলে ভালো হয়। দেরি না করে রিসেপশনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রিসেপশনিস্ট তাকে দেখে প্রশ্ন করে,
“ইয়েস? হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”

“একচুয়ালি মাই ওয়াইফ ইজ নট এট রুম। হোয়েন আই ওয়েক আপ আই ডিড নট ফাইন্ড হার। হ্যাভ ইউ সিন হার টু আউট এনিহোয়ার?”

লোকটা বেশকিছুক্ষণ ভাবে। ভেবে ইংরেজিতে উত্তরে বলে,
“আমি জানি না কিন্তু একটা সুন্দর করে মেয়ে ছিল। আর আমায় বলছিল সে দেশে ফিরে যাচ্ছে। একা চলে যাচ্ছে। তো আমি তাকে বলি চেক আউট করতে। কিন্তু সে বলে তার সাথে আরেকজন রয়েছে। আপনার নাম কি মি. প্রেম?”

“ইয়েস!”

“তাহলে আপনার কথায় বলছিল। আর বলেছিল আপনি চেক আউট করে নেবেন। তার নাকি কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিল তাই সে চলে যাচ্ছে। এই বলে তো ভোরেই বেরিয়ে গেছে।”

প্রেমের কেন যেন বিশ্বাস হলো না। ঐশ্বর্য কি করে তাকে না বলে চলে যেতে পারে? হয়ত এই রিসেপশনিস্টের কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কারণ এমনটা হতেই পারে না যে ঐশ্বর্য তাকে না জানিয়ে দেশে ফিরে যাবে! প্রেম নিজেকে শান্ত রেখে বলে ওঠে,
“আই থিংক আপনার ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। হয়ত অন্য কেউ গেছে আর আপনি অন্য কারোর কথা বলছেন!”

এই বলেই নিজের রুমে ফিরে আসে প্রেম। কিছুই মাথায় আসছে না তার। সবটা কেমন যেন লাগছে! সবই তো ঠিক ছিল কালকে! তাহলে কেন ঐশ্বর্য এমনটা করবে? সে বিরবির করে নিজ মনে বলে,
“এটা হতেই পারে না। নিশ্চয় কোথাও ভুল হয়েছে। এই মেয়েটা আমাকে পাগল করে ছাড়বে!”

কথাগুলো বলতে বলতে প্রেমের স্মরণ হয় গতকাল সে রেগেমেগে দুটো টিকিট বুক করেছিল দেশে ফেরার। মনে হওয়া মাত্র ব্যাগের দিকে এগিয়ে যায় সে। ব্যাগের ছোট চেইন খুলে নিয়ে টিকিট বের করতেই হতভম্ব হয়। মাত্র একটা টিকিট রয়েছে। বেশ ভালো করে টিকিট হাতায়। কিন্তু আরেকটা টিকিটের খোঁজ মেলে না। তা দেখে মাথায় হাত পড়ে প্রেমের। কিন্তু দেরি না করে ঐশ্বর্যের পাসপোর্টের খোঁজ করে। পুরো রুম উলোটপালোট করে খুঁজেও যখন সেটার দেখা মিলে না তখন সে নিশ্চিত হয় ঐশ্বর্য দেশেই ফিরেছে। বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে সে।
“এমন কি হলো ঐশ্বর্য? যে আমাকে একবার জানাতে অবধি পারলে না? আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? কি হলো এমন?”

হতাশ হয়ে বসে থাকে সে বেশ কিছুক্ষণ। ভাবতে পারছে না কিছু। ভাবলেশহীন সে। তারপর নিজের মনকে শান্তনা দিয়ে বলে ওঠে,
“তবে এখনো অভিমান ভাঙে নি তোমার অভিমানিনী? তাই হবে। কম কথা তো বলিনি তোমায়! এতো কড়া কথায় তোমায় বেশ কষ্ট হয়েছে না? তাই বুঝি চলে গেছো? ঠিক আছে! আমিও হাল ছাড়ছি না। অভিমান ভাঙিয়ে নিজের মধ্যে তোমায় বিলীন করে তবেই ছাড়ব এবার।”

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৫

রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ শেখ ম্যানসনে কলিং বেল বেজে উঠল। মিতালি সবে রান্নাঘরের সবকিছু গোছগাছ করে ঘুমোতে যাচ্ছিল। বাড়ির সকলে শুয়ে পড়েছে হয়ত। মিতালি জেগে রয়েছে শুধু। সেও ঘুমোবে। ঘুম পেয়েছে খুব। কিন্তু এতো রাতে কলিং বেলের আওয়াজে ঘুমটা যেন চোখ থেকে পালিয়ে গেল। এতো রাতে কে এসেছে? রান্নাঘর থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে আস্তে করে হলরুম পেরিয়ে গেল সদর দরজার কাছে। ছোট বড় সমস্ত লক করে দেওয়া হয়েছে দরজা। এতো রাতে তো কেউ সচরাচর আসেনা! আবার চোর নয় তো? উল্টোপাল্টা ভাবনা মিতালির মনে আসতেই আবারও বাজলো কলিংবেল। এবার লাগাতার বাজতেই থাকলো। অতঃপর মিতালির মনে হলো, চোর বা ডা’কাত কেউই নিশ্চয় কলিংবেল বাজিয়ে আসবে না? হাফ ছেড়ে ওপরের ছিটকিনি খুলে নিচের লক খুলে দরজা খুলতেই তার সামনে দৃশ্যমান হলো প্রেম। তার হাতে বড় লাগেজ। চোখমুখটা বেশ অন্যরকম ফ্যাকাশে। এলোমেলো চুল! অন্যরকম একটা রূপ। মিতালি হতভম্ব হয়ে কিছু বলে ওঠার আগেই প্রেম সাইড দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ল।

ওপরের ঝাড়বাতিটা জ্বলছে শুধু। ঝাড়বাতির সোনালি আলো চারিদিকে ছড়িয়ে আবছা আলোর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। প্রেম আশেপাশে তাকালো। মিসেস. পরিণীতা সিঁড়ি থেকে আস্তে আস্তে নেমে আসতে আসতে গলা উঁচু করে জিজ্ঞেস করল,
“কে এসেছে মিতালি এতো রাতে?”

