প্রেমোদ্দীপক পর্ব-০৬

0
868

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-৬)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

আকাশে আজ চাঁদ নেই। আঁধারি রাতের আকাশে গুটিকয়েক তারা মিটিমিটি জ্বলছে। তারার মাঝ দিয়ে একটা উড়োজাহাজ ধীর গতিতে পেরিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে গতিটা ধীর মনে হচ্ছে, কাছ থেকে দেখলে বুঝা যাবে দ্রুতই যাচ্ছে উড়োজাহাজ। হাসপাতালের রিসেপশনে বসে জানালার দিয়ে উড়োজাহাজের পার হওয়া দেখছে তাহিয়া। চোখে মুখে উদাসীনতার আভাস। কারণটা, মাহমুদা। মায়ের জন্য হাজার চিন্তার তার। মনে শত প্রার্থনা, মা যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান।

মাহমুদাকে টেস্টের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অভীক, নীলিমা আর তাহিয়াকে রিসেপশনে বসিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেছে। এতক্ষণ নীলিমা তাহিয়ার পাশে বসা ছিলেন। আকস্মিক অবনীর ফোন আসায় উঠে এক কোণে চলে গেলেন। নীলিমা যেতেই একাকিত্ব ঝেকে বসল তাহিয়ার মাঝে, উদাস হলো মন। তার উদাসীনতা দূর করতে উপস্থিত হলো অভীক। তাহিয়ার পাশে বসে তাহিয়াকে পরখ করে গলা খাঁকারি দিল। উদ্দেশ্য, নিজের উপস্থিতি জানান দেয়া।

ভাবনাচ্যুত হলো তাহিয়ার। শব্দের উৎস খুঁজে পাশ ফিরে চাইল। অভীককে পাশে বসে থাকতে দেখে তড়িৎ ঘাড় ঘুরাল। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে নড়েচড়ে বসল। অভীক ধীর স্বরে বলল,

‘তোমাদের বাসার হ্যাল্পিং হ্যান্ড মেয়েটা ভীষণ অদ্ভুত! কীসব বলছিল তখন। ‘

অর্ধাঙ্গিনীর মন ঘুরানোর চেষ্টায় তখনকার কথা তুলল অভীক। তার চেষ্টা বৃথা গেল না। তখনকার কথা মনে পড়তেই চিন্তা ভুলে ফিক করে হেসে দিল তাহিয়া। অভীক অন্তর্ভেদী চাহনিতে সেই হাসি পরখ করে বলল,

‘ খুব মজা নেওয়া হচ্ছে!’

থেমে সন্দিহান মুখে বলল, ‘কোথাও তুমি শিখিয়ে দাও নি তো! ‘

তাহিয়ার হাসি থেমে গেল। ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্কে তড়িৎ মাথা নাড়াল। তবে, অন্যদিকে তাকিয়ে ঠিকই ঠোঁট চেপে হাসল।

অভীক গম্ভীরমুখে বলল,
‘ আমার কেন যেন তেমনটাই মনে হচ্ছে। ওসব গান ডাউনলোড করে হেডফোন দিয়ে দিনরাত শোনাটা তোমার পক্ষে অসম্ভব নয়। হতে ও পারে, তুমি তোমার কোন এক দুলাভাইকে দেখে এমন সস্তা জোক করেছো, তা দেখে মেয়েটা তোমাকে কপি করল। করেছো না কি?’

লোকটা রীতিমতো অপমান করছে তাকে! কতটা বদ! স্যার না হলে রক্ষে ছিল না। নেহাৎ স্যার বলে চুপ করে রইল। বিরুক্তিতে মুখ কুঁচকাল তাহিয়া। উত্তরে হাজার কথা শোনানোর ইচ্ছে দমিয়ে শুধুই নেতিবাচক মাথা নাড়াল। অভীক স্মিত হেসে বলল,

‘আমাকে জব্দ করার উদ্দেশ্য থাকলে ঝেড়ে পেলো। চাইলে আমি ও জব্দের চেইন টানতে পারি। আমি জব্দের চেইন টেনে সম্পর্কের দাবিদার কোন আচরণ করলে, তুমি অস্বস্তিতে অক্কা পাবে নিশ্চিত। ‘

অভীকের কথার মাঝে সরু ইঙ্গিত ধরতে সময় লাগল না তাহিয়ার। লজ্জা,রাগ, অস্বস্তিতে চোখ মুখ খিচে ধরল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘ঝেড়ে তো ফেলতেই হবে, আমার ঘাড়ে যে একটাই মাথা!’

