#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব২১
#রাউফুন
ভোর বেলা সবাই খেতে বসেছে। রাতের পর মালার সঙ্গে আর কথা বলেনি প্রিহান। প্রিহানের আদালতে শুনানি নেক্সট উইকে। এর মধ্যে সে মোটামুটি ফ্রী বললেই চলে। রুপম আজ আসছে। ওঁ ওর গ্রামের বাড়ি গেছিলো। এসেই প্রিহানের কাছে আসবে অন্য কোথাও যাবে না৷ প্রিহান খাবার টেবিলে বসেছে তবে মালা বসেনি জন্য একটুও খাবার সে মুখে তুলে নি। সকালে সে মালাকে জানিয়েছে মালা না খেলে সে খাবে না। মুখে যখন সে বলেছে মালা টেবিলে বসলেই খাবে তখন তাই ই৷ এখন শাশুড়ী মা, ময়নাকে রেখে মালা কি করে খাবে? বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগছে তার কাছে। কাল রাত থেকে জেদ করছে প্রিহান তার সঙ্গে। মালা যেহেতু কাল না খেয়ে কা’টি’য়েছে সেহেতু মালার শুধু মুখের কথায় প্রিহান বিশ্বাসী নয়৷ প্রিহান খাচ্ছে না দেখে দাদাই-দাদিমা তাকিয়ে আছে। একবার মালা তো একবার প্রিহানের দিকে তাদের নজর। গলা খাকাড়ি দিয়ে রহমান সাহেব বলেন,
‘প্রিহান দাদু ভাই খাচ্ছো না কেন?’
‘খাবার টেবিলে বসে এমন আহাম্মকের মতো বসে থাকাটা কোন কথা?’ বললেন ফারুক সাহেব।
প্রিহান নিশ্চুপ! এদিকে মালা ঔশীর মুখে খাবার দিতে দিতে অবলোকন করে যাচ্ছে প্রিহানকে। সে তো জানে কেন এমন করছে প্রিহান। হঠাৎ এতো দরদ উতলে উঠছে কেন হুহু্? যখন জাকিয়া হাত ধরেছিলো তখন মনে ছিলো না? যখন জাকিয়ার জন্য তাকে এক গাদা কথা শুনিয়েছিলেন তখন মনে ছিলো না? মালা তাকিয়ে দেখলো প্রিহান এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। মালা চালাকি করে তার শাশুড়ী মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘মা আপনি খেতে বসুন। আমি আজ ঔশীকে নিয়ে স্কুল যাবো। আমাকে খেতে হবে! আপনাকে ছাড়া খাই কি করে বলুন তো। রাখুন তো সব কাজ।’
মালার কথায় তিনি কিছু একটা আন্দাজ করেছেন। তাই কাজ ফেলে খেতে বসলেন অমত না করে।
‘ময়না আপু তুমিও কাজ রাখো৷ আসো আমাদের সঙ্গেই খাও। ঘর পরে পরিষ্কার করো।’
‘আইচ্ছা নতুন ভাবি!’
সবাই খেতে বসেছে। মালা ঔশীর পাশের চেয়ার টেনে বসে পরলো। মালা প্লেট উল্টো করে খাবার নিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত খাবার মুখে না দিয়েছে ততক্ষণ অব্দি খাবার মুখে দেইনি প্রিহান। সবাই এটা দেখে মিটিমিটি হাসছে। লজ্জায় মালার যায় যায় অবস্থা। এদিকে প্রিহান নির্লিপ্ত। যেনো কিছুই হয়নি।
‘খাও দাদু ভাই। এখন খাও।’
‘ এই যে রহমান সাহেব আমার নাতীকে জ্বালিয়ো না তো। তা আজকে কি কোর্টে যাবে নাকি দাদু ভাই?’