“ছোট সাহেব এসেছেন।”

মিসেস. পরিণীতা অনেকটা অবাক হলেন। কারণ প্রেম আর ঐশ্বর্যের তো কালকে ফেরার কথা! দ্রুত পা চালিয়ে নিচে নেমে এলেন। প্রেমকে দেখে বিস্ময়ের শীর্ষে পৌঁছালেন উনি। অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন,
“প্রেম? তুমি! তোমাদের না কাল…”

মিসেস. পরিণীতাকে কথা শেষ করতে দিলো না প্রেম। আশেপাশে তাকিয়ে বেশ উগ্র গলায় বলে উঠল,
“ঐশ্বর্য কোথায় মা! এখনো কি ঘুমাচ্ছে? এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাবার মেয়ে তো ও নয়।”

মিসেস. পরিণীতা আরেক দফা চমকালেন। চকিতে বললেন,
“ঐশ্বর্য? ঐশ্বর্য এখানে কি করে থাকবে? ও তো তোমার সঙ্গে ছিল। তোমাদের দুজনের কাল ফেরার কথা ছিল। ঐশ্বর্য এখন এখানে কি করে থাকবে প্রেম?”

প্রেম এতোক্ষণ বিচলিত ছিল বেশ। মায়ের কথায় একপ্রকার হকচকিয়ে উঠে মায়ের দিকে তাকালো সে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি দিয়ে বলল,
“মানে কি? ঐশ্বর্য এখানে আসেনি? ওর তো দেশে ফেরার কথা!”

“কিহহ! তুমি কি বলতে চাইছো প্রেম? ঐশ্বর্য তোমায় ছাড়া দেশে ফিরবে? কিন্তু কেন? তুমি কি বলছো ভেবে বলছো এসব?”

নিজের চুলগুলো দুহাত দিয়ে নাড়িয়ে নেয়। কপালে পড়ে কিঞ্চিৎ ভাঁজ।
“হ্যাঁ মা আমি ভেবে বলছি। ওর আর আমার মধ্যে কিছু মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ক্রিয়েট হয়েছিল। আমরা তা মিটিয়েও নিয়েছিলাম। কিন্তু জানি না কি হলো! সকালে উঠে ওকে পাইনি আমি। রিসেপশনিস্ট বলেছে ও নাকি চলে গেছে। হয়ত আমি ওকে যেসব কড়া কথাগুলো বলে ফেলেছিলাম সেটা ও এখনো অবধি নিতে পারেনি।”

মিসেস. পরিণীতাও চিন্তিত হয়ে পড়েন। প্রেমকে কটাক্ষ করে বলে ওঠেন,
“এটাই তোমার প্রবলেম প্রেম। তুমি সহজে রেগে যাও না। আর রাগলে তুমি কি বলো আর কি করো নিজেও জানো না। কি এমন হয়েছিল তোমাদের মধ্যে যে এতো রেগে গেলে?”

প্রেম আর উত্তর দেয় না। পকেটে থাকা ফোনটা বের করে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে আবারও সদর দরজার দিকে হাঁটা দেয়। মিসেস. পরিণীতা পিছু ডাকেন।
“কোথায় যাচ্ছো এতো রাতে?”

“আমার ওয়াইফকে ফিরিয়ে আনতে। ভুলটা আমার ছিল মা। আর তুমি শিখিয়েছো নিজের ভুল থাকলে সেটা স্বীকার করতে হয়। তার খেসারতও হয়। আমি দেব খেসারত।”

মিসেস. পরিণীতা অবাক হয়ে চুপ হয়ে গেলেন। তবে প্রেম কিছু একটা ভেবে মায়ের কাছে ফিরে এলো। মায়ের হাত ধরে বলল,
“মা তুমি তো ছোট থেকে শিখিয়ে আসছো! যে কাউকে কি করে ভালেবাসতে হয়। কাউকে কি করে আপন করতে হয়। যে যেই হক না কেন! ঐশ্বর্যকে আমি নিজে বিয়ে করেছিলাম। ও বিয়েতে রাজিই ছিল না। তবুও আমি বিয়ে করেছি ওকে। অর্ধাঙ্গিনী বানিয়েছি নিজেকে। নিজের জান্তে অজান্তে অনেক অবহেলা আর কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু ওর অস্তিত্ব যদি আজ পাল্টে যায় আমি তো ওকে ছুঁড়ে ফেলতে পারব না মা। ওকে আমি নিজের হৃদয়ে নিজের অজান্তে সেই স্থান দিয়ে ফেলেছি যেটা আমি আগে কোনো নারীকে দিতে সক্ষম হইনি। ওর পরিচয় যদি পাল্টে যায় তবে কি তোমাদের অসুবিধে হবে ওকে মেনে নিতে?”

মিসেস. পরিণীতা তার ছেলের বলা কথার মানে কিছুই বুঝলেন না। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর বুঝলেন তার ছেলে তার উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি যা বুঝলেন তার ওপর ভিত্তি করে বললেন,
“বিয়েটা তুমিই করেছো। অমত করিনি। ঐশ্বর্য একটু বাচ্চা মেয়ে। মা-বাবার আদুরে মেয়ে। তাছাড়া ওর মন স্বচ্ছ। তোমার মতোই। তোমাকে ছোট থেকে একদম পারফেক্ট হিসেবে দেখতে চেয়েছি। সবাই দেখে যেন বলে, তোমার ছেলে এতো সুন্দর মনের মানুষ কেন! এই স্বপ্ন আমার পূরণ হয়েছে। তুমি ঐশ্বর্যকে সত্যিই ভালোবাসলে এতে আমাদের কোনো মত থাকার দরকার নেই। আমরা কোনো মত দিতে চাইও না। জানি, তুমি কখনো ভুল পথে পা বাড়াবে না। আমি জানি না তুমি ঐশ্বর্যের কোন অস্তিত্বের কথা বলছো! তবে যাকে বিয়ে করেছো সবসময় তোমাকে তার পাশে থাকতেই হবে। ওর অবহেলা আমিও মানব না।”

