প্রেম আমার পর্ব-৬৭ এবং অন্তিম পর্ব

0
5471

#প্রেম_আমার♥
#অন্তিম_পর্ব♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
বাসর ঘরে ফুলের চাদরে মোড়ানো বিছানাটায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে রয়েছি আমি। একটু পর পরই আড়চোখে দেয়াল ঘড়িতে সময়টা দেখে নিচ্ছি সাথে ৷ প্রহর গুনছি আমার সাদা বিলাই থুক্কু সাদা জামাইটার অপেক্ষায়।

আজ আকাশে থালার ন্যায় চাঁদ উঠেছে, যার আলো ছড়িয়ে আলোকিত হয়ে উজ্জ্বলতায় প্রস্ফুটিত হয়েছে রাতের পৃথিবীপৃষ্ঠ! মাঝেমাঝে হিমেল হাওয়া বইছে যার জানান দিচ্ছে খোলা জানালার পাড়ে টাঙানো ঢেউ খেলানো পর্দাটি। তবে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে হিমেল হাওয়া গায়ে মাখাবার বদলে বিচানায় বসে ঠোঁট কামড়ে ধরে মনে মনে ছক কষছি আমি। এখন অপেক্ষা শুধু নীবিড় ভাইয়ার। উনি এলেই আমার সাজানো গোছানো পরিকল্পনা গুলোকে বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে উদ্দ্যত হবো আমি।

.

আজ শেষসময়ে বিদায়ের মুহুর্তে পুরো বাড়িটা যেনো নিস্তব্ধতায় ঘিরে পড়েছিলো। ভেবেছিলাম কাঁদবো না আমি, অথচ সকলের ভগ্নহৃদয়ের ক্রন্দনরত হতবিহ্বলে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আমার গাল বেয়েও। ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে কাল থেকে নিত্য আপু আর রাত্রির মতো আমাকেও নিজের বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে শ্বশুর বাড়িতে। “শ্বশুর বাড়ি” শব্দটা একজন বিবাহিত নারীর কাছে খুবই সুপরিচিত হলেও একজন সদ্য বিবাহিত মেয়ের কাছে তা পাহাড় সমান ভারী। এ যেনো নিজের পৃথিবীর থেকে আলাদা কোনো জগৎ! ভিন্ন জগৎ! যেই জগৎে একবার বউ হয়ে পা রাখলে বাঁচতে হয় সে জগতেই, নিজের বলে গ্রহণ করতে হয় সেই জগতে কেই। অনেকে বলে শ্বশুর বাড়ি মধুর হাড়ি! মিষ্টতায় পরিপূর্ণ! কথাটা বাস্তব হলেও সদ্য বিবাহের পর বিদায়ের শেষ সময়ে এসে একটা মেয়ের কাছে তা হয়ে উঠে কোনো এক অচিনপুর! মনে হতে থাকে সেথায় গেলে যেনো আর বুঝি ফেরা হবে না। খুব করে চোখের সামনে ভাসতে থাকে সেই বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত পরিবারের লোকগুলোর সাথে কাটানো প্রত্যেকটি মুহুর্ত! মনে হয়, “ইশশস যদি আরোও একটু সময় পেতাম! আরোও কিছু সময় পরিবারের মানুষগুলোর সাথে খোশগল্প-আড্ডায় মেতে উঠতাম!”

বিয়ের করার জন্য যারা উন্মাদনায় ভরপুর, বিয়ের বয়স হবার পূর্ব থেকেই যাদের মনে বিয়ে নিয়ে হাজারো জল্পনা-কল্পনা গেথে থাকে তারাও এই সময় এসে আর নিজেদের ধরে রাখতে পারে না। মা-বাবা, ভাই-বোন কে আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে মনটা হাল্কা করতে চায়। মন খুলে তারা বিসর্জন দেয় চোখ নিসৃত নোনাজল গুলো। আসলে কান্না করতে হয় না, কান্নাটা অটোমেটিক্যালি চলে আসে। পরেরদিন ঠিকই বাপের বাড়ি আসা হবে কথাটা জানার পরও মন ভারী হয়ে আসে কারণ তখন বাপের বাড়ি আসাটাকে বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার সাথে তুলে ধরা হবে। কেউ তখন মিষ্টি হেসে ছোট্ট করে বলবে না “বাসায় যাচ্ছি”। সমাজের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ঠোঁটের কোণে হাহাকারে ঢাকা মলিন হাসি ফুটিয়ে বলবে “এইতো বাপের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি!”

