প্রেমোদ্দীপক পর্ব-০৩

0
918

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-৩)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হওয়ার পর ও তাহিয়ার পক্ষ থেকে কোন প্রকার উত্তর এলো না। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে এলো অভীকের। চোখের উপশিরায় রাগের রেখা উঁকি দিল। কিন্তু এই মুহুর্তে কোন প্রকার আক্রোশ প্রকাশ করতে চাইছেনা সে। চাপা শ্বাস ফেলে রাগ সংবরণ করল, পরপরই আলতো স্বরে বলল,
‘ আর ইউ রেডি ঠু ম্যারি মি? অ্যান্সার মি, ইয়েস ওর নো।’

পূর্বকার নিয়মে এবারও উত্তর দেয়ার পরিবর্তে নীরবতা চাদরে স্বর ঢাকল তাহিয়া। রাগটা চট করেই মাথায় চড়ে বসল অভীকের। মস্তিষ্ক হয়ে গেল তপ্ত। খানিক আগের স্বাভাবিক চেহারাটা গম্ভীর্যে রূপ নিল। তাহিয়ার নিরবতায় রাগটা ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে। নিয়ন্ত্রণ করা দায় হয়ে পড়ছে। রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় চাপা দাঁড়ির হলদেটে চোয়ালে আরেক হাত বুলাল। এই মুহুর্তে সে অফিস রুমে বসে আছে। তার ডেস্কের পাশে জানালা, অভীক ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে তাকাল।

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলা দিনপঞ্জিকায় কার্তিক মাস চলছে। হেমন্তকালে সাধারণত বৃষ্টি হয় না। কিন্তু অতীতের রেকর্ড ভেঙে আজ বৃষ্টি নেমেছে, বড্ড অবেলার বৃষ্টি। বৃষ্টিকন্যার আগমন টের না পাওয়ায় ছাড়া আনা হয়নি। তাহিয়ার পক্ষ থেকে ইতিবাচক উত্তর এলে এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই তাহিয়াদের বাসায় যেতে হবে।
উত্তরটা তাড়াতাড়ি এলে ভালো, বৃষ্টির প্রকোপ বাড়লে কলেজ থেকে বের হওয়া দায় হবে।
সূর্যটা ধূসর মেঘে ঢাকা। বেলা কত হলো বুঝা গেল না। অভীক অফিস রুমের দেয়াল ঘড়িটায় সময় দেখল। দুপুর ১২:০৭ বাজে। ১২:১৫ মিনিটে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস আছে তার। পরবর্তী ক্লাসের আগে
তাহিয়ার সাথে আলাপ সেরে নিতে চাইছে অভীক। তাহিয়ার পক্ষ থেকে ইতিবাচক উত্তর এলে, ডিপার্টমেন্ট হেড থেকে ছুটি ও নিতে হবে। নিজের ক্লাসটা অন্যের কাধে তুলে দিয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাহিয়াদের বাসায় যেতে হবে। নেতিবাচক হলে ক্লাসে যাবে। সময় চলে যাচ্ছে, অথচ মেয়েটার উত্তর দেয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

অভীক গম্ভীর গলায় বলল,
‘ আমি কি তোমার নিরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিব? উত্তর দাও তাহিয়া, আমাকে ছুটি নিতে হবে।’