প্রেম আর কিছু বলে না। মায়ের দুই বাহুতে হাত রেখে হালকা স্বস্তির হাসি হাসে। অতঃপর হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়।

রাত প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই। প্রেম বর্তমানে মাধুর্য এবং অনুভবের সাথে সোফায় বসে। মাধুর্য অঝোরে কেঁদে চলেছে। থামার কোনো নাম নেই। অস্থির হয়ে উঠেছে। বার বার উত্তেজিত হয়ে উঠছে। অনুভব পাশে থেকে তাকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রেম মাথা নিচু করে বসে। না আছে মুখে কোনো কথা আর না রয়েছে মুখ তুলে তাকাবার সাহস। ভেতরে সবটা যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। ঐশ্বর্য এখানেও নেই। আসেই নি সে এখানে। তার সব বন্ধু-বান্ধবদের ফোন করে খবর নেওয়া হয়েছে। তার বন্ধুবান্ধবদের সংখ্যাও ছিল সীমিত। তাদের কারোর কাছেই যায়নি ঐশ্বর্য। প্রেমের মুখ থেকে গত কয়েকদিনে ঘটা সমস্ত ঘটনাগুলো শুনেছে অনুভব ও মাধুর্য। মাধুর্য কেঁদে উঠে বলল,
“তোমায় বড্ড ভরসা করে আমার মেয়েটাকে ছেড়েছিলাম প্রেম। তোমার প্রতি সেই বিশ্বাসটা ছিল আমার যে আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি হবেনা। কিন্তু সেটা তুমি নিজে ভেঙে দিলে।”

“আমি আপনাকে সরি বা দুঃখিত কোনোটাই বলব না। কারণ আমার জন্য যা হয়েছে সেটা এই সামান্য কথায় ঠিক হবেনা। ঐশ্বর্য ভ্যাম্পায়ার এটা জানার পর আমার মাথা ঠিকঠাক কাজই করছিল না। তার ওপর ইফানের মৃ’ত্যু আমাকে যেন থমকে দিয়েছিল। আমি সেদিন ঐশ্বর্যের কাছে ছিলাম না। সারারাত সারাদিন বাহিরে কাটিয়েছি। আর আমার এই ভুলে যে ঐশ্বর্যকে শাস্তি পেতে হবে আমি ভাবিনি। আমি ভেবেছি ঐশ্বর্যের অভিমান এখনো কমেনি। তাই দেশে ফিরে এসেছে। কিন্তু ও নিখোঁজ হয়ে যাবে। এটা বিশ্বাসই করতে পারছি না।”

মাথা নিচু করেই জবাব দিল প্রেম। মাধুর্য তার জবাবের তোয়াক্কা না করে বলে উঠল,
“নিখোঁজ তো হয়েছেই! আমার মেয়ে তো নিখোঁজ হয়েই গেছে। আর আমি নিশ্চিত ওই মহা অমাবস্যার রাতে কিছু না কিছু নিশ্চয় হয়েছিল। ওই ডেভিলরা আমার মেয়ের সাথে কিছু একটা করেছে।”

থামলো মাধুর্য। বড় বড় শ্বাস নিতে থাকলো। কেঁদে কেঁদে ফর্সা চোখমুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে প্রেমের মুখের দিকে চাইলো। আর অসহায় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কি দোষ ঐশ্বর্যের বলো তো? ও মানুষ নয় এটা ওর দোষ? নাকি ও তোমার প্রতি আসক্ত হয়েছিল সেটা ওর দোষ?”

অনুভব এবার মাধুর্যকে সামলাতে না পেরে কিছুটা ধমকে বলে উঠল,
“মাধুর্য! কি পাগলের মতো কথাবার্তা বলছো তুমি তখন থেকে? যা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে। আমরা তো প্রেমের ওপরেও সকল দোষ চাপিয়ে দিতে পারি না। আমি তোমায় আগেই বলেছিলাম এমন একটা পরিস্থিতি আসবে। আর সেটা এসেছে। প্রেম একটা সাধারণ মানুষ মাধুর্য। ও আমাদের মতো নয়। এটা তো স্বাভাবিক যে ঐশ্বর্যের আসল রূপে দেখে আর ওর পরিচয় জেনে শকড হবে। আর তার ওপর ওর ভাইয়ের মৃ’ত্যুর খবর ওর পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে দেওয়ার মতো। আচ্ছা, তোমার জীবনেও এমন দিন এসেছিল মাধুর্য। তুমি আমাকে তোমার শত্রু ভেবেছিলে। তুমি ভেবেছিলে আমিই সে যে তোমার হ’ত্যা করেছিলাম। সেদিন কিন্তু তুমি সেটা মেনে নিতে পারো নি। রিয়েক্ট করেছিলে। কিন্তু পরে তুমি বুঝেছো। প্রেমের মানসিক পরিস্থিতি তখন ঠিক ছিল না মাধুর্য। ওকে দোষারোপ করে কোনো লাভ নেই।”

মাধুর্য এবার নিরব হয়। মুখ থেকে কোনোরকম কথা আসে না। শুধু নিরবে বিসর্জন দিতে থাকে অশ্রু। গাল বেয়ে চকচকে আলোতে যেন মুক্তর দানা খসে পড়ছে নিচে। মনটা শুধু চাইছে তার মেয়েকে দেখতে। অনুভব মাধুর্যের হাতে হাত রাখে তবে আড়ালে। সামনে প্রেম। সম্পর্কে জামাই। জামাইয়ের সামনে তো আর তা করা যায় না। অনুভবের স্পর্শ মাধুর্যের শান্তি। মাধুর্য অনুভবের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে তাকায়। অনুভব মোলায়েম সুরে বলে,
“জীবনে অনেক পরিস্থিতি এসেছে মাধুর্য। যেই পরিস্থিতি সামলানো অনেকের পক্ষে অসম্ভব হলেও তোমার পক্ষে সম্ভব ছিল। কারণ তুমি তোমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর দৃষ্টি দিয়ে সবদিকে সাড়া ফেলে দিতে পারো। তুমি সব পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রেখে সবটা সামলাতে পারো। আজ আমাদের মেয়ের বিপদ হয়েছে। কঠিন এক পরিস্থিতি। প্রেমের উপরে আমারও প্রথমে অনেক রাগ হয়েছিল। কিন্তু প্রেমকে দেখো মাধুর্য। ও কতটা ডেস্পারেট আমাদের মেয়ের জন্য। ও যদি সত্যি আমাদের মেয়েকে ভালো না বাসতো। তার মনে কোনো অনুভূতি না থাকতো ও আজ ছুটে আসতো না আমাদের মেয়ের জন্যে। ওর বিষয়টাও ভাবো মাধুর্য।”