সেই হাজারোও চাপা আর্তনাদ বুকের মাঝেই পিষ্ট করে মেয়েরা হাসিমুখে দিন পাড় করে দেয়। দিন যায় মাস যায়, একে একে পেড়িয়ে যায় বছর। অভ্যস্ত হয়ে পড়ে মেয়েরা। নিজের সবটা দিয়ে গুছিয়ে নেয় তাদের ভালোবাসায় ঘেরা ছোট্ট সংসারটাকে! আবার সকলের সেই কপাল থাকে না। কারোও কারোও ক্ষেত্রে না মেলে হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে সঙ্গ দেওয়ার মতো স্বামী আর না মেলে নিজের মেয়ের মতো করে ভালোবাসার মতো শ্বশুর-শাশুড়ী। আবার কারোও কপালে যদি যত্নশীল স্বামীর সাথে বিনয়ী শ্বশুর শাশুড়ী মেলে তবে সে তো সৌভাগ্যবতী। সেইদিক বিবেচনায় এটা স্বীকার করতে আমরা তিনজনই বাধ্য যে আমরা সৌভাগ্যবতী! নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবতী! যাদের কপালে এতো ভালো স্বামী আরো ভালো শ্বশুর বাড়ি জোটে তাদের সৌভাগ্যবতী না বললে কি আর চলে? অবশ্যই নয়।

নিতু আপু আজ তার বাবার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেছে, খুব করে কান্না করে আংকেলের পাঞ্জাবিটা ভিজিয়েই দিয়েছে। তাতে বিন্দুমাত্রও অস্বস্তি হয় নি আংকেলের। মেয়েকে পরম স্নেহে বুকে আগলে ধরে তার কান্নায় সঙ্গ দিয়ে চোখের জল ফেলেছেন তিনিও। রাত্রিও তাই, আদরের ছোট্ট বোনটাকে বুকে আগলে বাবা-মার বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে আর্তনাদ মিশ্রিত কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো সে। সবাই এই বলে স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছিলো যে “এইতো মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা! এক ছুটে আসা-যাওয়া করা যাবে!” তবুও মন শান্ত হয় নি কারো। আর এদিকে আমি নীরবে চোখের জল বিসর্জন দিয়ে গিয়েছি। অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়া তাদের ভালোবাসার মানুষটাকে এভাবে কান্না করতে দেখে নিজেরাও বোধহয় কেঁদে ভাসিয়ে ফেলবে এমন অবস্থা। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে কান্নাগুলো ঠোঁট চেপে আটকে তাদের সামলিয়ে গিয়েছে।

মাঝাখান থেকে আমায় নীরবে অশ্রুপাত করতে দেখায় বোনকে বুঝিয়ে নীবিড় আসেন আমার কাছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলগুলো মুছতে মুছতে বলে উঠেন,

—- এই পাগলি তুমি কাঁদছো কেনো? তুমি তো নিজের বাড়িতেই আছো। বরং অসহায় আমাকে সবাই বিদেয় করে চলে যাচ্ছে সেই হিসেবে আমার কান্না করা সাজে না কি তোমার বলো তো?

বিনিময়ে আমি ছলছল চোখে উনার দিকে তাকিয়েই ছিলাম স্রেফ। উনি আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে তাতে আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দেন। কপালে কপালে ঠেকিয়ে বলেন,

—- ব্যাস, অনেক হয়েছে আর কেঁদো না। নয়তো সবাই একসাথে কান্না করলে বাড়িটা সমুদ্রে তলিয়ে যাবে নির্ঘাত!

.

