#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব১৬
#রাউফুন
মালার চিৎকারে ধড়ফড় করে উঠলো প্রিহান। মালাকে দুই হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে অনুচিন্তন গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে? কি হয়েছে? এভাবে চিৎকার করলে কেন? বাজে স্বপ্ন টপ্ন দেখেছো? ভয় পেও না আমি আছি তো তোমার কাছে। কিচ্ছু হবে না। শান্ত হও।’
‘ওখানে কেউ ছিলো প্রিহান৷ আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি।’ হাপরের মতো শ্বাস নিতে নিতে বললো মালা।
ওর ভীতিকর অবস্থা দেখে প্রিহান জগ থেকে পানি ঢেলে ভরা গ্লাস এগিয়ে দিলো ওর দিকে। মালা পানি খেয়ে নিলো। মালাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো প্রিহান। মালার কথা মতো জানালার কাছে গিয়ে ভালো ভাবে চেক করলো সে। বারান্দায় গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে চেকিং করে দেখলো৷ কিন্তু কোনো কিছুই পেলো না। না কাউকে দেখা গেলো।
‘ওখানে কিছু নেই মালা। কে আসবে ওখানে? আমি তোমার কথাকে অগ্রাহ্য করছি না। কিন্তু ঔশীর সঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটার কারণে আমাদের বাড়িতে টাইট সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছিলাম। সে-সকল বাঁধা পেরিয়ে কেউ-ই এই বাড়িতে প্রবেশ করতে পারবে না।’
‘তাহলে আমি কাকে দেখলাম।’
‘তোমার ইল্যুশন হবে হইতো। তুমি ঘুমাও তো। আসো আমি ঘুম পারিয়ে দিচ্ছি।’
‘বিশ্বাস করুন আমাকে প্রিহান। ওখানে কেউ তো ছিলো। আমার মনে হলো কেউ জানালা টা খোলার চেষ্টা করছিলো।’
‘আমি বিশ্বাস করি তোমাকে। বাট আমি দেখলাম কেউ নেই। তাও তুমি যখন বলছো কাল সকালে আমি বাগান টা আবার চেইক করবো।’
‘ঠিক আছে। আমি কি তবে শুধু শুধুই এতো জোরে চিৎকার করলাম। নিশ্চয়ই সবাই শুনেছে আমার চিৎকার। প্রথম দিন বাড়িতে এসেই আমি এমন করলাম সবাই কি ভাববে?’
‘নাহ কেউ শুনতে পাইনি তোমার চিৎকার। কারণ রুম টা সাউন্ডপ্রুফ! আর শুনলেও চিন্তিত হয়ে আরও আগে ছুটে চলে আসতো সবাই।’
কেউ শুনতে পাইনি ভেবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মালা। কিন্তু ওই অবয়ব টা নিয়ে সে আবার চিন্তিত হলো। এতোটাই ভুল দেখলো সে? সবটাই কি সত্যিই তার ইল্যুশন? মালার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রিহান বললো,
‘কাল আমাদের বিয়ে উপলক্ষে রিসেপশনের আয়োজন করা হয়ে। সবাইকে জানানো হবে আমাদের বিয়ের ব্যাপার টা। সকালে উঠতে হবে এখন ঘুমানো উচিত।’
‘আচ্ছা!’
‘আদর লাগবে না?’
‘নাহ?’
‘সত্যি লাগবে না?’
‘উঁহু!’
‘কিন্তু আমার তো লাগবে!’
‘লাগবে নিয়ে নিন!’