এতক্ষণে প্রিহান মুখ খুললো, ‘না দাদিমা। আজকে তেমন কাজ নেই। তবে আমি বেরোবো। আর না হলে রুপম আসছে ওর সঙ্গে বাড়িতেই কেস নিয়ে ডিসকাস করবো।’
‘সব ঠিক আছে! তবে সব-সময় এতো কাজ কাজ করলে হয়। তোমার নতুন বিয়ে হয়েছে কোথায় বউকে নিয়ে ঘুরতে যাবে না তা না বাড়ি আর কোর্ট কাচারি করেই দিন কাটাচ্ছো।’
রহমান সাহেব এর কথা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই মালার কাশি উঠে গেলো নাকে মুখে।
‘উফফ! তুমিও না। খেতে বসে এতো কথা বলো না তো।’
‘আহাহ কুলসুম তোমার মনে নেই, বিয়ের পর কেমন তোমায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর জন্য কত সুচো খুঁজতাম। আমার মা তো আগের দিনের মানুষ ছিলেন তিনি ভাবতেন বউকে বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিন্তু নতুন নতুন আইডিয়া বের করে কেমন ঘুরতে নিয়ে যেতাম তোমায় বলো তো।’
কুলসুম বেগম রহমান সাহেব কে কনুই দিয়ে গুতো দিলেন। এদিকে রহমান সাহেব এর কথায় সবাই সমস্বরে হেসে উঠে শুধু প্রিহান বাদে। মালা তাকাতেই প্রিহান ও তার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি বুড়ো যে রোমান্টিক আসিলা সে আমরা জানি। তা না হলে আমাদের কি টিপস দিতা এই বুড়ো বয়সে! শুনেছি বাবাকেও এরকম টিপস দিয়েছো।’
ফারুক সাহেব খুকখুক করে কেশে উঠেন ছেলের কথায়। খোদেজাও পারলে এখনি এখান থেকে সটকে পরেন। লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে উনার। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে মালা বলে,
‘ঔশী তোমার মাকে মনে পরে না?’
এই কথায় ফ্যাল ফ্যাল করে সবাই তাকিয়ে থাকে মালার দিকে। সবার এরকম চাহনিতে মালা কিছুই বুঝতে পারলো না। তাদের চাহনি দেখে মনে হচ্ছে সে বড়সড় কোনো ব্ল্যান্ডার করে ফেলেছে। সবাই গম্ভীর হয়ে খেয়ে দেয়ে উঠে যায়। প্রিহান ও উঠে গেলো। বাদ বাকি মালা চুপসে বসে রইলো। তার মানে কি ঔশী ব্যাপারে কিছুই জানতে পারবে না সে? ঔশীর সঙ্গে তার যে কি সম্পর্ক এটা সে কিভাবে সবাইকে বুঝাবে। তবে এর একটা শক্তপোক্ত প্রমাণ এর প্রয়োজন।
•
বিকেল তিনটাই রুপম এসেই প্রিহানের ঘরে গেলো। প্রিহান ল্যাপটপ নিয়ে কিছু একটা ঘাটাঘাটি করছে। রুপম কে দেখতেই বললো,
‘সা’লা গ্রামে কি গিয়ে বিয়ে করছস নাকি? আসতে চাস না গেলে। ওখানে কি পাইছিস তুই?’
‘তা তুই নেমোকহারাম লোক যে বিয়ে করলি আমাকে একবারও বলছিলি? অন্তত পক্ষে আমি তো এরকম তোকে না জানিয়ে বিয়ে করবো না।’
‘আরে তোকে তো সব বলছিলাম। এরপরও কিভাবে তুই এই কথা বলিস!’
‘হয়েছে হয়েছে! এবার কেস নিয়ে কি সাহায্য লাগবে।’
‘শুন এই যে ছবিটি দেখছিস? এই মেয়েটাকে গণ ধ’র্ষ’ন করা হয়েছিল। অতঃপর শয়তানের দল, মেয়েটিকে দেহ থেকে ধ’ড় আলাদা করে খুবই নৃশংস ভাবে তাকে হত্যা করেছিলো। চার বছর আগে খু’নিদের কে ধরতে না পেরে কেসটা আদালত থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। এরপর আজ চার বছর পর আড়াল থেকেই কোনো একজন ব্যাক্তি এই কেস টা রি-ওপেন করেছে। এই কেসের সম্পর্কে জাষ্ট আর কিছু ক্লু পেলেই কেস ডিসমিস।’
‘আর কি কি জানিস তুই? ডিটেলে বল তো?’