দরজা লাগানোর মৃদু শব্দে হকচকিয়ে উঠে ভাবনা জগৎ থেকে বেড়িয়ে এলাম আমি। মোমবাতির নিভু নিভু আলোয় নীবিড় ভাইয়ার স্নিগ্ধ মুখখানায় চোখ পড়তেই দাঁত বের করে মিষ্টি করে হাসলাম আমি। তবে আমায় দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলবার বদলে থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়লেন উনি। উনার মুখে এসে হানা দিলো ঘন কালো মেঘ! আমায় দেখে উনার এমন রিয়াকশন দেওয়ার কারণ বোধগম্য হলো না আমার তাই বিনিময়ে ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট উল্টালাম আমি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে বলে উঠলাম,

—- আপনি হঠাৎ স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন কেনো ভাইয়া?

এবার আগের থেকেও চোখের পরিধি বৃদ্ধি করলেন উনি। হতাশায় ঢাকা মুখে বুলি ফুটিয়ে আহত কন্ঠে বলে উঠলেন,

—- এসব কি করেছো তুমি? শাড়ি, গহনা খুলে টি-শার্ট আর স্কার্ট পড়েছো কেনো?

এবার আগের থেকেও ঠোঁট টাকে অধিক পরিমাণে উল্টালাম আমি। কাবার্ডের দিকে এক পলক তাকিয়ে মিনমিন করে বললাম,

—- একটু পর তো ঘুমোতেই হবে, ওসব পড়ে প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছিলো আমার, তাই খুলে ফেলেছি? কেনো, ঠিক করি নি?

উনি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে কপালে হাত দিয়ে ওপরের দিকে তাকালেন। বার কয়েক কপাল চাপড়ে শান্ত হয়ে মুখে জোড় পূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললেন,

—- না না, খুব ভালো করেছো তুমি! একেবারে মহাভারত শুদ্ধ করে ফেলেছো। ডাফার!

উত্তেজনায় এতোটাই মত্ত হয়ে পড়লাম আমি যে উনি আমায় ডাফার বলেছেন তাতে কোনো ধ্যানই দিলাম না। চট করে বিছানা থেকে নেমে পড়ে উনার হাত ঝাঁকিয়ে বলে উঠলাম,

—- চলুন, বাসরে হাংগামা মিশন শুরু করা যাক।

বলেই উনার হাত টেনে দরজা খুলিয়ে বেড়িয়ে এলাম তৎক্ষণাৎ। উনি একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন ঠিকই তবে আপাতত তাতে কোনো ভাবাবেগ হচ্ছে না আমার। ঘর থেকে বেড়িয়ে উনাকে এক কোণায় দাঁড়াতে বলে নিঃশব্দে দরজার চাপিয়ে আশেপাশে চোখ বোলাতে লাগলাম উনি। আমার কার্যকলাপ উনার বোধগম্য না হওয়ায় কপাল কুঁচকে উনি আবারও প্রশ্ন করলেন,

—- কি করতে চাইছো তুমি আমাকে বলবে? বাসরে হাংমাগা মানে কি?

আমি হাতের ইশারায় উনাকে ভলিউম কমিয়ে কথা বলতে বলে আড়চোখে রুশো ভাইয়ার ঘরের দিকে দেখিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলাম,

—- উফফ…! আপনি এতো অবুঝ কেনো বলুন তো? বেস্টুর বাসরে হাংগামা না করলে মান সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে আপনি বুঝেন না? সেই জন্যেই তো ওদের ডিস্টার্ব করতে আপনাকে নিয়ে বেড়োলাম। আপনি শুধু পাহারা দেবেন আর হাংগামা করবো আমি। সিম্পল!

টাস্কি খেতে খেতে চরম পর্যায়ে পৌঁছে এবার ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লেন উনি। কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে আমার মুখপানে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

—- লাইক সিরিয়াসলি! তোমার মাথায় কি এসব উল্টোপাল্টা বুদ্ধি ছাড়া আর কি কিছুই খেলে না? আজ যে আমাদের বাসর সে কথা কি ভুলে গিয়েছো? আর কোথায় লেখা আছে যে বেস্টুর বাসরে প্রবলেম ক্রিয়েট না করলে তোমার মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যায়? জাস্ট থিংক কতোটা স্টুপিড তুমি!