অভীকের হঠাৎ ফোনে মস্তিষ্কের ভাবনা গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে তাহিয়ার। চিরপরিচিত লেকচারারের বিয়ে বিষয়ক কথাবার্তায় লজ্জা, ভয়, অস্বস্তির সংমিশ্রণ ঘটল তার মাঝে। অভীকের প্রতিটি কথার উত্তর তার ভেতর সাজানোই আছে, সাজানো উত্তরের সাথে অগোছানো কত কথাই না বলতে চাইছে। কিন্তু কথারা যেন আজ হরতাল ডেকেছে, গলা অবধি আসতেই তালগোল পাকিয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হৃদপিণ্ডটা অস্বাভাবিক গতিতে স্পন্দন করছে, গা হাতে কাঁপুনি ধরছে। স্নায়বিক দৌর্বল্যগ্রস্থতার কারণে উচ্চ রক্তচাপের পরিমাপ বাড়ছে। মাথার উপর ফুল স্পিডে ঘুরছে তবুও দরদর ঘামছে সে। তাহিয়া হাজার প্রচেষ্টা চালাল, বড়ো উত্তর না হলে ছোটো করে উত্তর দিতে। কিন্তু গলা দিয়ে ছোট্টো ‘না’ উত্তর ও বেরুল না। এক রাশ অস্বস্তি নিয়ে ফোন রেখে দিল। খানিক ভেবে কাঁপা হাতে কিছু একটা টাইপ করল।

তাহিয়া কল বিচ্ছিন্নতায় অনিশ্চয়তার সাগরে ডুব দিল অভীক। বিয়েটা কি মেয়েটা কাছে ছেলেখেলা মনে হচ্ছে! ও কি বিয়ের সংজ্ঞা জানে না? কাল অবনীর কাছে নির্দ্বিধ কত কথা বলে গেল, অথচ আজ ছোট্ট করে হ্যাঁ না বলতে পারছেনা। আশ্চর্য! এখন ধরে বেধে বিয়ে দিলে পরবর্তী এর পরিণতি শুভকর হবে বলে মনে হয় না। তাই যা বলার আগেই বলে দিক, বিয়ের পর আর ইতিউতি করার সুযোগ হবেনা। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো অভীকের। তাকে চিন্তা মুক্ত করতে খানিক বাদে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। বার্তা খুলতেই দৃশ্যমান হলো দুটো বাক্য,
‘I’m not ready for the engagement now. I need time.’

তৎক্ষনাৎ বাইরের দিকে তাকাল অভীক। বৃষ্টির প্রকোপ বেশি। এই বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে তাহিয়াদের বাসায় যেতে হবে না ভেবেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। দ্বিধার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল বিগত সময় ধরে, মেয়েটা কূলে আনল তবে! উত্তর সে পেয়ে গেছে। তাহিয়ার উত্তর নেতিবাচক। মেয়েটা সরাসরি নিষেধ করতে পারেনি পরোক্ষভাবে বলেছে। বুদ্ধিদীপ্ত অভীকের সে কথা অজানা রইল না।

অভীক খানিক ভেবে মায়ের নাম্বারে কল করল। ফোন রিসিভ হতেই সেখানকার অবস্থান জেনে তাহিয়ার সময় চাওয়ার কথা বলল। নিজের মতামত প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ করল না সে, এতে মা কষ্ট পাবেন। সুক্ষ্ম ভাবে কথা ঘুরিয়ে বলল,

‘মা, তোমার কি মনে হয়, তাহিয়ার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আমার ওকে আংটি পরানো ঠিক হবে? তোমার যদি ঠিক মনে হয়, তবে বলো আমি আসছি।’ সিদ্ধান্তটা মায়ের উপর ন্যস্ত করল।

নীলিমার কপালে চিন্তার গাঢ় ভাজ। চিন্তিত গলায় তিনি বললেন,

‘ মেয়েটা ভীষণ জেদী। এখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও আংটি পরাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তখন ঘটনা আমাদের জন্য শুভকর হবে না। এখন কী করা যায় বলতো?’