মাধুর্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। প্রেমের দিকে মাথা তুলে তাকায়। ছেলেটা নিরব হয়ে রয়েছে। ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে রয়েছে। সে কি অশ্রু আটকানোর চেষ্টায় রয়েছে? হয়তবা তাই। এই অশ্রু তো ছলনা করবে না। মিথ্যে বলবে না। হয়ত অনুভবের কথাগুলো সত্যি! ছেলেটার মাঝে তো কোনো ভেজাল নেই। সে খাঁটি মানুষ!

“জানো প্রেম, ঐশ্বর্য যখন আমার গর্ভে ছিল তখনই আমাদের রাজ্যের সবথেকে বড় এবং বিজ্ঞ মানুষ আমায় দেখে বলেছিলেন আমার ভেতরে যে বেড়ে উঠছে সে এক বি’ষে পরিপূর্ণ ছোট দেহ। যার রগে রগে রয়েছে এমন শক্তি যা সবকিছু ধ্বং’স করতে সক্ষম। এমন সন্তান জন্ম না দেওয়ায় নাকি ভালো। রাজ্য ছড়িয়ে গেল কথাটা। সকলে বলল এই সন্তান নষ্ট করতে। আমি করিনি। বলেছিলাম ওই রাজ্য ছেড়ে দেব। ভ্যাম্পায়ার কুইনের পদ ত্যাগ করব। তবুও আমি আমার সন্তান জন্ম দিতে চাই। সেদিন অবশ্য কেউ আর আমার অমান্য করেনি। তবে আমি মূহুর্তে মূহুর্তে অনুভব করেছিলাম এই সন্তান আসলেই স্বাভাবিক নয়। তাকে জন্ম দিই। তারপর তার এমন সুন্দর রূপ দেখে ঐশ্বর্য নামটা যেন আপনাআপনি বেরিয়ে আসে। কিন্তু ও যত বড় হতে থাকে তত আশঙ্কা বাড়তে থাকে। একদিন আমাদের ইতিহাসের বইয়ে ওর মতোই এক রাজকন্যার ইতিহাস পড়ি। তারপর মনে হয় আমাদের চির’শত্রু ডেভিলদের রানী হবার আশঙ্কা রয়েছে। তারপর জানি আমারই রাজ্যের তিন জন আমার মেয়েকে মা’রার পরিকল্পনা করছে। আমি দিশেহারা হই। তখন তোমার দেখা মেলে। তার পরের কাহিনী তোমার জানা।”

প্রেম হতবিহ্বল হয়ে গেল। চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“এর মানে…”

“এর মানে ওই অমাবস্যার রাতে ডেভিল কুইনের প্রথম বার আসল রূপ বেরিয়ে আসার কথা। ওই ডেভিলরা যদি সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করে ঐশ্বর্যকে ওই রূপে নিয়ে আসে এর মানে ওর মধ্যে খারাপ শক্তি এসে গেছে।”

মাধুর্যের কথায় প্রেমের তৎক্ষনাৎ মনে পড়ে ঐশ্বর্যের সেই ভয়া’নক রূপের কথা। সে দ্রুত বলে ওঠে,
“ওয়েট! সেদিন তো ঐশ্বর্য নিজের ভ্যাম্পায়ার রূপ ছাড়া আরেক ভয়া’নক রূপে দেখেছিলাম। সেই কালো চোখ। সেই রূপ যে কাউকে ভয়ে গুটিয়ে দেবে।”

মাধুর্য চকিতে তাকায়। এবার শব্দ করে কেঁদে দেয়,
“তার মানে আমাদের মেয়েটা ডেভিল হয়ে গেছে অনুভব। আমি জানি না এখন কি করব! ওকে কি করে আটকাবো!”

অনুভব উঠে দাঁড়ায়। ক্রোধের সাথে বলে,
“আমি এক্ষুনি ডেভিল কিংডমে আক্র’মণ করব। আর ঐশ্বর্য ওখানেই আছে তাহলে। ওকে নিয়ে আসব।”

মাধুর্য তাকে আটকায়। কথার মাঝে বলে ওঠে,
“পারবে না। আমরা ওদের প্রবেশদ্বার অবধিও যেতে পারব না। অনুভব, তুমি ভুলে যাচ্ছো। ভ্যাম্পায়াদের ওদের রাজ্যে প্রবেশ করার মতো শক্তি বা অনুমতি নেই আর ওদের আমাদের রাজ্যে প্রবেশ করার অনুমতি নেই।”

অনুভব এবার কথা মিলিয়ে বলে,
“তবে উপায়?”

মাধুর্য ভাবে। ভাবুক হয়ে প্রেমের দিকে তাকায়। ভাবলেশহীন হয়ে বলে,
“জানি আমি। প্রেম কখনো এটা করতে পারবে না। এটা অসম্ভব! ভ্যাম্পায়ার, ডেভিল, ওয়ারওল্ফ এদের থেকেও শক্তিশালী যদিও কারা হয় তাহলে তা মানুষ। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীবন। আমরা যেখানে পৌঁছুতে পারব না মানুষ তা পারবে। কিন্তু প্রেম পারবে না। এর জন্য অধিক সাহস লাগে। আর প্রা’ণের আশঙ্কা তো আছেই। তবে আমাদের মেয়েকে বাঁচানোর কোনো পথ খোলা রইল না অনুভব।”

প্রেম উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর হাঁটু গেঁড়ে বসে মাধুর্যের সামনে। মাধুর্যের হাত দুটো ধরে সম্মানের সাথে। অতঃপর বলে ওঠে,
“আপনি আমার মায়ের মতো। বলতে পারেন আপনি আমার আরেক মা। অন্যদিকে ঐশ্বর্য! হক সে ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস বা ডেভিল কুইন। আমি ওকে ভালোবাসি। আই রিপিট আমি ওকে পাগলের মতো ভালোবাসি। ওকে আমি অবস্থাতে নিজের করে চাই। তার জন্য যদি ওই শয়’তানের মাঝে আমাকে নিজের প্রা’ণ প্রবেশ করতে হয় আমি রাজি আছি। এতোদিন তো ও পাগলামো করে গেছে আমার জন্য। এই প্রসঙ্গে আমিও না হয় একটু সুযোগ পেলাম! এবার ও নিজেও দেখবে আমিও কত বড় ভালোবাসার কাঙাল!”