শেষ কথাটা মুখ ফসকে বলেই মালা লজ্জা পেলো ভীষণ। লোকটা এমন ঠোঁট কা’টা কেন? লাগামহীন মানুষ! মুচকি হেসে প্রিহান ওঁকে কাছে টেনে নিলো। অত্যন্ত একান্ত ভাবে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আবারও। মালা লক্ষী মেয়ের মতো গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রইলো। প্রিহানের অন্যরকম স্পর্শ পেয়ে সে কেঁপে উঠলো। ওঁ বুঝতে পারলো নিজের স্বামীর চাওয়া! সে লজ্জায় আবিষ্ট হয়ে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে মুখ লুকালো নিজের স্বামীর বুকে।
•
মালা সুন্দর একটা শাড়ী পরে তৈরি হয়ে নিলো। যেহেতু নিজেই সাজতে জানে সেহেতু অন্য কারোর সাজানোর প্রয়োজন পরলো না তাকে। আজ তাদের বিয়ের দ্বিতীয় দিন। অথচ আজও প্রিহান অফিস গিয়েছে ইম্পর্ট্যান্ট কাজ পরাই৷ আইনের কাজ কখন পরে যায় বুঝা দায়। সে বলেছিলো দুপুর বারোটার মধ্যে চলে আসবে। কিন্তু এখন বারোটা বেজে একুশ মিনিট। তখনই হন্তদন্ত হয়ে প্রিহান ঘরে ঢুকলো। হাতের ব্যাগ টা যথাক্রমে নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে রাখতে বললো,
‘স্যরি মাই ড্রাগনফ্লাই’স। তারাতাড়ি আসতে চেয়েও পারলাম না।’
‘সমস্যা নেই মাত্র বাইশ মিনিট লেট করেছেন।’ মালা প্রিহানের হাত ঘড়ি, টাই, কোট, জুতো, পা মুজা খুলতে খুলতে বললো।
‘বা’জে অভ্যাস গুলো খুব ভালো ভাবে তৈরি করে দিতে পারো তুমি।’
‘মানে কিভাবে বা’জে অভ্যাস তৈরি করে দিলাম?’
‘এই যে আগে বাইরে থেকে এসেই নিজেই নিজের কাজ করতাম আর এখন থেকে তুমি করছো। বা’জে অভ্যাস না এটা?’
‘মোটেও নাহ! কিছু ভালো অভ্যাস যেমন ভালো তেমনই কিছু বা’জে অভ্যাস ও ভালো।’
প্রিহান মুচকি হেসে মালার কোমড় চেপে ধরলো। কাছে টানতেই মাঝ খানে ঠেলে ঔশী ঢুকে পরলো। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দুজনের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই হকচকিয়ে তাকালো ঔশীর দিকে। মালা বিমুঢ় হয়ে ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো।
‘আজকেও সেইম কাজ করেছো মামাই?’
‘স্যরি! স্যরি আমার ফুল! কাল থেকে আর এমন হবে না প্রমিস।’
‘ওসব প্রমিস টমিস রাখো তোমার পকেটে। আমি বলিনি করতে। রাখতে পারবে না যেটা সেটা করে লাভ নেই। আমি জানি এখন থেকে রোজ এসেই তুমি বউয়ের সঙ্গে গল্প করবে।’
‘ওরেহ পাকা বু’ড়ি রে। আমি মামাইকে বলে দিবো আগে যেনো তোমার সঙ্গে গল্প করে তারপর আমার সঙ্গে। আজকের জন্য মিস্টেরিয়াস আন্টি মামাই এর হয়ে স্যরি চাইছে।’
‘ওঁকে তুমি বলছো বলে মেনে নিলাম।’
‘ঠিক আছে মা চলো আমরা নিচে যাচ্ছি তোমার মামাই রেডি হয়ে নিচে আসুক।’ প্রিহানের হাতে তোয়ালে হাতে দিয়ে বললো।
‘ঠিক চলো, চলো, মিস্টেরিয়াস আন্টি।’
•
মালাদের রিসিপশনে অনেক লোকজন এসেছে ইতিমধ্যে। সবাই মালাকে দেখে প্রশংসা না করলেও অনেকেই তার রুপ দেখে প্রসংশা করছিলো। অনেকে তো তাকে চেনেও। কেউ কেউ তো মুখের উপরেই বলে দিচ্ছে “আপনি সেই না যে অমুক বিউটি পার্লার এর অনার!” মালাও ঔশীকে কোলে নিয়েই সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলো। তখনই ওর চোখ গেলো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা, ওর ভাই -বোন আর মা বাবার দিকে। মালা ঔশীকে কোলে নিয়েই ছুটে গেলো। পুতুল তাকে দেখতে পেতেই জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেমন আছো আপু? একটা দিন তুমি বাড়িতে নেই মনে হচ্ছিলো কতদিন থেকে তুমি আমার সঙ্গে নেই।’
‘ভালো আছি সোনা বোন আমার! তুমি কেমন আছো?’