উনার কথায় চোখ ছোট ছোট করে ঠোঁট কুচকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম,

—- হ্যা আমি স্টুপিড ই তো। আপনি তো ইন্টেলিজেন্ট! তো যান একা একা বাসর করুন। আমি যাচ্ছি না!

এবারের এক্টিংয়ে বোধহয় কিছুটা কাজে দিলো যা উনার রিয়াকশনে স্পষ্ট! বিয়ের প্রথম রাত যে কারোর ই নিজের পার্টনার ছাড়া কাটুক কেউই চাইবে না সেরকম উনিও চান না কোনোকালেই। তাই নিজের রাগটাকে দাঁত চেপে দমিয়ে নিয়ে চটজলদি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন উনি। আমায় সাইডে দাঁড় করে ঠোঁটে আঙুল চেপে বলে উঠলেন,

—- ওকে ফাইন, ডিস্টার্ব করতে হবে তো? আমিই করে আসছি বাট তুমি কোথাও যাচ্ছো না। ইজ ইট ক্লিয়ার? চুপটি করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি দরজায় নক করে লুকিয়ে চলে আসবো।

বলেই প্রতিউত্তরে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন উনি। তবে বেশিদূর যেতে হলো না উনাকে। মাত্র রুশো ভাইয়ার ঘরের কাছাকাছি যেতেই ধপাস ধুপুস আওয়াজে ভূমিকম্প সৃষ্টি হলো সেখানেই। বুঝলাম অঘটন ঘটে গেছে, তাই আর দেড়ি না করে লাইটের সুইচ অন করে ছুট লাগালাম রুশো ভাইয়ার ঘরের সামনে।

.

নীবিড় ভাইয়ার ওপর অগ্নি ভাইয়া আবার তার ওপর রুশো ভাইয়া। বলা যায় তিনজন মিলে মেঝেতে একটা ছোটখাটো পাহাড়ের জন্ম দিয়ে উল্টে পড়ে রয়েছে। অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়াকে এই মুহুর্তে বাসর ঘরে রোমান্স করবার বদলে বাহিরে থাকতে দেখে নিজের দূর্ভাগ্যকে আবারও ব্যাড লাক উপাধি দিয়ে কপাল চাপড়ালাম আমি। ভাইয়ারা ফ্লোরে পড়ে গিয়ে যথেষ্ট ব্যাথা পাওয়ার স্বত্ত্বেও ঠোঁট চেপে একে অপরকে উঠতে বলে চাপা আর্তনাদ করে যাচ্ছে।

—- আবে ওই হাতির তিন নম্বর বাচ্চাগুলা, ওঠ আমার ওপর থেকে! হাড় হুড্ডি সব পাউডার হয়ে গেলো বোধহয় আমার। (নীবিড়)

নীবিড় ভাইয়ার চাপা শব্দে করা ধমক খেয়ে অগ্নি ভাইয়া চোখ-মুখ কুঁচকে বলে উঠলো,

—- আবে শালা আমাকে বলছিস কেনো? রুশোকে বল! ওই ব্যাটা না উঠলে আমি উঠবো কি করে? ইশশশ! আহ….! কালকের আধভাঙা কোমড় টা বোধহয় আজ পুরোপুরিই ভেঙে গেলো রে…….! (অগ্নি)

—- আরে ব্রো পা টা মেইবি মোচকে গেছে, উঠতে গেলেই চিনচিন করে উঠছে….! একটু ওয়েট করো, আম ট্রাইয়িং ট্রাইয়িং বাট ডোন্ট ক্রায়িং! (রুশো)

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে নিয়ে রুশো ভাইয়া ভাইয়াদের ওপর থেকে একা একা ওঠার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে হাপিয়ে গিয়ে অবশেষে দু হাত দূরে আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আকুতি ভরা কন্ঠে বলে উঠলো,

—- ছুটকি….আমাদের উঠা! হেল্প কর ছুটকি প্লিজ…!