ছেলের কাছে পরামর্শ চাইলেন নীলিমা। অভীক শান্ত গলায় বলল,

‘ তাহিয়া যেহেতু সময় চাইছে, তাহলে ওকে সময় দাও। দেখো ঠিকঠাক হয় কি-না।’

‘আমি তো সময় দিতে চাইলাম। মাহমুদাই তো মানতে চাইছেনা। এখন গিয়ে বাগদান পেছানোর কথা বলে দেখি ও কী বলে। ‘

চিন্তিত স্বরে বললেন নীলিমা। অভীক পরামর্শ দিল,

‘ঘটনা বুঝিয়ে বলো। যাতে বাড়তি চাপ না আসে। আন্টির শারিরীক অবস্থা অনুযায়ী এখন উনার জন্য কোন মানষিক চাপ নেয়া বিপজ্জনক। ‘

নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রাখলেন। ফোন রেখে মাহমুদার কাছে গেলেন। মাহমুদা তখন রান্নাঘরে ফিরনি রান্না করছেন। বাগদান ঘরোয়াভাবেই হবে। বাইরের কাউকে ডাকা হয়নি, বিয়েতে একবারে দাওয়াত দেয়ার প্রয়াশ তার। অল্প কয়েকজনের জন্য রান্না করছেন তিনি। নীলিমা প্রথমে মেয়ের সাথে কথা বললেন। তারপর দুজন মিলে গেল মাহমুদাকে বুঝাতে। সব শুনে মাহমুদা তেড়ে গেলেন তাহিয়ার রুমের দিকে। রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। মস্তিষ্কের উষ্ণতার পরিমাণ বাড়ল তা দেখে। সর্বশক্তি দিয়ে দরজায় বাড়ি দিয়ে হুংকার ছাড়লেন।

.
মায়ের হুংকার কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই বিছানায় নির্বিকার বসে থাকা তাহিয়ার অধর কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। যাক, কাজ হয়েছে তবে! অভীককে ধন্যবাদ দিল অসংখ্যবার। খুশিতে লাফিয়ে উঠল। দরজার বাইরে মাহমুদা বকাঝকা করছেন, ভেতরে তাহিয়া গানহীন নেচে যাচ্ছে। মাহমুদা বকে বকে ক্লান্ত হলেন, তাহিয়া দরজা খুলল না। সে পণ করেছে, আগামী দু’দিন রুম থেকে বেরুবে না। মায়ের সামনে পড়লে গায়ের চামড়া আস্ত থাকবে না নিশ্চিত। আপাতত নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।
আযান পড়তেই মাহমুদা স্বর কোমল হলো। ধীরে ধীরে বিলীন হলো। তাহিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানায় বসল।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। তাহিয়া তুহিনকে ফোন দিয়ে খবরাখবর জেনে নিল। অবনীরা খানিক আগেই চলে গিয়েছে। তারা যাওয়ার পর থেকে মাহমুদা দরজা আটকে বসে আছেন। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। ক্ষিধেতে পেটে টান পড়েছে, এখন কিছু না খেলেই নয়। তুহিনকে মায়ের রুমের দরজায় পাহারা বসিয়ে বাইরে বের হলো তাহিয়া। অভীকের জন্য বানানো খাবার খেল তৃপ্তিভরে। খাবার খেয়ে ফেরার সময় তুহিন এগিয়ে এসে বলল,

‘অভীক ভাইয়া চমৎকার মানুষ। তুই রাজি হলেই পারতি, মা ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। নীলিমা আন্টিও মন খারাপ করে ফিরেছেন।’

তুহিনের স্বরটা গম্ভীর শুনাল। তাহিয়া বিশেষ পাত্তা দিল না। স্মিত হেসে বলল,
‘কিছুদিন সময় দে, দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।’

আবার দরজায় খিল দিল তাহিয়া। রাতে আর বের হলো না। পরদিন মাহমুদার স্কুলে যাওয়া পর বের হলো। তুহিন ও স্কুলে চলে গেছে, বাড়িটা পুরোপুরি ফাঁকা। তাহিয়া কলেজের জন্য তৈরি হয়ে নিল। আর ঘরে থাকা যাচ্ছে না। কলেজ গেলে যেন অভীকের সাথে দেখা না হয়, এ দোয়া করতে করতে কলেজের জন্য রওনা হলো।

বাড়ির গেটে যেতেই নীলিমার কল এলো। আতঙ্কে বুক কাঁপল তাহিয়ার, আন্টি আবার বকবেন না তো! ভীত ঢোক গিলে কল ধরল। অপাশ থেকে অবনীর গলা শোনা গেল। অবনী ফোন ধরেই চঞ্চল গলায় বলল,
‘ অভীকের সাথে কথা বলার পর তোর কাছ থেকে ফোনটা নেয়া হয়নি। বাসায় এসে মনে পড়েছে। অভীককে বলেছি কলেজ গেলে তোর থেকে ফোনটা নিয়ে নিতে। তুই একটু অফিস রুমে গিয়ে ফোনটা দিয়ে আসিস তো!’