‘তুমি নেই ভালো থাকি কি করে? তাই তো প্রিহান ভাইয়া যেতেই চলে এসেছি তোমাকে দেখতে!তোমায় দারুন লাগছে আপু।’
‘পা’গ’লি আমি কি সারাজীবন তোমার সঙ্গে থাকতাম নাকি? তুমি বড় হলে বিয়ে দিতাম তখন তো আমাকে ছেড়ে থাকতে হতো নাকি?’
‘হুম। আপু কি টিউটর ঠিক করে দিয়েছো তিন দিন থেকে খোঁজ নেই।’ মন খারাপ করে বললো পুতুল।
‘নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা ছিলো তাই আসেনি। আমি কথা বলবো প্রশান্তর সঙ্গে। আমার গহীন ভাইয়া কেমন আছে? মুখ গোমড়া কেন?’
গহীন ঔশীকে মালার কোলে দেখে হিং’সেই ফে’টে পরছে। তাই সে কথা বলছে না। তার আপুর কোলে এই মেয়েটা কেন? কেন থাকবে? এতো বড় মেয়ে সে কিনা তার আপুর কোলে উঠে ললিপপ চুষছে। মালা তার বাবার সঙ্গে কথা বললো। মায়ের সঙ্গে কথা বললেও তিনি কথা বললেন না। সে না চাইতেও হাসলো। মেকি হেসে বললো,
‘আসেন আব্বু। ভেতরে আসেন।’
‘প্রিহান ছেলেটা কি যে করে না। এই তো একটু আগে গিয়ে জোর করে এসেছে যাতে আমরা এখানে আসি।’
‘উনি গেছিলেন আব্বু, আপনাদের আনার জন্য।’
‘হ্যাঁ। এমন ভাবে বললো না এসে পারলাম না।’
মনে মনে ভীষণ খুশি হলো মালা। প্রিহানের আসলে ওঁদের বাড়ি গিয়ে ওর বাবা মাকে আনতে গিয়েই দেরি হয়েছে৷ তাও মানুষটা একবারও বললো না।তাকে চমকে দেবে ভেবেই হইতো বলেনি৷ আনন্দে ওর চোখের কোণে জল চলে এলো। সে নিজেকে সামলে বললো,
‘এই পুতুল গহীনকে ধরে নিয়ে আসো! আব্বু আম্মু আসেন এই বাড়ির সবার সাথে পরিচিত হয়ে নিন।’
ওর সবাই ভেতরে এলো। মালার শশুড় বাড়ির সকলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিলেন উনারা। মালার বাবা মা উনাদের সকলের ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন। মালার প্রাক্তন স্বামীর বাসায় যখন গেছিলেন তারা তখন কিভাবে অপমানিত হতে হয়েছিলো তাদের। তারা গরীব বলে মানুষ বলে গন্যই করেনি তারা। এমন কি শাহনাজ তাদের নিজের শশুড় শাশুড়ী বলে সবার সঙ্গে পরিচয় পর্যন্ত করাইনি।
প্রিহান আসছে না বলে মালা ঔশীকে নামিয়ে দিয়ে উপরে গেলো তাকে ডাকতে।
এখানে মালার ইনভাইটেশন পেয়ে প্রশান্তও চলে এসেছে। প্রথমে মালার বিয়ের কথা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলো সে। পরক্ষণেই খুশি হয়েছে সে। সে এসেই কাঙ্ক্ষিত মানুষ কে খুঁজতে লাগলো। কারণ সে জানে মেয়েটা এসেছে। খুঁজে খুঁজে শেষে দেখলো এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে কাউকে খুঁজছে। পুতুলের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। পুতুল তার দুলাভাইকে খুঁজছে। পিছনে ফিরতে নিলেই ধরাম করে ধাক্কা খেলো। নাকে ব্যথা পেয়ে সে রাগান্বিত স্বরে বললো,
‘কে রে ধামড়ি লোক। দেখে চলতে পারেন না। দেখে শুনে মানুষের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন। সুবিধাবাদী লোকজন। যত্তসব!’