রুশো ভাইয়ার ডাকে হুশ ফিরলো আমার! এতোক্ষণ তাদের বাসর ঘরে রোমান্স করার বদলে বাহিরে কাবাডি খেলার রহস্য উদঘাটন করায় মন দিয়ে ফেলেছিলাম অথচ এদিকে যে ভাইয়ারা আবারও কোমড় ভেঙে ফেলেছে তাতে কোনো ধ্যান অই ছিলো না আমার!
আর এক মুহুর্তও দেড়ি করলাম না আমি, এক ছুটে ভাইয়াদের কাছে গিয়ে রুশো ভাইয়াকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলাম। রুশো ভাইয়া পা মোচকে যাওয়ায় ঠিক মতো দাড়াতে পারলো না। রেলিং ঘেঁষে পা টাকে বাঁকা করে রেখে পিলার ধরে দাড়ালো স্রেফ।

রুশো ভাইয়াকে উঠানোর পর অগ্নি ভাইয়া হাত বাড়িয়ে দিতেই ভাইয়ার হাত চেপে ধরে নীবিড় ভাইয়ার ওপর থেকে উঠিয়ে নিলাম তাকে আমি। অগ্নি ভাইয়া কোমড় চেপে ধরে একধাপ এগিয়ে বেঁকে যাওয়া কোমড় টাকে সোজা করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এবার নীবিড় ভাইয়াকে টেনে তুলবো তার আগেই চোখের পলক দু পায়ের ওপর ভর করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন উনি। আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ভাইয়াদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

—- এই তোরা বাসর ঘরে না থেকে বাইরে ঘুরাঘুরি করছিস কেনো বলতো?

নীবিড় ভাইয়ার প্রশ্নে ভাইয়ারা কিসের জন্য ঘর থেকে বেড়িয়েছে মনে করার চেষ্টা করতেই ভয়ে আঁতকে উঠলো। রুশো ভাইয়া নীবিড় ভাইয়াকে দু হাতে ঝাপটে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,

—- বো..ব্রো…! বাসর ঘরে ভূ…ভূ…ভূত!

রুশো ভাইয়ার সাথে অগ্নি ভাইয়াও একই সময়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

—- তো..তোর বোন আমায় পেটাবে বলে তারা করছে….!

রুশো ভাইয়ার ঘরে ভূত আবার অগ্নি ভাইয়াকে নিত্য আপু পেটাবে কথা দুটোই হজম করতে গিয়ে কাশি উঠে গেলো আমার। নীবিড় ভাইয়া অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে “হোয়াট!‌” বলে চেঁচানো মাত্রই হাতে স্টিলের পাইপ নিয়ে রাগান্বিত লুক নিয়ে হাজির হলো নিত্য আপু। তার পেছনেই হাত দিয়ে নাকে ঘুষি মারার উদ্দেশ্যে হাত মুঠো করে পেত্নিরূপে এলো রাত্রির।
তাদের দুজনকে দেখে ভয়েই কুকরে উঠে অগ্নি ভাইয়া আর রুশো ভাইয়া নীবিড় ভাইয়ার পেছনে লুকিয়ে পড়ে ভয়ার্ত কন্ঠে মিনমিন করে বললো,

—- ব্রো মুঝে বাঁচালো ভূ….ভূ..ভূউউত……!

—- এ দুলাভাই হই তোর, শালার দায়িত্ব পালন কর বে। বাঁচা তোর বোনের হাত থেকে।

নীবিড় ভাইয়া ওদের শান্ত হতে বলে সামনে তাকাতেই বোনের হাতে স্টিলের পাইপ আর রাত্রিকে পেত্নি রূপে আবিষ্কার করে চমকে উঠলেন। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উনি বলে উঠলেন,

—- হেই কি হচ্ছে এসব? নিত্য তুই অগ্নিকে মারতে চাইছিস কেনো? আর রাত্রি তুমিই বা রুশোর নাক ফাটাতে চাইছো কেনো?

নীবিড় ভাইয়ার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে নিত্য আপু হুংকার ছেড়ে বলে উঠলো,

—- তোর এই ঘুমকাতুরে বেস্টু কম ভাই বেশি আবার দুলাভাই কম শালা বেশি, যে বাসর রাতে উল্টে উল্টে ঘুমোতে চাইছে তা আমি কি ওকে বাচ্চাদের মতো কোলে করে ঘুম পাড়িয়ে দেবো? মানে মানুষ এতোটা নিরামিষ কি করে হতে পারে? বাসর রাতে ঘুম, হাউ ফুল!

