প্রেম এসেছিলো নীরবে পর্ব-০৩

0
824

#প্রেম_এসেছিলো_নীরবে (৩)
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ঝালমুরি খাচ্ছে হিয়া আর ওর বেষ্টফ্রেন্ড ইশি।মূলত তারা অপেক্ষা করছে হেমন্ত’র জন্যে।রায়হানা বেগম মেয়েকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে হেমন্ত আসবে আজ তাকে নিতে আর তার জন্যে না-কি বাড়িতে কি এক সার্প্রাইজও আছে।এই কথা শুনে হিয়া পারেনা উড়ে উড়ে বাড়িতে চলে যেতে।ঝালমুরি শেষ হতেই হিয়া মুখ থে ‘চ’ এর মতো শব্দ করে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করলো তারপর বলে,

-” এই হেমন্ত ভাইয়ার আসতে এতোক্ষন লাগে?বাল ভাল্লাগে না।”

হিয়ার কথায় ইশি নিজের চোখের চশমাটা ঠিক করে আস্তে করে বলে,

-” এতো হাইপার হচ্ছিস কেন?ধৈর্য ধরা শিখ।”

হিয়া ইশির কথায় যেন আরো বিরক্ত হলো।সে জানেনা এই মেয়েটা এতো শান্ত আর ভদ্র কেন?মানে এতোটা?এই মেয়ে কারো দিকে ঠিকভাবে চোখ তুলে পর্যন্ত কথা বলতে পারে না।কি একটা অবস্থা।ইশি তো ওকেও তুমি করে বলতো।হিয়ার কতো যে কাঠখোর পোড়াতে হয়েছে ওকে তুই ডাকার জন্যে।সেই ৩য় বিশ্বযুদ্ধ সে কিভাবে জয় করেছে সেটা শুধু সে নিজেই জানে।হিয়ার ভাবনার মাজেই একটা কালো রঙের গাড়ি এসে থামলো ওদের সামনে।হিয়া জানে এটা ওদেরই গাড়ি।কিছুক্ষন পর গাড়ি থেকে নেমে আসলো হেমন্ত।এগিয়ে গেলো হিয়াদের দিকে।ইশি আঁড়চোখে একবার তাকালো হেমন্ত’র দিকে।যেটা হেমন্ত’র নজর এড়ালো না।মেয়েটার এটুন নজরেও যেন হেমন্ত’র নিশ্বাস আটকে যায়।চশমায় আবৃত চোখের চাহনীতেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে যখন চশমাবিহীন চোখ দ্বারা তো হেমন্তকে মেরেই ফেলবে এই মেয়ে।গত ১ সপ্তাহ যাবত মেয়েটাকে ঠিকভাবে দেখতে পারিনি হেমন্ত।কারন সে তো ব্যস্ত ছিলো প্রাহিকে খোজার জন্যে।আজ মন ভরে দেখে নিক।হেমন্ত যখন নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে দেখতে ব্যস্ত তখন হঠাৎ হিয়ার প্রকট চিৎকারে তার মস্তিষ্কের নার্ভগুলো ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম।হেমন্ত হতভম্ব হয়ে তাকায় হিয়ার দিকে।তারপর ইশি দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটাও ভয়ে চোখ মুখ খিচে রেখেছে।হেমন্ত এইবার চোখ গরম করে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” হোয়াদ দ্যা হেল হিয়া।এইভাবে চিৎকার করলি কেন?”

হিয়াও রাগি গলায় বলে,

-” গত আধা ঘন্টা যাবত এই রোদে দাঁড়িয়ে তোর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।তুই আসলি লেট করে।আর এসে গাড়ি থেকে নেমেই ইশির দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলি।তোকে কতো করে ডাকলাম।তোর তো খেয়ালই নেই তাই তো চিৎকার দিলাম।”