পাশে বসে থাকা অভীক শুনে ফেলল কথাটা। ঠোঁট চেপে হেসে রগড়ের সাথে বলল,
‘ একটা মাথা হলে, ওসব গান টান শোনা বন্ধ করে দাও। আমাদের বাসায় যাওয়ার পর কোনদিন আবার তানভীর ভাইয়ের সামনে গিয়ে তোমার দিলে ও বাত্তি জ্বলে উঠে। তারপর তুমিও রিনার মতো গানে গানে সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়ার আবদার করে বসো, তার নিশ্চয়তা নেই। তখন কী লজ্জাজনক হবে আমার জন্য! আজ বাসায় গিয়ে ‘আপা’, ‘দুলাভাই’, ‘বেয়াই’ ‘শ্বশুর’ ‘শ্বাশুড়ি’ সম্পর্কিত সব গান ফোন ডাউনলোড করা আছে সব ডিলিট দিবে। তবে, ‘স্বামী’ সম্পর্কিত কোন গান থাকলে রাখতে পারো। আমি দায়িত্ব সচেতন মানুষ, আমার কাছে প্রয়োগ করলে আমি তোমাকে হতাশ না করে, কানে তুলো দিয়ে শুনে নিব।’

রাগে চোয়াল শক্ত হলো তাহিয়ার। এত কথার পর চুপ থাকা যায় না। অবনীর স্বামী তানভীরের সাথে তো তার এখন অবধি দেখাই হয়নি। বিয়ের দিন এসে বিয়ে পড়ানোর পরপর কাজের বাহানা দিয়ে চলে গেল। তাহিয়া কি না সে লোকের সামনে গিয়ে গান গাইবে? আশ্চর্য! তাহিয়াকে কী ভাবে লোকটা! এতটা নিচুস্তরের? যে যাকে তাকে দেখে গান গেয়ে উঠবে? দুটো কথা শুনানোর আশায়, চোখে একরাশ রাগ ঢেলে চোখ তুলে তাকাল। অভীকের দৃষ্টি তার পানে আবদ্ধ। ওর কালো মণির চোখজোড়ায় দৃষ্টি ধাক্কা খেতেই হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল তাহিয়ার। সব রাগ উবে গেল, জড়তা হানা দিল। তড়িৎ চোখ নামাল। চোখ মুখ খিচে মনে মনে বলল,

‘এই মানুষটার চোখে চোখ রাখলে ও ভয়ে দমবন্ধ হয়ে আসছে। সেখানে কথা শোনানোর কথা ভাবা তো বিলাসিতা। আল্লাহ, আমার সহ্য ক্ষমতা বাড়িয়ে দাও!’

তাহিয়ার পরিবর্তিত মুখভাবের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল অভীক। তার বলা কথার রেশ ধরে আগত ঘন্টা দুয়েক তাকে বকতে বকতে পার করবে, এটা সুনিশ্চিত। এসবের মাঝে মন খারাপের অবকাশ পাবে না।

নীলিমা এসে পড়লেন। ছেলে, ছেলে বউকে পাশাপাশি বসা দেখে হৃদয় শীতল বাতাস বয়ে গেল। এই দম্পতির সম্পর্কে উন্নতির আশায় প্রহর কাটছে তাদের দুই বান্ধবীর। নীলিমা প্রসন্ন হাসলেন। মায়ের আগমনে অভীক নিরবতায় গা ঢাকল।

কলেজের অডিটোরিয়াম রুমে ‘র‍্যাম্প ওয়াক’ এর রিহার্সাল চলছে। সিনিয়র-জুনিয়র জুটি বেধে নানা কায়দায় হেটে স্টেজের এ মাথা থেকে ও মাথায় যাচ্ছে। দর্শক সারিতে বসে সবার হাটা দেখছে তাহিয়া। কাল অভীকের কথায় ভরসা পেয়ে আজ কলেজে এসেছে। অভীকের সাথে সাক্ষাৎ এড়াতে ডিপার্টমেন্টে না গিয়ে সোজা অডিটোরিয়াম রুমে চলে এসেছে। দুই বান্ধবীকে ডেকে এনে কথার ঝুলি খুলে বসেছে। তাদের কথায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে একটা পুরুষ কন্ঠ ডেকে ওঠল তাকে,
‘তাহিয়া, রিহার্সাল করবি না?’