নিত্য আপুর অগ্নি ভাইয়াকে নিয়ে করা অভিযোগে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দাঁতে দাঁত চেপে ভাইয়ার দিকে তাকালেন নীবিড় ভাইয়া। জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে উঠলেন,

—- ঠিক এই ভয় টাই পাচ্ছিলাম আমি। ওই শালা, এই জন্যে আমার বোন টাকে তোর হাতে তুলে দিয়েছি আমি?

বলেই নিজের পেছন থেকে অগ্নি ভাইয়াকে টেনে বের করে নিত্য আপুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

—- বোন, এটাকে নিয়ে যা। কি আর করবি বল, আমার মতো তোরও কপাল একটু আধটু ফাটা ফুটাই বলা যায়, পিটিয়ে হলেও চালিয়ে নিস!

বলেই অগ্নি ভাইয়ার পেছনে হাটু দিয়ে লাথি মেরে দিলেন উনি। পেছন থেকে ধাক্কা লাগায় ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে কয়েকধাপ এগিয়ে যেতেই নিত্য আপু চটজলদি অগ্নি ভাইয়ার কান ধরে “আজ তোমার ঘুম বের করছি, চলো একবার!” বলেই টেনে নিয়ে গেলো ভাইয়াকে।
ওরা যেতেই এবার রাত্রি রুশো ভাইয়ার এদিকে রেগেমেগে বোম্ব হয়ে তাকিয়ে অভিযোগ করা শুরু করলো,

—- ভাইয়া….আপনি আপুর সমস্যার তো সমাধান করলেন এখন আমারটা শুনুন। এইযে এই ধলা ইন্দুর, বিদেশি চিকা, রুশো ফুশো….আমায় ঘোমটা উঠিয়ে দেখে ভূত ভূত বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ঘর ছেড়ে পালিয়ে পুরো বাড়ি দৌড়ে বেড়িয়েছে। আচ্ছা আপনিই বলুন আমায় কোন এংগেল দিয়ে ভূত বলে মনে হচ্ছে? তখন কার মেকআপ হাল্কা হয়ে যাওয়ায় তো আবারও সুন্দর করে সাজলাম, কোথায় ঘোমটা উঠিয়ে প্রশংসা করবে তা না ভূত বানিয়ে চলে এলো!

রাত্রির গর্জনে রুশো ভাইয়া বুঝলো ওটা কোনো ভূত নয় তারই ময়দা মাখানো এটমবোম্ব! যার দরুন ভয়ে আবারও শুকনো ঢোক গিলে হাত খামচে ধরলো নীবিড় ভাইয়ার। এদিকে নীবিড় ভাইয়া রাত্রির অভিযোগ শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বিচক্ষণ চোখে রাত্রির মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন,

—- অবশ্য ভুল উপাধিও তো দেয় নি!

নীবিড় ভাইয়ার বিড়বিড় করে বলায় কথাটা স্পষ্ট ভাবে বোধগম্য হলো না রাত্রির। সে কপাল কুঁচকে আবারও জিজ্ঞেস করলো,

—- কিছু বললেন ভাইয়া? দেখুন আপনি রুশোকে পেছন থেকে বের করে আমার হাতে ছেড়ে দিন। বাকিটা আমি নিজেই সামলে নিতে পারবো।

বিনিময়ে নীবিড় ভাইয়া ঘাড় ঘুরিয়ে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন রুশো ভাইয়ার দিকে। রুশো ভাইয়ার আকুতি করা চাহনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপেক্ষা করে বললেন,

—- নাথিং টু ডু ড্রিমার….! বিয়ে যখন করেইছো প্যারা তো সামলাতে হবেই। এখন গিয়ে একটু ওয়েল মারবার ট্রাই করো নয়তো নাকের একটা হাড্ডিও আর আস্ত থাকবে না।