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৬

আশপাশটা নিকষ কালো। আকাশটা বড্ড মেঘলা। সকাল হয়েছে তবুও যেন সন্ধ্যা। সূর্যের কোনো দেখা নেই। ঘন কালো রঙের মেঘের খেলা শুধুমাত্র। প্রকৃতির রঙটাও যেন কালো। জঙ্গলের পাতাগুলো শুঁকিয়ে ঝরে ঝরে পড়েছে। গাছগুলো নেতিয়ে গেছে। নিচে মাটিগুলো যেন শুঁকিয়ে চৌচির। সব জঙ্গল এবং অনেকটা শুঁকিয়ে যাওয়া নদী পেরিয়ে এক পাহাড়ের গা ঘেঁষে কালো পাথরের সিঁড়ি তৈরি করা। সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের সীমানায় এক কালো রাজপ্রাসাদ। সেখানে সকলে হম্বিতম্বি করে প্রবেশ করছে। প্রাসাদ পুরোটাই কালো। যেন কালোই প্রতীক সেই রাজ্যের। সেখানকার সকলের পরনেই কালো পোশাক। মুখে লেগে রয়েছেই একটা হাসি। হাসি থাকবে না-ই বা কেন? এতোদিন পর তাদের রাজ্য পরিপূর্ণ হয়েছে। তাদের রানীর পদার্পণ হয়েছে। প্রবেশ করেছে রাজ্যে। রাজ্য তো এবার সম্পূর্ণ। সকলে তো এক পলক দেখার জন্যই ছুটে চলেছে প্রাসাদের ভেতরে।

বড়সড় একটা জায়গা। চারিদিকে পানি। জায়গাটা পুকুরের মতো হলেও বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। পানিতে কতগুলো কালো গোলাপের পাপড়ি। সেখাকার সিঁড়িতে একটুখানি পা ভিজিয়ে বসে রয়েছে কালো কাপড় পরিহিত এক রমনী। উম্মুক্ত হাত পানি ও মধু মাখিয়ে দিয়ে চলেছে কয়েকজন দাসী। তাদের মনটাও খুশিতে পরিপূর্ণ। দাসীদের মধ্যে একজন বলে উঠল,
“এতো পরিচর্যার কি প্রয়োজন? আমার হবু রাণীর রূপের কি খামতি পড়েছে? ওমন সুন্দর স্বর্ণের মতো গায়ের রঙ! আমারই রঙ তো ঝলসে যাচ্ছে!”

“আহা! আজকের দিনটা আমাদের সকলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রথম আমাদের রাণী রাজসভায় বসবেন। সকলকে দেখা দেবেন। আজ যে অভিষেকের দিন ঠিক হবে। তাই তো এতো পরিচর্যা!”

সুন্দর রমনীটি রহস্যময় হাসি হাসে। হাসিতে যেন ঝরছে মুক্ত! সেই রমনী অন্য কেউ নয়। স্বয়ং ঐশ্বর্য। সম্পূর্ণ রূপে বদলে গেছে সে। নতুন এক রূপ পেতে চলেছে। সেই সাথে নতুন এক রাজ্য।

চারিদিকে বাজছে দামামা। উদ্ভট সুর। আনন্দের ঝঙ্কার। সুরটা অদ্ভুত এবং ভয়ানক। ঢোল পিটানো হচ্ছে। ঐশ্বর্য বসেছে আয়নার সামনে। পরনে একটা কালো পোশাক। পা ছেড়ে মেঝেতে অনেকদূর অবধি লম্বা সেই পোশাক। কোঁকড়ানো চুল ছেড়ে দিয়ে এক দাসী তার চুল আঁচড়ে দিয়ে চলেছে। তার হাতে পড়ানোর হলো নানারকম ব্ল্যাক স্টোনের আংটি। আংটি পড়ানোর সময় ঐশ্বর্যের হাতের অনামিকা আঙ্গুলে থাকা এক সাদা স্টোনের আংটি খুলে নিতে উদ্যত হলো এক দাসী। তা খেয়াল করে ঐশ্বর্য ধমকে উঠল।
“কি করছো? ওই আংটি খুলছো কেন?”

দাসী হাত সরিয়ে ফেলল। ঐশ্বর্য হাতের একটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো। সেই সময় আগমন হয় রোজির। আর বলে ওঠে,
“অপ্রয়োজনীয় কোনোকিছু রাখতে নেই কুইন। ফেলে দিন ওটা। রেখে কি হবে?”

ঐশ্বর্য আংটিতে হাত বুলিয়ে নিল। আনমনে প্রশ্ন করল,
“তোমরা কি করে জানলে? এটা অপ্রয়োজনীয়?”

“আমরা জানি বলেই বলছি। আপনার হয়ত কিছু মনে নেই। এটা আপনাকে সেই প্রেম দিয়েছিল। যে আপনাকে সবসময় অবহেলা করেছে। মনে পড়ছে?”

