#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব১২
#রাউফুন
প্রিহান আর মালা একই গাড়িতে বসে আছে। এক কিম্ভূতকিমাকার ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে আজকে তারা। মালার শরীরে নব বিবাহিত নারীদের শাড়ী জড়ানো। আর বরের বেশে প্রিহান হাওলাদার। প্রিহান বিয়ের আগে থেকে এইপর্যায়ে একটাও কথা বলেনি৷ সন্ধ্যার কিছুক্ষন আগে মালা তাকে ফোন করে হঠাৎই দেখা করতে বলে। এরপরে কোনো প্রশ্ন করতে বারন করে তাকে। কথা মতো প্রিহান একটাও প্রশ্ন করে নি মালাকে। যেখানে বলেছে সেখানেই তার কথা মতো যায় প্রিহান। কিন্তু সেখানে গিয়েই আশ্চর্যজনক ব্যাপার ঘটে। প্রিহানের সে-সময় কিছুই বলার থাকে না। কারণ সে তো মনে প্রাণে চাইতো মালাকে বিয়ে করতে। তারা কোর্ট ম্যারেজ করেছে। কাবিন ও করা শেষ। এরপর মালা নিজেই কনের সাজে নিজেকে সাজিয়ে তুলে। সব টাই ছিলো প্রিহানের কাছে অযাচিতভাবে ঘটে যাওয়া স্বপ্নের মতো৷ মাথা ফে’টে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে প্রিহানের। অনেক গুলো প্রশ্ন মাথার ভেতর জটলা পাকিয়ে আছে। সে আর চুপ করে থাকতে না পেরে গাড়ি চালাতে চালাতে প্রশ্ন করে মালাকে,
‘আপনি বিয়ের সিদ্ধান্ত টা এভাবে হুট করে কিভাবে নিতে পারলেন? যে মেয়ে কাল অব্দি আমাকে বিয়ে করবে না বলে নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলো তার হঠাৎ করেই এই সিদ্ধান্ত টাকে মানতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন? কোথায় গেলো আপনার দৃঢ় আত্মসম্মান বোধ? কোথায় গেলো আপনার সেই মনোবল? আমি জাষ্ট মেনে নিতে পারছি না এই সব টা।’
‘ওহ তাহলে আপনি আমাকে এতো দিন এমনি এমনি বিয়ের কথা বলতেন তাই তো? সেজন্য এখন বিয়েটা করে পস্তাচ্ছেন? এতো দিন বিয়ে করবেন, বিয়ে করবেন বলে জ্বালিয়ে মা’র’তেন তবে এখন কি হলো?’ কিছুটা রুঢ় হয়ে বললো মালা।
‘আপনি ভুল বুঝছেন মালা। আমি সে কথা বলতে চাইনি। আমি আপনাকে যত টুকু চিনি, আপনি এভাবে আমাকে বিয়ে করবেন এটা আমার কল্পনার বাহিরে। আপনি আমাকে বিয়ে করবেন, যখন জানলাম তখন আমি খুব খুব খুশি হয়েছিলাম কিন্তু আমার মনের মধ্যে যে খটকা টা আছে সেটা থেকে বেরোতে পারছি না।’
‘কেন আপনি তো নিজেই বলেছিলেন আপনি আমার মত নিয়েই আমাকে বিয়ে করতে চান? এখন যখন বিয়ে টা হয়ে গেছে তখন এতো প্রশ্ন করছেন কেন?’
‘এখন যদি আপনি অন্য কোনো কারণে বিয়েটা করে থাকেন তবে সেটা আমাকে বলুন প্লিজ!’
‘ওকে চলুন তবে বিয়েটা ভেঙে দিবো!’ রেগে বললো মালা।
‘এখন আপনি রেগে আছেন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। রাগ থেকেই এরকম কথা বলছেন আপনি। কদিন পর যখন আপনার রাগ পরে যাবে তখন আপনার আর এরকম মানসিকতা থাকবে না। বিয়েটা নিয়ে আপনিই না পস্তান শেষে।’
প্রিহানের দিকে চোখ কুচকে তাকাই মালা।আর বলে,
‘আমি যখন যেটা ডিসাইড করি তখন সেটাতেই স্টিক থাকি। আমার কামিটম্যান্ট এর দাম আছে। আর বিয়েটা কেন করলাম একদিন এর উত্তর ঠিক পেয়ে যাবেন। আজ আমাদের বিয়ের রাত এটাকে খারাপ না করলে খুশি হবো।’
প্রিহান নিশ্চুপ৷ সে আপাতত এসব কিছু মাথা থেকে বের করতে চাইছে। এই তো ঔশীর সঙ্গে মেয়েটা দেখা করে এসেছিলো দুপুরেই। মনে হচ্ছিলো কত আপন দুজন দুজনার। আসলেই মালা মানুষ টাই এরকম। যাকে ভালোবাসে তাকে নিজের সবটা দিয়েই ভালোবাসে৷ হিসেব নিকেশের বাইরে গিয়ে কোনো মাপ ঝোখ না দেখে সে মানুষ কে নিজের করে নিতে পারে। তার নামের মানের মতোই মন টাও খুব সুন্দর। তাই সে যখন কাউকে ভালোবাসে সেটা ভেতর থেকেই বাসে৷ কিন্তু সে যদি কারোর এগেইন্সটে যায়, যদি কাউকে হ্যাট করে তাহলে সেখানে কোনো রাগ ঢাক রাখে না। যেটা ওর মন চাই সেটাই করে৷ ওর কাছে দুই ক্ষেত্রেই হিসেব টা বরাবর।
কোনো ভাবে ওই ফোন কলের ব্যাপারে শাহনাজ নেই তো? কোনো ভাবে যদি ওর কোনো সাধ্য সিদ্ধি পুরণ করার জন্য এসব প্ল্যান করে থাকে তবে?
