প্রেমে পড়া বারণ পর্ব-১০

0
289

# প্রেমে পড়া বারণ
# পার্ট- ১০
# Writer: Taslima Munni

এই মেয়ে, তুই কি কিছুই বুঝিস না? এতো বোকা কেন তুই?
উনার কথায় আমার মুখভার হয়ে গেছে।
– সারাটা দিন সবাইকে সময় দিচ্ছিস,আমার জন্য একটু সময় হয়নি তোর?
– আমি…..
– তুই কি?
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। উনার চোখের মাদকতায় কথা হারিয়ে ফেলেছি।উনি আরও একটু কাছে এসে চুলের খোপা খুলে দিলেন।
আলতো করে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

——-
” সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী; ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।।”

—————————
মুগ্ধ হয়ে উনার আবৃত্তি শুনলাম।
– আমার হিয়া মন পাখি! তুই আমার সামনে বসে থাকবি।
– বাহবা!
– কি?
– কিছু না।।
মুচকি হেসে বললাম।
– ঘুমাবি না?
– হুমম।
– চল ঘুমাই।
আমি চুপচাপ শুয়ে আছি। উনি আধশোয়া হয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
একবার ফিরে দেখি উনি তাকিয়ে আছেন।
বুকের ভেতর ধপ করে উঠলো।
তার দৃষ্টির মাদকতায় আমি ডুবে যাচ্ছি।
উনি দু-চোখের পাতায় যখন চুমু খেলেন, যেন আমার শরীরের শিয়ার উপশিরায় শিহরণ বয়ে গেছে।
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে। ভীরু পাখির মতো তার বুকে মুখ লুকিয়েছি।
চাতক পাখি একফোঁটা বৃষ্টি পেয়ে যেমন উচ্ছ্বসিত, রেহানের বুকে আমিও এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে নামলাম।
জানালা গলিয়ে এক ফালি চাঁদ সাক্ষী হয়ে রইলো।

অন্যরকম একটা সকাল। সকাল টা এতো সুন্দর হতে পারে আগে কখনো বুঝিনি।
ভোরের সূর্যোদয় জীবনে নতুন করে বাঁচার হাতছানি দিয়ে গেল।
রেহান আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
আমি ওর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি।
– এবার উঠেন।
– উঠবো না।
– তাহলে শুয়ে থাকেন, আমি গেলাম নিচে।
– একদম নড়বি না এখান থেকে। চুপচাপ বসে থাকবি।
– আপনার আর কি?!! কটা বাজে খেয়াল আছে।
– মাত্র ৭ টা।এতো সকালে নিচে যাওয়ার দরকার নেই। সবাই তো আছেই।
– হু,সেই জন্য… সবাই আছে বলেই যাবো।
আপনি থাকেন।
– তুই এখনো ‘আপনি’ ‘ আপনি’ করছিস কেন?
– তো? কি করবো?
– ‘তুমি ‘ করে বলবি।লোকে শুনলে কি বলবে? জামাইকে অই পুরনো দিনের মতো আপনি আপনি করছিস।
– লোকের কথায় আমার কি?
আমি ‘ আপনি’ করেই বলবো।এটাই কেন জানি অনেক বেশি আপন আপন লাগে।
আর যখন ইচ্ছে ‘ তুমি ‘ বলবো, যখন ইচ্ছে ‘ আপনি ‘!
– ধুর!
– ধুর না।সত্যি বলছি।তুমি করে বললে আনইজি লাগবে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
– না, ঠিক নেই।।
– কি ঠিক নেই??!
– আপনি যে তুই তুই করে ডাকেন?
– যা… এখন থেকে আমিও আপনি করেই বলবো।।
– ধ্যাৎ!
– আচ্ছা, তুমি করে বলবো। ঠিক আছে?
– না।
– আবার কি না!?
– তুই করে বলবেন সবসময়।।
– হা।। তুই করে বলি আর যখন বাচ্চারা দেখবে ওদের আম্মুকে তুই করে বলি! তাও একজন টিচার হয়ে!! কি ভাববে বল?

