প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-১৫

0
425

#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব১৫
#রাউফুন

মালা ভেবেছিলো তাকে শশুড় বাড়িতেও কেউ না কেউ কথা শুনাবে। কেউ তো থাকবে যে তাদের বিয়েটা নিয়ে অমত করবে। কিন্তু না তার ধারণাকে সম্পুর্ন বদলে দিয়ে তাকে সমাদরে, সাদরে গ্রহণ করেছে বাড়ির প্রতিটি সদস্য! দাদি, দাদা, তার শশুড়-শাশুড়ী সবার কি সুন্দর ব্যবহার! সবচেয়ে বেশি খুশি বোধহয় ঔশী। কিন্তু সমস্যা হলো একটাই। তার শাশুড়ী মা এখনো অব্দি একটাও কথা তার সঙ্গে বলেনি৷ এমনিতে তিনি হেসেছে কি সুন্দর! ব্যবহার দেখে তো মনে হয়নি যে মালাকে তার পছন্দ হয়নি বা তিনি বিয়েটা নিয়ে অমত পোষণ করেছেন৷ কিন্তু তাহলে কথা কেন বললেন না? সবাই তো কত সুন্দর কথা বললো। তাহলে বোধহয় মনে মনে একটু রুষ্ট তিনি। শুধু প্রকাশ করছেন না। হতেই তো পারে তীব্র অভিমানে কথা বলতে চাচ্ছেন না। সে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখলো তার শাশুড়ী মা কাজ করছে রান্না ঘরে। বাড়ির পরিচারিকা কুটনো কা’ট’ছে পাশেই দাঁড়িয়ে। মালা আলতো পায়ে এগিয়ে গেলো রান্না ঘরে। গলা পরিষ্কার করে সে তার উপস্থিতি জানান দিলো। তার শাশুড়ী মা গাল ভরে হাসলেন। খোদেজা বেগম ইশারায় বললেন,

‘এখানে কি করছো?’

মালা মৃদু হেসে বুঝার চেষ্টা করলো। বুঝতে পেরেই বললো,

‘মা আমি রান্নার কাজে সাহায্য করি? আপনি একা একা করছেন সব কাজ। আর আমিও ঘরে ব্যোর হচ্ছি। আপনার ছেলে তো কাজে বেরিয়ে গেছেন আমার ভালো লাগছে না।’

খোদেজা খুশি হয়ে আবারও গাল ভরে হাসলেন। এবং মালার চিবুক ছুয়ে আদর করলেন। মালা নত মস্তকে বললো,

‘মা আপনি কি কোনো ভাবে রেগে আছেন? কথা বলবেন না আমার সঙ্গে?’

‘সে-কি গো নতুন ভাবি আপনি জানেন না? খালাম্মা তো কথা বলতে জানেন না। খালাম্মার মতো এমন একজন ভালো মানুষের মুখের কথা আল্লাহ তায়ালা যে কেন দেন নি!’ মন খারাপ করে বললো ময়না। (পরিচারিকা)

মালার মুহুর্তের মধ্যে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে কি তবে না জেনে বুঝেই শাশুড়ী মাকে কষ্ট দিয়ে ফেললো?

‘দুঃখিত মা! আপনার ছেলেতো আমাকে বলেই নি এ কথা।’

খোদেজা আবারও হেসে মালার দিকে স্নেহের চোখে তাকিয়ে রইলেন। ইশারায় বুঝালেন তিনি কিছু মনে করেন নি। আর ঘরে যেতে বললেন। মালা বুঝতে পেরে বললো,

‘না মা তা হচ্ছে না। আমি যাচ্ছি না। আমিও কাজ করবো। আমার মোটেই বসে থাকতে ভালো লাগে না। কাজ ছাড়া এক মুহুর্ত চলে না আমার। আর এখন থেকে আমিই সব কাজ করবো। আপনি শুধু আমাকে কাম্পানি দেবেন।’