এতকিছুর পর স্যারের সামনে পড়তে হবে ভাবতেই আঁতকে উঠল তাহিয়া। ইতস্ততভাবে বলল,
‘আমি কীভাবে…

কথা সম্পন্ন করতে দিল না অবনী। করুণ গলায় বলল,
‘ অয়নের বাবা ফোন দিয়ে পাচ্ছে না, মায়ের নাম্বারে ফোন দিয়ে রাগারাগি করছে। ঝামেলায় পড়ে গিয়েছি। প্লিজ তাহিয়া দিয়ে যা! অয়নের স্কুলের সময় হচ্ছে, আমার বেরুতে হবে। তুই মনে করে ফোনটা দিস কিন্তু!’

তাহিয়াকে প্রতিত্তোরের সুযোগ না দিয়ে ফোন রাখল অবনী। ফোন রেখে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘তোমার ছেলে এবং তার হবু বউয়ের মিটিং ফিক্সড। ওদের দেখা সাক্ষাতের মাত্রা বাড়লে যদি কোন চমৎকার ঘটে, তবে আমার ফোন রেখা আসাটা সার্থক!’


অফিস রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাহিয়া। অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করছে। অফিস রুমে নিজের ডেস্কে বসে আছে অভীক। হাতে বই ধরা, দৃষ্টি বইয়ের মাঝে নিবদ্ধ। অফিস রুমে অভীক ছাড়া কেউ নেই। এখনই অভীককে ফোন দিয়ে আসার মোক্ষম সময়। এমন ভাবনা থেকে কাঁপা হাতে দরজায় কড়া নাড়ল।

বই থেকে চোখ তুলে দরজায় তাকাল অভীক। তাহিয়াকে দেখে বই বন্ধ করে বলল,
‘আসুন।’

ধীর পায়ে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করল। হাটতে গিয়ে তাহিয়া স্পষ্ট বুঝতে পারল, তার পা কাঁপছে। অভীকের ডেস্কের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। অভীক গম্ভীরমুখে বলল,
‘কিছু বলবেন, তাহিয়া?’

ভীত ঢোক গিলল তাহিয়া। চোখ মুখে ফুটে উঠেছে অস্বস্তির রেখা। কপালের বিন্দু ঘাম জানান দিচ্ছে অভীকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় স্নায়বিক দৌর্বল্যগ্রস্থের মাত্রা কতখানি। হাতে ধরা বই, দৃষ্টি বইয়ের মাঝেই আবদ্ধ। আসার পর থেকে একবারও অভীকের দিকে তাকায় নি।

অভীক এক পলকে সবটা পরখ করে নিল। মনে মনে হাসল বোধহয়।

রাজ্যের অস্বস্তি ভর করা স্বরে তাহিয়া কিছু বলতে চাইল,
‘আয়াপ… স্বর জড়িয়ে গেল। বলতে পারল না, থেমে গেল। অভীক ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘অযথা সময় নষ্ট না করে যা বলার স্পষ্ট বলুন।’