কথা থামিয়ে চারপাশে চোখ বুলালো। পুরুষ কন্ঠের মালিকের নাম ‘সায়িদ’। তাহিয়ার ক্লাসমেট। র‍্যাম্প ওয়াকে সায়িদের সাথে তাহিয়ার জুটি নির্ধারণ করা হয়েছে। সায়িদ ততক্ষণে তাহিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাহিয়া বলল,

‘ আমাদের থিম কী?’

‘ গ্রামীণ কৃষক বর-বউ।’

বিরক্তভরা স্বরে বলল সায়িদ। তাহিয়া চঞ্চল গলায় বলল,

‘ইন্টারেস্টিং! আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল বাঙালিয়ানা সাজ দেয়ার। যাক, এবার পূরণ হবে। ‘
থেমে সায়িদকে পরখ করে বলল,

‘এত বাজে এক্সপ্রেশন দিচ্ছিস কেন তুই?’

সায়িদ কিছুটা রেগে বলল,
‘ভালো এক্সপ্রেশন আসছে না। আমার গেট আপ কী জানিস? ফতুয়া-লুঙ্গি, তেল দিয়ে লেপ্টে দেয়া চুল, কোমরে গামছা বাধা, পায়ে শুকনো কাদা মাখানো, হাতে এক গোছা ধান আর আরেক হাতে একটা কাচি। জীবনে ও এসব গায়ে জড়াইনি আমি। এখন এসব উদ্ভট সাজে না কি স্টেজে গিয়ে হাটব! অসহ্য লাগছে ভাবতেই। কত চেষ্টা করলাম বদলানোর, সিনিয়র ভাইয়েরা কোন কথা শুনলই না। রাগ লাগছে!’

সায়িদের কথায় হেসে ফেলল তাহিয়া। আকস্মিক হাসি থামিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
‘ তুই যেভাবে বলছিস যেন কৃষকরা মানুষ নয়। ওরাও মানুষ, বরং শ্রেষ্ঠ এবং সংগ্রামী মানুষ। ওদের কারণেই ভাত মুখে তুলতে পারছিস, নয়তো অভুক্ত মরে পড়ে থাকতি। সেই কৃতজ্ঞতা থেকে ও একদিন ওদের মতো সেজে দেখ, ওদের মাঝের অনুভূতিগুলোকে অনুভব কর!’

উঠে দাঁড়াল তাহিয়া। স্টেজ কিছুটা ফাঁকা হয়েছে। কয়েকজন ব্রেক নিয়েছে। এখনই সুযোগ। তাহিয়া ধীর পায়ে স্টেজে উঠল। গ্রামীন বউয়ের হাটা চলার কায়দা বুঝে নিয়ে রিহার্সাল করল কিছুক্ষণ। স্টেজে একটা জুনিয়র মেয়ে ছিল। নাম রায়তা। রায়তা রিহার্সাল করছে, তার থিম হলো ‘মর্ডান মেয়ে’। সেই মাফিক হাটতে পারছে না মেয়েটা। তাহিয়া বলল,
‘দাঁড়াও আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।’

বাড়ি থেকে আসার সময় চুলে পনিটেইল বেধে এসেছিল তাহিয়া। আকস্মিক হেয়ার ব্যান্ড খুলে চুলে ছেড়ে দিল। কোমর অবধি লালচে রেশমি চুলে ছড়িয়ে গেল পিঠময়। হাত দিয়ে আঁচড়ে এক পাশে সিথি করে সামনে নিয়ে এলো। তার পরনে ছিল, মেজেন্টা লং টপস আর নীল জিন্স। কোমরে ওড়না বাধা ছিল। ওড়না খুলে গলায় প্যাচালো। চশমা খুলে রায়তাকে দিল। ওর থেকে সানগ্লাস নিয়ে চোখে পরল। তারপর কোমরে এক হাত রেখে, কোমর দুলিয়ে হাটা ধরল। র‍্যাম্প শো দেখা হয় অনেক, সে হিসেবে মডেলদের হাটাচলা মুখস্থ তার। বেশ ভাব নিয়ে পায়ে পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে এলো সে। ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি।