খোদেজা মনে মনে ভীষণ সন্তুষ্ট হলেন মালার প্রতি। প্রথম দিন এসেই তাকে কতটা আপন করেছে মেয়েটা। খুবই পছন্দ হয়েছে তার মালাকে। তার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে। খোদেজার চাহনীতে মালা লজ্জা পেলো। সে না চাইতেও তার শাশুড়ী মাকে জড়িয়ে ধরলো। খোদেজাও স্নেহের স্পর্শ একে দিলেন। তবুও খোদেজা বারন করলেন যাতে রান্না ঘরে না থাকে। কিন্তু মালা জোর পূর্বক কাজ করলো। দুপুর গড়ানোর আগেই দুপুরে রান্নাটা শেষ করে ফেললো তিনজনে।

প্রিহান রাতে বাড়ি ফিরলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব চিন্তিত। মালা ঔশীকে পড়াচ্ছিলো। তার সারাদিন খুবই ভালো কে’টে’ছে। বিশেষ করে ঔশীর সঙ্গ সে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছে। বাচ্চাটির প্রতি আলাদা টান অনুভব করে সে। এটা যেনো হওয়ারই ছিলো। সব ঠিকই আছে এই মুহুর্তে প্রিহান কে দেখে মন টা খারাপ হলো তার। সে এগিয়ে এসে প্রিহানের হাত থেকে ঘড়ি খুলে দিলো। হাতের ব্যাগ টা নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রাখলো৷ এরপর টাই, কোট খুলে দিলো নিজেই৷ প্রিহান ছিলো নির্লিপ্ত, নির্বিকার। মালা প্রিহানের মনোভাব বুঝার চেষ্টা করলো। কিছু তো একটা হয়েছেই। হুট করেই ওঁদের মাঝখানে ঔশী চলে এলো। মালা আর প্রিহান দুজনের দৃষ্টি গেলো কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঔশীর দিকে। সে একবার প্রিহান তো একবার মালার দিকে তাকালো। এরপর আঙুল নেড়ে নেড়ে বললো,

‘এই যে পঁচা ছেলে, বউ এসেছে বলে শুধু বউয়ের সঙ্গে কথা বলছো? আগে আসলেই তো আমার সঙ্গে কথা বলতে। একে তো আমাকে না জানিয়েই বিয়ে থা করে বসে আছো। তারপর এখন এসে থেকেই আমাকে লক্ষ্য করলেই না।’

ছোট্ট মেয়েটির অভিমানের বুলিতে মালা মুচকি হাসলো। কি পাকা মেয়ে রে বাবা। কত কথা জানে।সে চোখের ইশারায় বোঝালো প্রিহানকে, ‘এবার সামলান আপনি।’

প্রিহান হাটু মুড়ে বসে অপরাধী মুখ করে বললো,
‘ওওওহ আমার ফুল বুঝি খুব রাগ করেছে? স্যরি গো আর হবে না এমন। আচ্ছা তোমার কি মামিয়াকে ভালো লাগেনি নাকি?’

‘ধুর! ভাগ্যিস মিস্টেরিয়াস আন্টি কে আমার পছন্দ খুব তাই রাগ করি নি। ওসব ভুলে গেছে ঔশী। আমার জন্য রোজ যে জিনিস নিয়ে আসো সেটা দেও এখন। ‘

‘এই রে আজ তো মামাই ভুলে গেছে এখন উপায়?’

‘এই যে তাহলে ঔশী খুব রাগ করলো।’

মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে ফিরে তাকালো। মালা বুঝতে পেরেছে আজ প্রিহান কিছুই আনতে পারেনি। তাকে দেখেই টেন্সড লাগছে ভীষণ! সে তার ব্যাগে থাকা চকলেটের বক্স এনে ঔশীর আড়ালে প্রিহানের হাতে দিলো। প্রিহান বুঝতে পেরে সেটা নিয়ে ঔশীর সামনে ধরলো। বাচ্চা মেয়েটি খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।

‘ইয়েএএ এটা তো আমার পছন্দের চকলেট। তার মানে তুমি মিথ্যে বলছিলেন?’

‘মামাই ঔশীর সঙ্গে একটু মজা করলো।’

‘এটা আমি ন্যানি কে আর বুড়ি আম্মা কে দেখিয়ে আনি।’

ঔশী দৌড়ে চলে গেলো বাইরে। সে যেতেই প্রিহান মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পরলো। মালা তার পাশে বসে সহাস্যে বললো,

‘কি হয়েছে আপনাকে এমন বিচলিত লাগছে কেন? কিছু নিয়ে কি ডিস্টার্বড আপনি?’