হেমন্ত থতমত খেয়ে যায়।বজ্জাত মেয়েটা ইশির সামনে তার মান ইজ্জতের বারোটা বাজিয়ে দিলো।এইদিকে ইশি এই কথা শুনে লজ্জায় আর একবারও চোখ তুলে তাকালো না।হেমন্ত আর কথা বাড়ালো না।জানে এই মেয়েটা আবারও ওর মান ইজ্জত নিয়ে হামলে পড়বে।একে তো বাড়ি গিয়ে সাইজ করতে হবে।তাই শান্ত ভাবে নিজের রাগ দমন করে বলে,

-” জলদি গাড়িতে উঠ।”

হিয়া ইশির হাত ধরে হনহন করে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো।হেমন্তও গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রওনা হলো বাড়ির দিকে।মাজ রাস্তায় ইশির বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে ওকে ওর বাড়ি অব্দি পৌছে দিয়ে তারা নিজেরাও বাড়ি চলে আসে।গাড়ি থেকে নেমেই হিয়া হেমন্তকে বলে,

-” ভাই ভালো যেহেতু বাসিস।তাহলে বলে দিস না কেন?”

হেমন্ত মাথা চুলকে হালকা হেসে বলে,

-” তোর বান্ধবি যেই ভীতু প্রোপোজ করলে দেখা যাবে আর আমার সামনেই আসবে না।তাই ঠিক করেছি তোদের পরিক্ষার পরই ওদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো।”

হিয়া খুশিতে চিৎকার করে উঠলো।ইসস, তার বেষ্টফ্রেন্ড তার ভাবি হবে ভাবতেই খুশিতে নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর।হঠাৎ চুলে টান পরায় ‘ ও মাগো! ‘ বলে চিৎকার করে উঠে হিয়া।হেমন্ত দাত কেলিয়ে হেসে বললো,

-” ইশির সামনে আমার ইজ্জতের ফালুদা বানানোর জন্যে এটা তোর শাস্তি।”

হিয়া ‘ ভাইয়া!’ বলে দৌড় লাগায় হেমন্তের পিছু পিছু।সারা ড্রয়িংরুম জুড়ে দু ভাই বোন ছোটাছুটি করছে।রান্না ঘর থেকে রায়হানা বেগম আর হেনা দুজনই বের হয়ে আসলেন।প্রাহিরও এমন চেচামেচির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তাই সেও রুম থেকে বের হয়ে সিড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।ভাই বোনের এতো সুন্দর খুনশুটিময় দৃশ্য দেখে ওর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। প্রাহি ভালোভাবে হেমন্ত’র পিছু ছুটন্ত মেয়েটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।নিজের মস্তিষ্কে ভালোভাবে চাপ সৃষ্টি করে মেয়েটি কে মনে করার জন্যে।মনে পরতেই লাফিয়ে উঠে এটা তো ওর হিয়া আপু।ইসস,আপুটা কতো বড় হয়ে গিয়েছে আর কতো মিষ্টি দেখতে।আর কি সুন্দর।প্রাহির আনন্দ যেন আর ধরছে না।দীর্ঘ অনেক বছর পর বুজি সে একটু সুখের সন্ধান পেলো।জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে সে।তবে কি আজ থেকেই ওর সুখের অধ্যায় শুরু?কি জানি? জানে না প্রাহি এসব।শুধু সুবহানাল্লাহ তায়লার কাছে একটাই প্রার্থনা ওর আল্লাহ্ যাই করুক না কেন তা যেন সবার জন্যে ভালোই হয়।

রায়হানা বেগম আর হেনা ছেলেমেয়েদের এমন বাচ্চামো দেখে বেশ বিরক্ত হলেন।এরা দিন দিন বড় হচ্ছে নাকি ছোট হচ্ছে সেটাই বুজেন না উনারা।দুটো সারাদিন ঝগরা করতেই থাকে।অর্থ এই এক সপ্তাহ যাবত বাড়িতে না থাকায় তাদের দুষ্টুমি যেন আরো বেড়ে গেছে।হেনা হালকা আওয়াজে ধমকে উঠলেন হেমন্তকে,

-” হেমন্ত! এইসব কি হচ্ছে?তুই হিয়াকে আবার কি করেছিস?”