নবীণবরণ উপলক্ষে অডিটোরিয়াম রুম কিভাবে সাজানো হবে, এ সম্পর্কে আলোচনা করতে করতে ডিপার্টমেন্টের ছয়জন লেকচারার ও ডিপার্টমেন্ট হেড এলেন অডিটোরিয়াম রুমে। দর্শক সারির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সিনিয়র কয়েকজন ছাত্র-সমেত পরামর্শ করছিলেন। তাদের মাঝে অভীক ও ছিল। স্টেজের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল সে, কথা বলতে বলতে আকস্মিক চোখ গেল স্টেজের মাঝে। লাল গালিচা বিছানো স্টেজে বিশেষ ভঙিমায় হাটতে থাকা মেয়েটাকে দৃষ্টিগোচর হলো তার। তার অনন্য ভাবভঙিমা দেখে বিস্মিত হলো অভীক। ভ্রু নাড়িয়ে সেকেন্ড খানেক তাকিয়ে চোখ সরাল।

স্টেজের একবারে প্রথম প্রান্তে আসতেই পেছনের দিকে চোখ পড়ল। গম্ভীর আলোচনায় মত্ত স্যারদের মাঝে অভীককে দেখে ভড়কে গেল। তড়িৎ কোমর থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কথা বলতে বলতে অভীক আবার এদিকে তাকাল। বিব্রতবোধ করল তাহিয়া। চোখ মুখ খিচে পেছন ঘুরল, হুলস্থুল হয়ে রায়তা থেকে চশমা নিয়ে এক প্রকার দৌড়ে স্টেজ থেকে নেমে গেল। তাড়াহুড়ায় পা মচকে পড়ে গেল, সিড়ির কাছে। উঠে দাঁড়িয়ে খানিকটা খুড়িয়ে গিয়ে বসল দর্শক সারির প্রথম লাইনে মীরার পাশে একটা চেয়ারে। চোখমুখ খিচে চেয়ারে বসে বুকে হাত দিয়ে হাফ ছাড়ল, হৃদপিণ্ড এত দ্রুত স্পন্দন করছে, মনে হচ্ছে এখনি খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে যাবে। হাত পা কাঁপছে। একটু ঢং করতে গেছিল, তখনি লোকটাকে আসতে হলো! আরেকটু পরে আসলে কী হতো!

তার অবস্থা দেখে মীরা উদ্ধিগ্ন হয়ে বলল,
‘কী হয়েছে? তুই এমন করলি কেন?’

মীরার স্বর শুনে চোখ খুলল তাহিয়া। রাগত স্বরে বলল,
‘সব দোষ তোর। আগ বাড়িয়ে আমার নাম লেখাতে গেলি কেন? তুই যদি নাম না যদি তবে এখন আমাকে এতটা লজ্জায় পড়তে হতো না। এবার আমি সামনে যাব কিভাবে!’

আকস্মিক তাহিয়ার আক্রমণাত্মক কথায় হতভম্ব হয়ে গেল মীরা। ভালোর জন্য বান্ধবীর নাম দিল, এখন দোষ হয়ে গেল! সে মুখ বাঁকিয়ে অসন্তোষ গলায় বলল,

‘ তোর ভালোর জন্য নাম দিলাম। এখন আমাকেই দোষ দিচ্ছিস? হাহ্! ভালা কা জামানাই নেহি রাহা। ‘

শৈলী ঘাড় ঘুরিয়ে স্যারদের দেখে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
‘ গেলো বছর তো স্যারদের সামনেই পারফরম্যান্স করেছিস, তখন তো লজ্জা পাসনি। তবে আজ কাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছিস?’

প্রশ্ন ছুঁড়ে সন্দেহী চোখে তাকাল বান্ধবীর দিকে। তাহিয়া থতমত খেল। ধরা পড়ার আতঙ্কে কথা ঘুরাল,
‘আমি অন্য ভাব ভঙিমায় ঢং করে হাটছিলাম, আকস্মিক স্যারদের চোখে পড়ায় লজ্জা পেয়েছিলাম। আর কিছুই না। ‘

মীরা সন্দিহান হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তাহিয়া চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন! চোখ সরা, বেয়াদব!’