‘দেখ, আমি আদালতে পৌঁছানোর সাথে সাথে আমার হোয়াটস অ্যাপে এই কালো মোষের মতো লোকটার ছবি পাঠিয়েছে। আপাতত কেস টা আমার ফরে।’
‘ছবিটি কে পাঠিয়েছে কিছু জানতে পেরেছিস?’
‘নাহ রে। এমন কেউ আছে যে আমাকে আড়াল থেকে সাহায্য করেছে। ওই নাম্বার টাই কল করেছিলাম। কোনো ভাবেই ট্র্যাস করা যায়নি ওই নাম্বার টা। এখন মনে হচ্ছে আমি একদম ক্লু-লেস।’
‘খুব রহস্যজনক কেস তো! আচ্ছা যে এই কেস টা রি-ওপেন করেছে সেই ব্যাক্তিই তোকে ওই ছবিটা পাঠাইনি তো? সে হইতো কারোর সামনে আসতে চাইছে না।’
‘জানি না রে। কিছু তো একটা রহস্য আছে। যেটা আমাদের কে এক সপ্তাহের মধ্যে খুঁজে পেতে হবে।’
‘আমি আছি তোর সঙ্গে! সব রকম সাহায্য পাবি তুই আমার থেকে।’
খু’নের বর্ণনা শুনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে মালার৷ মালা করিডোর এর আড়াল থেকে সবকিছু শুনে ফেলে। হাত পা অবশ হয়ে আসছে তার। মালা চুপটি করে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। প্রিহান তার রুমের বাইরেই বসার জায়গায় বসে আছে রুপমের সঙ্গে। সে সময় মালা ঔশীকে স্কুল থেকে নিয়ে ফিরেছে। সে ঔশীকে স্কুল থেকে সরাসরি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেছিলো। সুন্দর কিছু মুহুর্ত কা’টাই তারা দুজন। এরপর বাড়ি আসে। যখন রুপম আর প্রিহান আলোচনা করছিলো তখনই তার কানে আসে কথা গুলো। কথা শেষ হতেই মালা শব্দ করে হেঁটে আসে। মালাকে দেখে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে রুপম চলে যায়। মালা রুমে গিয়ে সোজা ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরে। কিছু ভালো লাগছে না তার।
•
মালা ঘুমে বিভোর। রাত দশটাই মালার প্রিহানের ডাকে ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে উঠেই মালা অবাক হয়ে যায়। এতো সময় সে ঘুমিয়েছে অথচ তাকে কেউই ডাকেনি। সে আশেপাশে খুঁজলো প্রিহানকে৷ না কোথাও নেই সে। সে আলগোছে উঠে ফ্রেশ হয়ে আসে। এসেই দেখে প্রিহান খাবার নিয়ে হাজির।
‘উঠে পরেছো মাই ড্রাগনফ্লাই’স?’
‘হুম! এতটা সময় কিভাবে ঘুমালাম আমি! ডাকেননি যে?’
‘আমাদের বাড়িতে কেউ ঘুমালে তাকে ডাকা হয়না যতক্ষণ সে ব্যাক্তির নিজে থেকে ঘুম না ভাঙে!’
‘তাই বলে ডাকবেন না। অনেক্ষন ঘুমিয়েছি আজ।’
‘হ্যাঁ তাই তো দেখছি। এখন আসো খেয়ে নাও।’
‘আপনি আবার খাবার আনতে গেলেন কেন?’
‘আমি ঠিক করেছি আজকের পর থেকে আমিই তোমাকে খাইয়ে দেবো। তুমি না খেলে আমিও খাবো না। সারাদিন তো থাকি না। কিন্তু রাতে তো থাকি। আর এই সময় টা আমি তোমাকে দিবো। এবং নিজের হাতে খাইয়েও দিবো।’
‘রোজ দিতে হবে না। অফিসে তো খেতেই হয় আপনার আমাকে ছাড়া!’ খাটে বসতে বসতে বলে মালা। প্রিহান ও খাবার হাতে নিয়ে বসে তার সামনে।
‘হ্যাঁ খাই তো!’
‘হ্যাঁ। তাই তো বলছি!’