শাহনাজ একজন সুবিধা বাদী লোক। শুধু মাত্র নিজের পিঠ বাঁচাতে সে সব করতে পারে এটা তার বোধগম্য হচ্ছে৷ মালা বুঝতে পারে ও যতটা ভালোবাসতো শাহনাজ কে তার দ্বিগুণ ঘৃণা করে এখন।
মালা যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত তখন প্রিহান আঁড়চোখে একবার মালাকে দেখে নিলো। গাড়ির বাইরে তাকিয়ে আছে সে। মালাকে তার কাছে ভীষণ সুন্দর দেখতে লাগছে। এর আগে কখনোই মালাকে সে এভাবে পর্যবেক্ষণ করেনি। সে বুঝতে পারে সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর প্রতি তার ভালোলাগা তৈরি হয়েছে।
গাড়িটা এসে থামে সেই রেস্টুরেন্টে। জেনারেলি এই ধরনের রেস্টুরেন্টে সাধারণ আমজনতা আসতে পারে না খুব বেশি। আসলে এসব জায়গায় আসতে গেলে শুধু যে পকেট ভারী হতে হবে তা নয়, একই সাথে একটা স্পেশাল স্ট্যাটাস মেইনটেইন করতে হয়। না হলে এই রেস্টুরেন্টের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়া যায় না৷ বিয়ের পরানোর কাজ শেষ হতেই প্রিহান ফোন করে মালার জন্য একটা ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করতে বলেছিলো। গাড়ি থেকে নেমেই প্রিহান তারাতাড়ি গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিলে মালা গাড়ি থেকে নামলো।
‘আহাহ্ নাইস জেসচার! ইম্প্রেসিভ!’
‘মাই প্লেজার মেম!’
তারপর দুজনেই এক সাথে রেস্টুরেন্টে ঢুকে বসে পরে। আজকের পর থেকে তারা দুইজন এক সাথে নিজেদের জীবন নতুন করে শুরু করতে চলেছে। তাই মালা মনে করে তাদের মধ্যে কিছুই অজানা বা অচেনা থাকা উচিত না। সে আসলে খুব ইন্টেলিজেন্ট একটা মেয়ে। বাস্তব জ্ঞান তার যথেষ্ট। সে জানে কোনো ভাবেই প্রিহান হাওলাদার এর মতো একজন ইনফ্লুয়েনশাল মানুষের কাছ থেকে কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারবে না। তাই সে ঠিক করে তার জীবনের যা কিছু সত্যি সব টাই সে বলে দিবে প্রিহানের কাছে। মালা ওর অতীত বলতে চাইলেও বাঁধা দিলো প্রিহান৷ আজকের রাত টা সে কিছুতেই স্পয়েল করতে চাই না। তাই এসব নিয়ে পরে কথা বলবে। যেহেতু মালার তাকে হঠাৎ বিয়ে করার সিদ্ধান্ত টা নিয়ে প্রিহান আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি তবে মালাও যেনো তার অতীত সম্পর্কে আজ কিছুই না বলে। প্রিহান সব কিছু ফেলে এই রেস্টুরেন্টের সবচেয়ে স্পেশাল ডেজার্ট অর্ডার করে। খেতে খেতেই সে বলে,
‘আমরা কিন্তু আজকে বাড়ি যাচ্ছি না।’
‘ওমা কেন?’
‘আমার ইচ্ছে ছিলো আমার বউ আর আমি এই রেস্টুরেন্টে একটা স্পেশাল রাত কা’টা’বো। সেটা হোক ফুলসজ্জা আর কন্টকসজ্জা। আমার বউয়ের জন্য স্পেশাল হানিমুন স্যুটও রেডি আছে।’
কথাগুলো বলার সময় সে মালার মুখ লক্ষ্য করে মালার এক্সপ্রেশন দেখার জন্য। মালার অভিব্যক্তি ছিলো স্বাভাবিক। বরং সে প্রিহানকে অবাক করে দিয়ে বলে,
‘আমার কোনো অসুবিধা নেই৷ আপনার যা ভালো মনে হয়।’
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওঁরা দু’জনেই রুমে যায়।রুমে যেতেই সে দেখতে পেলো, পুরো রুম টা সাদা অর্কিড আর লাল গোলাপের ফুল দিয়ে সাজানো।
ফ্লাওয়ার ভাস গুলো তে রঙ-বেরঙের ডেফোডিলস রয়েছে। আর বিছানার উপর দুটো টাওয়াল দিয়ে দুটো রাঁজহাঁস সাজানো আছে। আর তার মাঝ খানে লাল গোলাপের পাপরী দিয়ে তৈরি হার্ট শেপ করা। লাভ শেপের মধ্যে হলুদ গোলাপ দিয়ে এম আর পি এই দুটো লেটার লেখা আছে৷ আর পুরো রুমের পর্দা গুলো ছিলো লাল, ইভেন বিছানার চাদর সহ বালিশ, এবং রুমে যা কিছুই ছিলো বাকি সব কিছুই লাল রঙের। অর্থাৎ বুঝা যাচ্ছে, এই রুম টা হানিমুন স্পেশালিষ্ট দের জন্য স্পেশাল ডিজাইন করা।
‘এতো কিছু কি কারণে সাজানো হলো?’