‘আরে আরে রিলেক্স। আল্লাহ এতো রাগ! এই জন্যই বুঝি নাকটা লাল।আমি পড়াতে গেলে তো মেনিমুখো হয়ে থাকো। সে কি-না এখন এতো কথা বলছো?’
পরিচিত কন্ঠ শুনে ততক্ষণে পুতুল চোখ তুলে তাকিয়েছে। প্রশান্ত কে দেখতেজ গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রশান্ত অসহায় মুখ করে বললো,
‘বারে পাত্তাই দিলে না। মনে হচ্ছে আগে কোনোদিন আমাকে দেখোই নি। কোনো সম্পর্কই নেই।’
‘কে আপনি? আপনাকে তো চিনলাম না? আগে কখনো দেখেছি?’
‘আল্লাহ্ মাইয়া কই কি? আমারে চিনো না?’
‘নাহ তো চিনি না।’
‘আমি তোমার স্যার ভুলে যেও না। স্যারের সঙ্গে হেয়ালি?’
‘ওওও হো-হো আপনি আমার স্যার বুঝি? গত তিন দিন কোথায় ছিলেন আপনি স্যার?’
‘সেদিনই তো দেখে এলে জ্বর ছিলো। তারপর দিন জ্বর নিয়েই ভার্সিটি গেছিলাম। এরপর দিন ঘুম থেকে উঠতেই লেট হয়েছে। এই জন্য বুঝি কোনো সম্পর্ক নেই তোমার সঙ্গে আমার? আমাকে তুমি চেনো না! বাহ বাহ কিয়া চিজ হে!’
‘নাহ নেই কোনো সম্পর্ক!’
‘বাব্বাহ অভিমান করেছো নাকি?’
‘যাকে চিনি না, যার সাথে কোনো সম্পর্কই নেই, তার সঙ্গে কিসের অভিমান!’
‘রাগ, অভিমানে যে সম্পর্ক থাকে না, অপরিচিত হয়ে যায় আগে জানতাম না তো!’
‘এখন থেকে, আজকে থেকে জেনে রাখবেন।
সবাই তো আর এক না। কেউ কেউ বরাবরই ইউনিক ভাবে রাগ, অভিমান করে। যেমন আমি।’
‘রাগ অভিমান ও ইউনিক হয়?’
‘মানুষের সঙ্গে সঙ্গে রাগ অভিমান ও ইউনিক হয়।’
‘আল্লাহ্ আর কি কি যে দেখতে হবে।’
‘সবকিছু দেখতে হবে।’
‘এহ সবকিছু দেখতে হবে?’ চোখ ছোট ছোট করে বললো প্রশান্ত। কথার মা’র প্যাচ বুঝতে পেরে পুতুল দুই হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো প্রশান্তকে। এর মধ্যেই আরও অনেক মানুষজন চলে এসেছে।সবাই সবার মতো আছে। তাই তাদের কথা বলাটা কেউ-ই লক্ষ করেনি।
#চলবে