মীরা গম্ভীর স্বরে বলল,
‘আমি বলি কী, তাহিয়া? তুই বরং একবার পাবনা থেকে ঘুরে আয়। দেখবি ব্যাটার ফিল করছিস!’

তাহিয়া চশমা পরে রাগত স্বরে বলল,
‘আমি পাবনা যাব কেন? আমি কি পাগল না কি?’

‘ তোর কান্ড কারখানা দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে।’

হাসি চেপে বলল মীরা। তাহিয়া রাগে বিড়বিড়াল,
‘এই লোকটা আমাকে পাগল বানিয়ে ছেড়েছে। কী আমি, কী হয়ে গেলাম! আল্লাহ বিচার করবে এই লোকের। ভালো হবে না।’

আকস্মিক ফোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল আননোন নাম্বার। ভ্রু কুঁচকে রিসিভ করে সালাম দিল। উত্তরে অপাশ থেকে পুরুষালি স্বর ভেসে এলো,
‘ব্যাথা পেয়েছো?’

স্বরটা অচেনা ঠেকল তাহিয়ার কাছে। কে এই পুরুষ, যে ভাব ভণিতা ছাড়া উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করছে? সে ঝাঁজালো গলায় বলল,
‘কে আপনি? ‘

অপাশ থেকে শান্ত স্বর ভেসে এলো আবার,
‘আমি অভীক। ‘

থতমত খেল তাহিয়া। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে দেখল, নাহ্, স্যার নেই। সে তো নাম্বার দেয় নি, তবে নাম্বার কোথায় পেল স্যার? নিশ্চয়ই অবনী আপু দিয়েছে। ফোন কানে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। অভীক ফিরতি প্রশ্ন করল,
‘ তখন পড়ে গেলে যে, ব্যাথা পেয়েছো? পায়ে লেগেছে?’

লোকটা সেটাও পরখ করেছে! খানিকটা অবাক হলো তাহিয়া। জড়তার সাথে ছোটো করে উত্তর দিল,
‘না।’

এ পর্যায়ে স্বর গম্ভীর হলো অভীকের,
‘আমাকে দেখে এতটা হুলস্থুল করতে হয় কেন তোমার? একটু স্বাভাবিক থাকা যায় না? এখন পায়ে লাগলে, নবীন বরণ অনুষ্ঠানে স্টেজে কোমর দুলিয়ে র‍্যাম্প ওয়াকের বদলে বিছানায় শুয়ে কাতরাতে। ফাজিল!’

ধমক মিশ্রিত কথায় কেঁপে ওঠল তাহিয়া। নিজের দোষে অন্যকে বকা দিচ্ছে! লোকটা যদি এখানে না আসতো তবে সে এমন হুলস্থুল কান্ড বাধাতো না। স্যার ছাড়া পুরো কলেজের মানুষ সামনে থাকলে সে একটুও বিব্রতবোধ করতো না। নিঃসঙ্কোচে র‍্যাম্প ওয়াক করতে পারতো। এই এক স্যারের কাছে এলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে নেতিয়ে যায় সে। মনে মনে বেশ গালমন্দ করে কল কেটে দিল। এই ভদ্রলোকের ধমক শোনার ইচ্ছে নেই তার। ফিরতি ফোন এলো। তাহিয়া কেটে দিল। এবার ম্যাসেজ এলো,
‘পা ঝেড়ে একটু হাটো। না হয় পরে ব্যাথা করবে। হোচড় তো দারুণভাবে খেয়েছো। ‘

‘হোচড় তো দারুণভাবে খেয়েছো!’ লেখাটা পড়ে রাগ হলো তাহিয়ার। মানে কী! লোকটা মজা করছে? কতটা বদ! রাগে চোয়াল লাল হলো তার।

তাহিয়ার রাগে ঘি ঢেলে শৈলী বলল,

‘ শুনেছিস, অভীক স্যার না কি বিয়ে করেছেন?’

শৈলীর কথা কানে যেতেই হকচকিয়ে তাহিয়া বলল,
‘কী!’