রুশো ভাইয়া আর কোনো পথ খোলা না পেয়ে উনাকে ছেড়ে দিয়ে গুটিগুটি পায়ে বেড়িয়ে আসতেই আবারও মোচকে যাওয়া পায়ে আঘাত লাগায় “আউউচ্চ” বলে চাপা আর্তনাদ জুড়ে দিলো। রাত্রি আরোও ক্ষেপে গিয়ে বললো,

—- বউ এর থেকে পালাতে চাইলে এভাবেই পা ভেঙে যাবে।

বলেই এগিয়ে এসে চোখের পলকে রুশো ভাইয়াকে কোলে উঠিয়ে নিলো রাত্রি। ছোট্ট ছোট্ট ধাপ ফেলে ভাইয়াকে কোলে নিয়েই ঢুকে পড়লো সে ঘরের ভেতরে। আর এদিকে মেয়ে হয়ে কোনো ছেলে কে কোলে তুলতে পারায় হতভম্ব হয়ে রইলাম আমি সহ নীবিড় ভাইয়া। চোখ যেনো আর নিজের কোটরে থাকতে চাইছে না, যেকোনো মুহূর্তে খুলে হাতে চলে আসবে এমন অবস্থা!
নীবিড় ভাইয়া এক দৃষ্টিতে হা করে কিছুক্ষণ একভাবেই ওদের যাওয়ার দিকে চেয়ে থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। হতবাক হয়ে অবাক কন্ঠে বলে উঠলেন,

—- ওটা কোনো মেয়ে নাকি এলিয়েন?

বিনিময়ে কাধ উঁচু করে ঠোঁট উল্টালাম আমি। যার অর্থ “আমার নিজেরও তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে!”

.
🍂
.

—- নিত্য বেবি, আমি তখন জাস্ট মজা করছিলাম, তুমি সিরিয়াসলি নিয়ে নিলে?

—- ওহ! তা মজা করলে এখন এতো ভয় পাচ্ছো কেনো সোনা? কাছে এসো…..

নিত্যর আক্রমণাত্মক কন্ঠে ঝাপিয়ে পড়ার আভাস পেয়ে আবারও শুকনো ঢোক গিললো অগ্নি। কাদো কাদো মুখ বানিয়ে সে কিছু বলবে তার আগেই নিত্য তার ঠোঁট জোড়া আবদ্ধ করে নিলো নিজের ঠোঁটের ভাঁজে। অগ্নি হতভম্ব হয়ে বোঝার চেষ্টা চালাতে লাগলো যে এক্সাক্টলি কি হচ্ছে তার সাথে! পর মুহূর্তে বুঝতে পেরে নিজের মনে হেসে সেও তাল মিলিয়ে নিত্যতে ডুব দিলো। সে তো এটাই চাইছিলো তার বউ তাকে প্রথমে স্পর্শ করুক! প্রথম ভালো যেহেতু সেই বেসেছে স্পর্শ করার অধিকারও তারই প্রথম! নয় কি?

.

—- হেই এটম বোম্ব! প্লিজ আজকের দিনে আর নাক ফাটিয়ো না। নয়তো কাল বাড়ির লোকেরা লাল হয়ে যাওয়া নাক দেখে ভাববে নিশ্চয় বাসর রাতে তোমার সাথে কুস্তি লড়েছি আমি!

বিনিময়ে রাত্রি কোনো জবাবই দিলো না, বড়বড় পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফেইস ক্লিন করে এসে আবারো রুশোর কলার চেপে ধরলো সে। রুশো ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করতে রাত্রি মুচকি হেসে রুশোর নাকেই আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো। ঘুষির বদলে ভালোবাসার পরশ অনুভব করায় অবাক চোখে তাকালো রাত্রির মুখপানে রুশো। রাত্রি আবারও ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে তাকে ফেলে দিলো ফুলের পাপড়ি বিছানো বিছানাটায়। রুশো অবাক চোখে রাত্রির দিকে হা করে তাকাতেই রাত্রি তার ওপরে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লো তৎক্ষণাৎ! দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসায় মত্ত হলো তারা দুজনে।
.
🍁
.
ঠোঁট উল্টে বিছানায় বসে রয়েছি আমি। সামনেই পায়চারি করতে করতে কপালে স্লাইড করে চলেছেন নীবিড় ভাইয়া। সব রীতি অনুযায়ী বিয়ের হবার পরও আমার মুখে ভাইয়া ডাক শুনায় চিরম বিরক্ত উনি। এই নিয়ে যতো বারই আমায় নিজেকে ভাইয়া বলে সম্মোধন করতে বলেছেন ঠিক ততবারই আমি “নীবিড়” এর সাথে “ভাইয়া” এড করে দিয়ে মিষ্টি করে ডেকেছি “নীবিড় ভাইয়া!” যার দরুন উনি বিরক্ত হয়ে ক্রন্দন মিশ্রিত কন্ঠে আহত চিৎকার ছেড়ে বলেছেন,