‘আমি তো নিজের স্বার্থ বুঝি, তাই তোমার সাথে কথা না হলেও, তোমার ছবির সাথে কথা বলি। তোমার ছবির সামনে খাবার খাই। আমি তো স্বার্থপর, আমি আমার ব্যাথায় না, তোমার ব্যাথায় কান্না করি। আমি আমার জন্য মায়া করি না, আমি তোমার মায়ায় নিজেকে সিক্ত করি। কারণ আই লাভ ইউ মালা। সেদিন তোমার সঙ্গে মিস-বিহেভ করে আমি নিজেই দগ্ধ হয়েছি। আমি কিন্তু সেদিন জাকিয়ার বাসায় যায়নি। তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম তোমার রিয়াকশন দেখার জন্য। আসলে নিজের উপর রাগ থেকেই বাড়ি আসিনি আমি। সেদিনের জন্য স্যরি মাই ড্রাগনফ্লাই’স। আর কখনো আমি তোমাকে কষ্ট দেবো না।’
‘এহ! ওই জাকিয়া আপু যখন হাত ধরেছিলো তখন তো কিছু বলেন নি!’
‘কি বলবো আমি সবার সামনে।’ খাবার মেখে খাইয়ে দিতে দিতে বলে প্রিহান। একটু খেয়েই মালা বলে,
‘আমি আর খাবো না।’
‘সব খাবে। না হলে দিবো কানের নিচে দুটো।’
‘খেতে ইচ্ছে করছে না তো।’
‘সব খেতে হবে যখন এনেছি আমি। না হলে কাল রাতের মতো হাত বেধে খাওয়াবো।’
‘বকছেন কেন?’
‘তো কি করবো? যা শুরু করেছো তুমি।’
‘আপনি বকছেন বলেই তো আমার পেটে মোচড় দিয়ে ব্যথা করছে এখন। তাই আর খাবো না।’
‘হোয়াট? বকলাম বলে তোমার পেট ব্যথা করছে। আজব আজব জিনিস সব শুধুই তোমার মধ্যে।’
‘উঁহু! একদম না। আচ্ছা আপনি মন থেকে বলছেন যে আমাকে রোজ খাইয়ে দেবেন?’
‘হুম মাই ড্রাগনফ্লাই’স। তুমি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকি। তুমি হলে আমার ণ,(মূর্ধন্য-শ)।
‘এহ, ণ(মূর্ধন্য-শ) আবার কি?’
‘ণ,(মূর্ধন্য-শ) ইংরেজি বর্ণমালার পঞ্চদশ বর্ণ, সম্বোধনসূচক শব্দ, অক্সিজেনর সংকেতচিহ্ন! তুমি আমার অক্সিজেন! তোমাকে ছাড়া কিভাবে ভালো থাকবো আমি!’
‘হয়েছে, হয়েছে। আচ্ছা আমি যদি আপনাকে ছেড়ে দিই তাহলে?’
‘এই যে তুমি শাহনাজ কে ছেড়ে দিয়েছো না? এটা হলো আমার জন্য ভালো। আমি লাকি তাই তোমাকে পেয়েছি। শাহনাজ তোমাকে চিনতে পারেনি। ও জানেও না ও কি হারিয়েছে। তবে সব সময় ছেড়ে দেওয়া টা কিন্তু ঠিক না। সব সময় সবকিছু ছেড়ে দেওয়াটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয় বরং যে তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তাকে দু’হাত দিয়ে শক্ত করে আগলে রাখো। আর তুমি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমিও তোমাকে আগলে রাখবো সারাজীবন।’
মালা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রিহানের দিকে। সে প্রিহাননের সঙ্গে শুধু শুধুই অভিমান পুষে রেখেছিলো। প্রিহান হইতো নরমালি নিয়েছিলো জাকিয়ার হাত ধরাটা। সে আজ প্রথম বার প্রিহান কে খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করলো।সে বলতে বাধ্য যে প্রিহানের চোখগুলো আসলে ভয়ঙ্কর ধরনের সুন্দর। ছেলেদের এত সুন্দর চোখ হতে নেই। প্রিহান ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিচ্ছে বারবার। হুট করে মালার মনে এক ভয়ঙ্কর চিন্তা আটক হলো। কথা নাই বার্তা নেই হুট করে চুমু দিয়ে দিলো প্রিহানের গালে। অবাক সাথে খুশিতে ঝলমল করে উঠে প্রিহানের চোখ মুখ। তা দেখে মালা মুগ্ধ কন্ঠে বলে,
‘হৃদয়ের বিনিময়ে যদি আপনার হৃদয় টা চাই দেবেন প্রিয়।’
‘হঠাৎ প্রিয় বলছো যে? খাইয়ে দিলাম বলে?’ অবাক ভাব তখন কা’টে নিয়ে প্রিহানের।
‘কেন বলা যাবে না?’