মীরা সায় জানাল,
‘হ্যাঁ। আমি শুনে ভীষণ অবাক হয়েছি। আফসোস হচ্ছে, না জানি কোন মেয়ের কপাল পুড়ল! আহারে বেচারি! মেয়েটার জীবনের কথা ভাবতেই আমার শীতল পাটি বিছিয়ে বিলাপ করতে ইচ্ছে করছে।’

মীরার কথায় তাহিয়ার বলতে ইচ্ছে হলো, ‘আমার কপাল পুড়েছে রে বোন, বেচারিটা আমিই। আয় কাঁদি। ‘ ইচ্ছেদের দমিয়ে আমতা-আমতা করে বলল,
‘কে বলেছে তোদের?’

শৈলী উত্তর দিল, ‘ ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দিয়েছে।’

লোকটা সেদিন তো খুব করে বলল জানাবে না। আজ জানিয়ে দিল! বদ! তাহিয়া গম্ভীরমুখে বলল, ‘দেখা তো!’

শৈলী অভীকের ফেসবুক প্রোফাইল গেটে দেখাল। গতকাল রাত দশটা নাগাদ দিয়েছে, ‘গট ম্যারিড’। তাহিয়া ভাবতে বসল। গতকাল রাতে দশটা অবধি তো স্যার হাসপাতালে ছিলেন, সেও ছিল সাথে। তবে দিল কখন! আর হুট করে দিলোই বা কেন? হঠাৎ মাথায় এলো অভীকের বলা ‘চাইলে আমিও জব্দের চেইন টানতে পারি।’ বাক্যটা। তার মানে শুধুমাত্র তাকে জব্দ করার জন্য স্যার সবাইকে জানিয়ে দিল!

রাগটা মস্তিষ্কে গিয়ে ঠেকল। ফোনটা তখন হাতেই ছিল। রাগের বশবর্তী হয়ে খানিক আগে কল করা নাম্বারে ম্যাসেজ দিল,
‘শুধুমাত্র আমাকে জব্দ করার বিয়ের কথা জানিয়ে দিলেন!’

তৎক্ষনাৎ ম্যাসেজের উত্তর এলো না। ফোন হাতে উত্তরের আশায় বসে রইল তাহিয়া। মিনিট পাঁচেক বাদে ও উত্তর না আসলে চোয়াল শক্ত হলো তার। ইচ্ছে করল, অফিস রুমের গিয়ে সবার সামনে ক’টা কথা শুনিয়ে আসতে। কিন্তু সাহসের ঘাটতি থাকায় তা করতে পারছে না। অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়াল সে। থমথমে গলায় বলল,
‘মাথা ধরেছে, বাসায় যাচ্ছি। থাক তোরা।’

মীরা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
‘ বাসায় না গিয়ে পাবনা যা। তুই যে অদ্ভুত ভাবনা মনে চেপে আছিস, তা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। স্যারের বউয়ের শোকে তোর মাথা মঙ্গলে চলে গেছে। পাবনা গিয়ে নাসার সাথে যোগাযোগ করে মাথা ফিরিয়ে আন। আমি পাবনার টিকেট কেটে দিচ্ছি। ‘

‘দুটো কাটিস, তোর যাওয়া প্রয়োজন। ‘ ঝাঁজালো স্বরে কথা বলল তাহিয়া। শৈলী হা করে তাকিয়ে রইল। এ মেয়ের হলো টা কী!

হনহন করে অডিটোরিয়াম রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। ক্যাম্পাস পার করে সবে রিক্সায় উঠেছে। ম্যাসেজ টোন বাজল তখন। তড়িঘড়ি করে ফোনে চোখ রাখল তাহিয়া। অভীক লিখেছে,
‘ জনসম্মুখে তোমাকে জব্দ হওয়া থেকে বাঁচাতেই বিয়ের কথা জানিয়েছি।’

অভীকের কথা বোধগম্য হলো না তাহিয়ার। রাগের সাথে না বুঝেয়েই রিপ্লাই করল,
‘ আপনি কথা দিয়েছেন। কথার খেলাপ যাওয়াটা আশা করিনি।’