‘আমাকে এক কাপ কড়া করে কফি দিতে পারবে প্লিজ!’

‘নিয়ে আসছি। ততক্ষণে আপনি একটু ফ্রেশ হয়ে আসুন। ভালো লাগবে।’ বলেই মালা চলে গেলো।

মালা দু-কাপ কফি করে নিয়ে এলো। প্রিহান ও ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেছে। দুইজনেই বারান্দায় গেলো। প্রিহান ডিভানে বসলো এবং সে মালাকে ধরে নিজের কোলে বসালো। মালা বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে বসে প্রিহান কে আলতো করে চুমু দিয়ে কফিতে চুমুক দিলো। তারপর উপদেশ দেওয়ার মতো করে বললো,

‘আমাদের ব্যস্ততায় ভরা এই জীবনে উত্থান-পতন লেগে থাকবেই। প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে চলেছি আমরা প্রত্যেকে। যার ফলে মাঝেমধ্যে শারীরিক শক্তির পাশাপাশি মনের জোর হারিয়ে ফেলি, হারিয়ে যায় নিজেদের উপর আস্থা। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি জটিল কিছুতে ফেসেছেন। কি, আমাকে কি কিছু বলা যাবে?’

‘আমি তো তোমার কাছে মানসিক, শারিরীক সব কিছুর জোরই পাই। শুধু তোমাকে দেখলেই আমার সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায় মাই ড্রাগনফ্লাই’স। এইতো সেদিন তোমাকে দেখলাম, তুমি জানো এর আগে আমি কখনো প্রেমে পরিনি তাই প্রেমে পরার অনুভূতি ঠিক জানি না। আর সত্যিকারের কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকার কাছে নিজের নিজস্ব কিছুই লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে না। দিন শেষে, রাতে গিয়ে ঠিক সেই মানুষ টার কাছে নিজের সকল প্রকার চিন্তা, ভালো মন্দ, উদ্বেগ প্রকাশ করে। আমার ক্ষেত্রেও তাই।’

‘বলুন না তাহলে। আপনাকে চিন্তিত দেখে ভালো লাগছে না আমার।’

‘আসলে তিন-চার বছরের আগের একটা জটিল কেস আবার রিওপেন হয়েছে। তোমার মনে আছে, আমাদের কিন্তু বিয়ের তিন দিন আগেও দেখা হয়েছিলো। আমি খুব চিন্তিত ছিলাম সেদিন। কারণ ওই দিনই চার বছরের আগের কেস কেউ একজন রিওপেন করে গেছে। এবং নতুন কিছু সূত্র দিয়ে গেছে। যেটা খুবই জটিল এবং টাফ। যেখান থেকে শুরু করছি সেখানেই এসে থেমে যাচ্ছি বার বার। এবং এই কেস টা আমাকেই লড়তে হচ্ছে। আমাকে হায়ার করা হয়েছে এই কেস টার জন্য। বুঝতে পারছি না কিভাবে এটাকে শেষ করবো।’

‘উম বুঝলাম। হঠাৎ কেউ কেন এতো বছর আগের কেস টা নতুন করে ওপেন করলো? কি তার উদ্দেশ্য? আপনার কাছে কি কেস টার ডকুমেন্টস আছে?’

‘হ্যাঁ আছে।’

‘আমি কি একবার ওটা দেখতে পারি?’

বিনাবাক্যে প্রিহান সেই ফাইল টা এনে মালার হাতে দিলো। মালা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রিহানের দিকে। ঠিক কতটা বিশ্বাস করলে একজন মানুষ একবার বলাতে নিজের এত্তো ইম্পর্ট্যান্ট ফাইল দেখাতে পারে। এই বিশ্বাসের মর্যাদা কি সে দিতে পারবে? সে ফাইল টা নেরেচেরে দেখে বললো,

‘আপনি আমাকে এতোটা বিশ্বাস করেন প্রিহান? একবার বলাতেই এরকম ইম্পর্ট্যান্ট ফাইল দেখিয়ে দিলেন?’