‘না বলা যাবে না কেন? একশোবার বলবা।’
‘আপনি জানেন প্রিহান শব্দের অর্থ কি?’
‘হ্যাঁ! নাম টা আমার। তাই জানা আছে!’
‘তাহলে?’
‘তাহলে কিছু না। কিন্তু প্রিহান বলেই ডাকবে। আমি কিছু মনে করবো না।।’
‘নাহ। প্রিহান শব্দের অর্থ তো প্রিয় তাই না? তাহলে প্রিহান=প্রিয়। সিম্পল! আমি প্রিয়ই বলবো।’
‘আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। হঠাৎ এতো ভালোবাসছো? কি মতলব!’ দুষ্টু হেসে বললো প্রিহান।
‘ঠিক আছে। কাউকেই আর কোনো নামে ডাকবো না। হ্যাপি! ওই জাকিয়া ডাকলে তো ঠিকই ভালো লাগতো।’
‘আরে শুনবে তো নাকি! রাগ দেখি নাকের ডগায় ঝুলে থাকে সব সময়!’
‘হ্যাঁ আমি তো খালি রাগ ই করি।’ বলতে বলতেই মালা বেরিয়ে আসে রুম থেকে। নিচে আসতেই কলিং বেল বেজে উঠে । সে ভড়কে গিয়ে পীপহোল দিয়ে তাকিয়ে দেখতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এতো রাতে, এখানে কি করছে সে?
#চলবে
#প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব২২
#রাউফুন
মালা হতচকিত হয়ে এক ধ্যানে দাঁড়িয়ে রইলো। এর মধ্যে আবার কলিং বেল বেজে উঠতেই মালা দরজাটা খুলে দিলো। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি আর কেউ-ই নয় জাকিয়া। মালা বুকের নিচে আড়া-আড়ি ভাবে হাত ভাজ করে জিজ্ঞেস করলো,
‘আরে জাকিয়া আপু যে? তা এতো রাতে এখানে?’
‘আমি এখানে কখন আসবো সেটা কি তোমাকে বলে আসতে হবে? আমার মামা বাড়ি আমি যখন খুশি এখানে আসবো। যখন ইচ্ছে হবে চলে যাবো।’ অত্যন্ত দাম্ভিকতার সহিত বললো জাকিয়া।
‘ওমা তা কেন? আপনি আসবেন ই তো। কিন্তু সবকিছুর একটা সঠিক সময় থাকে! কোনো ভদ্রমহিলা কখনোই এতো রাতে কারোর বাড়িতে গিয়ে উঠে দেখেছিলেন?’
‘এই মেয়ে, তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো!’
‘নাহ! অপমান করার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার। আপনার মধ্যে সহবত এর বড্ড অভাব। এটাই জাষ্ট বুঝাচ্ছিলাম।’
‘হু দ্যা হ্যাল আর ইউ? তুমি আমাকে সহবত শেখাবে?’
‘আমার স্বামী মানে প্রিহান তো আপনার বয়সে বড় তাই না? আমি আপনার বয়সে বড় না হলেও সম্পর্কে বড়। সেক্ষেত্রে আপনি আমাকে এই মেয়ে বলে সম্বোধন করতে পারেন না।ভাবি, ভাবি বলবেন।’
‘আমি মানি না তোমাকে প্রিহানের বউ হিসেবে!’
‘আপনি মানা না মানাই কারোর কিচ্ছু না। আশা করি সেদিনের ঝা’ড়ু পে’টার কথা ভুলে যান নি। বড় হিসেবে আপনাকে সহবত শেখানোর প্রয়োজনে আবার সেটা এপ্লাই করতে পারি।’
‘এই সরো তো। এতো যে সহবত শেখাচ্ছো, একজন মানুষ কে যে বাড়ির ভেতরে আসতে বলতে হয় জানো না।’
‘জানি তো। শুধু ভাবছিলাম আপনি সেদিনের কথাটা ভুলে গেলেন কিভাবে!’