ঐশ্বর্যের ভ্রু জোড়া কুঁচকে আসে। অতঃপর চোখে জ্বলে ওঠে ক্রোধের আগু’ন। আংটিটা নিজে খুলে ছুঁড়ে মারে এক প্রান্তে। কোথাও একটা হারিয়ে যায় সেটা। বড় বড় শ্বাস ফেলে আয়নার দিকে তাকালো সে। তার চোখ ক্রমশ কালো হয়ে আসছে। রোজি শান্ত হয়ে বলল,
“রাগান্বিত হবেন না। সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। এই তোমরা সবাই সাজাও।”

তিন-চারজন মিলে ঐশ্বর্যকে তৈরি করতে থাকলো। নতুন রূপে তাকে যেন গড়ে তোলা হলো। কানে বড় বড় কালো স্টোনের দুল, গলায় কালো মালা। চোখ ভর্তি কালো কাজল। ঠোঁটেও লাগানো হলো কালো রঙ। হাত ভর্তি কালো আংটি। মাথার এক পাশে টায়রা। চুলগুলো হালকা করে বেঁধে দেওয়া হলো। সবশেষে উঠে দাঁড়ালো ঐশ্বর্য। নিজেকে দেখতে থাকলো নিপুনভাবে। এ যেন কালো রাজ্যের রাণী। এ ‌যেন ভয়ং’করী অপরূপে। যার চোখে ও রূপে দুটোতেই যে কারো মৃ’ত্যু অনিবার্য। রোজি ঐশ্বর্যকে দেখে নিল। প্রশান্তির হাসি দিল। সে আজ সফল। ঐশ্বর্যকে এনে দেখিয়ে দিয়েছে সে নিজের কথা রেখেছে। সবখানে ডেভিলদের রাজত্বের বেশি সময় নেই তবে আর! ঐশ্বর্য আয়না দিয়ে রোজির দিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি তৈরি।”

ঐশ্বর্য বেরিয়ে এলো। তার পেছন পেছন দাসীরা। সেই সাথে রোজি। সকলের আনন্দ দ্বিগুন হলো। সিঁড়ির ওপরে লম্বালম্বি বারান্দা দিয়ে প্রবেশ ঘটছে ঐশ্বর্যের। তার আশপাশটা যেন কালো ছায়ায় পরিপূর্ণ। খোলা বারান্দা পেরিয়ে প্রান্তে এসে সেখানে থাকা রেলিং ধরে নিচে তাকালো সে। নিচে সভায় কতশত প্রজা। সকলে হইচই ফেলেছে। সকলের কেন্দ্রবিন্দু শুধুই ঐশ্বর্য। সেখানে ছিল রোজির বাবাও। তিনি বললেন,
“আসুন। সভায় প্রবেশ করুন। আমাদের সিংহাসন যে আপনার জন্য খালি এতোগুলো বছর ধরে। সেই সিংহাসনে পুনরায় প্রা’ণ ফিরিয়ে দিন আপনি।”

ঐশ্বর্য আর কিছু বলে না। সরে এসে সিঁড়ি দিয়ে নামে। সকলে সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল ঐশ্বর্যের আগমনের অপেক্ষায়। অতঃপর তার দেখা পাওয়া মাত্র তার ওপর কালো রঙের গোলাপের অজস্র পাপড়ি বর্ষিত হলো। ঐশ্বর্য সভায় উপস্থিত হলো। সকলে মাথা নুইয়ে রাখলো তার সামনে। সভার সিংহাসনের কাছে পৌঁছুতে সিঁড়িতে পা রেখে উঠতে লাগল। তার সাহায্যের জন্য এক দাসী হাত বাড়িয়ে দিল। তা দেখে ঐশ্বর্য ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,
“যার তার হাত ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস ঐশ্বর্য ধরে না।”

রাজসভার সকলে স্তব্ধ। মূহুর্তে থামে হইচই। রোজি এবং রোজির বাবা চকিতে তাকায়। ঐশ্বর্য সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। চোখেমুখে কোনো বিস্ময় নেই। ওর খেয়ালই নেই ও নিজেকে কোথায় কি বলে দাবি করেছে! ও নির্বিকার ভঙ্গিতে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তখনও সকলে শান্ত। রোজির বাবা পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠলেন,
“সকলে শান্ত কেন? আনন্দ করো! আমাদের ডেভিল কুইনের আগমন হয়েছে এতো বছর পরে!”

বলেই সকলের উদ্দেশ্যে ইশারায় সবাইকে ঠিক থাকতে বলল। আবারও শুরু হলো শোরগোল, হইচই। সবাই হুড়োহুড়ি করতে লাগলো ঐশ্বর্যকে একটি পলক দেখার জন্য। রোজ তার বাবাকে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
“যতই হক আমাদের রাজ্যের রাণী। আসল পরিচয় তো সে ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস। নিজের অস্তিত্ব যেন কিছুতেই ভুলতে পারছে না।”

“চুপ করো। কুইন শুনে নেবেন। উনার শ্রবণশক্তি অত্যন্ত প্রখর।”
রোজি থামলো। অন্দরমহলে ছুটলো বাকি আয়োজনের জন্য।

অন্দরমহলে গিয়ে সবার আগে নিজের কক্ষে প্রবেশ করলো সে। কালো দেয়াল জুড়ে অদ্ভুত সব ছবির সমাহার। কোনো কোনো ছবিতে মালা। যাদের কেন্দ্র করে য’জ্ঞ করা হয়। সেখানকার কালো রঙের আসবাবপত্র পেরিয়ে জানালায় এসে দাঁড়াল সে। হাসতে থাকলো আপনমনে।
“ইতিহাসে আরো একবার একটা ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেসকে নিজেদের রাজ্যের একজন করতে সফল। সেটাও আমি সফল হয়েছি। এর থেকে আনন্দের কি হতে পারে? বোকা শেখ আনন প্রেম। সেদিন রাতে কুইনকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু সেটা তোমার কাছে উনাকে রাখতে নয়। ছিনিয়ে নিতে বরাবরের মতো। তোমরা মানুষরা বড্ড বোকা হও। সেদিন রাতে কুইন ঐশ্বর্য রূপে ফেরতও এসেছিল। কিন্তু আজীবনের মতো নয়। সেদিন তো কুইন সম্পূর্ণ শক্তি রপ্ত করতে পারেনি।”

এটা বলে থামলো সে। তার ঘরের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। জানালার দিকে মেঘলা আকাশটার দিকে তাকিয়েই বলল,
“ভেতরে এসো।”

ভেতরে প্রবেশ করলো প্রহরী। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“আমাদের রাজ্যে একজন মানুষের আগমন ঘটেছে।”

কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ল রোজির। ঘাড় ফিরিয়ে প্রহরীর দিকে তাকালো। প্রহরীর এমন উত্তেজনা দেখে চিন্তাটুকু আরেকটু বাড়ল। শক্ত কন্ঠে বলল,
“মানুষ? কিভাবে? এই রাজ্যে মানুষের প্রবেশ মানে তার মৃ’ত্যু এটা তাকে বুঝিয়ে দাওনি?”