চিন্তা করো! উনি বাচ্চা-কাচ্চার চিন্তাও করে ফেলেছেন!!
– আপনি আসলে একটা…
– একটা কি? শেষ কর কথাটা।।।
– বলছি, উঠে বসেন।
ঠেলে তুলে দিলাম।
– আপনি একটা নির্লজ্জ । লজ্জা শরম নাই।
ঘড়ির দিকে দেখেন।আর এক মিনিট ও আমি নাই।
বলেই আমি প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এলাম।
– এই হিয়া, শুন,শুন….
উনি ডাকছেন।আমি শুনে মিটিমিটি হাসছি।

– ভাইয়া তোকে ডাকছে তো।
রুম থেকে বেরিয়ে মাহি আপুর সাথে দেখা।
– কই? ডাকুক।
বলেই আমি মৃদু হেসে চলে আসছিলাম।
আপু খপ করে হাত ধরে বললো
– কি ব্যাপার?!! আজ একটু বেশিই খুশি খুশি লাগছে!!
– কেন? প্রতিদিন কি আমাকে কাঁদতে দেখো?
– তা দেখিনা।কিন্তু এতো টা খুশিও দেখিনি।
কিন্তু আজ তোর চোখে – মুখে,ঠোঁটে খুশির ঝিলিক, সেটা তো লুকাতে পারবিনা।
মাহি আপুর কথায় আমি আরও লজ্জা পেলাম।
এমন সময় ফুপি আমাদের দেখে ডাক দিলেন। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

আজ মাহি আপু আর রিয়াদ ভাইয়া তারা চলে গেছে। একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
কত আনন্দ করেছি একসাথে।
ছোট থেকে বড় হয়েছি।আপু কত দূর চলে গেলো!!

রেহান কতোটা ভালোবাসে সেটা প্রকাশ করতে পারেনি, হয়তো ওর অনুভূতি গুলো নিজে থেকে প্রকাশ করতে পারেনা।কিন্তু সেগুলো ওর পাগলামির মধ্যেই প্রকাশ পেয়ে যায়।

দুদিন পরে ফুপি নাস্তার টেবিলে বসে বললো – তোরা কদিনের জন্য ঘুরে আয়।
রেহান আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

আমরা ঘুরতে গেলাম।
আমার বরাবরই পাহাড় পছন্দ। প্রথমে সমুদ্র দেখলাম,তারপর পাহাড়ে । সব কিছু ছাপিয়ে রেহানের সাথে কাটানো সময় গুলো অনেক বেশি ভালো লাগার।
পাহাড়ে আমাদের সময় যেন আরও বেশি ভালো কাটছে। দুজন পাহাড়ি রাস্তায় হাত হেঁটেছি।।
সন্ধ্যায় দুজন পাশাপাশি বসে উপভোগ করেছি পাহাড়ি সন্ধ্যা।
রাতে খাবার পরে দুজনে বসে আছি।
আমি রেহানের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়েছি।
ও গুনগুন করছে।
– গুনগুন না করে একটা গান শুনালে কি হয়?
– শুনবি? আচ্ছা তোকে আজ একটা পছন্দের গান শুনাই।
আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে নড়েচড়ে বসলাম।

———————-

ঘুমহারা চোখে, ফিরে দেখি একবার।
ইচ্ছে করে তোমার, হাতে হাতটা মেলবার।

খুব মন খারাপের রাতে,
দূরের বাঁকা চাঁদটার সাথে,
আমার হাতটা যেন থাকে,
তোমার ছোট্ট হাতের পাশে।
তোমার ঘুম ভাঙ্গানোর রাতে,
যখন বড্ড একা লাগে,
আমার হাতটা যেন থাকে,
তোমার ছোট্ট হাতের পাশে।

তোমার দুচোখ ভরা মায়ায়,
আমার সকল বাহাদুরি।
তুমি শূন্য কোন দিনে,
আমি ভীষণ আনাড়ি।

খুব মন খারাপের রাতে,
দূরের বাঁকা চাঁদটার সাথে,
আমার হাতটা যেন থাকে,
তোমার ছোট্ট হাতের পাশে।
তোমার ঘুম ভাঙ্গানোর রাতে,
যখন বড্ড একা লাগে,
আমার হাতটা যেন থাকে,
তোমার ছোট্ট হাতের পাশে।

——————————

রেহান শক্ত করে আমার হাতটা ধরে আছে।
এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমি নিজেকে সবচেয়ে সুখী বলে নির্দ্বিধায় দাবি করতে পারি।

– হিয়া…
– হুমম।
– হিয়া মন পাখি!
– হুমম… বলো।শুনছি তো।
– একটা রাত বারান্দায় বসে কাটাতে পারবি?
– এখানে?
– হুম। আজকে চাঁদের আলো কত সুন্দর দেখেছিস? এখানেই বসে থাকতে ইচ্ছে করছে তোর সাথে। থাকবি?
– হুম।
রেহান একহাতে আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো চুপটি করে ওর বুকে লেপ্টে আছি।
ওর হৃদস্পন্দন শুনছি।
অনেক রাত পর্যন্ত আমরা বসেছিলাম।