‘তোমার কি মনে হয় ওই সামান্য বিষয় টার জন্য আমি এখানে আসা বন্ধ করবো! এতোটা বোকা জাকিয়া মেহরা নয়। আমি এখানে হাজার বার আসবো। আমি আমার প্রিহানের জন্য সবকিছু সহ্য করতে পারি।’
‘জাকিয়া আপু!’ হিং’স্র’তার সহিত উচ্চারণ করলো মালা।
‘হাহ, চেচিয়ে লাভ নেই। আমি শুনবো না। আমি প্রিহানকে ভালোবাসি।’
‘ভুলে যেও না সে বিবাহিত! তারই স্ত্রীর কাছে তুমি তার স্বামীকে ভালোবাসো বলছো!’
‘কাউকে ভালোবাসাটা দোষের কিছু নয় তবে আমার ক্ষেত্রে দোষটা কোথায়?’
‘যে যুগে মানুষ ভলোবাসাটাকে একটা অপসন মনে করে। সেই যুগে দাঁড়িয়েও কিছু মানুষ সেই একজন কেই ভালোবেসে যায়। আর প্রিহান ও শুধুই আমাকেই ভালোবাসে। তাই আপনার আমার স্বামীর ভালোবাসা এক্সপেক্ট করাটা নিছকই একটা ব্যাঙ্গাত্মক বিষয়!’
‘তুমি তো বৃষ্টিতে জন্মানো কালকের ব্যাঙের ছাতা।
আর আমি হলাম বটবৃক্ষ। তোমাকে সরিয়ে দিতে আমার বেশি সময় লাগবে না।’
‘কে বটবৃক্ষ আর কে ব্যাঙের ছাতা সেটা তো সময় বলবে। আসুন মেহমান মানুষ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটা শোভা পায় না।’
‘কার সঙ্গে কথা বলছো মালা? তোমার জন্য কখন থেকে অপেক্ষা করছি রুমে।’ সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে প্রিহান প্রশ্ন করলো মালাকে।
‘প্রিয় দেখুন না, জাকিয়া আপু এসেছে।’ মালার প্রিয় সম্বোধনে জাকিয়া নাক, মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো মালার দিকে। যেনো পারলে এখনি চোখ দিয়েই ভষ্ম করে দেবে মালাকে।
‘তুই এতো রাতে এখানে?’ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো প্রিহান।
‘এমনিতেই এসেছি। আমি এই সামনের রেস্টুরেন্টে একজন ক্লাইন্ড মিট করতে এসেছিলাম। রাত হয়ে গেছে অনেক তাই ভাবলাম এখানেই আসি।’
‘ওহ আচ্ছা। তুই গেস্ট রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।’
মালার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝাতে চাইলো জাকিয়া। মালাও মেকি হাসলো।
‘উফফ কখন থেকে অপেক্ষা করছি বলোতো। রুমে আসো।’
‘নাহ যাবো না রুমে। আজকে ঠিক করেছি বাহিরেই রাত কাটাবো।’
‘উম বললেই হলো নাকি। বাইরে থাকবে মানে টা কি। তুমি যা বলবে তাই হবে নাকি। ‘ প্রিহান মালাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে নেশাক্ত গলায় বললো।
‘কি করছেন টা কি? কেউ দেখে ফেলবে তো।’
‘এতো রাতে কেউ-ই জেগে নেই। তাছাড়া আর কি করবো বলো আমার বউ তো রুমেই যেতে চাইছে না। তাই এখানেই আদর স্টার্ট!’
‘উফফ! লাগাম দিন মুখে!’
‘আরে না চলো না। বাইরেই—!’
কথা শেষ করার আগেই মালা প্রিহানের মুখ চেপে ধরলো।
‘আর কথা না। চলুন রুমে যাচ্ছি!’