অভীকের স্বর গাঢ় হলো। তাহিয়ার মনে হলো, আর কয়েক মুহুর্ত চুপ থাকলে অভীক তাকে ধমক দিয়ে বসবে। প্রথম দিনের সেই সিংহী গর্জন। আতঙ্ক ঝেকে বসল তাহিয়ার বুকে। সাহসের ঘাটতি দেখা গেল। আর যাই হোক অভীককে কিছু বলা তার দ্বারা হয়ে ওঠবে না। খানিক ভেবে হাতে ধরা বইটা ডেস্কের উপর রাখল। বইয়ের মাঝে অবনীর ফোন। শুধু ফোনটা দিলে ভালো দেখাবে না, কে আবার কী ভাবে! এই ভেবেই বইয়ে গুজে দিয়েছে। বইটা ডেস্কে রেখে এক মুহুর্তে দেরি করল না, দ্রুত পালাল।

ভ্রু কুঁচকে বইটা হাতে নিয়ে খুলতেই একটা ফোন বেরিয়ে এলো। ফোনটা নবনীর। অভীক ফোন পকেটে রেখে নিজের ফোন থেকে মায়ের ফোনে কল দিল। অপাশ থেকে অবনীর গলা ভেসে এলো,
‘তাহিয়া গিয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী বলল?’ অবনীর স্বরে একরাশ কৌতুহল। তিন নারী মিলে উঠে পড়ে লেগেছে তাদের বিয়ে দিতে। এদিকে যাদের বিয়ে তাদের রাজ্যের আপত্তি। অভীক চাপা হাসল। রগড়ের স্বরে বলল,

‘কাঁপাকাঁপির জন্য বলতে আর পারল কোথায়!’

অবনী হাস্যরসের সাথে বলল,
‘ আন্টি আটঘাট বেধে নেমেছেন, তোদের বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন। মেয়েটার প্রতি এবার একটু কোমল হ। অন্যথায় সারাজীবন ইংলিশ পড়িয়েই যেতে হবে, কেমিস্ট্রি পড়ানো আর হয়ে উঠবে না।’

‘লাগবে না পড়ানো। ক্লাসের সময় হয়ে আসছে। ছাড়ছি।’ বোনের কথায় অভীক বিব্রতবোধ করল। বোনের সাথে ফ্রি হলেও এ পর্যায়ে তার মাঝে জড়তা দেখা দিল, তাই দ্রুত ফোন রাখল।’

অফিস রুম থেকে বেরিয়ে কমন রুমে গেল তাহিয়া। বুকে হাত দিয়ে হাফ ছাড়ল। হাত পা এখনো কাঁপছে, হৃদপিন্ডের কুঁদন এখনো স্পষ্ট টের পাচ্ছে। ভাগ্যিস এই ভয়ানক লোকটার সাথে বিয়ে ভেঙেছে, অন্যথায় বিয়ের দু’দিনের মাঝে মারা যেত। এত ভয় অস্বস্তি নিয়ে বাঁচা যায়! বিয়ে ভাঙার খুশিতে আকস্মিক মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেল। এ খুশিতে বান্ধবীদের ট্রিট ও দিল। সারাবেলা ঘুরে বিকেলে বাসায় ফিরল। কলিংবেল চাপানোর পর মাহমুদা এসে দরজা খুলে দিলেন। মাকে দেখে প্রাণবন্ত হাসল তাহিয়া। মাহমুদা না দেখার ভান করে সোজা ঘরে চলে গেলেন।

চোখে মুখে বিস্ময়ের আভা মাখিয়ে ভ্রু কুঁচকাল তাহিয়া। অন্যদিন দরজা খুলেই হাসিমুখে চায়ের আহ্বান করে। আজ সেটাও করল না। কালকের ঘটনার জন্য বকল ও না। হলো টা কী! রেগে আছে বোধহয়। দু’দিন গেলে ঠিক হয়ে যাবে, এমন ধারণা মস্তিষ্কে হানা দেয়ায় বিশেষ প্রাধান্য দিল না।

তাহিয়ার ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে দু’দিন অতিবাহিত হওয়ার পর ও মাহমুদা স্বাভাবিক হলেন না। সকালে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রেখে স্কুলে চলে যান, বিকেলে এসে রুমে ঢুকে যান আর বের হন না।
তাহিয়া বেশ কয়েকবার যেসে কথা বলতে গিয়েছে , বিশেষ লাভ হয়নি। এই তো আজ বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর তাহিয়ার সাথে দেখা হলো মাহমুদার। মাকে দেখে তাহিয়া প্রসন্ন হেসে বলল,
‘চা খাবে মা? আমি চা বানিয়ে আনি?’