—– হায়,
বাসর রাতে দুরুদুরু বুক কাঁপে,
বিয়ের পরও বউ আমায় ভাইয়া ডাকে…!

তবুও আমার মুখ থেকে ভাইয়া ব্যতীত উনার নামটাই আসতে চাইছে না যাতে বিরক্ত আমি নিজেও। টানা ২ বছর ধরে করে আসা সম্মোধন হুট করেই কি বদলানো যায়? অবশ্যই নয়।

অবশেষে পায়চারি থামিয়ে ফিরে দাড়ালেন উনি। ধপ করে বিছানায় বসে পডে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,

—- ওকে তোমায় আমাকে শুধু নীবিড় বলে ডাকতে হবে না, পারলে জামাই বলে ডেকো তবুও প্লিজ ভাইয়া ডেকো না!

আমি কিচ্ছুক্ষণ চোখের মনি এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে ভেবে নিয়ে মিষ্টি হেসে টুপ করে উনার গালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে উঠলাম,

—- ওক্কে নীবিড় জামাই…..!

উনি ডান হাতে বুকের বাম পাশে চেপে ধরে কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে মৃদু স্বরে বললেন,

—– আজ তোমায় কে বাঁচাবে অনন্যা…?

উনার হঠাৎ ভয়ানক মুখশ্রী ফুটে উঠায় শুকনো ঢোক গিললাম আমি। উনি আমার দিকে এগোতে এগোতে নেশাভরা কন্ঠে বলে উঠলেন,

—– মে আই অনন্যা…..?

উনার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আমি চুপ করে রইলাম। লজ্জায় লাল হয়ে উনার শার্ট খামচে ধরতেই বাঁকা হাসলেন উনি। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে শীতল কণ্ঠে বললেন,

—- আজ থেকে আর কোনো বাধা নয়, কোনো দূরত্ব নয়! আজ থেকে তুমি আমার! শুধুই আমার, কারণ তুমিই যে “#প্রেম_আমার!

উনার কথাগুলোয় জানিনা আমার কি হলো। আচমকাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আমি উনাকে। কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে বলে উঠলাম,

—- ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি আমি আপনাকে! আমায় ছেড়ে যাবেন না কখনোও প্লিজ!

উনি মুচকি হেসে কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দিয়ে বললেন,

—- ভালোবাসি বলেই সাথে ছিলাম, আছি, এবং জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত থাকবো, তোমার নিঃশ্বাসে তোমার প্রঃশ্বাসে তোমাতেই মিশে……..!

উনার উত্তরে আস্বস্ত হলাম আমি। ভালোবাসায় মত্তো হয়ে ধরা দিলাম উনাতে, মিলিত হলাম দুজনে, মিলিত হলো দুটি হৃদয়ের দুটি প্রাণ। ভালোবাসার চাদরে মোড়ালো আমাদের খুনশুটি ভরা প্রেমময় দুটি জীবন।

—————————–সমাপ্ত—————————

(অবশেষে শেষ হয়ে গেলো গল্পটা, জানি না কার কেমন লেগেছে, তবে আজ অবশ্যই সকলে নিজেদের মন্তব্য জানাবানে। গুছিয়ে লিখতে পারিনি সময় স্বল্পতায় তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ফিরে আসবো আগামীতে, নতুন কোনো গল্প নিয়ে নতুন কোনো অধ্যায়ে, ধন্যবাদ 💕)