বলতে না বলতেই প্রিহান মালাকে কোলে তুলে নিলো। দরজার আড়াল থেকে জাকিয়া সব দেখে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এদিকে মালা মিচকে হাসছে। সে জানে জাকিয়া লুকিয়ে লুকিয়ে ওঁদের দেখছিলো৷ তাই ওঁকে দেখাতেই মালা নাটক টা করলো৷ একটু আ’গু’ন জ্বালিয়ে দিলো জাকিয়া মেডামের বুকে।
•
মাহিয়া ভীষণ কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে নাক মুখ লাল করে ফেলেছে। পুতুল কখন থেকে ওঁকে সামলানোর চেষ্টা করছে। স্কুল থেকে আসার পথে পুতুল মাহিয়ার সঙ্গে দেখা করতে আসে। কারণ মাহিয়া কয়েকদিন থেকে স্কুলে যায়নি। পুতুলের দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিলো ওর জন্য। কারণ মাহিয়ার মতো ব্রাইট স্টুডেন্ট কখনোই স্কুল কামাই করে না৷ জ্বর, ঠান্ডায় কাবু হয়ে থাকা মেয়ে, যে নিজের শরীরের তোয়াক্কা না করে স্কুল যেতো। তার হঠাৎ কি হলো যে স্কুলে আসছে না এক তিন-চার দিন থেকে। মাহিয়া পুতুলকে হঠাৎ করেই জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিলো। ভড়কে গেলো পুতুল। মাহিয়াকে শান্ত করতে করতে বললো,
‘কি হয়েছে তোর জান পাখি। এভাবে কাঁদছিস কেন? বল আমায়।’
মাহিয়া ওঁকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছলো। কাঁন্নার দাপটে হিচকি কাটছে মেয়েটা ক্ষনে ক্ষনে। পুতুল মাহিয়াকে সময় দিলো কথা বলার জন্য! কি হয়েছে এটা শুনার জন্য মাহিয়ার দিকে অধির আগ্রহে তাকিয়ে রইলো পুতুল। মিনিট দুই পর মাহিয়া মুখ খুললো। বললো,
‘নয়ন আমাকে ডিচ করেছে পুতুল!’
‘কিহ!’ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো পুতুল। কথাটা যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
‘হ্যাঁ! ও নাকি আমাকে আর ভালোবাসে না। ও কি বলেছে জানিস? বলেছে আমার মতো ফকিন্নি মার্কা মেয়ের সঙ্গে নাকি ও সম্পর্ক রাখবে না। কিন্তু এখন অনেক কিছু হয়ে গেছে পুতুল। এই সময় যদি নয়ন আমাকে ছেড়ে দেই আমি কিভাবে সবাইকে মুখ দেখাবো!’
‘অনেক কিছু মানে? বুঝতে পারছি না! কি বলছিস তুই!’
‘মানে আমার সঙ্গে জোর করে ওর ওই বাগান বাড়িতে—!’ কথা শেষ করতে পারে না মাহিয়া। হুহু করে কেঁদে উঠে সে।
পুতুলের সারা শরীর শিউরে উঠে। দুই হাতে মাহিয়াকে জাপটে ধরে বললো!
‘আমাকে পুরো ঘটনা টা বল মাহিয়া। আমি জানি তোর মতো মেয়ে কখনোই স্বেচ্ছায় এতটা বা’জে কাজ করবে না।’
মাহিয়া কিছু টা শান্ত হলো। চোখ, নাক, মুখ দুই হাতে মুছে বললো,
‘সেদিন নয়ন আমাকে চিঠি লিখে বলেছিলো সে শুধু আমাকে একটা বার দেখতে চাই। তুই সেদিন আসিস নি স্কুলে। বোধহয় তোর বোনের বিয়ের জন্য আসতে পারিস নি।’
‘হুম এরপরে যখন তোকে দেখেছি তখনো তো তোকে স্বাভাবিক লেগেছিলো!’
‘আমি মোটেও স্বাভাবিক ছিলাম না রে পুতুল! আমি জানি আমার ভেতরে কি চলছিলো। তুই জানিস না নয়নের কথায় ওর বাগান বাড়িতে গিয়ে কি মস্ত বড়ো ভুল টা করেছি। সেদিন ওর আসল রুপ টা আমার সামনে বেরিয়ে আসে৷ ও আমাকে জোর করে ধর্ষণ করেছে পুতুল!’