মাহমুদা নিরবতায় গা ঢেকে ছিলেন খানিকক্ষণ। তারপর তাহিয়ার কথা না শোনার ভান করে নিজের রুমে চলে গেলেন। গিয়ে দরজা দিলেন। তাহিয়া দরজায় নক করল। ক্ষমা চাইল, অপাশ থেকে উত্তর এলো না। মায়ের এই অভিমান সইতে না পেরে কান্না পেল তার। বাবা সেই ছোটোবেলাতেই চলে গিয়েছেন, তারপর থেকে মা-ই সব। এখন মাও মুখ ফিরিয়ে নিলে সে যাবে কোথায়?

বসার ঘরে সোফায় বসে টিভিতে খেলা দেখছে তুহিন। তাহিয়া ভাইয়ের পাশে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। বোনের মলিন চেহারা দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কী হয়েছে আপু?’
‘মা, এমন করছে কেন বলতো?’
করুণ স্বরে প্রশ্ন করল তাহিয়া। তুহিন টিভিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,
‘ নীলিমা আন্টিদের অমন চলে যাওয়া মা মেনে নিতে পারেনি। ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন।’

‘মা, এমন একটা আবদার করে বসেছেন, যা আমি মানতে পারিনি। কী করব বল?’ অসহায় শোনাল তাহিয়ার স্বর। তুহিন আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
‘তোর ইতিবাচক উত্তর ছাড়া মায়ের অভিমানের মাত্রা নিঃশেষ হবে না। একবার রাজি হয়ে যা, দেখবি সব ঠিকঠাক।’

তাহিয়া চোখে সর্ষে ফুল দেখল। স্যারকে বিয়ের কথা ভাবতেও পারছে না, এদিকে মায়ের অস্বাভাবিক আচরণ ও সহ্য হচ্ছে না। ভীষণ কষ্ট লাগে।

দ্বিধাযুক্ত আরও একটা দিন পেরুলো। মায়ের সাথে কথা বলার সর্বাত্মক চেষ্টা করল, কিন্তু ফলাফলের খাতায় ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই এলো না।

এর দিন দুয়েক বাদে ফিরোজ সাহেবকে কল করল তাহিয়া। উদ্দেশ্য, মাকে একটু বুঝানো না। বলা বাহুল্য, ফিরোজ সাহেব বাগদান বাতিল করার পরপরই রাজশাহী ফিরে গেছেন। ফোন তুলে কুশল বিনিময়ের পর মায়ের অবস্থার কথা উল্লেখ করল তাহিয়া। অনুরোধ করল ফিরোজ সাহেব যেন বোনের সাথে কথা বলে বোনকে বুঝান। তাহিয়ার অনুরোধের বিপরীতে ফিরোজ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘তোকে কিছু কথা বলি, মন দিয়ে শুন। ‘

তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল। ভেঙে পড়ার মতো কিছু হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না তার। সে প্রশ্ন করল,

‘কী কথা, মামা?’

পরবর্তী কথা বলার আগে কিছুক্ষণ সময় নিলেন ফিরোজ সাহেব। তারপর ধীর স্বরে বলতে শুরু করলেন,