‘আমাদের ফার্স্ট নাইট সেলিব্রিট করতে!’
‘তা-বলে এভাবে?’
‘তো আপনি কি রকম টা চান?’
‘উহ কিছুই না। কি চাইবো।’ চোখ ঝাপটে বলে মালা।
এই মুহুর্তে এসে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পরলো মালা। তা দেখে প্রিহান গাল চুলকে হাসলো। বললো,
‘আপনি না চাইলে কিছুই হবে না। এখন থাকেন আমি বরং একটা হট শাওয়ার নিয়ে আসি। ততক্ষণে আপনি আপনার নার্ভাসনেস কাটিয়ে নিন। যদিও এই ফেস টা আমি ভীষণ পছন্দ করছি।’
‘অসভ্য!’
‘তাই?’ মালার দিকে ঝুকে বলে প্রিহান।
‘তা নইতো কি?’
‘আজকে প্রথমে ভেবেছিলাম শুধুই আই কন্টাক্ট করেই রাত টা পার করবো কিন্তু না এখন অসভ্যতামোর মাত্রাটা প্র্যাকটিক্যালি করে দেখাতে হবে।’
‘উম জাষ্ট নেওয়া যাচ্ছে না। মুখে লাগাম দিন!’
মালার এমন মুখো ভঙ্গি দেখে হো হো করে হেসে উঠলো প্রিহান। এরপর ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো। তম্বন্ধে মালার ফোন বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করতেই কর্কশ তবে আস্তে আস্তে পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো,
‘এইটা তুমি কি করলে হ্যাঁ? বিয়ে টা তো আমাদের প্ল্যান এ ছিলো না তবে? ওই বাড়িতে ঢুকার আরও অনেক রাস্তা ছিলো তার জন্য বিয়ে কেন করতে হবে?’
‘আপনি বলেছিলেন ওই বাড়িতে ঢুকতে হবে যে-কোনো উপায়েই হোক না কেন। আপনার প্ল্যান মোতাবেক চলবো বলেছিলাম! কিন্তু আমি যে কোনো প্ল্যান আপনার করা প্ল্যান এ এড করতে পারবো না এটা তো বলেন নি? বা এটা নির্ধারিত করাও ছিলো না।তাই বেশি কথা বলবেন না! আপনার সব কথা মানতে আমি বাধ্য না!নেহাৎ একটা দুর্বল পয়েন্ট পেয়েছেন তা না হলে বুঝতে পারতেন এই মালা কি জিনিস!’
‘এই এই জ্ঞান দিও না হ্যাঁ।এসব ফাঁকা হু’ম’কি অন্য কোথাও প্রয়োগ করবে।যায় হোক ওই বাড়িতে ঢুকে দুই একদিন পর কল করবে এর আগে না।’
‘আপনার প্রয়োজন আপনি কল করবেন আমি কেন করবো?’
‘বেশি বেড়ো না হ্যাঁ? ‘
‘কার সঙ্গে কথা বলছেন মালা?’
চমকে উঠে মালা পিছনে ফিরলো। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। সে নিজের শুষ্ক ঠোঁট জোড়া আলতোভাবে ভিজিয়ে নিলো। কি বলবে এখন সে? যদি প্রিহান কিছু শুনে থাকে তবে?
‘আরে কে ফোন করেছিলো?’
‘ওই একটা ফ্রেন্ড। আপনি অজু করেছেন? নামাজ পড়বেন না?’
‘নাহ। আপনি চান নামাজ পড়তে?’ দুষ্টু হেসে বললো প্রিহান।
‘এটাই তো নিয়ম!’
‘হ্যাঁ আমার তো আর কোনো সমস্যা নেই তাই না, যে নতুন বউ পাশে রেখে এমনি এমনি ঘুমাবো। এটা খুব টাফ একটা ছেলের জন্য তো বটেই! তবে আমার কেন যেনো মনে হচ্ছে এটা সঠিক সময় নয়। যেদিন আপনি মন থেকে চাইবেন সেদিন আমরা না হয় নামাজ পড়বো।’
‘আমি অজু করে আসছি। নামাজ পড়বো।’
প্রিহান শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মালার যাওয়ার পানে। তার মানে মালার সম্মতি আছে? পরক্ষণেই হেসে দিলো সে।
#চলবে