ফোনটা বোধহয় অভীকের হাতেই ছিল। তৎক্ষনাৎ জবাব এলো,
‘আমি কথা দিয়েছি, আমাদের বিয়ের কথা কাউকে জানাব না। আমি আমার কথা মাফিক আমাদের বিয়ের কথা কাউকে জানাইনি। শুধু আমার বিয়ের কথা জানিয়েছি, আমাদের নয়। পোস্ট চেক করে দেখো, কোথাও তোমার নাম আছে কি-না। আমি তোমার নামটা উল্লেখ করিনি। কলেজের কেউ জানে না তোমার কথা। ‘

‘অভীক আহমেদ’ নামের প্রোফাইল চেক করে সত্যিই নিজের নাম পেল না তাহিয়া। রাগে ভাটা পড়ল। তবে পুরোপুরি নিঃশেষ হলো না।
আবার লিখল,
‘এই বার্তার ও কোন প্রয়োজন ছিল না। এখন না জেনে সবাই আমার সম্পর্কে নানান কথা বলছে।’

তাহিয়ার ম্যাসেজ দেখে গম্ভীরমুখে বিড়বিড়াল অভীক, ‘এই মেয়ে এতটা বোকা কেন! সহজ কথাটা বুঝতে পারে না। পারে শুধু আমাকে দেখে অস্বস্তির সাগরে ডুবে মরতে আর হুলস্থুল কান্ড বাধিয়ে হোঁচট খেতে। আবার এসেছে আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। ফাজিল!’

রাগ সংবরণ করে সে বিস্তারিত লিখল,
‘প্রয়োজন আছে বৈ কী। আমার বিয়ের কথা সবাই জেনে থাকলে, তোমাকে আমার সাথে দেখে মানুষ খারাপ কিছু ভাববে না। সবার আগে মনে পড়বে, আমি বিবাহিত। আমার স্ত্রী সম্পর্কে যেহেতু কারো জানা নেই, তাই আমার পাশে যাকে দেখবে তাকেই স্ত্রী হিসেবে ধরে নিবে। এ ক্ষেত্রে তোমার চরিত্র, আমার সুখ্যাতির উপর প্রশ্ন ওঠবে না। বাস্তবতা বড়ো কঠিন। চোখ মেলে দেখো, বৈধ সম্পর্ককে মানুষ নিমিষেই অবৈধ প্রমাণ করতে পারে, সেক্ষেত্রে আমাদের সম্পর্ক সম্পর্কে না জানলে কত কী রটাবে তুমি কি আন্দাজ করতে পারছো না? কাল তুমি আমার সাথে বেরিয়েছো, কলেজের কেউ দেখে ফেললে কী রটাতো? নিশ্চয়ই না জেনে আমাদের স্বামী-স্ত্রী বলতো না। হাজার কথা বানিয়ে আমাদের এবং আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক, দুটোকেই খারাপ ভাবে উপস্থাপন করতো। তখন পরিস্থিতি তোমার জন্য শুভকর হতো? তুমি হয়তো বলবে, তখন প্রমাণ দিবে। কিন্তু প্রমাণ দেয়ার আগেই যে মান সম্মান চলে যেতো। তা ছাড়া, আমার কাধে অর্পিত দায়িত্বের তালিকায় তোমাকে বিপদাপদ থেকে রক্ষা এবং কষ্ট দূরীকরণে সহায়ক হওয়ার দায়িত্বটাও আছে। সেই দায়িত্ব রক্ষার্থেই স্ট্যাটাসটা দিতে হলো। বুঝার চেষ্টা করো তাহিয়া। বি ম্যাচিয়ুর। ‘

অভীকের দেয়া ম্যাসেজ পড়ে তাহিয়ার রাগ নিঃশেষ হয়ে গেল। এতটা গভীর ভাবে তো ভেবে নি সে। সত্যিই কাল কেউ দেখলে কী হতো! কলেজে এতক্ষণে ছিঃ ছিঃ পড়ে যেত। মেয়ে হওয়াতে অধিকাংশ দোষ তার ঘাড়ে এসে চাপাতো সবাই, কেউ খুঁজে দেখত না সত্যটা কী! এগুলো আজকাল অহরহ দেখা যায়। এসব ভাবনা মনে আসতেই তাহিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মনে মনে অভীকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। লোকটা নেহাৎ খারাপ নয়, একটু রাগী এই যা!

চলবে…