‘ বছর খানেক আগে হঠাৎ মাহমুদার হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। গুরুতর হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়, পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা যায়, মাহমুদার হার্টের চর্বি জমে হৃদযন্ত্রের রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেছে । তিনটি ব্লক ধরা পড়েছে। এনজিওলস্ট করানো হয়েছিল। সেই সাথে মেডিসিন চলছিল। এসব হয়েছে তোর অগোচরে। তুই আবেগী। তুই ভেঙে পড়বি বলে তোকে জানানো হয়নি। মাহমুদা তোর সামনে নিজেকে শক্তভাবে উপস্থাপন করতো সবসময়। ওর অসুস্থতা বেশি হলেই তোকে রাজশাহী পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মাঝে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ও থাকতে হয়েছে। ইদানীং মাহমুদার সমস্যা গুরুতর হয়ে গেছে। ঔষুধ দিয়ে চিকিৎসা সম্ভব নয়। ডাক্তার বলেছে, হার্ট সার্জারি করাতে হবে। কিন্তু মাহমুদা রাজি হচ্ছেনা।’

এতটুকু বলে থামলেন ফিরোজ সাহেব। তাহিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল। চোখজোড়া ভাসছে জ্বলে। প্রিয়জন হারানোর ভয়ে কাঁপছে বুক। ভেজা গলায় প্রশ্ন করল,
‘কেন রাজি হচ্ছে না?’

এ পর্যায়ে ফিরোজ সাহেবের স্বর কিছুটা গম্ভীর শোনাল,
‘তোর জন্য। মাহমুদার ধারণা অপারেশনের পর ও বাঁচবেনা। ডাক্তার বলছে, মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি নয়। তবুও মাহমুদা মানতে নারাজ। ছোটোবেলায় তোরা বাবাকে হারিয়েছিস। বাবার অবর্তমানে মাহমুদা দেখভাল করেছে, কিন্তু ওর অবর্তমানে কে তোদের দেখভাল করবে? এই আশঙ্কায় আতঙ্কিত মাহমুদা। তুহিন ছেলে মানুষ, বড়ো হয়ে নিজেরটা নিজে বুঝে নিবে। কিন্তু তোর কী হবে! তুই ছেলেমানুষ, পড়ালেখায় ও খুব একটা ভালো নয় যে নিজের পায়ে দাঁড়াবি। তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই চোখে সর্ষে ফুল দেখছে মাহমুদা। ও চাইছে, অপারেশনের আগে তোর বিয়ে দিতে। এমন কারো কাছে তোর দায়িত্ব দিয়ে যেতে যে ওর অবর্তমানে তোকে আগলে রাখবে। এ ক্ষেত্রে অভীকের চেয়ে ভালো কাউকে মাহমুদার চোখে পড়েনি। অভীক ছেলেটা ভালো, দায়িত্ববান। তোকে ঠিক আগলে রাখবে, সুখে রাখবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, অভীকের মা নীলিমা। নীলিমা তোকে ছোটোবেলা থেকে মেয়ের মতো আদর করেন। এখন তুই নীলিমার ঘরে গেলে মাহমুদার অবর্তমানে মায়ের অনুপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারবি না। নীলিমার কাছে তোকে দিয়ে যেতে পারলে মাহমুদার আপসোস থাকবে না, ওর ধারণা ও মরেও শান্তি পাবে। এমন ভাবনা থেকে জেদ ধরেছে, তোদের বিয়ে না দিয়ে অপারেশন করাবে না। ‘
এ টুকু বলে থামলেন ফিরোজ সাহেব। সামনে রাখা গ্লাসে চুমুক দিয়ে গলা ভেজালেন। অতঃপর কোমল স্বরে বললেন,