প্রিহান মালার গলায় আদুরে ভাবে নিজের ঘ্রান্দ্রেয়ী ঘষলো। নাকে আলতো লাভ বাইট দিয়ে বললো,

‘তোমাকে বিশ্বাস করবো না তো কাকে করবো? তোমাকে অবিশ্বাস করা মানে আমার নিজেকে অবিশ্বাস করা।’

‘আমি মনে করি আমার বাবাকে পটানোর চেয়ে এই কেস টা বেশি সহজ।’

বলেই হেসে ফেলে মালা। মালার কথা শুনে না চাইতেও প্রিহানও হেসে দিলো। তার মনে হলো মালার সঙ্গে শেয়ার করে তার মন টা একটু রিলেক্স লাগছে। মন মস্তিষ্ক, স্নায়ুকোষ সব কিছু যেনো একটা ধোঁয়াশায় ছেঁয়ে ছিলো। সবাই রাতের খাবার এক সাথে খেয়ে নিলো। মালা প্রিহান ও খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরলো।

প্রিহান শুয়ে পরার মিনিট পাঁচেক বাদ ই ঘুমিয়ে গেলো। সে অনেক ক্লান্ত ছিলো বিধায় জলদি ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু মালার ঘুম নেই। এই মানুষটা,এই বাড়ির প্রতিটি সদস্য কতটা উদার, ভালোবাসা-ময়। এরকম মানুষ গুলোকে সে কিভাবে ঠকাবে? না চাইতেও মালাকে সব টা ভীষণ ভাবাচ্ছে। মন তো আর বোকামি করতে পারে না। মন মস্তিষ্কের সঙ্গে লড়াই চলছে তার। ”আপনি অন্য সবাইকে বোকা করতে পারেন, কিন্তু নিজের মনকে বোকা করতে পারবেন না।” তেমনই হয়েছে মালার ক্ষেত্রেও। সে এই কিছু সময়ের মধ্যেই না চাইতেও কতটা আপন করে নিয়েছে সবাইকে। এটা সে খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। সে প্রিহানের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। হলদে টিমটিমে আলোয় কি-যে সুন্দর লাগছে মানুষ টাকে। তার শাহনাজের কথা মনে হলো হুট করেই। শাহনাজ রোজ রাতে তার চাহিদা মিটিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পরতো। ভালো মন্দ কোনো কিছুই জিজ্ঞেস করতো না। সে সারাদিন কি করলো, কিভাবে কে’টে’ছে কিছুই জিজ্ঞেস করতো না কখনোই। সে-তো গভীর রাতে ফিরতো আর শুয়ে পরতো। কোনো দিন খেয়ে আসতো বাইরে থেকে আবার কোনোদিন না খেয়ে আসতো। কিন্তু সে রোজ অপেক্ষা করতো খাবার বেরে। একটা দিন লোকটা তাকে জিজ্ঞেস করতো না সে খেয়েছে কি না। নানান কথা ভাবতে ভাবতেই সে কখনো যেনো তন্দ্রাচ্ছন্নে ডুবে গেলো।

রাতে হঠাৎই মালার ঘুম ভেঙে গেলো অদ্ভুত আওয়াজে।সে পাশে তাকিয়ে দেখলো প্রিহান ঘুমাচ্ছে খুব সুন্দর ভাবে।এমনিতেই লোকটাকে তার খুব চিন্তিত মনে হয়েছে।সারা মুখ জুড়ে ক্লান্তির শেষ নেই৷শব্দের উৎস খুঁজতে সে অন্ধকারেই সারা রুম জুড়ে চোখ বুলালো।ভালো ভাবে দেখতেই দেখলো জানালাটা খুলা।এবং সেখান থেকেই ক্যাচ ক্যাচ টাইপ শব্দ আসছে।মনে হচ্ছে ওখান থেকে কেউ কিছু একটা দিয়ে থাই-গ্লাসে খোচাচ্ছে। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো মালা।তড়াক করে উঠলো তার বুকের ভেতর টা। হুট করেই সে কিছু একটার কালো অবয়ব দেখেই জোরে জোরে চিৎকার করে উঠলো।

#চলবে