“দিয়েছিলাম। তার বুকে অ’স্ত্র ধরেছিলাম। কিন্তু সে বলেছে এই রাজ্যের রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায়। শুধু একবারের জন্য।”

চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে এলো রোজির। সন্দেহি নজরে তাকালো বাহিরের দিকে। তৎক্ষনাৎ বাহিরের দিকে ঝড়ের বেগে চলে গেল। লম্বাটে বারান্দা পেরিয়ে শেষ প্রান্তের এক খোলামেলা বারান্দায় গিয়ে পৌঁছালো সে। যেখান থেকে স্পষ্ট নিচের দিকটা দেখা যায়। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল মানুষটির দিকে। রোজির পেছন পেছন এলো সেই প্রহরী। তার আগমন টের পেয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে রহস্যময় হাসি দিল সে। এবং বলল,
“যখন এতো করে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছে প্রকাশ করছে। ঢুকতে দাও। এবার ওর যা ব্যবস্থা করার আমাদের কুইন করবে। এই মানুষের থেকেই শুরু হক না কেন মৃ’ত্যু খেলার আরম্ভ!”

রাজসভায় সকলে উপস্থিত। নানারকম সুর বাজছে। বাজছে দম ফাটানো দামামা। রোজির বাবা এগিয়ে এসে বলে উঠলেন,
“এতোগুলো বছর পর! আবারও আমরা সফল হয়েছি। আমাদের সিংহাসনের অধিকারিনী আজ আমাদের সামনে। ডেভিল কুইন ঐশ্বর্য! উনার অভিষেক ঘটবে এবং এই রাজ সিংহাসন এবং রাজ মুকুটের প্রাণ ফিরে পাবে।”

এসব কথাবার্তা শুনে যখন হইচই শুরু হলো। তাদের মধ্যে একজন প্রজা বলে উঠল,
“তবে কি এবার আমরা রাজত্ব করব? ধ্বং’স করতে পারব আমাদের শত্রুদের?”

এবারের উত্তরটা রোজির বাবা নয় বরং ঐশ্বর্য নিজে বলল,
“ঐশ্বর্য যেখানে রাজত্ব সেখানে। আমরা ডেভিল। কোনো দয়ামায়া নেই আমাদের মধ্যে। যেমনটা আমার পছন্দ না হলে ভ্যাম্পায়ার, মানুষ কাউকে পরোয়া না করে প্রা’ণ কেঁড়ে নেব। ঠিক তেমনটাই এই রাজ্যে এখন থেকে আমার কথা না মানলে শাস্তি একটাই হবে। মৃ’ত্যু।”

সকলে মাথা নিচু করল। ঐশ্বর্যের জয়ধ্বনি গাইলো। সকলের মনে প্রশ্ন জাগলো! কবে অভিষেক? বলাবলি করল আশেপাশে। তাদেরকে থামাতে যেই না রোজির বাবা কিছু বলতে উদ্যত হলেন তৎক্ষনাৎ হুংকার ছাড়া হলো। প্রহরীরা ভীড় সরিয়ে টেনেহিঁচড়ে আনলো একজনকে। সকলে তখন নিরব ভূমিকা পালন করে সরে সরে যাচ্ছে। শিকলের অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। ব্যক্তিটির হাতে শিকল দিয়ে বদ্ধ। ঐশ্বর্যের চোখ বর্ণের আঁখি যেন উৎসুক চাহনি নিয়ে তাকালো ব্যক্তিটির দিকে। একনাগাড়ে চেয়েই রইল। সেই পুরুষটি যখন মাথা তুলে ঐশ্বর্যের দিকে তাকালো। এক পলক দৃষ্টি ফেলল ঐশ্বর্যের গলা তখন শুঁকিয়ে এলো। যেন নিচের ভিত নড়ে গেল। এ কেমন মোহনীয় দৃষ্টি?

এসময় প্রবেশ ঘটে রোজির। দ্রুত ঐশ্বর্যের নিকটে এসে ধীর কন্ঠে বলে,
“কুইন এই হচ্ছে সেই মানুষ যে আপনাকে পদে পদে অবহেলা করেছে। মনে আছে তো? শেখ আনন প্রেম?”

ঐশ্বর্য শক্ত হয়ে দাঁড়ালো। এবার তার দৃষ্টিতে যেন কেঁপে উঠল রাজপ্রাসাদ। কিছু মূহুর্তের জন্য সেই স্বচ্ছ সমুদ্রের পানির ন্যায় চোখ হারিয়ে অমাবস্যার আঁধার দেখা গেল তার চোখে। তখন প্রহরী ব্যক্তিটিকে আরো শক্ত করে ধরে বলে উঠল,
“কুইন, আমাদের রাজ্যে মানুষের প্রবেশ ঘটেছে। অত্যন্ত দুঃসাহস তার। আপনার সাক্ষাৎ পেতে চায়। আপনিই এর ব্যবস্থা করুন।”

এই দুঃসাহসী মানুষটির যেন কোনো খেয়াল নেই। সে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে এখনো তার সামনে থাকা সেই রঙে আবৃত নারীটির দিকে। ঝলমলে সেই লাবণ্যময়ী রূপে কালো রঙটাও যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তবে তার নেত্র দুটো চিনতে বেশ বেগ পেতে হলো প্রেমের। এ যেন সেই সৌন্দর্য যা সকলকে মোহের মাধ্যমে হ’ত্যা করবে।

ঐশ্বর্য সিঁড়ি দিয়ে একপা একপা করে নেমে আসে। তার কালো পোশাকের বর্ধিতাংশ আস্তে আস্তে সিঁড়ি ছুঁইয়ে আসছে। নিচের ভিত কেঁপে কেঁপে উঠছে তার পাদচারণে। চোখে মারা’ত্মক এক ক্রোধের আ’গুন। একটু একটু করে প্রেমের নিকটে এসে দাঁড়াল ঐশ্বর্য। প্রেম ক্লান্ত কন্ঠে ধীর কন্ঠে বলে,
“ঐশ্বর্য!”