থরথর করে সারা শরীর কাঁপছে পুতুলের। অস্বাভাবিক ভাবে সারা শরীরে লোমশ দাঁড়িয়ে গেছে। এতো কিছু, এতো কিছু হয়ে গেছে তার বান্ধবীর সঙ্গে! আল্লাহ এটা কি শুনলো সে। কি হলো এটা!
‘শান্ত হো আমার জান! আমি আছি। আমি, আমি তোর হয়ে নয়ন এর সঙ্গে কথা বলবো।’
‘নাহ পুতুল কথা বলে লাভ নেই। সেদিনের পর আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার। কিন্তু পারিনি। আর ওঁকে আমার চাই না আর। তুই জানিস না ওঁ কতটা হিং’স্র। যে লোকটা আমাকে একা পেয়ে নিজের কামোত্তেজনাকে সংবরণ করতে পারেনি তাকে আমার চেনা হয়ে গেছে। ওর মতো নর্দমার কী’টের সঙ্গে আমি থাকতে চাই না।’
‘কিন্তু—!’
‘মাহিয়া! এই মাহিয়া। দেখ বাইরে এসে তোর জন্য কি এনেছি!’
ধুরমুর করে মাহিয়া উঠে দাঁড়িয়ে পরলো। পুতুলের শরীর এখনো অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। পুরো বিষয় টা সে কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারছে না।
‘পুতুল ভাইয়া এসেছে। এখন আমি ওর সামনে যাবো কিভাবে। আমাকে দেখলেই বুঝে যাবে আমি কাঁদছিলাম। এমনিতেই ভাইয়া মনে হয় আমাকে সন্দেহ করছে সেদিনের পর থেকে।’
‘আমি বাইরে যাচ্ছি। তুই, তুই ঘরেই থাক। আন্টি কোথায় রে?’
‘আম্মা মিহিকে সাথে নিয়ে বাড়ি ওয়ালার বাড়ি গেছে। বাসা ভাড়া দিতে।’
‘আচ্ছা!’ বলেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো পুতুল।
‘আরে আরে পুতুল দেখছি। আমি গরীব মানুষ আমার বাড়িতে রাজকন্যা কি করে! আমার বাড়ি কি মনে করে আজ?’ রসিকতার ছলে বলে প্রশান্ত।
‘লুট করতে এসেছি!’ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো পুতুল।
‘মানে ডাকাতি।’
‘হুম।’
‘কি নিতে? আমার বাড়ি যে শুন্য। তোমার নেওয়ার মতো কিছুই নেই যে।’
‘আপনি নামক আপাদমস্তক মানুষ টাকেই লুটিয়ে নিতে চাই।’
‘আমাকে নেওয়ার তো কিছু নেই। তবে নিতে চাচ্ছো কেন মেয়ে!’
‘এমনিতেই নিতে চাচ্ছি।’
‘আমাকে নিয়ে তোমার কি কাজ শুনি?’
‘ওই যে বললাম আপাদমস্তক মানুষ টাকেই নিতে চাই। লাভ ক্ষতির হিসেব করবো কেন আপনাকে নিয়ে। আর কেন নিতে চাই এখন বলার মুড নেই। সরুন বাড়ি যাবো।’
‘আরে শুনো? যাহ এই মেয়ে তো দেখি লজ্জা পেয়ে চলেই গেলো।’ বিড়বিড় করে বললো প্রশান্ত।
‘এই মাহিয়া, দেখ কি এনেছি তোর জন্য।’ ঘরে ঢুকলো প্রশান্ত।
পুতুল আর অভিনয় করতে পারছিলো না তাই দ্রুত প্রশান্তর সামনে থেকে চলে এলো। সারাটা রাস্তায় সে কেবল মাহিয়ার সঙ্গে নিকৃষ্ট ঘটনা নিয়েই ভাবছিলো। চোখের অশ্রু যেনো বাধ মানছে না। প্রিয় বান্ধবীর এই দষা সে কিভাবে মানবে? সেই মানতে পারছে না তাহলে মাহিয়ার কি অবস্থা! আচ্ছা ও ওই ঘটনা কে কেন্দ্র করে বা’জে কিছু ঘটিয়ে ফেলবে না তো নিজের সঙ্গে? ভাবতেই আরেকদফা শিউরে উঠে পুতুল।
#চলবে