বাসায় ফেরার পরে আমি পাক্কা গৃহিণী হয়ে গেছি।রেহান সকালে উঠে ভার্সিটিতে চলে যায়।সকালে উঠে নাস্তা তৈরি করি।ওর কাপড় আয়রন করি।
ও চলে যাবার পরে ফুপিকে কিচেনে হেল্প করি। অবসরে আম্মুর কাছে যাই।
আর সবাই এতো কাছাকাছি থাকি যে কখনো মনে হয় না আমি শ্বশুর বাড়ি থাকি।ওর অপেক্ষা করি কখন ফিরবে।
বিকালে সবাই একসাথে বসে গল্প করি।
ও যখন কোনো কাজ করে, আমি বই পড়ি।এভাবেই সময় চলে যাচ্ছে।

কিছু দিন পরে আমার রেজাল্ট বের হলো। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলাম।
এরপর পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য ভর্তির এপ্লাই করলাম। ভর্তির আগে হটাৎ একটা ইমেইল পেলাম।।
পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য কানাডার একটা ভার্সিটিতে আমি সু্যোগ পেয়েছি।
কিন্তু আমিতো এপ্লাই ই করিনি।
এ কাজ রেহান ছাড়া কেউ করেনি।

রাতে রেহানকে এটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– এসব কি?
– আরে! That’s great!! তোর চান্স হয়ে গেছে।
– সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি।এসবের মানে কি?!! তুমি তো বলোনি এপ্লাই করেছো!!
– এভাবে বলছিস কেন? এখানে চান্স পাওয়া কতটা হার্ড জানিস? তোর তো লাক ভালো।
এটা থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী নিতে পারলে তোর জন্য পিএইচডি করা আরও সহজ হবে।
– এসব গিয়ে তোমার স্টুডেন্টদের বুঝাও আমাকে বুঝাতে হবে না।
আমি সবাইকে ছেড়ে ওখানে গিয়ে পড়াশোনা করার প্রশ্নই আসে না। আর তোমার পিএইচডি?? তোমার ডিগ্রী আছে এটাই থাকুক আমার তো প্রয়োজন নেই।
– আশ্চর্য! আমার ডিগ্রী থাকা আর তোর থাকা এক কথা?
শোন, প্রত্যেকটা মানুষের রাইট আছে নিজের জন্য কিছু করা।
– তার মানে কি? আমি কিছু করতে চাইলে বাইরে গিয়েই পড়তে হবে? এখানে পড়ে কি কেউ হয়নি? সবাই বাইরে গিয়েই পড়ে?
– আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে।। মাথা ঠান্ডা কর।আমরা এটা নিয়ে পড়ে কথা বলবো।
কিছুদিন সময় আছে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।

রেহানের এমন কাজে আমি শুধু অবাকই হইনি, ভীষণ রাগও হচ্ছে।

রাতে আমি বেডে এসে পাশ ফিরে শুয়ে আছি।
রেহান কি কাজ করছিলো ল্যাপটপে।এর মধ্যে রেহান ও কোনো কথা বলেনি,আমিও চুপচাপ শুয়ে।
রেহানের দিকে না তাকিয়েও বুঝলাম ও বেডে এসেছে।
– কি হয়েছে? এতো চুপচাপ শুয়ে আছিস?
– কিছু না।
– কিছু তো একটা হয়েছে। কি হয়েছে বল।
– কিছুই হয়নি। কি বলবো?
– আমার দিকে ফিরে কথা বল।দেয়ালের সাথে কথা বলছিস নাকি?
এদিকে ফির।।
রেহান জোর করেই ওর দিকে ফেরালো।
– তুই বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছিস! কি হয়েছে শুনি।বল।
– বললাম তো কিছু হয়নি।
– রাগ করেছিস?
– তুমি আমাকে দূরে পাঠিয়ে দিতে চাও?
– এইজন্য কাঁদছিস?!! বোকা মেয়ে।
রেহান বুকে জড়িয়ে ধরলো।
– তুই ভাবলি কি করে তোকে দূরে পাঠিয়ে দিতে চাই??
– তাহলে এটা করলা কেন?
– হুম। ঠিক আছে। তুই যদি যেতে না চাস তবে আমি জোর করবো না। তবে..
– তবে কি?

চলবে…..