“ঐশ্বর্য নয়। ডেভিল কুইন ঐশ্বর্য। আমার দেখা এতোই শখ?”

প্রেম হাসে। মাথা নাড়ায়। আগের মতোই বলে,
“তোমায় দেখতে নয় নিতে এসেছি। যাতে আজীবন দেখে যেতে পারি।”

ঐশ্বর্য কটমট করে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“এতো সাধ করে নিজের মৃ’ত্যু ডেকে এনেছো তুমি সামান্য মনুষ্য! বোকা তুমি। বুঝতে পারো নি আমি আর তোমাকে প্রেম নিবেদন করব না। বরং আমাকে তাচ্ছিল্য, অপমান করবার অপরাধে গুনে গুনে মাশুল তুলব।”

“সেই অপেক্ষাতেই অনেকদিন ধরে আছি। পানিশমেন্ট আসলেই আমি চাই। তোমার হাতে তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব। শুধু আদেশ করো।”

ঐশ্বর্য আশ্চর্য হয়ে তাকালো। মানুষটির মনে সামান্য ভয় নেই? প্রেম আবারও থেমে থেমে বলল,
“তুমি যদি এই রাজ্যের রাণী হও তুমি আমার মনেরও রাণী। তাই তোমার আদেশ শিরোধার্য।”

“ভয় লাগছে না তোমার?”

প্রেম হালকা করে হাসে। নিজের শিকল বাঁধা হাত তুলে ঐশ্বর্যের হাতটুকু ধরে।
“ভয় যদি লাগতো আজ এ পর্যন্ত আসতাম না। ফিরে চলো নিজের রাজ্যে।”

তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে রোজি বলে ওঠে,
“ওর মন ভুলানো কথায় ভুলবেন না কুইন। ও তো আপনার মন কাবু করতেই এসেছে। এই নিন অ’স্ত্র। শে’ষ করুন এই মানুষটার অধ্যায়। আর সূচনা করুন ধ্বং’সাত্মক গল্পের।”

রোজি যেই না পেছন থেকে ছুঁড়ে দিল এক ধারালো তলো’য়ারের সেই মূহুর্তে কৌশলে তা ধরে নিল ঐশ্বর্য। সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে। প্রেমের মৃ’ত্যু দেখবে তারা। প্রেম এবার নির্বাক। ঐশ্বর্যের দিকে হতবিহ্বল নয়নে চেয়ে। তার প্রেয়সীর হাতেই হবে কি তার অন্তিম সমাপ্তি? প্রেম কিছু একটা ভেবে পিছিয়ে যায়। ঐশ্বর্য তা খেয়াল করে তলো’য়ার সোজা করে তাক করে ধরে বলে,
“ভয় পাচ্ছো? প্রেম বেরিয়ে গেছে না?”

প্রেমও মুচকি হেঁসে মাথা দুলায়। দুহাত শিকল ছড়িয়ে চিৎকার করে সকলের সামনে বলে ওঠে,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি ঐশ্বর্য। ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।”

ঐশ্বর্য চকিতে তাকায়। তারপরও কর্ণকুহরে বাজতে থাকে রোজির কথা। রোজি বারংবার বলতে থাকে,
“এই মানুষটার জন্য আপনাকে অশ্রু ফেলতে হয়েছে। তবুও কি এর শাস্তি হবেনা?”

তলো’য়ার নিয়ে এগিয়ে যায় ঐশ্বর্য। তাক করে প্রেমের বুকে। প্রেম চুপচাপ দেখতে থাকে ঐশ্বর্যের কর্মকান্ড। সেও আজ দেখতে চায়। ঐশ্বর্য আচমকা বিদ্যুতের বেগে ঘুরে গিয়ে প্রেমের পেছনে দাঁড়িয়ে তার ঘাড় চেপে ধরে গলার সামনে তলো’য়ার ধরে। শক্ত গলায় বলে,
“ভয় লাগছে এবার? মৃ’ত্যুভয়?”

প্রেম সে অবস্থাতেও হাসে।
“মৃ’ত্যু যদি এতো ভালোবাসাময় হয় তবে ভয় আসবে কোত্থেকে রাজকন্যা?”

ঐশ্বর্যকে এবার পাগল পাগল লাগে। তলোয়া’র সরিয়ে প্রেমের সামনে এসে আঙ্গুল উঠিয়ে বলে,
“এই লোকটা তো পাগল একেবারে। একটা উন্মাদ!”

“তোমার ভালোবাসায় উন্মাদ হয়ে গেছি। ভুলে গেছো?”
পাগলের মতোই হেঁসে বলে উঠল প্রেম। শিকলযুক্ত হাতটা তুলে ঐশ্বর্যের কোমড় টেনে নিতেই সকলের চক্ষু চড়কগাছ। নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিল ঐশ্বর্যকে। ঐশ্বর্য যেন মাথা ঘুরে পড়েই যাবে। তার এখনো তলো’য়ার দিয়ে উশখুশ করছে। প্রেমের এমন পাগলামি দেখে সকলে স্তব্ধ! বাকরুদ্ধ! ঐশ্বর্য তেতে বলে উঠল,
“তোমাকে আমি হ’ত্যা করব! সামান্য মানুষ! আমাকে স্পর্শ করার স্পর্ধা হয় কি করে তোমার?”

“অনেকদিন এই শুষ্ক ঠোঁটের স্পর্শ তোমার মোলায়েম ত্বকে পড়ে না তাই না?”

ভ্রু উঁচিয়ে বলল প্রেম। ঐশ্বর্যের হাত থেকে তলো’য়ার টুকু পড়ে যায় সেই মূহুর্তে। কন্ঠস্বর কাঁপতে থাকে। কিছু বলার আগ মূহুর্তে ঠিক তার ডান গালে পড়ল প্রেমের ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ। পরিবেশ থমথমে হয়ে গেল। বোকা চোখে তাকিয়ে রইল ডেভিল কুইন!

চলবে…