হেমন্ত ছুটতে ছুটতেই চেচিয়ে বললো,

-” আমি কিছু করিনি মা।এই শাকচুন্নি শুধু শুধু আমার সাথে লাগছে।”

হিয়া কাধের ব্যাগটা হেমন্ত উদ্দেশ্য ছুড়ে মারলো তা গিয়ে লাগলো হেমন্ত’র পিঠে।হেমন্ত ব্যাথা পেয়ে থেমে গেলো।রাগি চোখের হিয়া দিকে তাকাতেই হিয়া বলে,

-” ছোটমা তোমার ছেলে আমার চুল ধরে টান মেরেছে।”

তারপর আবার হেমন্ত’র দিকে তাকিয়ে বলে,

-” এখন কি কারনে টান মেরেছিস সেটা বলে দেই।”

হেমন্ত চোখ বড় বড় করে তাকালো।এই মেয়ে যা বিচ্ছু বলেও দিতে পারে।হেমন্ত তড়িঘড়ি করে বোনকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-” আমার বোনটাকে আর মারবো না।তার জন্যে আমি এখনি হুডা বিউটির শ্যাডোবক্স ওর্ডার দিয়ে দিচ্ছি।”

হিয়া খুশি হয়ে একঝটকায় হেমন্ত দিকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

-” সত্যি ভাইয়া।”

-” হ্যা!”

-” আচ্ছা! যা তোকে মাফ করে দিলাম।”

রায়হানা বেগম আর হেনা চলে গেলেন রান্না ঘরে।এটা নতুন কিছু না এই দুটো ছোট বেলাও এমন করতো।আর হেমন্ত বিদেশ থেকে আসার পরেও এমনি করছে।হেমন্ত হিয়াকে মানিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সোফায় বসলো।হিয়াও খুশি মনে উপরে সিড়ি দিয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার জন্যে উদ্যুক্ত হতেই সিড়ির উপরে একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে গেলো।এই মেয়েটা কে?ওকে তো আগে কখনো দেখিনি।হিয়া আবারও পিছনে ফিরে হেমন্ত’র দিকে তাকালো।তারপর বলে,

-” হেমন্ত ভাইয়া! ”

হেমন্ত চোখ বুজে ছিলো।হিয়ার ডাকে আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালো।হিয়া এইবার হাত দিয়ে প্রাহিকে ইশারা করে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-” এটা কে ভাইয়া!”

হেমন্ত হাসলো।তারপর ছোট্ট করে বললো,

-” এটা প্রাহি।আমাদের ছোট্ট প্রাহি।”

হিয়া কথাটা শুনে মুখে হাত দিয়ে দু-কদম পিছিয়ে গেলো।ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা প্রাহি।ওর চোখ ভরে উঠলো।হেমন্ত’র দিকে করুন চোখে তাকাতেই হেমন্ত চোখের ইশারায় বুজায় হ্যা এটা সত্যি প্রাহি।হিয়া আর এক সেকেন্ড অপেক্ষা না করে দৌড়ে গিয়ে ঝাপ্টে ধরে প্রাহিকে।তারপর ভেজা কন্ঠে বললো,

-” তুই প্রাহি?আমার ছোট্ট প্রাহি।”

প্রাহির চোখের বাধও ভেঙে গেলো।প্রাহি বলে,

-” হ্যা হিয়া আপু আমি প্রাহি।”

হিয়া প্রাহিকে ছেড়ে ওর গালে হাত ছুইয়ে বলে,

-” কেমন আছিস তুই?এতোটা বছর কোথায় ছিলি?”