‘ তানভীর আহমেদের যখন মৃত্যু হয় তখন মাহমুদার বয়স সবে পঁয়ত্রিশ। রূপটা তখনো ঠুকরে পড়ছিল। অনেক সমন্ধ এসেছিল বিধবা মাহমুদার জন্য। বাবা তখন জীবিত ছিলেন। তিনি ও কম চেষ্টা করেননি মেয়ের বিয়ে দেবার, কিন্তু মাহমুদা তোদের দিকে চেয়ে রাজি হয়নি। বাবা যখন বিয়ের জন্য অতিরিক্ত চাপ দিচ্ছেলেন তখন সইতে না পেরে তোদের নিয়ে বেরিয়ে গেছে। বাবার বাড়ির রাজকীয় সুখ বাদ দিয়ে কুড়েঘরে উঠেছে, শুধু মাত্র তোদের ভালো চেয়ে। তোদের কথা ভাবতে গিয়ে কত কষ্টটাই না পেয়েছে জীবনে। পেয়েছে কী, এখনো পাচ্ছে। এই যে এখন তোর ভালো ভাবতে গিয়ে সার্জারি করাচ্ছে না, এতে কষ্টটা ওরই হচ্ছে। এত কষ্ট করে মেয়ে মানুষ করার পর সেই মেয়েই তাকে কষ্ট দিচ্ছে! তুহিন বলল,কদিন যাবত খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, ঠিকমতো ওষুধ ও খাচ্ছেনা। এভাবে থাকলে যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটে যাবে। তারউপর বাড়তি চাপ। ডাক্তার পাই পাই করে বলেছেন, যেন মানষিক ভাবে চাপ না নেয়। কিন্তু মাহমুদা তোর চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেই চিন্তার আগুনে ঘি টাও তাই ঢালছিস। কেন!
আমার বোনটার কি এসব পাওনা ছিল! ‘

লম্বা কথা শেষ করে থামলেন ফিরোজ সাহেব। প্রথম দিকে তার স্বর শান্ত থাকলেও শেষের দিকে অশান্ত হয়ে উঠেছে। ক্ষণে ক্ষণে বেড়েছে। এখন রাগে ফোঁসফোঁস করছেন। মামার রাগে ভয় পায়নি তাহিয়া, পেয়েছে মায়ের অসুখে। মামার কথাগুলো কানে যেতেই সর্বপ্রথম একটা কথায় মাথায় এলো, মাকে কষ্ট দেয়া যাবে না, বিয়েটা তাকে করতে হবে। মায়ের খুশির জন্য করতে হবে। মাকে সুস্থ হতে হবে। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,

‘আমি বিয়ে করব, মা যাকে চাইবেন তাকেই বিয়ে করব। তুমি নীলিমা আন্টিকে বলে দাও। সেই সাথে মায়ের সার্জারির ব্যবস্থা করো। আমার জন্য মায়ের কোন ক্ষতি হতে দিব না। ‘

ফিরোজ সাহেবের চেহারার রঙ বদলে গেল আকস্মিক। খুশিতে চোখ মুখ চকচক করে উঠল। খুশি মনেই জিজ্ঞেস করলেন,
‘ভেবে চিন্তে বলছিস তো!’
‘হ্যাঁ, তুমি মাকে ও বলে দিও।’

‘খুশির খবরটা তুই দিস মাহমুদাকে। আমি দিলে কিছু আন্দাজ করতে পারবে। মাহমুদা কোন ভাবেই চায় না তুই এখন ওর অসুস্থতার কথা জেনে যাস। তুই কান্নাকাটি করবি, ভেঙে পড়বি,ও এসব সহ্য করতে পারবেনা। তুই মাহমুদাকে জানতে দিস না, তুই যে সব জেনে গিয়েছিস। একটু গম্ভীরভাবে বলিস। একবারে নরম হয়ে যাস না।’

কান্নার জন্য উত্তর দিতে পারল না তাহিয়া। ফোন রেখে দিল। ফোন রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল। একরাশ অনুতাপ, হারানোর ভয় এসে হানা দিল। ইচ্ছে করল, তৎক্ষনাৎ গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু পাচে না মা টের পেয়ে যান, এই ভয়ে যেতে পারল না। চোখ জোড়াকে জলপ্রপাতের রূপ দিয়ে রুমেই রইল।

গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর। পা টিপে টিপে মায়ের রুমে গেল। মায়ের পায়ের কাছে বসে নিঃশব্দে কাঁদল কিছুক্ষণ। তারপর ফিরে এলো। সকালে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে মায়ের কাছে গিয়ে বলল,
‘মা, আমি যদি বিয়েতে রাজি হই, তবে কি তুমি আমার সাথে কথা বলবে?’

চলবে..