প্রাহি নিজের জলটুকু মুছে আস্তে ধীরে সংক্ষেপে হিয়াকে সবটা বললো।প্রাহি সব শুনে ঘৃনায় জর্জরিত হয়ে বলে,

-” ছিঃ এতোটা খারাপ কেউ কি করে হতে পারে।”

প্রাহি মাথা নিচু করে আছে।হিয়া একসাইড দিয়ে প্রাহিকে আবারও জড়িয়ে ধরে বলে,

-” টেন্সন করিস না।তোকে আর কেউ কষ্ট দিতে পারবে না।তুই আজ থেকে সুখে থাকবি আমাদের সাথে।”

প্রাহি মাথা নাড়ালো।দুবোন ভুলেই গেলো তারা কোথায় আছে এইখানেই গল্পের ঝুড়ি খুলে বসলো।
হেমন্ত এতোক্ষন ওদেরকেই দেখছিলো।হঠাৎ ওর ফোনে কল আসায় ফোন বের করে দেখে অর্থ কল করেছে।হেমন্ত হাসিমুখে কল রিসিভ করলো,

-” আসসালামু আলাইকুম ভাই।”

অর্থ গম্ভীর কন্ঠেই বলে,

-” ওয়া আলাইকুমুস সালাম! হেমন্ত ল্যাপটপ চালু কর ভিডিও কল দিবো।”

-” আচ্ছা ভাই!”

অর্থ কল কেটে দিতেই হেমন্ত ল্যাপটপ ওন করে ওয়াইফাই কানেক্টেড করতেই সাথে সাথে অর্থের ভিডিও কল আসলো।

সাদা রঙের শার্টের সাথে এ্যাশ রঙের স্যুট পরা,চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে, হালকা নীল,কালোর সংমিশ্রের চোখের মনিগুলো ফর্সা মুখশ্রীতে বেশ মানিয়েছে।চেহারাটায় একটা দাম্ভীকর্যতা বিদ্যমান।লাল কালচে বর্নের ঠোঁটজোড়া ক্ষনেক্ষনে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে।হেমন্ত হাসিমুখেই অর্থকে বলে,

-” কেমন আছো ভাই?আর কবে আসবে?”

অর্থ ঠান্ডা স্বরে জবাব দেয়,

-” আজই আসছি। অফিসের একটা মিটিং শেষ করেই দু ঘন্টা পর রওনা হবো।”

হেমন্ত চোখ কপালে তুলে বলে,

-” কি?কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে?তুমি না পাক্কা পনেরোদিনের সময় নিয়ে গেছিলে?আর যেই কাজ তা পনেরোদিনে শেষ হবে কিনা তাও সন্দেহ ছিলো।”

অর্থ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,

-” অর্থ কখনো তার সময়টা নষ্ট করতে পছন্দ করে না। আমি আমার কাছে কোন গাফিলতি করেনা।সো আমার এতোদিন সময় লাগার কথাও না।”

হেমন্ত আর কিছুই বললো না।সে জানে তার ভাই কতোটা কাজ পাগল।অর্থ আবার কিছু বলতে নিবে হঠাৎ হেমন্তের পিছে সিড়ির উপরে দুজন মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু-কুচকে এলো ওর।একটা হিয়া সেটা বোজা যাচ্ছে।তবে আরেকজন মেয়ে কে?
অর্থ তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকালো সাদা জামা পরিহিত,এলোমেলো চুলে চুল,হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে,মুখশ্রীটা অর্থ ভালোভাবে বুজতে পারছে না।মেয়েটাকে দেখে বুকের বা’পাশটায় হঠাৎ কেমন যেন একটা চাপ সৃষ্টি হলো।অর্থ বুজলো না কেন হঠাৎ এমনটা হওয়ার মানে কি?অর্থ চাইলো চোখ সরিয়ে নিতে কিন্তু পারছে না।অবশেষে জোড়পূর্বক দৃষ্টি সড়িয়ে হেমন্তের সাথে কথায় মনোযোগ দিলো।তাও বার বার নজর মেয়েটার দিকেই চলে যাচ্ছে।অর্থ আর না পেরে নিজের ওপরেই নিজে বিরক্ত হয়ে গেলো।তাই হেমন্ত বলে কল কেটে দিলো।তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।কিছুই ভালোলাগছে না।বিরক্ত হয়ে অর্থ চলে গেলো মিটিংরুমে।তাকে এখন এই লাস্ট মিটিংটা ভালোভাবে শেষ করে দেশের জন্যে রওনা হতে হবে।

#চলবে,,,